“অরিত্র, ওঠ বাবা, সকাল হয়ে গেছে”,মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙে অরিত্রর।
“মা, আমি কি আর দুটো মিনিট বেশি ঘুমাতে পারি না আজকে? আজ তো ছুটির দিন”,ঘুম ঘুম চোখে বলতে থাকে অরিত্র। কিন্তু সে জানে মিসেস জাহানারা চৌধুরী তাকে এই স্বাধীনতা দিবেন না। রোজ সকাল ছয়টায় ঘুম থেকে উঠে তাকে বাবার সাথে মর্নিং ওয়াকে যেতে হবে। ঠিক এক ঘন্টা পর বাসায় ফিরে গরম পানিতে একটা শাওয়ার নিতে হবে। এরপর ব্রেকফাস্ট করে তার পরের কাজ। সপ্তাহের অন্য ছয়টা দিন হলে ভার্সিটিতে যেতে হবে আর উইক এন্ডে গিটার ক্লাসে। তারপর বাসায় ফিরে একদম গৎবাঁধা কিছু কাজ, বিকালে মা’র সাথে নাস্তা করা, হয়ত সময় সুযোগ বুঝে কিছু বই পড়া, এরপর রাতে পড়াশোনা করে ঠিক রাত এগারটায় ঘুম। সেই ছোটবেলা থেকে এই নিয়মের সাথে অভ্যস্ত সে। অরিত্র’র বাবা জামিল চৌধুরী কোনদিনও এর ব্যতিক্রম হতে দেন নি আর কোন এক কারণে তাদের এই তিন জনের ছোট ফ্যামিলি এটাকে তাদের রুলস বলেই মেনে নিয়েছে।
“অরিত্র তুমি খুব ভালো করেই জানো এরপর তোমাকে কি করতে হবে, উঠে পড় তো বাবা লক্ষ্মী ছেলের মত।”
অরিত্রর ঘুম ততক্ষণে ভেঙে গেছে। সে ফ্রেশ হয়ে অন্যান্য দিনগুলোর মতই বাবার সাথে মর্নিং ওয়াকে বের হল। সারা দিনে তিনবার তার বাবা’র সাথে দেখা হয়; একবার মর্নিং ওয়াকের সময়, একবার ব্রেকফাস্টের টেবিলে আর আরেকবার ডিনারে। কপাল ভালো হলে কোন কোন দিন ভুলক্রমে তাকে লাঞ্চের সময়ও পাওয়া যায় তবে সেই ভুলটা জামিল সাহেবের খুব কমই হয়। দেশের নামকরা দশজন বিজনেসম্যানের সে একজন, তাকে তো একটু ভিন্ন হতেই হবে।
অরিত্র তার বাবা-মা দুজনের একজনকেও যে খুব একটা পছন্দ করে তা না তবে তাদেরকে অপছন্দও করে না। তবে এই দুইজনকে কেন যেন তার কাছে নিজের বাবা-মা বলে মনে হয় না। ছোট বেলায় সে কখনও এই ব্যাপারটা বুঝত না। যখন যা দরকার ছিল হাতের সামনে চলে আসত তাই কোনকিছুর অভাববোধটা তার মাঝে তেমন কাজ করে নি। কিন্তু বিপত্তি বাধিয়েছে একজন, খুব সাধারণ তবে অসাধারণ একজন, অধরা।
অধরা, অরিত্রের ক্লাসমেট, খুব ভালো বন্ধুও। একদম বন্ধু বলতে যা বোঝায় অধরা তাই। কিন্তু এই অধরার জন্য আজকাল অরিত্র ভীষণ বাজে একটা সমস্যায় পরেছে, জীবনের পার হয়ে যাওয়া বিশটি বছরেও যেই অরিত্র কোন কিছুর অভাব বোধ করে নি সেই অরিত্র হয়ত এখন খুব বাজে ভাবে একটা জিনিসের অভাব বোধ করছে। “স্বাধীনতা”, এই একটা জিনিস নেই অরিত্রের জীবনে, কোনভাবেই নেই। প্রতিটি মুহূর্তে অধরা অরিত্রকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় সে কতটা পরাধীন, কতটা অসহায়।
-কিরে? কি ভাবছিস? তোর মাঝে দেখি আজকাল আমার ভূত চড়ছে রে ! চিন্তা ভাবনা করিস! একটু রোমান্টিক রোমান্টিক ! প্রেমে পরছিস নাকি?
