স্বাধীনতা ও ফিরে দেখা “১৯৭১/২০১৩”

“ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের অঙ্গীকার
বাংলাদেশ আমার সেরা অহংকার”

জীবনের সবচেয়ে অসাধারণ অংশে এসে দাঁড়িয়ে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামের লড়াই করা প্রত্যেকটি মানুষের ত্যাগ, তাদের জীবনবোধ, মূল্যবোধ ও তাদের উপলব্ধিকে সম্মান জানাতে এবং কিছু উপলব্ধি তুলে ধরতে এই লেখাটির সূচনা। আমাদের প্রজন্ম ও স্বাধীনতার অনুভুতি নিয়ে আমার চিন্তাভাবনাতে গতানুতিক কোন ধারার কথা আমি আসলে লিখতে বসি নি।

আমি আজকে যাদের কথা লিখছি তাঁরা ঠিক ৪২ বছর আগে ছিলেন তাঁদের প্রজন্মে আমাদের বা তারুণ্যের প্রতিনিধি। সময়কাল: ১৯৭১ সাল, ২১ এপ্রিল। পাকিস্তানবোর্ডে তৃতীয় স্থান অর্জন করা ছেলেটি তাঁর মায়ের সাথে প্রচণ্ড তর্ক করছিলো। তর্কের বিষয় ছিলো ছেলেটি যুদ্ধে যেতে চায়। প্রচণ্ড তাকবিতণ্ডার পর মা ছেলেকে দেশের জন্য কোরবানী করে দিলেন।

স্বাধীনতার ৪৩ বছরে আজকের দিনে আমরা পা ফেললাম। তবে ছেলেটি যুদ্ধ থেকে আজো ফিরে আসেনি। মার্কিন মুল্লুকে প্রকৌশলী পড়ার ইচ্ছাকে জলাঞ্জলি দিয়ে জীবনের বস্তুগত চাহিদাকে ছুঁড়ে ফেলে সর্বোচ্চ ত্যাগের জন্য প্রস্তুতি নেয়া ছেলেটি যে কারণে ১৯৭১ সালে নিঁখোজ হয়েছিলো, তার নেপথ্যের অনেক রথী মহারথীরা ঢাকার রাস্তাতে গত কয়েক বছর আগেও জাতীয় পতাকার গাড়িতে চড়ে ঘুরে বেড়িয়েছে। সেই কুকুর বা হায়েনাদের চামড়া ছিলে ফেলতে আমাদের বিন্দুমাত্র দ্বিধা হচ্ছে না বলেই আমরা যু্দ্ধপরাধের বিচার চাইছি মনে প্রাণে।

আমি এখনো স্বপ্ন দেখি, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় জেলায় যুদ্ধপরাধ ট্রাইবুন্যাল বসবে, প্রত্যেকটি থানায় মামলা লড়বো আমরা ও আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের যোদ্ধারা। রাজাকার আলবদর, আলশামস নামের এক একটি শুকুনকে এদেশের মাটির সাথে বেইমানীর দায় শোধ করে তবেই কবরে যেয়ে শুতে হবে। একটু সময় লাগবে হয়তো, তবে আমি নিশ্চিত আলো আসবেই।

পাকিস্তান বোর্ডে তৃতীয় স্থান অর্জন করা ছেলেটির নাম ছিলো রুমী। আমরা অনেকেই রুমীকে চিনি ও জানি। মাত্র ২২ বছর বয়সে ১৯৭১ সালে নিঁখোজ হওয়া রুমী, হয়তো একদিন আবারো ফিরে আসবে, হয়তো রুমী লুকিয়ে রয়েছে কোন একটি গহীণ ঘরে, হয়তো বা তাঁর মনে রয়েছে প্রচণ্ড অভিমান। তবে বাস্তবতা এটাই যে, আমি বা আমরা নিশ্চিত নই রুমী বা তাদের মতো বীর সৈনিকরা আদৌ আর আসবেন কি না বা সত্যিই তাঁরা ফিরবেন কী না?

কাজী নূরুনবী, রাজশাহী মেডিক্যালের শেষ বর্ষের তুখোড় ছাত্র ছিলেন। প্রিয় মাকে লেখা শেষ চিঠিতে নূরুনবী বলেছিলেন সাধারণ মানুষকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে মা, আমাদের বেঁচে থাকাটাই হলো লজ্জার। ১৯৭১ সালের ১ অক্টোম্বর রাজশাহীর শহীদ জোহা হল থেকে পাকিস্তানী আর্মি কাজী নূরুনবীকে তুলে নিয়ে যায়। আমার প্রশ্ন হলো : কাজী নূরুনবী যে জোহা হলে ছিলেন সেটি তো পাকিস্তানী আর্মির জানার কথা নয়, তাহলে যে শকূনের দল নূরুনবীকে চিনিয়ে দিয়েছে তারা আসলে কারা? এখন সত্যি তারা তাহলে কোথায়? আফসোস ১৯৭১ সালের শকূনদের পরের প্রজন্মও বাংলাদেশের মানচিত্রকে এখন ছিঁড়ে খেতে চাচ্ছে। প্রিয় মাতৃভূমির মানচিত্রকে সত্যিই এবার খামচে ধরেছে সেই পুরনো শকূনের প্রতিনিধিরা। তবে সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী। কেবল জনতার সংগ্রামকে শুধু এগিয়ে নিতে হবে।

ফিরে যাই আবার ১৯৭১ এ: সময় ১৯৭১ সালের ২৫ অগাস্ট। ধানমন্ডির ২০ নম্বর রোডে দুর্ধষ অপারেশন কোড নেম: ধানমন্ডি হাইডআউট শেষে একটি গাড়ি সাঁ করে গ্রীণরোড হয়ে নিউমার্কেটের দিকে ঢুকে পড়ে। গাড়িতে বসা ছিলো ক্র্যাকপ্লাটুনের কাজী, বদি, আলম, রুমী, স্বপন, হ্যারিস, জিয়া, আরো অনেকে। অন্যদিকে, শহরে তখন একের পর এক সফল আক্রমণ তখন চালিয়ে যাচ্ছিলো জুয়েল, আসাদ আজাদসহ আরো অনেকে তুখোড় মুক্তিযোদ্ধারা। তবে শেষ পর্যন্ত ভাগ্যের নিমর্ম পরিহাসে ক্র্যাকপ্লাটুনের বেশীরভাগ ছেলে পাকিস্তান আর্মির হাতে ধরা পড়ে যায় অগাস্টের একদম শেষের দিকে। বাতাসে গুজব উঠে ৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সালে নাকি কয়েকশো মুক্তিযোদ্ধাকে পাকিস্তানী আর্মি মেরে ফেলেছিলো। বলাবাহুল্য ধরা পড়া মুক্তিযোদ্ধাদের কেউই আর পরে ফিরে আসেনি।

আর্মি ক্যাম্পে আজাদের মায়ের সাথে একজন সুবেদার মেজরের দেখা হয়েছিলো। সুবেদার মেজর আজাদের মাকে বলেছিলেন, “মাইঝি তুমি চলে যাও, তোমার ব্যাটার কোন তকলিফ হবে না, ইন্টারোগেশন শেষে ব্যাটাকে ফেরত পাবে তুমি।” তবে মহান মুক্তিযুদ্ধ ইতিহাসের সেরা ত্যাগের গল্প বলেই আজাদের মার সাথে আজাদের শেষ বার দেখা হয়েছিলো। আজাদের মা তাঁর প্রিয় সন্তানকে শঙ্কার সাথে বলেছিলো, “তুই কারো নাম বলিসনি তো বাবা!” আজাদ উত্তরে বলেছিলো, “মা, ওরা প্রচণ্ড মারে। ভয় লাগে মারের চোটে যদি নাম বলে দেই!” প্রতিউত্তরে আজাদের মা বলেছিলেন, “বাবা ওরা যখন মারবে শক্ত হয়ে থেকে সহ্য করবি। কিন্তু কারো নাম বলিস নারে বাবা।” শেষ পর্যন্ত আজাদের মা শোকে মুহ্যমান হয়ে ছেলেকে হারানোর পর কোনদিন আর ভাত মুখে তুলেননি। কারণ আজাদ তার মায়ের কাছে ভাত খাওয়ার শেষ আবদারটুকু জেলে বন্দী অবস্থায় করেছিলো। তবে হতভাগ্য মা শেষ পর্যন্ত তাঁর প্রিয় সন্তানের জন্য জেলখানাতে খাবার নিয়ে আর পৌঁছাতে পারেননি।

