বাক স্বাধীনতা নিয়ে

কথা বলতে চাই। বাক স্বাধীনতা চাই। বাক স্বাধীনতার স্বীকৃতি, অনুশাসন ও অনুসরণ চাই।

ছোট্ট যে শিশুটি খেলনার জন্য বায়না ধরে বা কিছু খাবেনা বলে মাঝে মাঝে যে অনশন শুরু করে এর মধ্যে এক ধরণের  প্রতিবাদী সত্তার দেখা মেলে। শৈশব আর কৈশোরের বয়স ভেদে যে পার্থক্য আর তার প্রকাশভঙ্গি যে ভিন্নতর সে কথা না বললেও চলবে। এক সময় স্বাভাবিক নিয়মে আমরা সমাজবদ্ধ এক ধরণের সামাজিক সত্ত্বায় পরিনত হই এবং সমাজকে দেখি আপন আলোয়, কিন্তু প্রতি ভিন্ন চিত্রে, অর্থাৎ একজন এক এক রকম করে। হাজার মানুষের হাজার রকমের চিন্তা সেই বাস্তবতার প্রতিফলন। এর মধ্যে গড়ে ওঠে আমাদের রাষ্ট্রিক ও সামাজিক কাঠামো। কিছু প্রথা, ভাঙ্গন, গড়ে ওঠা নতুন- এই সব মিলে নতুনের দিকে আমাদের যাত্রা চলতে থাকে অবিরত।

এই যে আমরা সমাজে চলি, সেই চলাতেই আমরা কিন্তু এক একজন এক এক রকমের স্বার্থ বিনির্মাণ ও প্রবাহ করে চলি। চিন্তার সাযুজ্য বা বিপ্রতীপ অবস্থান অথবা একেবারেই ব্যক্তি বা গোষ্ঠীগত অবস্থান থেকে সে স্বার্থের কাঠামোগত রুপটি আমরা অজান্তে এবং সজ্ঞানে দাঁড় করিয়ে ফেলি। জীবনের এই স্বাভাবিক নিয়ম এর কারনেই সমাজে দ্বন্দ্ব থাকে আবার আনন্দযোগও হয়। কখনও সেই দ্বন্দ্ব সংঘাতে যায় আবার কখনও সেই আনন্দযোগ উৎসবে রঙিন হয়। আমরা যখন অধিকার বা দাবীর কথায় আসি, তখন স্বাভাবিকভাবেই তা সেই দ্বন্দ্বকেই ঘিরে চলে। সেখানেই সমাজ ও রাষ্ট্র তার তার অবস্থান থেকে নাগরিক স্বার্থ সংরক্ষণ করে সামাজিক বা রাষ্ট্রিক স্বার্থ সংরক্ষণেরই জন্য। এই সংরক্ষন পদ্ধতি কখনও নেতিবাচক, অর্থাৎ রাষ্ট্র শোষকের ভুমিকায় অবতীর্ণ হয় এবং ক্ষমতা ও প্রভাবশালীর স্বার্থকেই গণতান্ত্রিক স্বার্থের উপর প্রাধান্য দেয়। আর আধুনিক রাষ্ট্রের ভুমিকা হয় ইতিবাচক, যা  নাগরিক স্বার্থ বা গণতান্ত্রিক স্বার্থ সংরক্ষন করে।

বাক স্বাধীনতার বিষয়টি এখানেই সবচে গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ রাষ্ট্রকে তার নাগরিকের কথা বলার পূর্ণ অধিকার সংরক্ষন করতে হবে, এমনকি তা রাষ্ট্রের বিরোধে গেলেও। এখানেই বাক স্বাধীনতার আসল মর্ম বর্তমান।

প্রশ্ন উঠতে পারে বাক স্বাধীনতার সীমারেখা কতটুকু, আর কতটুকু পর্যন্ত একজন নাগরিক তার অধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন। এই প্রশ্নের একটি পরিচ্ছন্ন অবস্থান বাক স্বাধীনতার জায়গাটি খোলাসা করে দিতে পারে বলে আমরা মনে করি। তবে তার জন্য আমাদেরকে একটু নৃবিজ্ঞানের তত্তের আশ্রয় নিতে হচ্ছে। মোটা দাগে সেই তত্ত্বকথাটা হচ্ছে- সংস্কৃতি সব সময়ই সংস্কৃতি এবং সংস্কৃতির কোন শ্রেণী নেই। অর্থাৎ সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যই আসল কথা। কোন সংস্কৃতি উঁচু দরের আবার কোনটা নিচু জাতের, এই ভেদাভেদ নেই। শহুরে ভদ্রলোকের ঘরের কোনায় রাখা সৌখিন কাচবস্তু তার উন্নত সংস্কৃতির পরিচায়ক আর কৃষকের গোয়ালে ধুলো মাখা লাঙল নিচ জাতের ব্যপার স্যপার- আসল ব্যপারটা এমন নয়। বরং দুটো জিনিষই তার তার অবস্থান থেকে সৌন্দর্য বিকশিত করে। আর তাই স্বাধীনতা ও স্বকীয়তার পরিচায়ক।

