এরেঞ্জ ম্যা্রেজ

আমি লেখক মানুষ।গল্পের প্লটের সন্ধানে থাকি সবসময়।মানুষজনের সাথে আজাইরা খাতির জমিয়ে তাদের জীবনের গল্প শোনার চেষ্টা করি।এইতো সেদিনই এক বন্ধুর বিয়েতে গিয়েছিলাম।খাওয়ার টেবিলে  পাশে বসা এক ভদ্রলোকের সাথে আলাপ জমিয়ে ফেলেছিলাম।আমি লেখালেখি করি শুনে তিনি খুব আগ্রহী হলেন। কথায় কথায় জানলাম, ভদ্রলোক নিজেও একসময় লেখালেখি করতেন। আলাপেরই এক পর্যায়ে তিনি নস্টালজিক হয়ে তার নিজের বিয়ের দিনের কাহিনি শোনালেন।সেই কাহিনিই হুবুহু তার মত করে লিখছি।

আজ আমি বিয়ে করতে চলেছি।রাত নটার সময়ে বিয়ে হওয়ার কথা।দুলাভাইয়ের কথা যদি ঠিক থাকে,তবে আমাদের গাড়িটি আর আধাঘণ্টার মধ্যই কনের বাড়িতে পৌঁছবে।এই বিয়েটি নিয়ে আমার কোন উচ্ছ্বাস নেই,বরং প্রচণ্ড মন খারাপ।প্রথমেই বলে রাখি,এটা কোন প্রেমের বিয়ে নয়,রীতিমত এরেঞ্জ ম্যা্রেজ।বন্ধু বান্ধব বিশেষ কাঊকে দাওয়াত করিনি একরকম রাগ করেই।অবশ্য কাকে দাওয়াত করা হয়েছে সেটাও জানি না।জানতে ইচ্ছেও করছে না।খালি একটা কারণে খুব লজ্জা লাগছে।পুরো স্টুডেন্ট লাইফে যে আমি ছিলাম এরেঞ্জম্যা্রেজের ঘোর বিরোধী; পারিবারিক সামাজিক জীবনে এর কুফল সম্পকে বন্ধুদের ব্রিফ করে্ কতবার মুখে ফেনা তুলেছি তার ইয়ত্তা নেই ।অথচ সেই আমাকেই কিনা আজ বাবা-মায়ের পছন্দের পাত্রীকে বিয়ে করতে হচ্ছে ।পাত্রী সম্পকেও কিছু জানি না।মা একবার বলতে চেয়েছিল,কিন্তু আমিই মাকে থামিয়ে দিয়েছি।তাই আর কিছুই শোনা হয় নি।

আমাদের বহনকারী কারটি বেশ দ্রুতই ছুটছিল। সময় তখন বাজে রাত সাড়ে সাতটা।রাস্তায় যানবাহনও বেশি নেই।জানালা দিয়ে বাইরে তাকাই।চারদিকে নিকষ কালো আঁধার।মাঝেমধ্য ঝিঝি পোকার ডাকের শব্দ ছাড়া সমস্ত প্রকৄতিতেই যেন শূন্যতা।শূন্যতার হাহাকার আমার সমস্ত হৃদয় জুড়েও।

হ্যা, আমি একজনকে ভালবাসতাম।মৌনতা ছিল ওর নাম।বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা পড়তাম ফিজিক্সে একসাথে,একই সেকশনে।তবে আমরা ছিলাম ঠিক একে অন্যের বিপরীত।আমি বসতাম শেষে আর ও সামনে ।পরীক্ষায় আমি কোনমতে পাশ করতাম,সেখানে ও নিয়মিত প্লেস করতো।আমি চুপচাপ থাকতে ভালবাসি আর সে পছন্দ করে হৈ-হুল্লোর।কিন্তুু তারপরও ঠিক কিভাবে যে এই দুইমেরুর বাসিন্ধা একসময় এক মেরুতে মিলেছিল-সেটা ভাবলে নিজের কাছেই বিস্ময় লাগে ।

