হুইলচেয়ার প্রবেশগম্য বাস; একটি আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় প্রতিযোগীতা ও কিছু কথা

সভ্য একটা দেশের বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে হামাগুড়ি দিয়ে চলাচল করছে কোন শিক্ষার্থী, দৃশ্যটা কল্পনা করে গা শিউরে উঠলো!? করুণায় আর্দ্র হয়ে উঠলো কি মনটা!?

দৃশ্যটি কাল্পনিক নয়! ঢাকার নামকরা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’জন শারীরিক প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী এভাবেই চলাচল করেন। এমন আরো অনেক স্বল্প মাত্রার শারীরিক প্রতিবন্ধী মানুষকে আমি জানি, যারা হুইলচেয়ারকে ঝামেলা মনে করে একি পন্থা অবলম্বনে বাধ্য হন। আমাদের কি একটু ভেবে দেখা দরকার, দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠের এই শিক্ষার্থীরা বা এমন আরো কিছু মানুষ হামাগুড়ি বা হাঁটুতে ভর করে চলাচল করতে কেনো বাধ্য হচ্ছেন!? নূণ্যতম পাঁচ হাজার টাকা খরচ করে একটি হুইলচেয়ার কিনে ফেললেই তো হয়ে যায়। হুইলচেয়ার কেনার সামর্থ নাই? তাতে কি! একটি মাত্র আবেদনে খুব সহজেই হুইলচেয়ার পেয়ে যাবেন যে কেউ। দেশে এমন এনজিওর অভাব নেই যারা নাকি সাগ্রহেই বিনামূল্য হুইলচেয়ার প্রদানের কাজটি করে থাকেন! তাহলে মূল সমস্যাটা কোথায়?

আচ্ছা! তার আগে আমরা একবার ভাবি তাদের কথা, যারা আরো গুরুতর মাত্রার শারীরিক প্রতিবন্ধী মানুষ। হামাগুড়ি দিয়েও চলাচলের সাধ্য নেই, যাদের একমাত্র অবলম্বন এই হুইলচেয়ারটিই। রাস্তা-ঘাটে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা অফিস-আদালতে তাদের তেমন উপস্থিতি চোখে পরে না কেনো !?

আপনি কি জানেন, আপাতদৃষ্টিতে শারীরিকভাবে কিছুটা অক্ষম এই মানুষগুলো নিজেকে ভিন্নভাবে সক্ষম হিসেবে প্রমাণের এক অসম্ভবের যুদ্ধে নেমেছেন। কিন্তু এরপরেও দু’চাকার হুইলচেয়ারের প্রতি কেনো তাদের এই বিদ্বেষ!? তার কি কোন খবর রাখি বা জানার চেষ্টা করি আমরা!?

আপনি কি এখনো দুঃখই করছেন! দুঃখ বা আফসোসের কথা ভাবলে বাকিটুকু পড়ে সময় নষ্ট করার কোন মানে হয় না। কারণ আমরা বিশ্বাস করি, হতাশা কোন সমাধান নয়। এখন সময় এসেছে সমাধানের পথ খুঁজে নেবার। আসুন, সামান্য একটু ধৈর্য্য নিয়ে আমাদের ব্যস্ত সময়ের কিছুটা হলেও ব্যয় করি এই বিষয়টির গভীরতা অনুভবের চেষ্টায়!