-অধরা ! তোর সব কিছু নিয়ে ফাজলামি পছন্দ হয় না ! স্যারের নেক্সট ক্লাসের অ্যাসাইনমেন্টটা বাকি এখনও ওটা করতে হবে !
– বাহ ! অ্যাসাইনমেন্ট করবি কর ! আবার আমাকে বকিস ক্যান? পারলে আমারটাও করে দিস!
-মোটেও না!
-আচ্ছা করা লাগবে না, নিশাদকে দিয়ে করিয়ে নেব !, বলেই একটা মুচকি হাসি দেয় অধরা !
– তুই এইটা ছাড়া আর পারিসটা কি?
-এই যে বনে-বাদাড়ে ঘুরতে পারি, ঝুম বৃষ্টিতে ধা তিন তিন করে নাচতে পারি, রাস্তায় অপরিচিত কাউকে হঠাৎ কিছু বলে ভড়কে দিতে পারি ! সবই তো পারি আমি !
-তোর এইসব পারা দিয়ে হবেটা কি শুনি? গ্র্যাজুয়েট কি এগুলা দিয়ে করবি? ভাত পাবি কিভাবে? বাবা-মা ঘর থেকে বের করে দেবে বুঝলি ! আর জামাইও পাবি না ,হাসতে হাসতে বলে অরিত্র
-তোর জীবনে সব কাজের পেছনে একটা উদ্দেশ্য আছে তাই না? এই যেমন তুই পড়াশোনা করিস কাওণ তোর গ্র্যাজুয়েট হওয়া লাগবে, ভাত খেতে হবে, তাই না ?
-হুম, তাই তো !
-কিন্তু কুমড়ো পটাশ, পৃথিবীতে অনেক কাজ এমন আছে যার কোন উদ্দেশ্যই নাই, আমরা কেন করি জানি না, কিন্তু ওগুলো করতে আমাদের ইচ্ছা হয়, আর সেটা করতে পারাটাই আমার কাজ, আমার স্বাধীনতা। আর শোন যেখানে ভাতের প্রশ্ন আসে তোকে বলে রাখি, আমি ভাত অত একটা পছন্দও করি না ! একটা আইসক্রীম ওয়ালা বিয়ে করে তার কাছ থেকে আইসক্রীম খাবো আজীবন। ভাত আর জামাই দুই সমস্যাই মিটে গেল ! তাই না !
বলে হাসতেই থাকে অধরা। “আচ্ছা, অধরার হাসিটা এত মায়াবী কেন?” ভাবতে গিয়েই আবার বাস্তবে ফিরে আসে অরিত্র,“এই সব কি ভাবি আমি! অ্যাসাইনমেন্ট কর অরিত্র!”
রাতের খাবার সময়ে জামিল সাহেব তার পুত্র আর স্ত্রীকে নিয়ে খেতে বসেন। এই সময় তিনি অরিত্রকে জীবন নিয়ে অনেক কিছু বলেন, কিভাবে আরও বড় হতে হবে , আরও বড় . .
-অরিত্র, তোমার পড়াশোনা কেমন হচ্ছে?
-হচ্ছে বাবা।
-এইটা কোন ভালো উত্তর হল না। তোমার উত্তর হওয়া উচিৎ “ভালো, বাবা।”
-জ্বী।
-শুনলাম, মাঝে মাঝেই তুমি তোমার মায়ের কাছে বায়না ধর বাহিরে কোথাও যাওয়ার?
-জ্বী।
-দেখ, এখন তুমি নিতান্তই ছোট। সামনে অনেক অনেক দিন পরে আছে। তুমি যখন আমার অফিসে জয়েন করবে তখন অনেক কাজেই তোমাকে বাইরে যেতে হবে, তখন অনেক দেশেই ঘুরতে পারবে। একই সাথে রি-ক্রিয়েশন আর বিজনেস দুটোই হল, এটাই কি বেশি প্রোডাক্টিভ চিন্তা না?
