“আমি ও আমরা” ভালো আছি কি?

প্রেক্ষাপট ১:

প্রায় এক বছর আগের সেই দিনটার কথা আজও ভুলতে পারি না। ভুলতে না পারার একমাত্র কারণ একটা প্রশ্ন, মিষ্টি একটা কণ্ঠে একরাশ অভিমান জড়ানো একটাই প্রশ্ন-

“তবে কি হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীদের কষ্ট বুঝবার জন্য অন্যদেরও হুইলচেয়ার ব্যবহার করতে হোক, এই অভিশাপ দেব?”

মেয়েটার নাম ছিল সুমাইয়া, একাদশ শ্রেণিতে পড়তো তখন। ছোট্ট মেয়েটার কণ্ঠে উচ্চারিত এক বছর আগের সেই প্রশ্নটা আজও আমাকে ভীষণভাবে দুমড়ে মুচড়ে ফেলে! অভিশাপ- কত নিষ্ঠুর একটা শব্দ! এত নিষ্ঠুর শব্দ একটা মানুষ কখন অবলীলায় উচ্চারণ করতে পারে? কতটা কষ্ট হলে? আমি মাঝে মাঝেই ভাবি। কিন্তু সত্যিকার অর্থে, সেই কষ্টের গভীরতা পরিমাপ করার সামর্থ কিংবা যোগ্যতা কোনটাই আমার নেই। নেই তার কারণ হলো, আমি-আমরা চাইলেই স্বাধীনভাবে এখানে-সেখানে যেমন ইচ্ছে ঘুরে বেড়াতে পারি, কিন্তু ঐ হুইলচেয়ারে বসে থাকা মানুষগুলো জানালা গলে এক মুঠো আকাশের সন্ধানও পান না। দিনের পর দিন তারা ঘরে বন্দী হয়ে থাকতে থাকতে হয়তোবা জোর করেই ভুলতে বসেন আলো গায়ে মাখবার অধিকার তাদেরও আছে। জোর করে ভুলতে গিয়েই হয়তো এত কষ্ট হয়, বুকের ভেতর জমে থাকা এত এত অভিমান গুমড়ে ওঠে।

আমি  জানি না, এই এক বছরে সেই মেয়েটার ছোট্ট বুকটায় জমে থাকা কষ্টগুলো আজ এতটুকুও কমেছে কিনা। জানি না, কেন বারবার সেই অভিমানী কণ্ঠটা আমার কানে বেজে উঠে বেয়াড়া চোখ দুটোকে কেবলই বেসামাল করে দিয়ে যায়।

প্রেক্ষাপট ২:

এক মায়ের কষ্টের কথা শুনছিলাম টেলিভিশনের পর্দায়। শুনছিলাম আর কেঁপে কেঁপে উঠছিলাম।

ভদ্রমহিলা তার ছোট্ট মেয়েটাকে নিয়ে বাসে উঠেছিলেন বেশ ঠেলাঠেলি, ধাক্কাধাক্কি করে। সিএনজি বা রিকশা ভাড়া করে রোজ যাতায়াত করবার সামর্থ তার নেই। অনেক কষ্ট করে মেয়েকে নিয়ে বাসে ওঠার পর কোনরকম দাঁড়াবার জায়গা পেয়ে দাঁড়িয়ে যেতেই মেয়েটা ঝুপ করে বসে পড়লো পাশের সিটে বসে থাকা আরেক ভদ্রমহিলার কোলে। এমন অভদ্রভাবে বসে পড়ায় ভীষণ বিরক্ত হয়ে তিনি সাথে সাথেই সেই বাচ্চা মেয়েটাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলেন কোলের উপর থেকে। মেয়েটার মা মেয়েটাকে আঁকড়ে ধরে সেই ভদ্রমহিলার কাছে অবুঝ বাচ্চাটার আচরণের জন্য ক্ষমা চেয়ে নিলেন। কিন্তু ক্ষমা বস্তুটা কি আর অতই সস্তা যে যাকে-তাকে অবাধে দিয়ে বেড়ানো যায়? তাই ক্ষমার বদলে তার কণ্ঠ থেকে ফুটলো বিরক্তি আর অবজ্ঞার স্বর,

“কোথা থেকে যে এইসব পাগল-ছাগল নিয়ে এরা বাসে ওঠে। রাস্তাতেই চলতে পারে না, আবার পাগল-ছাগল নিয়ে বাসে ওঠার শখ!”

