নিছক ভ্রমণকাহিনী কিংবা স্বপ্নপূরণের গল্প

হিমছড়ির পাহাড়ের উপর থেকে তোলা ছবি...... সূর্যাস্তের ঠিক আগমুহূর্তে......

[ বলে নেয়া প্রয়োজন। এটি শুধুই একটি ভ্রমণকাহিনী। খানিকটা গল্প আকারে লেখা। লেখার মূল উদ্দেশ্য দুটি। প্রথমত, অনেকদিন কিছু লেখা হয় না এবং দ্বিতীয়ত স্মৃতি সংরক্ষণ ]

# ২৪ মার্চ, ২০১৩

সময়টা বিকেল। আমি প্রচন্ড ব্যাস্ত। ব্যাস্ততার বিষয় বড়ই আচানক। আধ ঘণ্টা ধরে ব্যাগ গুছাচ্ছিলাম। প্রায় সব কিছু যখন গুছানো শেষ তখন দ্বিধায় পড়লাম থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট কি একটা নিবো নাকি দুইটা।

এমন সময় পকেট কাঁপিয়ে ফোন বেজে উঠলো। সৈকতের ফোন।

– কিরে শালা, কই তুই???
– এইতো বাসায়। ব্যাগ গুছাই। তুই কই??
– আমি বের হয়ে গেছি। শাওনের বাসায় এখন। ফেসানও আছে। রাতে বের হইলে আব্বায় বাসে উঠায় দিতে যাইবো। ধড়া খাইবার পারি। তাই, আগে বাইর হইলাম। তুই কখন বাইর হবি?
– আমি বাসায় সত্য কইয়া দিছি। বাস তো ৯ টায়। আমি সাড়ে ৭টার দিকে বাইর হমু নে। বেরোয়ে ফোন দিমু।
– ওকে। টাটা।
– মর শালা। বাই।

ব্যাগ গুছানো শেষে বাসা থেকে বেরোবার সময়ই কেমন যেন একটা রোমাঞ্চ অনুভব হচ্ছিলো। সবাই স্কুলের সামনে দেখা করলাম। গন্তব্য কমলাপুর হানিফের বাস কাউন্টার। আর শেষ গন্তব্য কক্সবাজার। সাথে কেউ নাই। শুধুই আমরা ৪ জন। SSC শেষ আমাদের ৩ জনের। আর ফেসান আমাদের ছোটভাই। ক্লাস নাইনে উঠলো কেবল।

কাউন্টারে গিয়ে খেলাম তৈলাক্ত বাঁশ। সাড়ে ৯ টার বাস ছাড়বে ১১ টায়। আমরা সবগুলা গিয়ে বসলাম কমলাপুর রেলস্টেশনে। দেখতে দেখতে কীভাবে যেন সময় কেটে গেলো। হালকা নাশতা খেয়ে একসময় বাসে উঠলাম। বাস ছাড়তেই কেমন কেমন ঘড় পালানো টাইপ একটা অনুভূতি আসতে শুরু করলো। আমি ছাড়া বাকি সবাই নানান ধরনের ভুং ভাং দিয়ে বাসা থেকে বের হইছে।

যাই হোক, এরই মধ্যে রাত ১২টা বেজে গেলো। অর্থাৎ, আমরা ২৫ তারিখে চলে আসলাম। চলেন পাঠক, আমরা সেদিনে যাই।

# ২৫ মার্চ, ২০১৩

বাস চলছে। আমি ভাব নিয়া ল্যাপটপ ছাড়লাম। যতক্ষণ কিউবি কানেকশন পেলো ততক্ষন পালা করে ফেসবুকে ঢুঁ মারা চলল একে একে। আস্তে আস্তে আমরা শহর পেরিয়ে এলাম। একসময় উঠে এলাম হাইওয়ে তে। আহা!! সে কি শান্তি!!! বাসের ড্রাইভার Need For Speed-Most Wanted খেলতে শুরু করলো। আর আমি জানালা দিয়ে চুল বের করে বসে থাকলাম। হাইওয়ে দিয়ে বাস চলার সময় চুল বের করে বসে থাকার কি যে শান্তি!!!!!! কিন্তু, কথায় আছে সুখ বেশিক্ষণ সয় না। আমারও সইল না। আমাদের ৪টা টিকেটের মাঝে ২টা ছিলো জানালার পাশে। সেই জানালার পাশের সিটও পালাক্রমে পরবর্তীত হতে লাগলো।

সে সময় সৈকতের দেয়া একটা স্ট্যাটাসের কিছু অংশ তুলে দেই। কথাটা খুব ভালো লাগছে আমার…… “ কখনো কখনো কৈশরের চঞ্চলতা Morality কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ছুটে চলে নিজ গন্তব্যে…..”

