প্রায় চারটা সপ্তাহ চলে গেল, আমি একটা বারের জন্যেও নতুন একটা ওয়ার্ড ডকুমেন্ট ফাইল খুলি নি। এই চার সপ্তাহে আমি কিছুই লিখি নি, এমনকি একটা আধ-খেঁচড়া লেখাও না! এটা সম্ভবত গত প্রায় দুই বছরে রেকর্ড! এর আগে গত প্রায় দেড় বছরে মনে হয় হাইয়েস্ট ৯ দিন না লিখে ছিলাম, আম্মুর অ্যাকসিডেন্টের সময় হাসপাতালে ছিলাম বলে। লিখতে বসার বিন্দু পরিমাণ ইচ্ছেও আমার ছিল না! কিন্তু হায়, অভাগা যেথায় চায়, জল সেখানে শুকিয়ে যে যেতেই হবে!
আমি ছোট মানুষ, স্মৃতির ডাইরিটা বড্ড ছোট, সেই ছোট্ট ডাইরি থেকেই ক’টা কথা বলি-
আমি তখন অনেক ছোট, স্কুলেও ভর্তি হই নি মনে হয়। আমার মামার মেয়ে হয়েছে খবর পেয়ে তাদের বাসায় গিয়েছি। সেখানে গিয়ে চোখে পড়ল মামার স্টেথোস্কোপ আর স্পিগ্নোমেনোমিটার। সেখানে আমার সাইজের আর কেউ ছিল না, একা একাই ওগুলো নিয়ে দুষ্টুমি করছিলাম। মামা কাছে আসতেই তার বুকে স্টেথোস্কোপ ধরে বলেছিলাম, “দেখি তো কেমন ধিব ধিব করে?”
মামা হেসে ফেলেছিলেন, বলেছিলেন, “তুই একদিন অনেক বড় ডাক্তার হবি!”
শুনে আম্মুও আমার মাথায় হাত বুলিয়ে মামাকে বলেছিলেন তাঁর দোয়া যেন সত্যি হয়…
সেদিন থেকে তাদের স্বপ্নে আমিও আমার ছোট্ট মনের কোণে স্বপ্ন বুনি, আমি একদিন নামকরা একজন ডাক্তার হব!
ছেলেবেলায় আমি খুব দুষ্টু ছিলাম, এখনও হয়ত আছি। আর এক্ষেত্রে আমার সবচেয়ে বেশী প্রিয় ছিল স্ক্রুডাইভার, টেস্টার, ভাঙ্গা সুইচ, রঙের কৌটা, ম্যাচ… আমার কোন খেলনাই ১/২ দিনের বেশী আস্তো থাকতো না। আর দু’তিনটা খেলনা একসাথে থাকলে একটার সাথে আরেকটা জোড়া লাগিয়ে নতুন একটা খেলনা বানানো যায় কিনা, সেটা ছিল আমার খুবই প্রিয় একটা কাজ! একবার আব্বুর অনেক দামী দুই মাথাওয়ালা একটা টর্চ লাইট ভেঙ্গে ফেলেছিলাম। লাইটটা কোনভাবেই কাজ করছিল না। আব্বু সেদিন আমাকে অনেক বকেছিলেন। লাইটটা ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দেয়া হয়েছিল। আমি সেটা তুলে এনে একটু গুঁতাগুঁতি করতে করতে হঠাৎ দেখি একটা লাইট কাজ করছে!!
পরে সেটা আব্বুকে দেখাতে আব্বু বলেছিলেন, “আমি দোয়া করি বাবা, তুই একদিন ইঞ্জিনিয়ার হবি! আমার চেয়ে অনেক বড় ইঞ্জিনিয়ার হবি!”
সেদিন থেকে আমিও আব্বুর স্বপ্নালু চোখে চেয়ে অনেক বড় একজন ইঞ্জিনিয়ার হবার স্বপ্ন বুনি!
একবার আমার খুব অসুখ করেছিল। ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড আর ডেঙ্গু- এই তিন রথী জোট বেঁধে আমাকে চেপে ধরেছিল। হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল অনেক দিন। প্রায় ১২ কেজি ওজন খুইয়ে অল্প ক’দিনের মাঝেই ভরের মাপকাঠিতে এক অঙ্কের ঘরে নেমে এসেছিলাম। এরপর বাসায় এলেও ডাক্তার বলে দিয়েছিলেন বেড রেস্টের কথা। আমার সারাদিন কাটতো কার্টুন নেটওয়ার্ক দেখে। এরপর সন্ধ্যায় আব্বু এলে তার সাথে বসে রবোকাপ দেখতাম। রবোকাপ ছিল আমার মারাত্মক এক বিস্ময়ের বিষয়! রবোকাপ একটার পর একটা গুলি খাচ্ছে তো খাচ্ছেই, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঐ জিতে যায় সবকিছুতে!! এসব দেখে আমি অবাক হতাম আর আব্বুকে জিজ্ঞেস করতাম, রবোকাপ কী। আব্বু বলতেন, “রবোকাপ হল একটা রবোট!” আমি আবার প্রশ্ন করতাম, রোবট কী, রোবট কীভাবে বানায়, রোবট কী খায়! ক;দিন পরই আমাকে একটা খেলনা রোবট কিনে দেয়া হয়! সেই রোবটের ব্যবচ্ছেদ করে আমি দেখলাম, ভেতরে আছে কেবল ক’টা তার, ম্যাগ্নেট আর সবুজ রঙের একটা পাতলা বোর্ডের মত কী যেন! দেখে ভেবেছিলাম, এ আর এমন কী?
