ভাস্কর্যে খুজে ফিরি পরিচয়ঃ অপরাজেয় বাংলা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন যাওয়ার জন্য রিকশা নিলে যে জায়গায় রিকশা মামা সব সময় নামিয়ে দেয়, সে জায়গাটা আমার খুব পছন্দের। সে জায়গায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে একটি অসাধারণ ভাস্কর্য, নাম “অপরাজেয় বাংলা”

সময়টা ১৯৭৩, সে সময় ডাকসু’র সাংস্কৃতিক সম্পাদক ম. হামিদ। বর্তমান অপরাজেয় বাংলা ভাস্কর্যটির জায়গায় তখন অন্য একটি ভাস্কর্য ছিলো, যা ভেঙ্গে ফেলা হয় (কারণটি আমার জানা নেই, কেউ জেনে থাকলে জানাবেন)। সে জায়গায় আবারও ভাস্কর্য নির্মানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, দায়িত্ব পরে ভাস্কর্য নির্মাতা সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ এর উপর। ১৯৭৩ এ কাজ শুরু করে বিভিন্ন প্রতিকুলতার মাঝে তিনি ১৯৭৯ সালে ভাস্কর্যটির কাজ শেষ করেন।

রাত আর দিন বলে কিছু নাই। খালিদ নামের মানুষটার মগজে তখন একটাই শব্দ “অপরাজেয় বাংলা”। রাস্তায় মানুষ, ছাত্র-ছাত্রীরা, বিদেশীরা, রিকশাওয়ালা মামারা কিংবা টোকাইরা আগ্রহ ভরে তাকিয়ে থাকতো। তিনি কাজ থেকে নেমে আসতেন, সবার সাথে আলাপ করতেন। আবার কাজে ফিরে যেতেন।

সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ কাজ ধরবার কিছুদিন পরেই ঘটে গেলো ইতিহাসের অন্যতম কালো দহ্যায়, পনেরই আগস্টের হত্যাকাণ্ড। এরপরে কাজ স্তিমিত হয়ে আসে। শহরের বুকে জায়গা করে নেয় বিধ্বংসী ট্যাংক। ইতিহাস বলে, একটা ট্যাংকের নল নাকি সবসময় অর্ধনির্মিত ঐ অপরাজেয় বাংলার দিকে তাক করা থাকতো।

পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে পাকিপন্থী ধর্মীয় লেবাস পরিহিত ফ্যানাটিকেরা রব তুললো, ভাস্কর্য ধ্বংস করা তাদের দায়িত্ব এবং সে লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এটি ভেঙে ফেলার সমর্থনে সাক্ষর সংগ্রহ শুরু করে। পরবর্তীতে তাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্র ছাত্রীরা ধাওয়া করে এবং দুজনকে পিটিয়ে চুন কালি মেখে ছাড়া হয়।

আরও অনেক ইতিহাস বিজড়িত এই অদ্ভুত সুন্দর ভাস্কর্যটি। প্রয়াত মিশুক মুনিরের ক্যামেরার হাতেখড়ি এই অপরাজেয় বাংলার নির্মানাধিন ছবি তোলা ও স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র “চাক্কি” তৈরীর মাধ্যমে।

এই ভাস্কর্য নিয়ে মিশুক মুনিরের খুব অসাধারণ একটি বক্তব্য না বলে থাকতে পারলাম না –

“অপরাজেয় বাংলা দেশের মানুষের কাছে পৌছাতে কোন লিফ্লেটের দরকার পরেনি। … ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রলীগ, বিএনপি, হোয়াটেভার ইট ইজ, যাদেরই রাজনৈতিক কোন বক্তব্য রাখার প্রয়োজন হতো, কোথায় হবে? অপরাজেয় বাংলায় হবে। এই যে একটা ইউনিভার্সেল এক্সেপ্টেন্স, এটা ৭৮, ৮৫, ৮৮ কন্সট্যান্টলি হয়েছে। …… এরকম উদাহরণ হয়তো খুব কমই আছে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এক্রস দা প্ল্যাটফর্ম, একই ভেন্যু, একই ইমেজ, একই ফিলিংস থেকে রিলেট করছে, গ্রেট এচিভমেন্ট”