মাঝে বাস কুমিল্লাতে থামলো। আমরা ঝটপট নাশতা করলাম। তারপর বাসে উঠে সবাই হালকা পাতলা ঘুম দিলাম। সকালে উঠে দেখি আমরা কক্সবাজারে। সে কি যে আনন্দ। বেশি Excited ছিলাম। তাই, একটু কম বেছেই মোটামুটি ফালতু টাইপ একটা হোটেলে উঠে গেলাম।

একটু ফ্রেশ হয়েই গেলাম সমুদ্র সৈকতে। শাওন ছেলেটা বড়ই বেরসিক। সে পা ভেজাবে। কিন্তু, সমুদ্রে নামবে না। নে তাহলে মেয়ে মানুষের মতো আমদের মোবাইল আর মানিব্যাগ নিয়ে বসে থাক। সমুদ্রে ভয়ানক দাপাদাপি করে হোটেলে ফিরে আসা। এসে হোটেলের বাথরুমের দিকে ভালো মতো নজর দিয়ে দেখি বারান্দা দিয়ে বাথরুমের ভেতরে ভেন্টিলেটরের মাধ্যমে পুরোটা দেখা যায়। বহুত টেনশন নিয়া গোসল করে বের হলাম।

বের হয়ে এক হোটেলে খাওয়া দাওয়া করলাম। ফেরার সময় যে CNG তে উঠলাম তার ড্রাইভার খুব করে বলল,

– মামা, চলেন আপনাদের হিমছড়ি নিয়ে যাই। আমার একটু ওদিকে যাওয়া দরকার। ভাড়া কমায় নিবানি।

একটু ভেবে দেখলাম। যাওয়া যায়। কোন প্রিপারেশন ছাড়াই চলে গেলাম হিমছড়ি। গিয়ে তো আমরা পুরাই টাশকি খেয়ে গেলাম। এ কোন স্বর্গে এসে পড়লাম। একটার পর একটা নতুন পাহাড়ে উঠতে লাগলাম। সময়টাও ছিলো অসাধারণ। সে সময়ে লেখা আমার একটি স্ট্যাটাস এখানে দিয়ে দিচ্ছি। সে মুহূর্তের অনুভূতি খানিকটা বোঝা যাবে……

“” ৭টার মত পাহাড় পেরোলাম…হিমছড়ির পাহাড়ে আমরা…. একপাশে সূর্য অস্ত যাবার অপেক্ষায়…. অন্যপাশে চাঁদ অন্ধকার দূর করার অপেক্ষায়…. মাঝে শুধু আকাশছোঁয়া পাহাড়, তুচ্ছ সমুদ্র আর বাঁধভাঙা আমরা…. আসলে জীবনটা বেসম্ভব আনন্দময়…. আর দেশটা আসলে অনেক অনেক সুন্দর…. দেশটাকে ভালোবাসতে হলে একবার দেখে যান…. বুঝবেন আমাদের দেশ, আমাদের মা কত ঐশ্বর্যময়……””

৪-৫ টা পাহাড় পেরোবার পরই আমাদের মাঝে যুদ্ধ জয়ের আনন্দ কাজ করতে লাগলো। পিচ্চি ফেসান তখন পুরা ট্রিপে আমার সবচেয়ে পছন্দের ডায়ালগটা দিলো……

“ ভাইয়া, একটু চিন্তা কইরে দেখেন, আমরা মাত্র ৩-৪ টা পাহাড় পার হইয়াই কি চিল্লা পাল্লা করতেছি। কতো আনন্দ পাইতেছি। আমগোরই যদি এই অবস্থা হয় তাইলে মুসা ইব্রাহিম যখন এভারেস্ট জয় করছিলো না জানি তার কি আনন্দ হইছিলো……”

পরদিন আমরা যাবো সেন্ট মার্টিন। টিকেট বুকিং সহ যাবতীয় কাজ শেষে আমরা হোটেলে গেলাম। রাতের খাওয়াও হলো। ঘড়ির টিক টিক শব্দের সাথে সাথে আবারো রাত ১২টা বাজলো। আমরা পরের দিনের প্রথম প্রহরে প্রবেশ করলাম।

# ২৬ মার্চ, ২০১৩

রাতে আমরা ৩ জন এক ফোঁটাও ঘুমাই নাই। ছোট ভাইটা ঘুমালো একটু। আর আমি শেষ রাতের দিকে ঘণ্টা খানেক। পরের দিন ৬টায় আমরা টেকনাফের বাসে উঠলাম। পরে জাহাজে। কোথাও ঠিকভাবে এনজয় করতে পারলাম না ক্লান্তির কারণে।

