থার্ড লেভেলের সেকেন্ড টার্মের সাথেই একটা কোর্স ছিল-ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্যুর। এই প্রথম বাসা ছেড়ে, আব্বু-আম্মুকে ছেড়ে বাইরে যাওয়া! অন্যরকম একটা অনুভূতি… এর আগে এমন একা কোথাও যাওয়া হয়নি।
তিন সপ্তাহের ট্যুর, কিন্তু নানা ঝামেলায় সেটা কমে পনের দিনে ঠেকল। এদিকে আম্মুর চিন্তার শেষ নেই- এই প্রথম একা কোথাও যাচ্ছি আমি। এই উপদেশ, সেই পরামর্শ……আমার নিজের-ই খারাপ লাগতে লাগলো আম্মুর চিন্তা দেখে।
আমিই আম্মুকে অভয় দিই—“ আশ্চর্য! একা কোথায় আমি! আমাদের ক্লাসের সবাই যাচ্ছে না একসাথে!”
— “ তোরা সবাই তো বাচ্চা….” আম্মু মুখ অন্ধকার করে বলে।
হাসতেও পারি না আমি। একুশ বছর ছুঁয়েছি আমি; এখনো যদি বাচ্চা-ই থাকি, কখন বড় হবো?
এদিকে ডিপার্টমেন্টে চেয়ারম্যান স্যার আমাকে বললেন- “ বাইরে তো আর থাকো নি… চিন্তার কিছু নেই… ট্যুর তো পিকনিকের মতো। খাবে, ঘুরবে, গ্রামের মেলা দেখবে… সাথে সাথে ক্লাস, সেটাও আরেক পিকনিক…..”
পাশ থেকে ট্যুর কোঅর্ডিনেটর স্যার তাল দিলেন—“সাথে সাথে শীতলক্ষ্যা নদীতে নৌবিহার….” ভেবেই পেলাম না বাসার বাইরেও টিচাররা পর্যন্ত আমাকে এভাবে নসীহত কেন করা শুরু করলেন…..
বাসায় ফিরে আম্মুকে অতি আনন্দিত হয়ে নৌবিহারের কথা জানাতেই আম্মুর চেহারায় মেঘ ঘনিয়ে উঠল। আমার হাতটা চেপে ধরল, যেন আমি কোথায় হারিয়ে যাচ্ছি! বলল—“বাবু, তুই তো সাঁতার জানিস না, নৌকায় চড়বি কিভাবে?”
— “ নৌকায় চড়ার জন্য কি সাঁতার জানা লাগে?”
— “না না, কোন দরকার নেই নৌকায় চড়ার, ঠিক আছে।“
— “ আম্মু প্লিজ…” আমি কাতর কন্ঠে বলি।
— “ তুই সাঁতার জানিস না। আল্লাহ না করুন, কোন বিপদ হলে….”
— “ ওটা একটা ছোট্ট নদী আম্মু! পানি নাকি অনেক কম….”
— “ ছোট নদী হোক আর পুকুর হোক—ভার্সিটি থেকে ট্যুরে গিয়েই তো কত দুর্ঘটনা হয়…খবরে দেখিস না!” আম্মুর কন্ঠে কিঞ্চিত ভৎর্সনার সুর।
— “ কিন্তু আম্মু, সবাই তো চড়বে…..”
— “ চড়লে চড়বে, তুই তীরে দাঁড়িয়ে থাকবি। দেখিস, অনেকেই চড়বে না”
— “ আম্মু… আম্মু প্লিইইইইইইজ…..”
—“ আমি আমার পছন্দ বললাম, তোর যা ইচ্ছে সেটা করিস…”
আমার দুচোখ জলে ভরে যায় প্রায়। অনেক কষ্টে কান্না আটকে বলি–“আচ্ছা, চড়ব না”।
আম্মুর বোঝানো পর্ব চলতেই থাকে– যখন বড় হবি, তখন যত খুশি নৌকায় চড়িস, কিচ্ছু বলব না। ছোট বাচ্চারা এমন একা একা নৌকায় চড়া আসলে বিপদজনক….. ইত্যাদি…ইত্যাদি…
আর আমি রাগে-দুঃখে-কষ্টে লাল-নীল-বেগুনী হয়ে যেতে থাকি। ভাবি-ক্রেডিট এস্যাইন্ড কোর্স না হলে যেতাম-ই না।
টার্মের সব ক্লাস শেষ করে তারপর ট্যুর, তারপর ফিরে এসে টার্ম ফাইনাল। শেষ সাইকেলটা যথারীতি অনেক ব্যস্ততায় কাটলো…কুইজ-ভাইভা, গোছ-গাছ ইত্যাদি…
আব্বু আমাকে ক্যাম্পাসে পৌঁছে দিয়ে গেল, আম্মু বিদায় জানিয়েছে বিল্ডিং এর নিচ থেকেই। আমাকে জড়িয়ে ধরে চোখ ছলছল….
