কলেজ থেকে ফিরে ঘরে ঢুকেই ব্যাগটা বিছানার একপাশে ছুড়ে মারল রোমানা। মনটা আজ ভীষণ খারাপ ওর। ক্ষোভে অপমানে চোখদুটো দিয়ে জল আসতে চাইছে। এখানে ওর দোষটা কোথায়? ও দেখতে তেমন ভাল নয় কিন্তু এটাই কি সব?
রোমানা ঢাকার এক নামী কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। পড়ালেখায় ভালই। ভাল গান গায়। স্কুলের বিভিন্ন ফাংশনে প্রায়ই গাইতো, প্রাইজও পেয়েছে বেশ কয়েকবার। কলেজে ভর্তি হবার পর এই প্রথম কোনো ফাংশনে গাইছে ও। এইচ এস সি পরীক্ষার্থীদের বিদায় উপলক্ষে একটা অনুষ্ঠান হবে ওদের কলেজে। ওখানে একটা সম্মিলিত রবীন্দ্রসঙ্গীতে গাইবার কথা ওর। এজন্য রিহারসেল চলছে কদিন ধরে। আজকে রিহারসেলে ওদের ম্যাডাম তুললেন প্রথম কথাটা।
“রোমানা তুমি সামনের সারিতে দাঁড়িয়ো না…”
“কেন ম্যাম? আমার তো প্রথম অন্তরার অংশটুকু শুরু করার কথা।”
“দেখ, যা বলছি শোন। তুমি পেছনের সারির ওদিকটায় গিয়ে দাঁড়াও।”
রোমানা ভালই জানতো ওখান থেকে ওকে একদম দেখাই যাবে না। যাই হোক এতে তেমন কিছু মনে করে নি সে। কিন্তু মায়াকে বলা ম্যামের পরের কথাগুলো ওর মনে যেন শেল হয়ে বিঁধল।
“মায়া…এদিকে এসো। তুমি রোমানার জায়গায় গিয়ে দাঁড়াও।”
“কিন্তু ম্যাম প্রথম অন্তরাটুকুতো রোমানার গলায় ভাল শোনায়। তাছাড়া, আমার গলাও খানিকটা বসা।”
“ওতে কি? তোমার লুক ভাল বলেই তোমাকে এখানে দাঁড়াতে বলছি, রোমানা ওখানে দাঁড়ালে কি স্টেজে ভাল দেখাবে? কেমন বেঢপ দেখতে…”। শেষ কথাগুলো বলার সময় ম্যামের দাঁতমুখ যেন খিচড়ে উঠলো।
সে শুনছে এটা জানার পরও কিভাবে কথাগুলো এভাবে বলে গেলেন উনি ভেবে পায় না ও। ম্যামের কথা শেষ হতেই আশেপাশে কানাকানি শুরু হয়ে গেল। ও শুনেও শুনছিল না। লজ্জায় মনে হচ্ছিল তক্ষুনি মরে যায়।
রিহারসেলের বাকি সময়টুকু যে কিভাবে গেছে ও জানে না। শুধু জানে এত কষ্ট করে গলায় তোলা গানের একটি লাইনও ওর মাথায় আসছিল না। মাথায় ঘুরছিল কেবল ওই শেষ শব্দকটি…
বাসায় ফিরে নিজের রুমে ঢুকেই চোখ আর বাঁধা মানল না ওর। বুকে জমা কষ্টগুলো নিমেষেই সব চোখের কোনায় জড়ো হয়ে গেল।
মনের ভেতর তোলপাড় করছিল অজস্র সব কথা।
“আচ্ছা একটা মানুষকে তুমি বিচার করবে কি দিয়ে? শুধুই কি তার চেহারা দিয়ে, বাইরের লুকটাই কি সব?”
“বাইরের লুকটাই হয়তো সব নয়…সবার কাছে, কিন্তু বেশীরভাগ মানুষ ওটাই আগে দেখে।”
“আবেগটাই যদি সব হয় তাহলে যুক্তির কি মূল্য থাকলো? সৌন্দর্যই যদি সব হয় তবে মানুষ আর মানুষ হল কেন?”
