সেই প্রাচীন চিঠি

কেউ একজন অনেক বছর আগে খুব আপন ছিল, পর হতে হতে কিরকম যেন আবার আপন হয়ে গেলো। আবার আপন হতে হতে পর হবার পালা। নতুন নতুন মানুষগুলো একেকজনের জীবনে আসছে, আর যাচ্ছে, ভিন্ন ভিন্ন অনুভবে ভিন্নতা নিয়ে কিরকম একটা স্বপ্নের মতই কেটে যাচ্ছে সেই আদি থেকে অন্তহীন পথ চলায় আমাদের সময়।

প্রতিটি গ্রীষ্ম তেতিয়ে আসার আগে একধরণের গন্ধ পাই ঝোপঝাড়গুলোর খুব কাছ দিয়ে হাঁটলে। তোদের মত আমি গন্ধকে দেখতে পাইনা, এই অন্ধকারে যখন মিজান এসে বলে, স্যার চা দেব? নির্লিপ্ত ভঙ্গীতে মাথাটা কেবল দুবার উপর নিচ করি। বাহিরে মাত্র অন্ধকারেরা জমাট বাধতে শুরু করেছে, দূরে সীমান্তের পার্শ্ববর্তী পাহাড়গুলোতে সন্ধ্যারা তাঁবু টাঙাচ্ছে। পাহাড়ি কোন সদ্য কৈশোর পেরুনো বাবা মায়ের চিন্তার জঙ্গল নিয়ে ঘুরে বেড়ানো তরুণী ছাগলগুলোকে টেনে টেনে বাড়ি আনার কোশেশ করছে। ছাগল যদি কখনো কোন দিকে যেতে না চায় তবে তাকে টেনে নেয়া অনেক কঠিন কাজ, দেখেছিস? পা দুটোকে মনিবের উদ্দেশ্যের দিকে বাঁকা করে শক্ত ভাবে মাটিতে ধরে রাখে। তরুণীর কোলের নরম আদরে একটি ছাগল-ছানা মায়ের কোলের মত নিশ্চিন্তে ঘুমায়।

উঁচু টিলার এই বারান্দা থেকে স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি, রাস্তার পাশের নাম না জানা ফুলগুলোকে ডাল সহ ছিঁড়ে নিয়ে যাচ্ছে মেয়েটি। ও নিজে সুন্দর বলেই কি অন্য সুন্দরগুলোকে দাম দিচ্ছেনা? মানুষেরা একটু বোধহয় এরকমই। আপন অবয়বে বাসা বাধা সৌন্দর্যের অহংকারে অন্য কিছুকেই পাত্তা দেয় না। অথচ দেখ, এখানে তার সামান্যতম কৃতিত্বও নেই। কি ছেলে কি মেয়ে, সবাই এরকম, শুনেছি তোদের দেশে নাকি নতুন করে সৌন্দর্যের প্রতিযোগিতা হচ্ছে?

তোদের বয়েসী ছেলে মেয়েগুলোর জন্য খুব মায়া হয়। কি রকম একটা ঘোরের মধ্যে লটকে রেখে সার্থবাজেরা নিজেদের পকেট পুরছে, আর তোরা পুড়ছিস সৌন্দর্যের আগুনে। দিনে দিনে বেড়ে চলে বাহিরের সৌন্দর্য, কিন্তু ভেতরটা ?

তোদের ভেতরটা কি কোনদিন এই পাহাড়ি মেয়ের আতিথেয়তার মত হবে?

পৃথিবীটা অনেক বদলে গেছেরে, তাই না? একসময় মানুষের কর্মকে অনেক বড় করে দেখা হত, সদাচরণ, সাদামাটা চলাফেরা, আর বিনয় এসবই ছিল সম্পদ, আজ? অশরীরী এই আত্মায় ব্যথা জমা হয়। খুঁজে যাই আসলে কোথায় তোদের সুখ, কিসের নেশা তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে এই অতৃপ্ত তারুণ্যের খেয়াল?

কুয়াশা পড়ছে অল্প অল্প ক’দিন হল, ঘোলা ঘোলা দেখা যায় চারিপাশ। জমাট অন্ধকারে পাহাড়ের নিচে দু’ একটা দোকানের বিজলী বাতিগুলো জ্বলা শুরু করেছে, এখানে বিদ্যুৎ নেই, জেনারেটর দিয়ে চলছে জীবন। লোকজনের চলাফেরা দিনের বেলাতেই কম, এখন দু একটা সাইকেল ছাড়া তেমন কিছুর দেখা মিলছেনা।

সেই কখন মিজান বড় এক মগ লাল চা এনে রেখে গেলো, এখন বোধহয় শরবত হয়ে গিয়েছে। দেখতে অনেকটা রুহ আফজার মত। তিন ঢোকে পুরোটা এক সাথেই সাবাড় করে দিলাম। হাতের কাছে একটা চিঠি। বহুদিন আগেই এসেছে, খুলে দেখা হয়নি। মুখটা ছিঁড়ে ভেতর থেকে বর্ণমুক্ত প্রাচীন কাগজ বের করে আনলাম। সেই একই ডাকঘর, একই মানুষ, বছরের পর বছর এভাবেই চিঠি পাঠিয়ে যাচ্ছে, আরেকটি ছোট চিরকুট, স্বচ্ছ হস্তাক্ষরে লেখা, কল্পনা করে নিও।

চিঠির সব ভাষা কল্পনা করে নেই আমি, অনেক আবেগ থাকে সেখানে, থাকে ভালোবাসা, এবং মায়া। প্রতিটি লাইন যেন পরম মমতার গাঁথুনিতে গড়ে তোলা স্মৃতিসৌধ। সেই প্রাচীন চিঠি, যা শতাব্দীর পর শতাব্দী আমার ঠিকানায় এসেছে, আসছে, হয়তো অনাদিকাল আসতেই থাকবে…।

অহনিশ সম্পর্কে

আলো কি কখনো অন্ধকারে পথ হারায়??
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে বিবিধ-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

5 Responses to সেই প্রাচীন চিঠি

  1. সামিরা বলেছেনঃ

    অতীব সুপাঠ্য!

  2. অনুজ বলেছেনঃ

    অসাধারণ!
    হাজার বছরের সেই চিঠি যেন শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তার আপন গন্তব্যের দিশায় সঠিক পথেই এগিয়ে যায়, সঠিক ঠিকানায় কড়া নাড়ে…

  3. বোহেমিয়ান বলেছেনঃ

    দারুণ সুপাঠ্য। দারুণ।

  4. অবন্তিকা বলেছেনঃ

    উদাস করা রকমের বেসম্ভব সুন্দর!

  5. ফিনিক্স বলেছেনঃ

    অনেক অ-নে-ক দিন পর কোন লেখা প্রিয় তালিকায় নিলাম!

    চিঠি- আমার অন্তরে বরাবরের দুর্বল জায়গা, ভালোবাসার জায়গা।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।