উপরের প্রসঙ্গটা টানতে হল বাক স্বাধীনতার স্বকীয়তা প্রসঙ্গে আলোকপাত করার জন্য। যার আসল কথা হল, প্রত্যেকেরই মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে এবং তাই স্বকীয় অবস্থানটি পরিচ্ছন্ন করে। সমাজের চেইন বা শৃঙ্খলে ব্যক্তি যে অবস্থানেই থাকুক না কেন তার মত প্রকাশের স্বাধীনতা সব সময় থাকবে।

গণ মাধ্যমের শিক্ষার্থী মাত্রই জানেন ক্ষমতাশালীরা তাদের ক্ষমতার প্রকাশ করে যার মাধ্যমে সেই ক্ষমতা প্রকাশকের মধ্যেও ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার বিষয়টি অন্তর্নিহিত থাকে। এই বিষয়টি মিশেল ফুকো আরো সহজ করে জ্ঞান/ ক্ষমতা ধারনার মাধ্যমে স্পষ্ট করেছেন। তাই মানুষের অধিকারের কথা বলার সুযোগ দেবার জন্য বিকল্প গণমাধ্যমই এখন রীতিমত উপযুক্ত মাধ্যম হবার প্রতিযোগিতায় বেশ শক্ত অবস্থানে আছে।

এই আলোচনার মাধ্যমে এটাই বলতে চাই মত প্রকাশের বা বাক স্বাধীনতার বিষয়টি প্রত্যেক নাগরিকের থাকবে এবং সেখানে ক্ষমতাধরের ব্যখ্যাই চূড়ান্ত সত্য নয়। রাষ্ট্র তার প্রত্যেক নাগরিকের এই স্বাধীনতা নিশ্চিত করবে এবং সেটাই আধুনিক রাষ্ট্রের পরিচায়ক। ভিন্ন মত থাকবে এবং সেই ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা থাকাই গনতন্ত্র। মুক্ত পৃথিবীতে সবাই কথা বলবে। কারটা সমাজ গ্রহণ করবে সেটি সমাজ গণতান্ত্রিক ভাবেই নির্বাচিত করবে। তাই রাষ্ট্রের দায়িত্ব গনতন্ত্র নিশ্চিত করা। রাষ্ট্র নাগরিকের মত প্রকাশের স্বাধীনতা যেমন নিশ্চিত করবে তেমনি কারো স্বাধীন পছন্দের অধিকারও নিশ্চিত করবে। এখানে কোন ক্ষমতাশালী বা প্রভাবশালী গোষ্ঠীর মতামত যেমন প্রকাশ পাবে, খেয়াল রাখতে হবে যেন ক্ষমতাহীন গরিবের কথাটা  ইথারেই হারিয়ে না যায়।

শেষ করবো মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও অধিকারের সীমারেখার বিষয়টা দিয়ে। এখানে খুব সহজ একটা বিষয় মনে রাখলেই হল যে স্বাধীনতা অনেক বড় দায়িত্ব পালনের আরেক নাম। আর অধিকার থাকলেই তার যত্রতত্র বা স্বেচ্ছাচার ব্যবহারের নাম স্বাধীনতা নয়। অন্যদিকে আমার অধিকার প্রয়োগ যেন আরেক জনের  স্বাধীনতা হরণকারী না হয় সেটি হচ্ছে সমাজের কাছে স্বাধীনতা প্রকাশের আপাত সীমারেখা। এই সীমারেখা যে সমাজ যতটুকু মেনে চলে সেই সমাজের নাগরিকরা তত বেশি স্বাধীনতা উপভোগ করেন। কাজেই মত প্রকাশ ও বাক স্বাধীনতার জন্য সম অধিকারের চর্চায় আমরা বিশ্বাসী থাকবো এবং এক্ষেত্রে অন্যর মতামতকে অবশ্যই শ্রদ্ধা করবো।