“মানুষের মধ্যে দুটো বোধই কিন্তু থাকে। তার সচেতন মনটা যুক্তি মেনে চলতে চাইলেও অবচেতন মনটায় সবসময় যুক্তিবোধের বাইরের পৃথিবীটাই প্রাধান্য পায়। মানুষ বোধ হয় কেবল নিজের প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির হিসাব কষার বেলায় নিজের অবস্থানটাকে সমালোচনার বাইরে রাখতেই যুক্তি খোঁজে। অবশ্য এক্ষেত্রেও অবচেতন মনটা প্রস্রয় পায় নিঃসন্দেহে।
আচ্ছা, তুমি পাশের বাসার অয়ন ছেলেটার কথাই ধর না কেন? এলো চুলের অমন সব পোশাক পরা এই ছেলেটাকে যে সবাই খুব পছন্দ করে ওতে কী যুক্তি খুঁজতে যাবে তুমি? ও কি পড়ালেখায় খুব ভাল? তা তো না। তাছাড়া বলার মত গুণও খুঁজে পাবে না। কিন্তু দেখ ও ফেসবুকে একটা ছবি আপলোড করলেই সবাই কেমন হুমড়ি খেয়ে লাইক দেয়…স্ট্যাটাস দেবার বেলায়ও ও তাই। মানুষের এসব কাণ্ডগুলোকে কিভাবে নেবে তুমি? আসলে আমরা বেশীরভাগ মানুষই এমন, কেবল বাইরেরটাই দেখে বেড়াই। তুমি দেখতে সুন্দর হলেই তোমাকে সবাই অন্যভাবে নেবে। এটাই নিয়ম।”
“কিন্তু আমি এসব মানতে চাই না। এসব মানলে তো আমাকে অন্যরা কেবল মাড়িয়ে যাবার সুযোগ পাবে। জানি তথাকথিত যোগ্যতাধারীদের চেয়ে হয়তো পিছিয়েই থাকব আমি। কিন্তু নিজেকে হীনমন্যতায় রেখে আরও পিছিয়ে যাব কেন?”
নিজের ভেতরের এসব অন্তরদ্বন্দ্বে কখন যে ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে টেরই পেল না রোমানা। এখন নিজেকে অনেকটা সামলে নিতে পেরেছে ও। দু’গাল বেয়ে নেমে আসা চোখের জলও শুকিয়ে গেছে অনেকক্ষন হল। হঠাৎ মায়ের গলার আওয়াজ শুনতে পেল ও।
“রোমানা খেতে আয়।”
“আসছি, মা।’- বলেই উঠে পড়লো সে। বাথরুমে গিয়ে কাপড় ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে খেতে চলে গেল।
খাওয়া হয়ে গেলে মাকে টেবিল গোছাতে সাহায্য করে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো ও। তিনতলা থেকে নিচে তাকাতেই পাশের বাসায় একটা রিকশা এসে থামল। রিকশায় অয়ন আর একটা মেয়ে। অয়নের গায়ে একটা ফতুয়া। সামনের বোতামদুটো খোলা। পাশের মেয়েটার পরনে চমৎকার একটা শাড়ি, চুল ছেড়ে রাখা। অয়নকে নামিয়ে দিয়েই চলে গেল রিকশা নিয়ে। মাত্র কয়েক মুহূর্তের জন্য দেখা। দুজনকে পাশাপাশি এত সুন্দর লাগছিল। কেন জানি হঠাৎ খুব দুঃখ হল ওর আর বুকের বা দিকটায় খানিকটা শূন্যতার অনুভূতি।
আচ্ছা …কী ভাবছে ও! ঘণ্টাখানেক আগেই বা কী ভাবছিল? সব মানুষের মনই কি তাহলে এমন?
লুকটাই সব না, কিন্তু দুঃখের বিষয় শিক্ষিত নামীদামী ডিগ্রিধারীরাও এই মানসিকতা থেকে বের হতে পারে নি সন্তোষজনক হারে…
“লুকটাই সব না, কিন্তু দুঃখের বিষয় শিক্ষিত নামীদামী ডিগ্রিধারীরাও এই মানসিকতা থেকে বের হতে পারে নি সন্তোষজনক হারে…” আসলেই তাই আপু। যতই পরিবর্তনের কথা বলি না কেন আমরা নিজেরাই মাঝে মাঝে নিজেদের ভেতরকার কিছু বিবশ চিন্তায় অন্যদের আঘাত করে বসি 🙁
সুচিন্তা আবশ্যক।
এটারও শেষ পাঞ্চটা ভালো লাগছে! :beshikhushi:
:yahooo:
ধন্যবাদ আপুমনি :happy:
ইয়ে… এই পোস্টটা কি দ্বিতীয়বার প্রকাশ করা হল নাকি? :thinking:
অবশ্য ভালই হল, আগেরবার নানান ব্যস্ততায় পড়ার সুযোগ হয় নি, ভুলে গিয়েছিলাম।
গল্পটা ভাল হয়েছে। ভেবে দেখার কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত বাস্তবতা। তবে ফিনিশিংটা বেশি এক্সক্লুসিভ!!
“আচ্ছা …কী ভাবছে ও! ঘণ্টাখানেক আগেই বা কী ভাবছিল? সব মানুষের মনই কি তাহলে এমন?”
– এই অংশটাই পুরো লেখাটাকে একটা অন্যরকম উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে!! :happy:
চমৎকার! :clappinghands:
ধন্যবাদ শাহরিয়ার… 😀
হুম, দ্বিতীয়বার প্রকাশিত…তবে কাহিনীটা আমি ঠিক ধরতে পারছি না…?!?! :thinking:
কিছুদিন ঢাকার বাইরে নেটবিচ্ছিন্ন অবস্থায় ছিলাম…তো সরবে ঢুকেই দেখি এই অবস্থা…যাই হোক তোমাকে পাঠক হিসেবে পাওয়া গেল… 🙂
আদর্শ ছোট গল্প! :love: