শ্রদ্ধাস্পদ

ফেসবুকের কল্যানে খুঁজতে খুঁজতে একসাথেই পেয়ে গেলাম কলেজ লাইফের এই ৪জন  শ্রদ্ধেয় শিক্ষাগুরুকে !

সর্ববামে বসা ঢাকা সিটি কলেজের ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের রেজাউল করিম স্যার । কলেজে থাকতে উনাকে এতো ভয় পেতাম যে, উনার ক্লাসে কেউ শার্টের বুকের একটা বাটন বেশি খোলা রাখারও সাহস কারো হত না ! স্যার কখনও চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতেন না। (ঠিক যেমন ছবি তোলার সময়েও তাকাননি ক্যামেরাম্যানের দিকে !) কিন্তু  দুর্ভাগ্যক্রমে কারো চোখে চোখ রেখে যখন তাকাতেন, গলা শুকিয়ে খট খট করতো, বুক হয়ে যেত সাহারা !

ফার্স্ট ইয়ারের কথা। একদিন রেজা স্যার ক্লাসে যথারীতি রোল কল করে ধীরে সুস্থে ডায়াসের মাঝখানে এসে দাঁড়িয়ে উনার অসীমতক দৃষ্টি (!) আবদ্ধ করলেন এক বন্ধুর উপর। ভয়ে থরহরিকম্প অবস্থায় বুকের বাটন ঠিক আছে কিনা চেক করতে করতে ছেলেটা উঠে দাঁড়ালো। আমরা সবাই মোটামুটি নিশ্চিতভাবে ধরে নিয়েছিলাম, যে আজকে বেচারার “খবর” আছে ! ক্ষণিকের নীরবতা। অতপরঃ স্যার আমাদের সেই বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলেন –

– ওই মিয়াঁ, গতকাল বিকালে কই ছিলা ?
– শিশু পার্কে !
– এখনো শিশু আছ ?
– (বন্ধুর মাথা নিচু – ক্লাসে চাপা হাসির রোল)
– আচ্ছা, ঠিক আছে। ব্যাপার হইলো যে, গতকাল তোমার সাথে থাকা বান্ধবীর কানে যে বড় দুলটা ছিল, তোমরা ম্যারিগো রাউন্ডের একদম টপ হাইটে থাকা অবস্থায় সেই দুলের ভিতরের ছোট্ট দোলক সদৃশ বস্তুটার দোলনকালের সমীকরণটা বোর্ডে এসে লেখো !  =))  =))

এই ছিলেন আমাদের রেজা স্যার। অসম্ভব শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার এই শিক্ষাগুরুর বিরুদ্ধে কিছুদিন আগে একটা মিথ্যা অপবাদ ছড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছিলো, যার ফলে অভিমান নিয়ে স্যার কলেজের অধ্যাপনা ছেড়ে দিয়েছেন। অথচ আমরা যারা স্যারকে কাছ থেকে দেখেছি, তারা এইসব ফালতু র‍্যুমারে কান দেইনি। স্যারের জানা উচিৎ, এখনো আমরা তাঁকে আগের মতই শ্রদ্ধা করি এবং ভালবাসি।

রেজা স্যারের ডান পাশে বসা কলেজের কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের হেড এ.এস.এম ওয়ালিয়ুল হক স্যার। স্যার যখন প্রায়ই লাত্থি দিয়ে সাইন্স থেকে বের করে দেয়ার অভিপ্রায় (!) প্রকাশ করতেন, প্রচন্ড অপমান বোধ করতাম, মনটা খারাপ হয়ে যেতো। এই অপমানের জ্বালা যে কতবার কলেজ থেকে ফিরেই কেমিস্ট্রি নিয়ে বসতে বাধ্য করছে, হিসাব নাই ! ইন্টারে আর কোন সাবজেক্টে এ প্লাস না পাইলেও স্যারের সাবজেক্টে এ প্লাস পাওয়ার দৃঢ় সংকল্প অবশ্য সফল হইছিল। রেজাল্টের পর স্যারের কাছে গিয়ে সালাম করে দুয়া চাইলাম, স্যার স্বভাবসুলভ ঝারি দিয়ে বলেছিলেন – “যা যা , ভাগ ! পারলে মানুষ হইস।”   😛