——

তোমার মতামতের সাথে আমি একমত নাও হতে পারি, কিন্তু তোমার মতামত প্রকাশের অধিকার রক্ষায় আমি অঙ্গীকারাবদ্ধ।

অন্য স্বর সম্পর্কে

ননরেজিস্টার্ড সদস্যগণও যেন সরবে লিখতে পারেন সেই জন্য এই একাউন্ট। যোগাযোগ পাতায় কিছু লিখে জমা দিলে সরব এর মডারেটরগণ তা মূল্যায়ন করবেন। মনোনীত হলে এই একাউন্ট দিয়ে ছাপা হবে।
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে চিন্তাভাবনা-এ এবং ট্যাগ হয়েছে স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

4 Responses to বাক স্বাধীনতা নিয়ে

  1. বোহেমিয়ান বলেছেনঃ

    ভালো লাগল
    এই প্রসংগে প্রাসঙ্গিক লিঙ্ক
    http://plato.stanford.edu/entries/freedom-speech/
    http://plato.stanford.edu/entries/mill-moral-political/
    http://en.wikipedia.org/wiki/Harm_principle

    এই বিষয়ে আমার নিজেরও কিছু লেখার ইচ্ছে আছে। যদি সম্ভব হয় একটি উপভোগ্য এনলাইটেনিং আলোচনা হোক

  2. মাধবীলতা বলেছেনঃ

    পোস্টটা সময়ের দাবি হিসেবে প্রশংসনীয়। গেল শুক্রবারে ডেইলী স্টার ম্যাগাজিন একটা কভার স্টোরি করেছে এই বিষয়টা নিয়ে, পড়ে দেখতে পারেন।http://www.thedailystar.net/beta2/news/understanding-the-blogosphere/

    স্বাধীনতা মানেই যা ইচ্ছা তাই নয়। আবার সর্বজনীন স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য সহনশীলতা ও পরমতসহিষ্ণুতার ব্যালেন্স প্রয়োজন।

  3. জ্ঞানচোর বলেছেনঃ

    বড় একটা লেখা, খুব কঠিন (না কি সহজ, কিন্তু ইচ্ছা করেই আমরা কঠিন করি?) একটা বিষয়ে লম্বা একটা লেখা। অন্যস্বর থেকে লিখা হওয়ায় লেখককে প্রত্যক্ষ সম্বোধন করতে পারছি না। কিন্তু, ‘কমা’র (,) ব্যবহার আরেকটু বেশী হলে বাক্যগুলো স্বাবলীলতা আরো রক্ষা পেত বলে মনে হয়।

    খুব সার্বজনীন একটা অবস্থান থেকেই বাক স্বাধীনতার আলোচনাটা স্টার্ট হয়েছিল এখানে। কিন্তু, প্রশ্ন ধরে গেল, ক্ষমতাসীন আর তার ক্ষমতায় গেঁড়ে বসার বদ খাসলতের মাঝে এসে। মিশেল ফুঁকোর জ্ঞানের ব্যাখ্যায়, ক্ষমতাধরদের বয়ানই, সব ধরনের জ্ঞানের উৎস কিংবা নীতি নৈতিকতার সীমারেখা বলেছেন। কিন্তু, আবার, সেই প্রতি-জ্ঞানের উৎস কিন্তু আসে একেবারে নতুন ধরনের একটা শ্রেণী থেকে।

    এখন, সেই নতুন ধরনের শ্রেণীকে সুযোগ দিতে কখনোই ক্ষমতাধররা রাজি থাকবেন না। রাষ্ট্রযন্ত্রই যখন ক্ষমতার এই ধারক, তাহলে প্রথমে রাষ্ট্রের কার্যক্রমকে প্রশ্ন করাই তাহলে, এই নৈতিকতার বয়ানকে চ্যালেঞ্জ করার মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়।

    তাহলে কি, রাষ্ট্রদ্রোহী হওয়াই কি বাক স্বাধীনতার সর্বোচ্চ বহি:প্রকাশ নয়?

    তার মানে দাঁড়াচ্ছে, আমরা বাক স্বাধীনতা বলতে গিয়ে, রাষ্ট্রদ্রোহী কোন কার্যকলাপকে ‘ইথারে হারিয়ে যেতে দেব না’ বলতে হবে।
    আমরা আজকে যারা বাক স্বাধীনতার কথা বলি, তারা কি এতটা ছাড় দিতে রাজি থাকি?

    আর নতুবা, বাক স্বাধীনতা ব্যাপারটা মিশেল ফুঁকোর বয়ানকে অনুসরণ করে, কি করে না, তা ভাববার বিষয় বৈ কি?

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।