– জ্বী বাবা।
-তাহলে আর কোন দিন মাকে এ নিয়ে ডিস্টার্ব করবে না। আমরা চাই তুমি অনেক বড় হও।
-আচ্ছা বাবা।
-আচ্ছা খাও তাহলে।
চুপচাপ খেতে থাকে অরিত্র।
পরদিন সকালে ভার্সিটিতে গিয়ে দেখে অধরা ঠিক মেইন গেটটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। অরিত্র তার ড্রাইভারকে বিদায় করে দিল।
-কিরে কুমড়ো পটাশ, আজকে পাক্কা তিন মিনিট লেট করলি যে? ঘড়ি স্লো, না নিজে দিন দিন স্লো হয়ে যাচ্ছিস?
-অধরা, তুই আবার মজা করছিস কিন্তু?
-আচ্ছা, যা বাদ দিলাম। এখন একটা কাজ করতে হবে তোকে।
-কী কাজ?
-আগে বল করবি?
-তুই বলবি তো আগে!
-আজকের সবগুলো ক্লাস বাঙ্ক মারবি?
-পাগলে পেয়েছে আমাকে?
-পাগলে পাবে কেন? আমি, মিস শাগুফতা আহমেদ অধরা পেয়েছি।
-ফাজলামো করিস না, ক্লাসে চল।
-মোটেও না, আজকে তোকে কিছু একটা দেখাবো।
-সরি অধরা, আমি যাচ্ছি না।
-ঠিক আছে যাস না, তবে মনে রাখিস এটা তোর সাথে আমার শেষ কনভার্সেশন ! বলে গট গট করে হাটা দিল অধরা। সে খুব ভালো করেই জানে খুব মারাত্মক একটা টোপ ফেলেছে সে, যদি অরিত্র না আসে এখন তাহলে ক্ষতি তারই বেশি হবে। এই গর্ধভটাকে কেন যেন না দেখে থাকতে পারে না সে।
-আচ্ছা, চল। যাবো তোর সাথে। তবে এই শেষ !
-ওক্কে দোস্ত ! ফাইস্যা গেছ, মামা ! অধরা অতি মাত্রায় উৎফুল্ল হয়ে গেলে তার মুখ থেকে এইটাইপ আজগুবি কথা বার্তা বের হতে থাকে। এগুলো খুব ভালো করেই জানে অরিত্র তাই সে আর অবাক হল না।
-নে রিক্সা ভাড়া কর। বাস স্ট্যান্ডে যেতে বলবি।
-বাসস্ট্যান্ড? অরিত্র আসলেই এবার অবাক হয়।
-চুপ ! যা বলছি কর।
অরিত্র আর অধরা এই মুহূর্তে ঢাকা থেকে দূরে কোন একটা নাম না জানা গ্রামের পুকুর পাড়ে বসে আছে। অরিত্রকে ধরে বেঁধে একটা বাসে উঠিয়েছে অধরা, ততটুকুও ঠিক ছিল। কিন্তু বাসটা কোথায় যায় সেটাও যে অধরা জানে না, সেটা শুনতে পাওয়া মাত্র অরিত্রের মাথা ধরেছে। জীবনে এত বড় ভুল সে কিভাবে করল? এই ভাবতে ভাবতে একটা স্টপেজে ধুম করে তার হাত ধরে টেনে নামিয়ে আনল অধরা। তারপর সেই গ্রামের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে মাত্রই তারা একটা পুকুর পাড়ে এসে বসল!
-তুই কি পাগল, অধরা?
-কিঞ্চিৎ, তবে এখনও সম্ভাবনা আছে পুরোটা হয়ে যাওয়ার। কেন বলত?
-এইখানে তুই কেন এসেছিস? আমাকে নিয়েই বা কেন?
-চুপ ! একদম চুপ, একটা কথাও না। এবার তোর বাপরে ফোন দে ! শালা বড় লোকের পোলা ভাব মারো?
-মানে?
-মানে আবার কি? তুই কিডন্যাপড !