বলতে বলতে মেয়েটির মা চোখের জল ধরে রাখতে পারলেন না, টপটপ করে ঝরে পড়তে লাগলো ফোঁটায় ফোঁটায়। আমি তাকিয়ে দেখলাম মেয়েটিকে- কী ফুটফুটে চেহারা, বছর পাঁচ-সাতেক হবে হয়তো। চোখ-নাক-মুখ আমাদেরই মত, তবু সে আমাদের একজন নয়! কারণ সে বিকল্পভাবে সক্ষম মানুষদের একজন।

প্রেক্ষাপট দ্রুত শেষ করছি, কারণ আমার চোখ দুটো আবার অকারণেই বেয়াড়া হয়ে উঠছে যে!

মিছেমিছি-সত্যিসত্যি:

মিছেমিছি ধরি, আগামীকাল আপনি বা আমি কোন একটা সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হলাম, অথবা, দেশের এই ভয়াবহ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সহিংসতার রোষানলে পড়লাম। আর তারপর নিয়তির খেলায় আমরা হয়তো কেউ পঙ্গু হয়ে গেলাম, শারীরিক প্রতিবন্ধিত্বকে বরণ করে নিলাম। কিন্তু আমাদের স্বপ্ন কি তখন থেমে যাবে? অথবা আমাদের পরিবারের মানুষগুলোর স্বপ্ন কি আমাদের সাথে সাথে পঙ্গু হয়ে যাবে? নাকি আমরা চেষ্টা করবো উঠে দাঁড়াতে? পড়াশোনা-ক্যারিয়ার-স্বপ্ন দেখা আবার নতুন করে শুরু করতে? হয়তো হাজার পাঁচেক টাকা খরচ করে কিনেই ফেললাম একটা হুইল চেয়ার, কিন্তু তারপর যখন মুখোমুখি হবো ঐ সত্যের তখন?

মিছেমিছিটাকে আমরা ধরে নিয়েছি কিন্তু সত্যিসত্যিটাকে ধরে নেবার কিছু নেই। সত্যিসত্যিটা হলো, তারপর যখন আমরা হুইল চেয়ার নিয়ে রাস্তায় বের হব, তখন দেখব চেনা এই পৃথিবীতে আমাদের চলতে দেয়ার কেউ নেই। গতকালের সেই সুস্থ আমিকে যারা চলে ফিরবার জন্য পথ ছেড়ে দিত, আজ তারা কেউ ফিরেও তাকাচ্ছে না! হাঁটতে তো পারছি না, এতটা পথ পাড়ি দিয়ে হাঁটবার শক্তি নিয়তি কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু আমাদের স্বপ্ন পূরণে থেমে থাকলে তো চলবে না। তবে কি রিকশায়-সিএনজিতে উঠে পড়ব? কীভাবে উঠব? আচ্ছা বুঝলাম কষ্ট হবে। উঠলামও না হয় খানিক কষ্ট করেই দু’এক দিন। কিন্তু রোজ কি সম্ভব? যদি উচ্চবিত্ত পরিবারের কেউ না হই আমি? স্বপ্ন তো তাই বলে থমকে থাকবে না। আর গরিবের স্বপ্ন পূরণের উপায় তো একটাই- বাস! কিন্তু বাস তো আমার মত মানুষের জন্য দুটো সেকেন্ডও বেশি দাঁড়াবে না। হুইল চেয়ার সমেত বাসে উঠবারই বা উপায় কী? অথবা কোনরমে উঠবার পর বসার জায়গাটাই বা কে দিচ্ছে আমাকে? কেউ তো যেচেপড়ে নিজের সিট ছেড়ে দেবে না, দেয় না সাধারণত। হুইল চেয়ারটাই ভরসা। কিন্তু নিজেই দাঁড়াতে পারি না তো চেয়ারটাই বা রাখব কোথায়? তাতে বসতে পারা তো আরো দূরের ব্যাপার। কতদিন টানা এমনি করে যুদ্ধ করে যেতে পারব একা একা? দু’দিন? দু’মাস? দুই বছর? দশ বছর? দ-অ-অ-শ বছর অর্থাৎ ৩৬৫x১০=৩,৬৫০ দি-ই-ই-ই-ন! স্বপ্নেরা ততদিন আমারই মত অসাড় হয়ে পড়বে না তো? কে বলতে পারে!