ওয়ালিউল স্যারের ডানে বসা নরম ও মিষ্টভাষী কেমিস্ট্রির মাজহার স্যারকে ক্লাসের সব চাইতে বদ স্টুডেন্টটারও ভালো লাগতো ! স্যারের ছোট একটা ছেলে ছিলো , যার খুনসুটি নিয়ে স্যার প্রায়ই ক্লাসে কথা বলতেন  , হাসতেন  আর আমরা মুগ্ধ  চোখে  রসায়নবিদ এক বাবার তাকিয়ে থাকতাম !

সর্বডানের স্নস্রুমন্ডিত স্ফীত হাস্যময় আব্দুল হালিম স্যারকে সেকেন্ড ইয়ারে প্রথম কিছুদিন ক্লাসে পাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিলো । কাউকে ধমক দেয়া তো দূরের কথা , কখনও ক্লাসে উনাকে জোরে কথা পর্যন্ত বলতে শুনিনাই । কি অদ্ভুত ক্ষমতা স্যারের ছিলো , জানিনা ! তবে সেই অজানা ক্ষমতা বলেই ক্লাসের পুরো সময়টুকু প্রত্যেকটা ছাত্র জুলুজুলু চোখে উনার দিকে তাকিয়ে থাকতো । ক্লাস শেষে শোনাতেন স্বরচিত কবিতা আর শের ! স্যারের প্রেমের কবিতাগুলা কি ভালোই না লাগতো তখন !  :brokenheart:

মনে পড়ে ফিজিক্সের হেড আফরোজা ম্যাডাম এবং বায়োলজি ল্যাবের নাসিমা ম্যাডামের কথা । কি মমতা নিয়েই না পড়াতেন আমাদের! সাধারণত আমাদের কেউ কোন অপরাধ করলে সবাই মিলে সেটাকে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করতাম। কিন্তু নাসিমা ম্যাডামের এক ক্লাসে কলার খোসা ছোড়া নয়ে তাঁর কষ্ট পাওয়া দেখে গোটা সেকশন হাতেনাতে এই আকাম করা ছ্যাচ্চরটাকে ধরিয়ে দিয়ে প্রমান করেছিলো, ম্যাডামের জন্যে তাদের অনুভুতি কতটা তীব্র !

মর্নিং শিফটের মেয়েদের কাছে বিশেষ জনপ্রিয়তা থাকায় কেমিস্ট্রির  হ্যান্ডসাম  ব্যাচেলর  কামাল হোসেন স্যারকে  ডে শিফটের অনেকেই হিংসা করতো ! তবে Cool ব্রেনে Cool ক্লাসে Hot কেমিস্ট্রি পড়ানোতে স্যারের অসামান্য দক্ষতার জন্যে সবাই -ই স্যারকে অসম্ভব পছন্দ করতো !

কলেজের সেই সোনালী দিনগুলো অদ্ভুত অতৃপ্ততা নিয়ে স্মৃতির পাতায় স্থান করে নিয়েছে বহু আগেই । চলে গেছেন হাফিজ  স্যার। রেজা স্যার, হালিম স্যারের মতো অনেক পুরোনো শিক্ষকই এখন আর কলেজে নাই । একটার জায়গায় এখন দুইটা বিল্ডিং নিয়ে ঢাকা সিটি কলেজ ধানমন্ডি ২ নাম্বারের ঠিক মাথাতেই  দাড়িয়ে আছে । কলেজের আইডির রিবন ব্লুর বদলে কিছুকাল বিদঘুটে  ফ্যাকাশে কমলা করার পর আবার আগের রঙ্গেই ফেরানো হয়েছে । ধানমন্ডি লেকের পাড়ে ভরদুপুরে এখনো ক্লাস  বাঙ্ক দেয়া পোলাপান আড্ডা দেখি , দেখি বিকেল-সন্ধ্যায় আড়ালে আবডালে “সাদা-কালো” আর “সাদা-সাদা”র ভালোবাসা !