আমি এখনো যখন ধানমণ্ডির রাস্তার পাশ দিয়ে যখন একা একা হাঁটি তখন মনে হয় হঠাৎ করেই অতীতে ফিরে গিয়ে দেখবো কোন গাড়ি সাঁই সাঁই করে ছুঁটে চলে যাচ্ছে, হয়তো দেখবো গাড়ির পেছনের কাঁচ ভেঙ্গে কোন ছেলে ফায়ার করে উল্টে দিচ্ছে পাকিস্তান আর্মির কোন গাড়িকে। তবে ইট কাঠ পাথরের বাস্তবতার ভীড়ে এমন স্বপ্ন আর কখনই সত্যি হয় না।

আজো স্বপ্ন দেখি, ঘুম থেকে উঠে হয়তো একদিন সকালে পত্রিকাতে পুরো কাভার হেডলাইন দেখবো যে, ১৯৭১ সালের শত শত নিঁখোজ মুক্তিযোদ্ধারা আবারো আমাদের মাঝে ফিরে এসেছে। হয়তো তারা কোন কারাগারে ছিলো অথবা তারা লুকিয়ে ছিলো কোন একটি জায়গায়, কিন্তু বাস্তব আর স্বপ্ন মেলাতে গেলে কিছুতেই যেন তা মিলতে চায় না।

২০১৩ সালে ফিরে আসি। শ্রীলংকা সফরে থাকা বাংলাদেশ ক্রিকেট দলে মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ নামের একজন ব্যাটসম্যান এখন মির্ডল অর্ডারে ব্যাটিং করে। ১৯৭১ সালে একটি স্বাধীন বাংলাদেশের ক্রিকেট দলের স্বপ্ন দেখা শহীদ জুয়েল নিজের জীবনের বিনিময়ে একটি দেশ ও একটি ক্রিকেট দলের স্বপ্ন আমাদের দিয়ে গিয়েছিলো। জুয়েলের জায়গায় রিয়াদ খেলে সেই আরাধ্য স্বপ্নকে পূরন করে দিচ্ছে। রুমী বলেছিলো সে প্রকৌশলী হবে, নাসাতে রোবট পাঠানোর প্রতিযোগীতায় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশী কিছু তরুণ নাকি দুর্দান্ত ফলাফল করেছে।

স্বপ্নের পারদ যথেষ্ট বাড়ছে এবং আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। মানব সভ্যতার সেরা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার জন্ম যুক্তরাষ্ট্রে। ব্যবসা আর উদ্যোগক্তা যে কি জিনিস সেটি বোঝার ক্ষমতা নাকি আমাদের নেই। একজন ছোট্ট কার্ড বিক্রেতা আজাদ বাংলাদেশে আজাদ প্রোডাক্টসের জন্ম দিয়ে বিশ্বাসকে শক্ত করে দিয়েছেন। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে চাকুরীর স্বপ্ন কে না দেখে বলেন, দামী মাইনে, গাড়ি, আবাসন আরো কত কত সুবিধা রয়েছে সেখানে। ৪২ বছর আগেও কী কেউ ভেবেছিলো দেশে আসলে বহুজাতিক কোম্পানী তৈরী সম্ভব হতে পারে? তবে স্কয়ারের স্যামসন এইচ চৌধুরী হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যবসা করে সব অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখিয়েছেন। ব্র্যাক এনজিও বেসরকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্বে সব এনজিওর মধ্যে তৃতীয় স্থান অধিকার করেছে। একজন ফজলে হাসান আবেদ নিজের জায়গা থেকে লড়াই করে পরিস্থিতি পাল্টে দিয়েছেন।