সত্যিসত্যির ছবি আঁকি:

প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, অনেককে দেখতে পাই দেশে কাজ করবার মত কাজ খুঁজে পান না, চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতায় ডুবে যেতে যেতে হঠাৎ একদিন অনুভব করেন, নিজের পড়াশোনা আর মেধাকে কাজে লাগিয়ে দেশের জন্য তেমন ইউনিক কিছুই তো করা হয়ে উঠল না! আমার সেই পরিচিত-অপরিচিত বন্ধুদের কাছে আজ তাদের মেধার প্রতি সম্মান জানিয়ে কাজে নেমে পড়তে অনুরোধ জানালে তারা এগিয়ে আসবেন তো? আমার বিশ্বাস, তারা অবশ্যই এগিয়ে আসবেন। শুধু প্রকৌশলী বা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই নন, চাইলে যে কেউ তার মেধা আর আইডিয়াকে কাজে লাগাতে পারেন, এমন সুযোগ এদেশে এসেছে এবার। সেই যে মিছেমিছি-সত্যিসত্যির গল্পটা বলছিলাম একটু আগেই, সেই গল্পের সত্যিসত্যিটার একটা নতুন ছবি আঁকতে হবে যে এবারে!

নতুন করে ছবি আঁকতে পারার এই অসাধারণ সুযোগটার কথা প্রথম শুনেছিলাম বি-স্ক্যানের সাবরিনা আপুর মুখে। আপু হঠাৎ দিন দুয়েক আগে ফেসবুকে ম্যাসেজ পাঠিয়ে জানালেন তার এই স্বপ্ন পূরণের কথা। আপুর অ-নে-ক অ-নে-ক দিনের স্বপ্ন বাংলাদেশে র‍্যাম্পযুক্ত বাস সার্ভিস চালু হবে। বিকল্পভাবে সক্ষম প্রতিটা মানুষ সেই বাসে চড়ে তাদের স্বপ্ন পূরণের পথে একটু একটু করে এগিয়ে যাবেন গন্তব্যের দিকে। আর তাই  “ইউনিভার্সাল অ্যাক্সেসিবিলিটি ইন পাবলিক ট্রান্সপোর্ট” বিষয়টিকে সামনে রেখে বাংলাদেশি সিস্টেমস চেঞ্জ এ্যাডভোকেসি নেটওয়ার্ক (বি-স্ক্যান) ও ইঞ্জিনিয়ারিং স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ (এসাব) যৌথভাবে এবছর উদ্যোগ নিয়েছে আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ডিজাইন কন্টেস্টের!

না, বিকল্পভাবে সক্ষম মানুষেরা দেশের উঁচু-নিচু রাস্তায় শরীরের সমস্ত শক্তি নিঃশেষিত করে চলতে চান না কোন ‘সেলফ ড্রাইভিং রিকশা’য়। তারা চলতে চান স্বাভাবিক মানুষদের মত তাদেরই সাথে। স্বপ্ন দেখতে চান ঐ মানুষদেরই মত করে, স্বপ্নের পথে তাই ছুটেও চলতে চান একই রকম দুর্বার গতিতে! সত্যিসত্যির নতুন ছবিটা তাই শুরু হবে র‍্যাম্পযুক্ত একটা বাসের ডিজাইন তৈরি করার মধ্য দিয়ে। ভয় পাবার কোন কারণই নেই, পুরো বাসের চিত্রটাকে ডিজাইন করতে হবে না কাউকে। কেবল আমাদের দেশের রাস্তার কথা মাথায় রেখে ডিজাইনে রাস্তা থেকে বাসে হুইল চেয়ার নিয়ে উঠবার পথ তৈরি করতে হবে আর হুইল চেয়ারটা নিয়ে বাসের ভেতরে বসার জন্য একটা জায়গা রাখতে হবে। কত ছোট্ট আর সহজ একটা কাজ, তাই না? অথচ এই কাজটাই আমাদের দেশে এতদিন ধরে কেউ করছিল না, হয়তো সুযোগ খুঁজেছিল কেউ কিন্তু করা আর হয়ে ওঠে নি।

ডিজাইন তৈরি করার সুবিধার্থে অংশগ্রহণে ইচ্ছুক বন্ধুদের জন্য ছোট্ট একটা নির্দেশিকা দিয়েছে এসাব। সরাসরি সেটি এখানে তুলে দিলাম-