অবশেষে সেন্ট মার্টিন পৌঁছে “সীমানা পেরিয়ে” নামক কটেজে উঠলাম। আসেন, এবার আমরা একটু এই ছোট্ট দ্বীপটার ইতিহাস জানি।

বলা হয়, এটি বাংলাদেশের মানচিত্রের শেষ সবুজ বিন্দু। দ্বীপটি দৈর্ঘে প্রায় ৮ কিলোমিটার এবং প্রস্থে কোথাও ৭০০ মিটার আবার কোথাও ২০০ মিটার। সেন্ট মার্টিনের উত্তর-পশ্চিম দিক জুড়ে রয়েছে প্রায় ১০-১৫ কিলোমিটার প্রবাল প্রাচীর। দ্বীপের শেষ মাথায় সরু লেজের মত আর একটি অবিচ্ছিন্ন দ্বীপ রয়েছে যার নাম ছেঁড়াদ্বীপ। জোয়ারের সময় পানি এসে এটিকে মূলদ্বীপ হতে বিচ্ছিন্ন করে বলেই এর নামকরণ করা হয়েছে ছেঁড়াদ্বীপ। ভাটার সময় পানি নেমে গেলে এটি আবার মূলদ্বীপের সাথে সংযুক্ত হয়ে যায়। তখন পায়ে হেঁটেই চলে যাওয়া যায় সেখানে।

সেন্ট মার্টিন দ্বীপ স্থানীয় ভাবে জাজিরা বলে পরিচিত। এক সময় এই দ্বীপটি ছিল একটি বিশ্রামাগারের মত। বিভিন্ন দেশের বনিকরা বিশেষ করে আরব বনিকরা পন্য নিয়ে যখন সওদা করতে যেতো তখন তারা এই দ্বীপে বিশ্রাম নিত। তখন থেকেই এই দ্বীপের নাম হয় জাজিরা। তবে পরবর্তীতে এটি নারিকেল জিনজিরাও বলে পরিচিতি লাভ করে। অসংখ্য নারিকেল গাছের সমারোহ থাকায় এই দ্বীপকে এই নামে ডাকা হয়ে থাকে। সর্বশেষে ইংরেজরা এই দ্বীপটির নাম করন করে সেন্ট মার্টিন এবং দেশ বিদেশের মানুষের কাছে এখন পর্যন্ত এই নামেই পরিচিত। তবে সাহিত্যের ভাষায় দারুচিনির দ্বীপ নামটিও বেশ পরিচিত ও জনপ্রিয়।

এবার আবার ভ্রমণকাহিনীতে ফেরত যাওয়া যাক। ৪টার দিকে আমরা ঘুম দিলাম। প্ল্যান ছিলো ঘণ্টা দুয়েক পরে উঠে আমরা বার-বি-কিউ খাবো। বাবার ফোনে ঘুম ভাঙলো। উঠে পুরাই তব্দা খেয়ে গেলাম। ঘড়িতে তখন ঠিক রাত ৯টা ৬ বাজে। দৌড়ে কোনোমতে খেয়ে আসলাম হালকা পাতলা। এসেই আবার বিচে খানিকক্ষণ ঘুরে ঘুমিয়ে পরলাম।

পুরো ট্রিপের মাঝে এই দিনটা পুরাই মাটি।

# ২৭ মার্চ, ২০১৩

ঘুম থেকে উঠলাম উঠলাম ৬ টার দিকে। সাড়ে ৭টার দিকে জেটিতে গিয়ে স্পীড বোট ঠিক করলাম। প্রথমে গেলাম প্রবাল দ্বীপ। তারপর গেলাম ছেঁড়া দ্বীপ। দ্বীপগুলো ঘুরে আমার একটা কথাই বার বার মাথায় আসছিলো —

“প্রকৃতি প্রদত্ত যেকোনো কিছুই আসলে পরিপূর্ণ। মানুষ যখনই প্রকৃতিতে হাত দেয় তখনই তা বিকৃত হয়ে যায়। আর দ্বীপগুলোতে মানুষের আনাগোনা কম বলে তা এখনও অনেকটাই পরিপূর্ণ রূপে আছে। মানুষের মাঝে অপূর্ণতার কমতি নেই বলেই মানুষ পূর্ণতা সহ্য করতে পারে না। তাই, প্রকৃতি এভাবে নষ্ট হয় আস্তে আস্তে।”