সবই আগের  মতোই চলে , শুধু আমরাই  হারিয়ে গেছি । মহাকালের স্বাক্ষী হয়ে রয়ে গেছে ঢাকা সিটি কলেজ।

স্কুল থেকে ভার্সিটির এই সময়পর্যন্ত শিক্ষক হিসাবে শ্রদ্ধা করতে পারা মানুষের সংখ্যা নেহাতই কম ।উপরের মানুষগুলো সেই হাতে গোনা মানুষদেরই ক’জন! মাঝে মাঝে খুব জানতে ইচ্ছা করে, আমরা যখন স্যার-ম্যাডামদের চোখের সামনে ছিলাম , তখন কি তাঁরা বুঝতে পারতেন, উনাদের জন্যে কি অসম্ভব শ্রদ্ধা মিশ্রিত ভালোবাসা আমরা অনুভব করতাম ?

মানুষ গড়ার এই কারিগরদের জন্যে জন্যে হৃদয় দিয়ে অনুভব করা ভালোবাসা আর শ্রদ্ধাটুকু আমাদের অনেকেই হয়তো সারা জীবন বয়ে বেড়াবো …।

সুহৃদ সম্পর্কে

সবার কথা শুনি আমি , আমার শ্রোতা নাই ... ।।
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে স্মৃতিচারণ-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

6 Responses to শ্রদ্ধাস্পদ

  1. ফিনিক্স বলেছেনঃ

    মনটা এত অস্থির ছিল!
    এর মাঝে এত অসম্ভব সুন্দর পোটটা পড়ে বেশ শান্ত হয়ে গেল।
    কলেজ-স্কুলের দিনগুলোর কথা মনে পড়ছে ভীষণ!
    আরো বেশি মনে পড়ছে সেই শ্রদ্ধার জায়গায় আসীন মানুষগুলোর কথা।

    “মানুষ গড়ার এই কারিগরদের জন্যে হৃদয় দিয়ে অনুভব করা ভালোবাসা আর শ্রদ্ধাটুকু আমাদের অনেকেই হয়তো সারা জীবন বয়ে বেড়াবো …।” :huzur:

  2. গোফরান বলেছেনঃ

    কি লিখব ভেবে পাচ্ছিলাম না , ………………… অনেক কিছু মনে করাই দিলি রেহ, 🙁 এক ঝলকে অনেক কিছু মনে পড়ে গেল …… যদিও অনেকেই বলত এটা একটা মুরগির খোপ… তারপরেও আসলেই দারুন ছিল সিটি কলেজের দিন গুলা !! 🙂

  3. শারমিন বলেছেনঃ

    পড়ে অনেক ভালো লাগলো 😀
    মানুষ গড়ার এই কারিগরদের জন্যে জন্যে হৃদয় দিয়ে অনুভব করা ভালোবাসা আর শ্রদ্ধাটুকু আমাদের অনেকেই হয়তো সারা জীবন বয়ে বেড়াবো
    আসলেই বয়ে বেড়াবো
    কিছু কিছু স্যার-ম্যাডামদের কখনই ভুলতে পারবো না

  4. অনাবিল বলেছেনঃ

    পড়তে পড়তে অনেক ভালো লাগছিল……
    স্কুল-কলেজে এমন অনেক অনেক টিচার পেয়েছি যাঁরা পড়াশোনার চেয়েও মূল্যবান অনেক কিছু শিখিয়েছেন……ভাবলেই অনেক ভালোলাগা কাজ করে……

    কিছুদিন আগেই ঢাকা কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে গল্প শুনছিলাম এই কলেজের…… 🙂

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।