অপরাজেয় বাংলা ভাস্কর্যটিতে যে তিনজন মানুষকে দেখা যায়, তারা হলেন – ফার্স্টএইড বাক্স হাতে একজন সেবিকা, সময়ের প্রয়োজনে রাইফেল কাঁধে তুলে নেয়া গ্রীবা উঁচু করে ঋজু ভঙ্গিমায় গ্রামের টগবগে তরুন এবং দু’হাতে রাইফেল ধরা আরেক শহুরে মুক্তিযোদ্ধা।

ফার্স্ট এইড বাক্স হাতে সেবিকার ভূমিকায় যিনি মডেল হয়েছিলেন, তিনি হলেন হাসিনা আহমেদ।

অপরাজেয় বাংলার রাইফেল হাতে মূর্তির মডেল সৈয়দ হামিদ মকসুদ। তিনি ১৯৭৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন।

অপরাজেয় বাংলার মাঝের মূর্তিটির মডেল বদরুল আলম বেনু। তিনি শুধু একজন মডেলই ছিলেন না ছিলেন সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদের একান্ত সহযোদ্ধা। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৯ পর্যন্ত সকল চড়াই উৎরাইতে শিল্পী আবদুল্লাহ খালিদের সাথে যে দুইজন সর্বাত্মক ভাবে জড়িত ছিলেন তার এক জন হলেন তৎকালিন চারুকলার ছাত্র বদরুল আলম বেনু আর অন্যজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ঢাকসু’র সাংস্কৃতিক সম্পাদক ম. হামিদ।

১৯৭৯ এ অপরাজেয় বাংলার নির্মান কাজ করছেন ভাষ্কর সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ ও বদরুল আলম বেনু।

১৯৭৯ সালের ১৬ই ডিসেম্বর উদ্বোধন করা এই ভাস্কর্যটি স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম একটি প্রতীক। অপরাজেয় বাংলা ছিলো, আছে, থাকবে। জয় বাংলা।

(কৃতজ্ঞতাঃ আর্টস ডট বিডিনিউজ, সাইফুল ওয়াদুদ হেলাল এর তথ্যচিত্র “অপরাজেয় বাংলা”, অপরাজেয় বাংলা নিয়ে মিশুক মুনিরের একটি সাক্ষাতকার)

এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে ইতিবাচক, ইতিহাস, সচেতনতা-এ এবং ট্যাগ হয়েছে , স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

13 Responses to ভাস্কর্যে খুজে ফিরি পরিচয়ঃ অপরাজেয় বাংলা

  1. safowan বলেছেনঃ

    poira felsi 😀

    ghataghatir time paili kemte?

  2. এখনও শিশু বলেছেনঃ

    চমৎকার, এক কথায় – চমৎকার ! :clappinghands:

  3. অনুজ বলেছেনঃ

    অনবদ্য!!
    নিশম দা’র লেখার পাঙ্খা কি আর এমনি এমনি!! :love:

  4. জুলফিকার ইসলাম বলেছেনঃ

    ধন্যবাদ নিশম ভাইকে। আমরা তো ইতিহাসের হাতে তৈরি হই। আমরা কি ভাবব, আমাদের কি ভাবা দরকার এর উত্তর পাওয়া যায় ইতিহাসেই। ইতিহাস জানা এই জন্যই জরুরি।

    • নিশম বলেছেনঃ

      খুব সত্যি একটা কথা। “আমরা ইতিহাসের হাতে তৈরি হই”, আর এ কারণেই যে বা যারা আমাদের গর্বের ইতিহাসকে বিকৃত করতে চেয়েছে, তাদের স্থান হয়েছে ইতিহাসের আস্তাকুড়ে।

  5. অবন্তিকা বলেছেনঃ

    “ভাস্কর্যে খুঁজে ফিরি পরিচয়”- নামটা দারুণ পছন্দ হয়েছে রে!

  6. ফিনিক্স বলেছেনঃ

    অসাধারণ!
    আরো অনেক জানতে চাই।
    সিক্যুয়েল চাই!

    পাঠকের দাবী, মানতে হবে! :love:

  7. hemal বলেছেনঃ

    tor lekha tow r ami emte vala paina!vali likchis lyk olways.

  8. Saiful বলেছেনঃ

    আমার কাছে এই লেখাটি অনেক বেশি ভাল লেগেছে। লেখক কে অনেক ধন্যবাদ।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।