-অধরা !
-চুপ !
আরেকটু হলেই অরিত্র’র চোখ বের হয়ে যেত কোটর থেকে !
-আব্বে নাহ, তোর মত বাচ্চা কাচ্চাকে আমি কিডন্যাপ কোন দুঃখে করব। ভয় পাস না, বলেই হু হু করে হাসতে থাকে সে।
-অসভ্য, বেয়াদব।
-আচ্ছা, যাই হোক। অরিত্র আজ তোকে আমি কিছু বলব। কিছু প্রশ্ন করব, উত্তর দিবি?
-হুম বল, চেষ্টা করব।
-আচ্ছা তুই কি তোর বাবা-মা কে ভালোবাসিস?
-হঠাত এই প্রশ্ন?
-উত্তর দে
-হুম
-কিন্তু আমার কেন যেন মনে হয় না। তোর জীবনে কিছু একটা নেই যার জন্য তুই তাদের ভালোবাসতে পারিস না। তোর কি মনে হয় তারা তোকে ভালোবাসে?
-ইয়ে মানে। আমি কি বলব?
-আজকে তোকে এখানে কেন নিয়ে এসেছি জানিস?
-নাহ।
-আজ তুই কিছু দেখবি, কিছু জীবন দেখবি।
দুজনে অনেকক্ষণ নিরবে বসে থাকে।
-আচ্ছা অরিত্র তুই আকাশ দেখেছিস?
-হুম, প্রতিদিনই তো দেখি।
-ভুল বললি। আমরা প্রতিদিন আকাশ দেখি কথাটা ভুল। তুই এখন একটু ভালো মত আকাশের দিকে তাকা, এখনই।
অরিত্র আকাশের দিকে, তাকায়। মাথার ওপর দিয়ে আকাশের দিকে তাকায়। “একি! এ কেমন আকাশ? সে তো কখনও এভাবে আকাশ দেখে নি! আচ্ছা আকাশ এত সুন্দর, এত বিশাল! একে এত মায়াময় লাগছে কেন? সে আসলেই কখনও এত সুন্দর আকাশ দেখে নি। আসলেই না”
-অরিত্র, চল। পুকুরে নামি।
-উমম, মানে ভিজে যাবো তো। আর আমি সাঁতার জানি না।
-তোকে গোসল করতে কে বলছে, গর্ধভ !
-আচ্ছা, ও !
অরিত্র আর অধরা পুকুড় পারের শেষ সিড়িতে বসে পা ডুবিয়ে বসে থাকে অনেকক্ষণ ওখানে। অরিত্র হাঁসদের খেলা করা দেখছে, একটু পর পর ওপরে তাকিয়ে আকাশ দেখছে, গাছের দিকে তাকিয়ে আছে। “প্রকৃতি আসলেই কি এত সুন্দর? অধরা কিভাবে জানল এসব? সে তো মাঝে মাঝে বই এ পড়েছে প্রকৃতির কথা কিন্তু বাস্তবে কখনও এভাবে দেখার চিন্তাও করে নি। আচ্ছা সে তাহলে এতদিন কেন এমন ছিল? বাবা কি কোনদিন পুকুর পাড়ে এসে বসেছে? এতে প্রোডাক্টিভ কিছু কি হবে?” ভাবতে ভাবতে কোথায় যেন হারিয়ে যায় অরিত্র।
-হুম, ওঠ এখন, কতক্ষণ বসে আছিস জানিস ! বিকাল হতে চলল, বাসায় ফিরব এখন।
-হুম, চল।–বলে উঠে দাঁড়ায় অরিত্র।
যেতে যেতে আবার উপরের আকাশের দিকে তাকায় অরিত্র? “আচ্ছা ঢাকার আকাশ বোধহয় এত সুন্দর না, তা না হলে আমি কেন দেখি নি।”
( চলবে . . .দুই পর্বে সমাপ্ত )
পরের পর্ব কখন দিবেন ভাইয়া ??
:fire:
দিয়ে দিয়েছি আপু ! 8)
:yahooo:
পরের পর্ব আগে পড়ে ফেললাম! আর আগের পর্ব পরে! 😳