একটা রোবট আমিও বানাবো! আমি তখন থেকেই স্বপ্ন দেখি, একদিন রবোটিক ইঞ্জিনিয়ার হব বলে!
তখন বোধ হয় ক্লাস থ্রিতে পড়ি। একদিন বোতলে ইস্ট পাউডার আর বেকিং পাউডার মিশিয়ে ঝাঁকি দিতেই ঠাশ করে বোতল ফেটে ফেনা বের হয়ে গিয়েছিল। চাচা জিজ্ঞেস করেছিলেন, “কী হইছে?” আমি বলেছিলাম, “কাকা, আমি বোমা বানানো শিখে ফেলছি!”
কাকার হাসি আর থামেই না! পরে বলেছিলেন, “তুমি বিজ্ঞানী হইবা! বিমান বানাইয়া আকাশে উড়বা!”
চাচার স্বপ্নে সেদিন আমিও যেন চোখ বুজে দেখতে পেয়েছিলাম, আমি অনেক বড় এক বিজ্ঞানী হয়ে গেছি!
এরকম হাজারো স্বপ্ন বুকে নিয়ে একটু একটু করে আমি বড় হতে থাকি। প্রাইমারী, জুনিয়র, মাধ্যমিক পার করে এখন উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিচ্ছি। দুরু দুরু বুকে পরীক্ষার কথা ভাবি, মনে মনে নিজেকে সাহস দেই – “কিপ ইউরসেলফ কা’ম! ইউ’ল ডু ইট! ইউ’ভ টু ডু ইট!!” স্রষ্টার দরবারে প্রার্থনা জানাই, যেন সবার স্বপ্নের সম্মান দিতে পারি। আম্মু, মামা, আপুদের স্বপ্নগুলোকে যেন আমি আমার সালাম জানাতে পারি! আব্বুর স্বপ্ন পূরণ করে যেন তাঁকে দু’দণ্ড শান্তির বারতা পাঠাতে পারি…
কিন্তু…
আমার ভাগ্য! আমি এমন এক দেশে জন্মেছি, যে দেশ প্রতি মুহূর্তে মুহূর্তে সোনার ডিম প্রসব করে! আর সেই ডিম ভক্ষণ করে কয়েকটা হিংস্র রাক্ষস! যাদের রক্ত পানি করা শ্রমে সেই ডিম তৈরী হয়, তারা তা চোখেও দেখে না! বরঞ্চ তাদের সাথে চলে নির্মম প্রহসন, অত্যাচার, নির্যাতন! জীবন যেন সেই সব রাক্ষসদের ছেলের হাতের খেলনা! ইচ্ছে হল, ভেঙ্গে ফেল! নতুন আরও খেলনা তো আসবেই!! একটা সময়ে এসে মানুষগুলো সেই ডিমের সব আশা ছেড়ে দেয়! রক্তের বিনিময়ে চায় শুধু একটুখানি শান্তি, সন্তানের মুখে এক চিলতে হাসি, স্ত্রীর হাতের একটুখানি ভালবাসার ছোঁয়া, মায়ের হাতের একটুখানি আদর…
হায়… রাক্ষসগুলোর এত খেয়েও পেট ভরে না! সোনার ডিম প্রসবকারী হাঁসটাকে খুন করে ঝোল রেঁধে খেলেই যেন তাদের পরম তৃপ্তি!
সোনার ডিম পাড়া হাঁসটাকে বধ করতে তাদের কতই না ফন্দী, ফাঁদ…
আর সেই ফাঁদে পড়ে আমার স্বপ্নগুলোর অকাল মৃত্যু হয়! একটা একটা স্বপ্ন ভাঙ্গে, একটা একটা সম্ভাবনা নষ্ট হয়, একটা একটা হৃৎস্পন্দন স্তম্ভিত হয়ে যায়!!
তোমার সোনার হাঁসের ভাগ আমি চাই না, চাই না তার সোনালী ফসল এক নজর দেখতে!!