MIDDLE DOOR:
width of the door (middle) 92cm
clearance from ground 37cm
rise of first step 27 cm
rise of 2nd step 24 cm
height of door 200cm

2 seat adjacent to the door ( 82cm along the length of the bus /75 cm along the width of the bus)

2 seat regular (82/66) in cm
3 seat (115/66) in cm

প্রতিযোগিতা ও রেজিস্ট্রেশনের সময়সীমা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে ফেসবুক ইভেন্ট পেইজওয়েবসাইটটিতে দৃষ্টি রাখার জন্য অনুরোধ রইলো।

যা থাকছে বিজয়ীর জন্য:

এই প্রতিযোগিতায় বিজয়ী দলকে ৪০,০০০ টাকা ও দ্বিতীয় বিজয়ী দলকে ৩০,০০০ টাকা নগদ পুরস্কার এবং গ্রুপ স্টেজ রাউন্ড উত্তীর্ণ সকলকে সনদপত্র ও ক্রেস্ট প্রদান করা হবে।

তবে আমি নিশ্চিত, স্বপ্ন পূরণের পথে যে বন্ধুরা বিকল্পভাবে সক্ষম মানুষের পাশে হাঁটতে চান, তারা কেউই পুরস্কারের লোভে এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেবেন না। নেবেন হৃদয়ের টানে, ভালোবাসার টানে, বন্ধুত্বের আহবানে। 

শেষ কথা:

কেউ যখন আমাকে জিজ্ঞেস করেন, “কেমন আছ”, তখন নিজের অজান্তে অভ্যাসবশত সহজ উত্তরটাই মুখে চলে আসে, “আমি ভালো আছি”! অথচ পরক্ষণেই মনে হয়, মানুষ হিসেবে আমার উত্তরটা কি সত্যিই এমন হবার কথা? কেবল একা ভালো থাকাটা কখনোই আমার মানবিক গুণাবলীর ভেতরে পড়ে কি?

আমি মাঝে মাঝেই ভাবি, যদি কখনো প্রশ্নটার উত্তরে সত্যি সত্যি বলতে পারতাম, “আমরা সবাই ভালো আছি”; আমরা- মানুষেরা, সক্ষম-অক্ষম প্রভেদহীন মানুষেরা যদি সবাই মিলে ভালো থাকতে পারতাম, কেবল তবেই মনের মাঝে সত্যিকার শান্তিটা অনুভব করতাম, শুধুমাত্র সেই মুহূর্তে সত্যিকার অর্থেই আমি খুব ভালো থাকতাম।

মুখোশের আড়ালে ‘ভালো আছি’র অভিনয় নয়, আমি সত্য সত্যি একদিন চিৎকার করে বলতে চাই-

“আমি খুব ভালো আছি, আমরা সবাই আজ খুব খুব ভালো আছি!”

ফিনিক্স সম্পর্কে

"প্রিয় পতাকার লাগি // জটায়ুর মত রক্ত ঝরাতে // আমিও প্রহর জাগি..." https://www.facebook.com/phoenix.chhanda
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে ইতিবাচক, উদ্যোগ, সচেতনতা-এ এবং ট্যাগ হয়েছে , , , , স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

6 Responses to “আমি ও আমরা” ভালো আছি কি?

  1. বোহেমিয়ান বলেছেনঃ

    আমাদের তরুণরা প্রকৌশল বিদ্যা পড়ে কেবলমাত্র টাকা/ উন্নত জীবনের জন্য। এই উদ্যোগ পুরাই ব্যতিক্রম।
    নিজেদের সমস্যা নিজেদের প্রযুক্তিতে

    দারুণ কাজ।
    আশা করি অনেক ভালো কিছু বের হবে।

    লেখাটিও খুব ভালো লেগেছে।

  2. স্রোতস্বিনী বলেছেনঃ

    ইনশাল্লাহ আজ হোক, বা কাল হোক কিংবা পরশু… কিন্তু খুব শীঘ্রই আমরা বলবো, ““আমরা সবাই ভালো আছি, খুব খুব ভালো আছি”

  3. হাসান বলেছেনঃ

    Sorry to myself, jehetu ato guruttopurno akta lekha porte ato late korlam.

    Jader kotha bollen tader jonno dukkho prokash korteo lozza lage nijer kase. Amar ki hoto oi jaygatay thakle seta vablei oder kosto kisuta onuvob kora jay…..

    Ami tader sathe share kore dilam, who can really do something.
    Please everyone do the same…

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।