শুক্রবার রাত দশটার ট্রেনে যাত্রা শুরু হল… সেদিন আবার বৈশাখের প্রথম দিন।
সারাটা রাত ধরে ছন্দময় ট্রেন যাত্রা, কম্পার্টমেন্ট জুড়ে বন্ধুদের গান, হৈচৈ….অতপর নরম ভোরের আলো ফুটে ওঠা… যাত্রা সমাপ্তি।
তিন সপ্তাহের ট্যুর দুই সপ্তাহে চলে আসায় ক্লাসের প্রচন্ড চাপ। শুক্রবারেও ল্যাব করতে হল।এরই মধ্যে একদিন বৈশাখী মেলায় গেলাম। যতই মেলার দিকে যাই আমার বিস্ময় বাড়তেই থাকে… এর আগে কখনো এমন গ্রামীণ মেলা দেখা হয় নি আমার। আঁকাবাঁকা মেঠো পথ, দুই পাশে সরু খাল, বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত, তার মাঝে দ্বীপের মতো গাছপালা ঘেরা বাড়ি, তারপর এক টুকরো মেলা। চারিদিকে উৎসব, রঙ্গিন কাগজ দিয়ে সাজানো, পথের ধারে মাটির তৈজস, খেলনা, পুতুল। একপাশে কাচের চুড়ির দোকান, আরেক পাশে জিলাপী ভাজছে ময়রা।পুতুল নাচ দেখানোর জন্য তাঁবু খাটানো আছে, আরেকজায়গায় দেখি ছোট একটা মঞ্চে পুরষ্কার রাখা- একটা টিভি, একটা সাইকেল আর একটা রিকশা।কোয়েলের ডিম বিক্রি করছে একজন, আরেকজন চাকার মতো একটা যন্ত্র ঘুরিয়ে বানাচ্ছে গোলাপী হাওয়াই মিঠাই! আরেক জায়গায় বিক্রি হচ্ছে সুগন্ধী লেবু!
হঠাৎ মাতাল হাওয়া বয়ে গেল.. ঠান্ডা বাতাস… কাল বৈশাখীর পুর্বাভাস। ফিরে এলাম মেলা থেকে।
এদিকে আম্মুর ফোন- খাচ্ছিস তো ঠিক মতো! পড়ছিস তো! পরীক্ষা গুলো কেমন হচ্ছে, কি খেলি আজ রাতে, মেলায় কেমন বেড়িয়েছিস…..
তার পরদিন ক্লাস শেষে নদী দেখতে গেলাম, কাছেই শীতলক্ষ্যা নদী। বন্ধু-বান্ধব সবাই নৌকায় উঠল মিনিট বিশেকের জন্য। আমি তীরে দাঁড়িয়ে রইলাম।ছোট্ট একটা নদী, নদীর ওপারে শান্ত ছায়াঘেরা গ্রাম। হঠাৎ আবার মাতাল বাতাস বয়ে গেল, সেই সাথে শুনি অপূর্ব বাঁশির সুর। অবাক হয়ে দেখি বাঁশের ছোট জেটিটাতে বসে একটা ছেলে উদাস হয়ে বাঁশীতে একমনে বাজাচ্ছে কী বিষণ্ণ এক সুর………
যখন ফিরে এলাম বাতাস তখন আরো প্রবল ভাবে বইছে। বাসায় ফিরতে না ফিরতেই টপ টপ করে পড়তে শুরু করেছে বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা। আমি বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। সামনে একটা কাঁঠাল গাছ আর সুপারি গাছের সারি। হঠাৎ দেখি একটা ছোট্ট লাল পাখি কোথা থেকে ছুটে এসে প্রথমে সুপারি, পরে কাঁঠাল গাছটায় বসল। আম্মুর মাধবীলতার ঝোপে বাসা বেঁধেছে নাম না জানা যেই লাল পাখি গুলো, ঠিক সেরকম।পাখিটার মাঝে অস্থির চঞ্চলতা আর ঝড়ের ভীরুতা….এদিকে বৃষ্টি পড়ছে অঝোরে…….
মাথার ভেতর দুটো লাইন টোকা দেয়।
বারান্দা থেকে রুমে ঢুকি।কোথায় যে লিখি…. ক্লাস লেকচার খাতাটা টেনে নিই টেবিলে বসে। রুমমেট বন্ধুটা বারান্দার দিকে যেতে যেতে পিঠ চাপড়ে দেয় আমার, বলে- গুড গার্ল, এসেই পড়তে বসে গেছো।
আমি ওর দিকে মুখ তুলে একটু হাসি। খাতার শেষ পৃষ্ঠাটা উলটে লিখে যাই–
কাল সকালে বৃষ্টি যদি হয়-
ভিজে যদি দোয়েল পাখি,
দালান-কোঠা, সারা শহর-
ভিজে যদি জানালা আমার,
ভিজে তোমার ঘর!