দুপুরে খেতে বসলাম। টেকচাঁদা নামক অসাধারণ এক মাছ খাওয়া হলো। স্বাদে খানিকটা ইলিশ ইলিশ ভাব আছে। তারপর আবার জাহাজে উঠলাম। গন্তব্য সেই কক্সবাজার।

যাবার পথটা এবার অসাধারণই গেলো। সমুদ্রের গাঙচিল গুলোকে বিস্কিট খাওয়ানোর ব্যাপক একটা আনন্দ আছে। ছুঁড়ে মারলেই হলো, কোনো না কোনো ভাবে ওরা মুখে নিবেই। এভাবেই আস্তে আস্তে চলে আসলাম টেকনাফ।

টেকনাফ থেকে কক্সবাজার যাবার পথটা আরও অসাধারণ ছিলো। আমি আর সৈকত বাসের ছাদে উঠে পরলাম। সে কি বাতাস। দুজনে খালি গায়ে চিল্লা পাল্লা করে গান গাইতে লাগলাম। একসময় পৌঁছে গেলাম কক্সবাজার।

সেদিন পূর্ণিমা ছিলো। ভরা পূর্ণিমা। হুমায়ূন স্যারের প্রিয় জোছনা। আমদের চন্দ্রস্নান হলো। একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম তখন…… “ভরা পূণিঁমায় সমুদ্রস্নান কিংবা চন্দ্র স্নান…. স্বর্গ নামক ধারণাটা কি এর থেকেও বেশি কিছু…???”

# ২৮ মার্চ, ২০১৩

ঘুম থেকে উঠতেই ১১টা। দুপুরে কিছু কেনাকাটা করে আবার হিমছড়ি গেলাম। আরও কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি। পাহাড়ে ওঠার নতুন কিছু রাস্তা আবিষ্কার করলাম। নতুন কিছু পাহাড়েও উঠলাম। আস্তে আস্তে রাত হয়ে এলো। হোটেলে ফিরে এসে ব্যাগ গুছানো শুরু করতে হলো। ১১টায় আমাদের বাস।

চলে যাবার পথে শেষবারের মতো সমুদ্র দেখে এলাম। শেষবারের মতো পা ভিজিয়ে বলে এলাম…… বিদায় হে সমুদ্র…… বিদায়……

Amit Pramanik সম্পর্কে

নিজের ব্যাপারে কিছু বলা মনে হয় সবসময়ই কঠিন। আসলে, প্রতিটা মানুষই তো স্বাভাবিক। আমিও তাই। পড়াশুনা করি, খাই, আড্ডা দেই, ঘুমাই, দুষ্টামি করি, মাঝে মাঝে এক আধটুক লেখা লেখির চেষ্টা করি আর মুভি দেখি। এইতো.... এভাবেই চলছে...... দুঃখ আছে, আনন্দ আছে...... হতাশা কিংবা বিস্বাদ সবই আসে মাঝে মাঝে...... কিন্তু, সময় তো আটকে থাকে না...... নতুন কিছুর অপেক্ষায় এভাবেই প্রতিদিন একটু একটু করে এগোতে থাকি সামনের দিকে..... " চাই সবচেয়ে বড় আকাশ নক্ষত্র আর ঘাস আর চাই চন্দ্রমল্লিকার রাত শুধু এইটুকুই জীবনের শেষ চাওয়া...... "
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে ভ্রমণ, সাহিত্য-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

11 Responses to নিছক ভ্রমণকাহিনী কিংবা স্বপ্নপূরণের গল্প

  1. অবন্তিকা বলেছেনঃ

    কক্সবাজার যেতে ইচ্ছুক! 🙁

  2. ফিনিক্স বলেছেনঃ

    পুরো ঢুকে গেলাম কাহিনীর ভেতর। আমাদের দেশটা এত্ত এত্ত সুন্দর! :beshikhushi:

    তিন বালতি হিংসা অমিতের জন্য। 😡

  3. গাঙচিল বলেছেনঃ

    কোথাও ভ্রমণকাহিনী টাইপের কিছু দেখলেই আমি ভীষণ আগ্রহ নিয়ে সেটা পড়তে শুরু করি, এবং পড়া শেষ হলে মন খারাপ করে ফেরত আসি……… 🙁

    এত সুন্দর এই দেশটার প্রায় কিছুই দেখা হয় নি।

    ছবিটা খুব সুন্দর।

  4. অনাবিল বলেছেনঃ

    …………………….. অনেক অনেক অনেক বেশি ইচ্ছে করছে যেতে……
    সুন্দর লিখেছেন……… 🙂

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।