১৬ কোটি মানুষের এই বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী তথা ভিন্নভাবে সক্ষম মানুষ যারা নাকি সংখ্যায় প্রায় ০২ কোটি ৪০ লক্ষ। ২০১১ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বিশ্ব ব্যাংক এর যৌথ উদ্যোগে নেয়া একটি জরীপ থেকে এই তথ্যটি আমরা জানতে পারি। এই বিশাল সংখ্যার মাঝে কতো-শতো শারীরিক প্রতিবন্ধী মানুষ আছেন সেই তথ্যটি কিন্তু আজো আমাদের অজানা! এই মানুষগুলো হুইলচেয়ার ব্যবহার করতে বাধ্য হওয়ার পরেই দেখা যায় তাদের বেশির ভাগই প্রবেশগম্যতা এবং যাতায়াত ব্যবস্থার নিদারুন যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে পড়েন। অবশেষে একসময় চারদেয়ালের কাল কুঠুরীতে জেলখানার বন্দী কয়েদির মতোন জীবন যাপন শুরু করেন। তাদের জন্য না আছে স্পেশাল স্কুল-কলেজ আর না পায় তারা সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাবার সুযোগ। তাদের শুধু আছে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে না পারার চাপা কষ্ট। ভেতরটা গুমরে কাঁদে। হতাশ হয়ে একে ভাগ্য মেনে নেন অনেকে। আর অন্য দিকে একেবারেই স্বল্প সংখ্যক দুঃসাহসীরা এক অসম্ভবের যুদ্ধে নেমে পড়েন। ঘর থেকে রাস্তায় বেড়িয়ে অসহায়ের মতোন যানবাহনগুলোর দিকে চেয়ে থাকেন তারা। কেউবা ধস্তাধস্তি করে হয়তো কোন ট্যাক্সি বা রিকশাতে উঠে পড়েন। নিত্য সঙ্গী হুইলচেয়ারটাকেও নানা ঝক্কি ঝামেলা করে কোন না কোন ভাবে জায়গা করে নিতেই হয়। আর বাস! সে হলো দিনে দুপুরে আকাশ কুসুম স্বপ্নে বিভোর থাকার মতোন ব্যাপার! এ যে কি অমানুষিক যন্ত্রণা তা একমাত্র ভুক্তভূগীই বলতে পারেন।

এদেশে রাস্তায় এমন একটা যানবাহনও নেই যেটায় কোন বাঁধা ছাড়া এই হুইলচেয়ারটা নিয়ে তরতর করে উঠে যাওয়া যায়। সহজে হুইলচেয়ার প্রবেশগম্য র‍্যাম্প যুক্ত একটা বাস, ট্যাক্সি কোন কিছুই নেই! তারাও যে মানুষ, এদেশেরই নাগরিক আমরা সম্ভবত ভুলতে বসেছি।

স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বি-স্ক্যান র‍্যাম্প যুক্ত একটি যানবাহনের জন্য গত এক বছর ধরে প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে গত ২রা মার্চ’১২ সেন্টার ফর দ্যা রিহ্যাবিলিটিশেন অফ দ্যা প্যারালাইজড (সিআরপি) এর সাথে যৌথ উদ্যোগে ঘর বন্দী হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী মানুষগুলোর অস্তিত্ব প্রমাণের চেষ্টায় ঢাকা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গনে র‍্যালী ও সমাবেশ আয়োজন করেছিলো বি-স্ক্যান। এই সমাবেশে একাত্মতা ঘোষণা করে এসেছিলেন মাননীয় যোগাযোগ মন্ত্রী জনাব ওবায়দুল কাদের, ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারসহ সর্বস্তরের মানুষ। সংহতি জানিয়ে যোগ দিয়েছিলো ওয়াটার এইড, বিভিন্ন ব্লগসহ বেশ কিছু সংগঠন। সে সময় মাননীয় মন্ত্রী আশ্বাস দেন বিআরটিসি কতৃক র‍্যাম্পযুক্ত বাস আমদানি করার। তার প্রেক্ষিতে বিআরটিসি মহাপরিচালকের সাথেও বৈঠক করেছে বি-স্ক্যান সদস্যগণ। সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে চলেছে নানাভাবে প্রচারণা।

তারই ধারাবাহিকতায় ইউনিভার্সাল এক্সেসিবিলিটি ইন পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বিষয়টিকে সামনে রেখে বাংলাদেশী সিস্টেমস চেঞ্জ এ্যাডভোকেসি নেটওয়ার্ক (বি-স্ক্যান) ও ইঞ্জিনিয়ারিং স্টুডেন্টস এসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ (এসাব) যৌথভাবে উদ্যোগ নিয়েছে আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ডিজাইন কন্টেস্ট এর। মূলত তরুণ প্রকৌশলী শিক্ষার্থীগণ তাদের মেধাকে কাজে লাগাবেন যানবাহনে এদেশের রাস্তা উপযোগী একটি নকশা তৈরি তথা পাবলিক বাসে হুইলচেয়ার সহজে চলাফেরা নিশ্চিতে বাস্তবধর্মী প্রয়োগযোগ্য একটি সমাধান বের করে আনার। এই প্রতিযোগিতা শুধু যে প্রকৌশল বিদ্যার পুরোকৌশল বিভাগ, যন্ত্রকৌশল বিভাগ এবং স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষার্থীরাই অংশ নেবেন তাই নয়, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া যেকোন শিক্ষার্থীই এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারবেন।

 

নিজ দেশেই পরাধীন অগুনতি হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী মানুষের স্বাধীনতার স্বপ্ন পূরণে দেশে এই প্রথমবারের মতোন কোন প্রতিযোগিতার আয়োজন হচ্ছে যেখানে প্রকৌশলবিদ্যার তিনটি গুরুত্বপূর্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা একই প্ল্যাটফরমে একিসাথে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে। বাংলাদেশের প্রকৌশল বিদ্যায় অধ্যায়নরত শিক্ষার্থীদের মাঝেও এই মানুষগুলোর জন্য একটি সহজ-স্বাভাবিক সুন্দর জীবন উপযোগী ব্যবস্থা গড়ে তোলার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করবে এই প্রতিযোগিতা সেই সাথে সচেতনতা তৈরি করবে অন্যদের মাঝেও। পরিবর্তনের চেতনায় বিশ্বাসী তরুণ প্রজন্মের উপর অগাধ আস্থা আমার। আমি জানি, তারা নিছকই একটা পুরুস্কারের আশায় নয়, তাদের সর্বোচ্চ মেধা এবং ব্যবহারিক জ্ঞানের ব্যবহার করে হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীদের জন্য এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করতেই চমৎকার একটি সহজ কার্যকরী সমাধান বের করে আনবেন। আমি ইতিমধ্যেই বিশ্বাস করতে শুরু করেছি, এই উদ্যোগের কথা জেনে স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় আক্রান্ত হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী মানুষগুলোও নিশ্চয় আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করবেন।

 

রূপকল্প (এবস্ট্রাক্ট) [আপনার আইডিয়ার সারসংক্ষেপ, টেকনিক্যাল ব্রিফ ইত্যাদি] জমাদান ও নিবন্ধন শেষ দিনঃ ৫ এপ্রিল ২০১৩

সম্ভাব্য গ্রুপ স্টেজ রাউন্ডঃ ১৯ এপ্রিল, ২০১৩

ফিল্ড ট্রিপ এবং গ্রুমিং সেশন ২৬ এপ্রিল, ২০১৩

এবং গ্র্যান্ড ফিনালে ৫ মে, ২০১৩ (তারিখ সমূহ পরিবর্তনযোগ্য)

তবে আর দেরী কেনো! আসুন আমরা সকলে মিলে আমাদের নাগরিক কর্তব্য পালন করি। এই প্রতিযোগিতার কথা ছড়িয়ে দেই বন্ধুদের মাঝে অথবা প্রতিযোগীতায় অংশ নিয়ে আমাদের সবচেয়ে ভালো ডিজাইনটি তৈরি করে ফেলি। এদেশের ভিন্নভাবে সক্ষম মানুষগুলোর জন্যে বাসযোগ্য একটি বাংলাদেশ গড়ে তুলতে সচেষ্ট হই।

 

প্রতিযোগিতার বিষয়ে বিস্তারিত জানা যাবে এবং নিবন্ধন করা যাবে এই ঠিকানায়

যোগাযোগঃ +৮৮০১৬৭৪৪১৫৯১৩

 

 

সাবরিনা সুলতানা সম্পর্কে

“আমার কতো দাবি! কতো চাহিদা! কিছুই পাইনা। যেদিকে হাত বাড়াই সেদিকে অন্ধকার। সব জায়গায় নিয়ন্ত্রণ। সামাজিক নিয়ন্ত্রণ। রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ। প্রাকৃতিক নিয়ন্ত্রণ। সব নিয়ন্ত্রণে আমি বাঁধা আর গুমরে গুমরে কাঁদে আমার আশা আকাঙ্ক্ষা। ভালোবাসা!”
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে ইতিবাচক, উদ্যোগ, সচেতনতা-এ এবং ট্যাগ হয়েছে স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

2 Responses to হুইলচেয়ার প্রবেশগম্য বাস; একটি আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় প্রতিযোগীতা ও কিছু কথা

  1. বোহেমিয়ান বলেছেনঃ

    অসাধারণ একটা কাজ। সিমপ্লি অসাধারণ

  2. ফিনিক্স বলেছেনঃ

    বিকল্পভাবে সক্ষম মানুষদের স্বপ্ন একদিন পূওণ হবেই- আমি বিশ্বাস করি।
    সাথে আছি আপু।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।