বাংলাদেশের প্রায় সব খানেই পরিবর্তনের হাওয়া বইছে, তবে হয়তো এর গতি একটু ধীর, কিন্তু তাতে কী আসে যায়? যে যাই বলুক স্বপ্ন দেখতে তো আর দোষ নেই। গত বছর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা উপলক্ষে গুগলের কাছ থেকে ডুডল পাবো বলে আশা রেখেছিলাম আমরা। চেষ্টা করে গিয়েছিলাম। কিন্তু সফল হয় নি। অথচ বছর ঘুরতেই ২০১৩, ২৬শে মার্চ গুগল স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ডুডল দিয়ে দিয়েছে। স্বপ্ন পূরণের পথগুলো একটু একটু করে আলোকিত হচ্ছে। আশা করি ২০১২ সালে এশিয়া কাপে মাত্র ২ রানের জন্য রানার্সআপ হওয়া বাংলাদেশে ২০১৯ সালের বিশ্বকাপেই ভালো একটি চাপ দিবে ক্রিকেট বিশ্বকে। আসুন আমরা বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হলে কিভাবে উৎসব করবো সেটির প্রস্তুতি নেই এখন থেকেই কারণ মানুষের বিশ্বাসটুকু কখনোই না টলে ওঠে না, কেবল বাস্তবতাই মাঝে মধ্যে একটু আধটু বিশ্বাসকে আঘাত করতে চায়।

শেষ কথায়, ১৯৭১ সালে আমাদের পূর্বপুরুষরা যদি গতানুগতিক চিন্তা করতো তবে আমরা কখনোই পৃথিবীর চতুর্থ সেরা সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে জিততে পারতাম না। বৃত্তের বাইরেও না আরেকটা বৃত্ত থাকে। আসুন, বৃত্ত ভেঙ্গে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করি। নিজের জায়গা থেকে বদলে ফেলার লড়াই করে সমাজের আর চারপাশের সব নেতিবাচক পরিস্থিতিকে চলুন পাল্টে দেয়ার চেষ্টা করি। বুকের মাঝে যে স্বপ্ন ধারণ করছি তা সত্য করি, সবাই একত্রিত হয়ে বলে উঠি… “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি”

একুয়া রেজিয়া সম্পর্কে

আকাশ তো ছুঁইনি, কিন্তু আকাশের মাঝে তো মেঘ হয়ে ভেসে আছি... বেঁচে আছি, দিব্যি জেগে আছি। রোদকে আমায় ভেদ করে স্পর্শ করতে দিচ্ছি...এই তো আমি....এই তো জীবন...আর বাঁচার সেকি আনন্দ...
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে অনুপ্রেরণা, চিন্তাভাবনা, বিবিধ-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

4 Responses to স্বাধীনতা ও ফিরে দেখা “১৯৭১/২০১৩”

  1. বৈরাগী বলেছেনঃ

    কিচ্ছু বলতে পারছি না অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও। সব কথা তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।
    “আমরা স্বপ্নে বাঁচি, স্বপ্ন গড়ি, স্বপ্ন বুকে ধরে দেব পাড়ি বহুদুর………”

  2. বোহেমিয়ান বলেছেনঃ

    :huzur: :huzur:

  3. অনুজ বলেছেনঃ

    কী লিখব কমেন্টে?
    বৃত্ত ভাঙ্গার উৎসবে আমিও শরীক হব, আমি মুক্ত বিহঙ্গের মত নীল আকাশে স্বাধীন হয়ে উড়ব…
    স্বপ্ন দেখে যাই…

  4. ফিনিক্স বলেছেনঃ

    শেষ একটা লাইন পুরো লেখার সারমর্ম করে দেয়-
    আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি!

    ভালোবাসি বাংলাকে, আমাদের মাকে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।