ছোটবেলা থেকেই লেখালেখির প্রতি একটা ঝোঁক ছিল আমার।সেবার ডিপার্টমেন্টের ম্যাগে বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে একটি লেখা বেড়িয়েছিল।পরদিন ক্লাসে গিয়ে সিটে বসে আছি এমন সময় সে হাজির।

‘তোমার গল্পটা খুব টাচি ।অনেক ভালো লিখেছ তুমি ।’

ক্লাসের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটি এসে আমার প্রশংসা করছে–বিষয়টি যেন আমার বিশ্বাস হতেই চাইছিল না।

‘কি ব্যাপার কথা বলছ না কেন? আরে আমি তোমাকেই বলছি।

 

’অসংখ্য ধন্যবাদ তোমাকে।এমনি যা মাথায় এসেছে তাই লিখে দিয়েছি।তবে তুমি যতটা বলছ,অতটা ভালো হয়নি।‘

’আরে না ,লেখালেখি চালিয়ে যাও।দেখবে অনেক বড় লেখক হয়ে গেছ।তখন হয়ত দেখা যাবে তুমি আমাকে চিনছই না।‘

’আমি বিগলিত হয়ে বলি,’ না না সেটা কি ভাবে হবে?’

‘আর তুমি এমন ক্লাসে চুপচাপ থাকো কেন?আমার নাম জান?’’

আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে সে বলতে থাকে,আমি মৌনতা ।‘’আর তুমি আকাশ,ঠিক না?আমি তোমার সম্পর্কে সব জানি।কি অবাক হলে তো? আসলে আমার ছোটবেলা থেকেই একটা অভ্যাস হল আমার প্রিয় লেখকদের খুঁটিনাটি সব জেনে রাখা।তোমার গল্পটি ভালো লাগার পরেই আমি বান্ধবীদের কাছ থেকে তোমার ডিটেইলস শুনে নিয়েছি।‘বলেই একটা হাসি দেয় সে।

আমি তো একইসাথে হতবাক,বাকরুদ্ধ,মুগ্ধ।আনন্দের আতিশয্যে আমি কথা বলতে পারছিলাম না সেদিন।আরেকবার ধন্যবাদ দিতে যাব তার আগেই সে বলে,আজ আসি।কাল আবার দেখা হবে।প্রথম দিনে মৌনতার বলা এই কথাগুলো আজো আমার স্পষ্ট মনে আছে। ।

এরপর থেকে আমাদের প্রতিদিনই কথা হত।প্রয়োজনে অ়প্রয়োজনে়,সময়ে অসময়ে। ওর জন্য আমি নিজেকে পুরোটাই বদলে ফেলেছিলাম।যে আমি কখনই আড্ডা দিতাম না,বন্ধুও ছিল হাতেগোনা কয়েকটা।সেখানে ওর সাথে একটু কথা হবে এই আশায় আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা ওর বন্ধুদের সাথে ধুম আড্ডা দিতাম ।মাঝেমধ্যই ওকে কবিতা শুনাতে হত।কবিতা ছিল ওর খুব পছন্দের।আর ও গাইত গান।চমৎকার গানের গলা ছিল ওর।সবাই আমাদের বলত ক্রিয়েটিভ কাপল।তবে বন্ধুত্বের বাইরে বেশিকিছু ভাবতাম না কেউই।কিন্ত তবু কেন জানি এর কোন প্রতিবাদ করতাম না ,বরং আমরা খুব মজা পেতাম ওদের কথায়।

 

এরপর অনেকগুলো বসন্ত কেটে যায়।বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার সময়ও ঘনিয়ে আসে।বিচ্ছেদের এই সময়টাতে এসে দুজনই অনুভব করি আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্কটা অন্য কিছুতে এসে ঠেকেছে।এতদিন অন্যদের মত ঘটা করে না হলেও অঘোষিত এক প্রেমের অধ্যায় পার করেছি আমরা।এখন বিয়ের কাজটা সমাধা করার সময় এসেছে। ইতঃমধ্য ভাগ্যক্রমে একটা ফার্মে আমার চাকরিও জুটে যায়।আমরা ভাবি তাহলে বোধহয় আমাদের আর কোন চিন্তা রইল না।

কিন্ত মানুষ ভাবে এক,আর হয় আরেক।আমাদের ক্ষেত্রেও তাই হল।ওদের বাসার সবাই আমাদের এই সম্পর্ক সহজে মেনে নিলেও বাধ সাধল আমার বাবা মা দুজনেই।জলদগম্ভীর কন্ঠে বাবা ঘোষণা দিলেন,এ বাড়িতে কোন প্রেম ভালবাসার বিয়ে মেনে নেওয়া হবে না।অনেক চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত আমি মাকে কোনরকমে রাজি করলাম।মা আর ছোটবোন গিয়ে মৌনতাকে দেখেও আসলো।কিন্ত তাতে কোন লাভ হল না।

 

মা বাবাকে রাজি করতে পারলেন না।বাবা গোঁ ধরে বসে থাকলেন।আমি কোন উপায়ান্তর না দেখে মৌনতাকে বললাম,চল পালিয়ে বিয়ে করি।কিন্ত সে উল্টা আমায় বলে,তুমি তোমার বাবার পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করে ফেল এবং এটাই আমার শেষ কথা। কি অবলীলায় সেদিন  সে এই কথাটি বলেছিল ।শুনে আমি থ হয়ে গিয়েছিলাম।ওকে খুব স্বার্থপর মনে হয়েছিল সেদিন।আমি এখনও সেই ঘটনা কল্পনাও করতে পারি না ।এরপর আর কি? প্রচন্ড রাগে মাকে এসে বলেছিলাম,তাদের যেখানে পছন্দ,সেখানেই যেন  বিয়ে পাকা করে।আর বিয়ে সংক্রান্ত কোন বিষয় যেন কেউ আমাকে জানানোর চেষ্টা না করে।

এরপর আমার অবস্থা সত্যিই দেখার মত হল।ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করতাম না, বাইরে বের হইনি অনেকদিন।চাকুরিতে শোকজ নোটিশ এসেছে দুইবার।বাধ্য হয়ে দুলাভাই নিজে মেডিকেল সার্টিফিকেট দেখিয়ে এসেছে ।বস নেহাত ভালো লোক বলে চাকুরীটি ছিল।এরইমধ্য এই বিয়ের দিন চলে আসল।সেকারনেই আজ এই গাড়িতে কনের বাড়ি যাচ্ছি।

আমরা এখন কনে বাড়িতে ।কনে বাড়ির লাকজন সম্ভবত আমাকে এগিয়ে নিতে এসেছে।কিন্ত একি রফিক ভাইকে দেখছি কেন?রফিক ভাই মৌনতার বড় ভাই।ওনাকে প্রথম দেখেছি গত বছর।ফরম ফিলাপের জন্য মৌনর কি একটা কাগজের দরকার পরেছিল।সে সসময় মৌন ওনার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল ।আমি নামছি না দেখে দুলাভাই হাসতে হাসতে বলছিল,কি শালাবাবু, যার বিরহে সারা রাস্তা মন খারাপ করে ছিলে,তার বাড়িতে এসে কি গাড়িতেই বসে থাকবে নাকি?নামো। আমি সম্ভবত সেদিনের মত খুশি এর আগে কখনও হইনি।দুলাভাই কাছে ছিল ।মাথার টুপি ফেলে সোজা বুকে জড়িয়ে ধরেছিলাম ।‘হয়েছে এবার চলেন-‘দুলাভাই তাড়া দিলেন ।

কিছু দুরেই বাবা দাড়িয়ে সব দেখছিলেন ।আমি কাছে গিয়ে বলি- ‘থ্যাংক ইউ বাবা’।তিনি স্বভাবসুলভ গম্ভীর মুখে বলেছিলেন,খবরদার বাদড়ামি করবি না।

বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হওয়ার পরে বউকে বলেছিলাম,তুমি আমার সাথে পালাতে চাইলে না কেন?তার সরল জবাব,কেন পালাতে যাব?তুমি বলার একদিন আগেই তোমার বাবা আর মা এসে আমাকে বলেছিল,মেয়ে খবরদার পালাবে না।বিয়ে আমরা তোমার সাথেই দিব।প্রথমে ভেবেছি বাদরটা কাকে না কাকে পছন্দ করেছে।না, তবে বোকা হলেও ছেলের পছন্দ আছে ।তোমাকে আমাদের খুব পছন্দ হয়েছে।এ কথা বলেই সে হাসতে লাগল।আমি বেকু্‌ব, বুঝলাম না ষড়যন্ত্রটা  আসলে কার ছিল ?

 

শুকপাখি সম্পর্কে

নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করার অভিপ্রায় বুকে লালন করি সবসময়ই।তাই হয়ত নিরানন্দ মেডিকেল লাইফের বাইরের জগত সম্পর্কে আমার জানার আগ্রহে কমতি নেই,বরং বোধহয় একটু বেশিই।জানতে, জানাতেই লেখার চেষ্টা করি।লেখা সুখপাঠ্য হয় কিনা জানি না,না হলে না হোক;নিজের আনন্দ লাভের এ উপলক্ষ ছাড়তে চাই না কখনই।
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে গল্প-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

20 Responses to এরেঞ্জ ম্যা্রেজ

  1. একলা পথিক বলেছেনঃ

    এহেন ষড়যন্ত্রমূলকভাবে কচি যুবকদের মাঝে শাদীচ্ছা (শাদী করার ইচ্ছা) জাগাইয়া তুলার সুতীব্র নিন্দা ও ধিক্কার জানাইয়া গেলাম।

    * লেখা ভালো হইসে।আর আমারেও কিঞ্চিত চিন্তায় ফালায় দিলেন মিয়া।ভালো থাকেন।লেখালেখি চলুক…

    • শুকপাখি বলেছেনঃ

      ভাইয়া, শাদীচ্ছা তো মাশা আল্লাহ আমারও কম নাই। কিন্ত আব্বায় তো স্বীকার করতে চায় না, আমি বড় হইছি । আরও যে কদ্দিন লাগবো কে জানে! 🙁

      আপনারা পাশে থাকলে লেখালেখি করতে আমার ভালোই লাগবে । আপনার জন্যও শুভকামনা ।ভালো থাকবেন ।

      • একলা পথিক বলেছেনঃ

        একটা কুবুদ্ধি দিয়া যাই, নিজেই কাম সাইরা ফালান।এর পরে বাপজানে টের পাইবো,নাহ আমার ছাওয়াল বড় হই গেসে !!

        *এই সংক্রান্ত সমুদয় রিস্ক নিজ দায়িত্বে……

  2. অনাবিল বলেছেনঃ

    পড়তে গিয়েই বুঝে ফেলেছি এই কাহিনী!!

    😛 😛

  3. শারমিন বলেছেনঃ

    কাহিনী যদিও আগেই বুঝেছি যে শেষে কি হবে 😛
    তবুও ভালো লেগেছে 🙂
    আর বিরাম চিহ্নের দিকে একটু লক্ষ্য রেখো
    আর সেই সাথে বানানের দিকেও।

  4. শাহরিয়ার বলেছেনঃ

    বাহ! বেশ মজার সারপ্রাইজ তো!! :happy:

    আর… কেন যেন সবার মত আমিও ফিনিশিংটা আগেই আঁচ করে ফেলেছি! 😛

  5. মাধবীলতা বলেছেনঃ

    সবার মত ফিনিশিং ধরে ফেললেও পড়তে বেশ ভালো লেগেছে। তবে জীবনে এইরকম করে সহজভাবে সুখের হিসাবগুলো মেলে না এই যা…গল্পে , সিনেমায় দেখেই মন ভরাতে হয়…

  6. তুসিন বলেছেনঃ

    শেষটা যদি সবার এমন হত তাহলে মন্দ হত না। 🙂

  7. আরণ্যক বলেছেনঃ

    ভারী সুন্দর, শুকপাখি! :love:

  8. সামিরা বলেছেনঃ

    সবাই দেখি এন্ডিং আগেই বুঝে ফেলছে, আমি ছাড়া। 🙁
    বহুদিন পর সরবে এসে এই পোস্টেই সবার আগে কমেন্ট করলাম!

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।