আমাকে আমার মত থাকতে দাও, আমি নিজেকে নিজের মত গুছিয়ে নেব!! তোমার আহার্যের দিকে আমার কোন লোভ নেই, কোন আগ্রহ নেই!! আমার স্বপ্নগুলোকে এভাবে খুন করো না!! দোহাই লাগে, আমাকে আমার স্বপ্নের হাতছানির দিকে এগুতে দাও… আমার স্বপ্নগুলোকে নিয়ে আমাকে বাঁচতে দাও!! আমাকে আমার মত চলতে দাও! আমাকে আমার স্বপ্ন পথের পরীক্ষায় অংশ নিতে দাও!! হাতজোড় করে মিনতি করছি, আমাকে আমার মত করে পরীক্ষা দিতে দাও!!
আমি তোমার কাছে চির কৃতজ্ঞ থাকবো!
যদি নাই দিবে, তবে এভাবে তিলে তিলে হত্যা না করে একবারে মেরে ফেল! হত্যা কর আমাকে!!
প্রিয় রাক্ষস, একটাবার কী ভেবে দেখেছ, যে হাঁসের ঝোল খেতে চাইছ, তার মৃত্যু হলে পরদিন যে না খেয়ে তোমাকেও মরতে হবে?? হতেও পারে, আমিই একদিন এক নতুন হাঁসের জন্ম দেব! কিন্তু তার একটা পালকের ছোঁয়াও তুমি পাবে না! তোমাকে আমি কোনদিন ক্ষমা করবা না!!
তুমি কি বুঝতে পারছ, কী ভয়ংকর একটা ঘৃণাবোধ তোমার বিরুদ্ধে আমার মাঝে জন্ম নিচ্ছে?? তুমি কি কোনভাবেই পারবে একে দমিয়ে রাখতে?? না, তুমি পারবে না। এখনো বলছি, সময় আছে, ফিরে এসো! ফিরে এসো!!
করজোড়ে মিনতি করি, শুদ্ধ হও! অন্তত আমাকে আমার স্বপ্ন দেখতে দাও!! আমাকে আমার মত আমার স্বপ্ন পথের দিশার খোঁজ করতে দাও! আমাকে আমার মত করে আমার ঠিকানা খুঁজে নিতে দাও!! …
ধ্যাত!! কী করতে কী! ভেবেছিলাম একটা ব্লগ পোস্ট লিখব! হয়ে গেল কী!
এডিট করতে ইচ্ছে করছে না! আর করেই কী লাভ! আমার এই মূল্যহীন কথায় কার কী আসে যায়!! আমি কে?? আমার গায়ে তো কোন ট্যাগ দেয়া নেই! থাক, ফেইসবুকে একটা সামান্য স্ট্যাটাস হিসেবেই দিয়ে নাহয় দিই… 🙁
ভালো লাগলো।
রাক্ষসদের সুমতি হোক।
সামিরা আপু, ‘রামের সুমতি’ সম্ভব কিন্তু এই
রাক্ষসদের সুমতি?????? 🙁
তবুও আশায় বাধি বুক,
কেটে যাবে এই ঘোর অমানিশা
মুছে যাবে সব দুখ। 😀
তবু আশা বেঁধে রাখি,
তবু দ্বীপ জ্বেলে রাখি…
তার আগে আমার দ্বীপ নিভে না গেলেই হয় :voypaisi:
থ্যাঙ্কস, আপু… 🙂
সুমতি হবে কিনা জানি না।
তবে আমাদের গ্রামের বাড়ীর ওদিকে লোকমুখে একটা কথা শুনি – “গাধা ফানি খায়, তয় ঘুইল্যা কইরা খায়।”
এমনটা মোটেও চাই না। সুন্দর সুমতিই কামনা করি।
ভালো লেগেছে অনুজ 😀
কাল পরীক্ষা না থাকলে বিশাল একখান কমেন্ট লিখতাম 🙁
আমার ছেলেবেলা কেটেছে পালাক্রমে দাদু আর নানুবাড়িতে থেকে।
আমিও কম ডানপিটে ছিলাম না! 😛
উপরের দিককার অংশগুলো পরে অনেক কিছুই মনে পরে গেল 🙂
আমি স্যান্ডউইচের যাঁতাকলে পড়ে এই কমেন্টে ধন্যবাদ ( 🙂 ) জানাচ্ছি… … :crying:
ভালো লেগেছে 😀
ছেলেবেলায় আমি ভীষণ দুষ্টু ছিলাম এখনো সেই দুষ্টুই আছি 8)
হুম… ‘দুষ্টু’… 😛
তোমার সাথে আমার অ্যাপয়েন্টমেন্টের কথা ভূলো (!) না যেন…