দোয়েল পাখি যদি উড়ে আসে
যদি বলে- দুপুর অব্দি থাকি
তোমার পাশে!
ঝড়-বাদলে যদি মেলা ভাঙ্গে,
মাটির পুতুল, মাটির তৈজস
লুটায় পথের পাশে!
যদি আমার মনটা খারাপ হয়-
কি করবো আর!ভাববো আমি
দোয়েল পাখি আমার পাশে
সারাটা দিন রয়।
ভাববো আমি-বৃষ্টি ভেজা আমি,
বৃষ্টি ভেজা দোয়েল পাখি,
বৃষ্টি ভেজা তুমি,
বৃষ্টি সুতোয় গাঁথা হয়ে
সূত্র বেঁধে রই।
কাল সকালে বৃষ্টি যদি হয়!
দোয়েল পাখি যদি উড়ে আসে
যদি বলে- দুপুর অব্দি থাকি
তোমার পাশে!
ঝড়-বাদলে যদি মেলা ভাঙ্গে,
মাটির পুতুল, মাটির তৈজস
অনেক ভালো লেগেছে আপুনি :love: :love:
মন ভালো করে দেওয়া একটা লিখা :love: 😀
ভালো লেগেছে জেনে অনেক ভালো লাগলো…… অনেক আগে লেখা, আমি অবশ্য বেশ বিষন্নতা নিয়ে লিখেছিলাম……… 🙂
কিন্তু বর্ণনাটা এত সুন্দর করে দিয়েছ যে ভালো লেগেছে
আমি যখন পড়ছিলাম অনেক ক্লান্ত ছিলাম আর ভালো লাগছিলা না কিন্তু তোমার লিখা পড়ে কেন জানো মনটা ভালো হয়ে গেল
তাই বললাম যে মন ভালো করে দেওয়া একটা লিখা 😛
বুঝতে পেরেছি… 🙂
সুন্দর
ধন্যবাদ…… 🙂
অনেক সুন্দর আপু. এত্ত সুন্দর করে লিখেন কী করে আপনি? খুব ভালো লেগেছে. বিশেষ করে কবিতাটাতো খুবই সুন্দর..সঙ্গের লিখাটাও..
:love:
খুশি হয়ে গেলাম… :happy: :happy:
ইশ কী সুন্দর!! এই স্নিগ্ধতা শুধু তোমার লেখাতেই পাই…কেমন যেন ভেজা ভেজা অনুভূতি… :huzur:
ধন্য হয়ে গেলুম… :happy: :love:
সেই লেখা! :love: আমার প্রিয়।
এত সুন্দর করে লিখতে পারা একটা মানুষ এত কম লিখলে হবে? 🙁 আমরা কত কী মিস করি!
তোমাদের মত জ্ঞানী-গুনী লিখা লিখতে পারি না দেখে লিখা হয় না… 🙁
এই অকাজের লেখা কেউ ভালোবাসে না… 🙁
ভালো লাগছে। বহুদিন বাদে লিখলেন
এইটা অনেক আগের লিখা…… অলস হয়ে গেছি… 🙁
…দোয়েল পাখি আমার পাশে
সারাটা দিন রয়।… 🙂
স্নিগ্ধ এবং কোমল কথকথা।
ধন্যবাদ… :happy:
সুন্দর আর কবিতা টা তো অসাধারন !
:happy: :love:
নৌকায় চড়লেই পারতেন, একটু আধটু দস্যিপনা দোষের কিছু না।
🙂
আশাকরি একসময় চড়ব… 🙂
কী ভারী মিষ্টি একটা লেখা!! পড়া শেষ করেও স্নিগ্ধতার একটা আবেশ রয়ে গেল। :beshikhushi:
ট্যুরে কোথায় গিয়েছিলেন আপু? যদিও চাটগাঁ আমি তেমন চিনব না… কলেজের ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল শেষ করে একবার চাটগাঁ যাবার সুযোগ হয়েছিল। যতটা দেখতে পেরেছিলাম তা ভীষণ ভাল লেগেছিল।
নৌকা ভ্রমণটা মিস করা উচিত হয় নি! একটুখানি দস্যি না হলে হয়! 😛
আম্মুদের কাছে কেন যে (কণ্যা) সন্তানরা সারা জীবন বাচ্চা থাকে?? :wallbash:
:happy:
চাঁটগা না, ট্যুরে গিয়েছিলাম নরসিংদী… 🙂
আম্মুরা একটু বেশি-ই আগলে রাখতে চান… মাঝে মাঝে কেমন লাগলেও মনে হয় এটাই ঠিক…… এইতো সেদিন একটা ছেলে পিকনিক এ গিয়ে পানিতে ডুবে গেলো…… 🙁