৩ জুলাই, ১৯৯৬। বিকেল ৫ ঘটিকা।
বারান্দার রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে চার-পাঁচ বছর বয়সী এক বালক। বালকের চোখ সুদূরের পানে- ঠিক কী দেখছে, বোঝা যাচ্ছে না। বারান্দায় ফুলগাছের সমাহার- বালকের গা ঘেঁষেই একটা অনিন্দ্যসুন্দর গোলাপ গাছ তার ডালপালা মেলে ধরেছে, তাতে সদ্য ফোঁটা কিছু গোলাপ কুঁড়ি আর পূর্ণপ্রস্ফুটিত গোলাপ শোভা পাচ্ছে। সাদা বেলি ফুলের মাতাল গন্ধে বারান্দায় যেন স্বর্গীয় পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। এই দুটো ফুলই বালকের খুব প্রিয়, কিন্তু আজ তাকে প্রিয় ফুলগুলোর প্রতি আগ্রহী মনে হচ্ছে না- সুন্দর চোখ মেলে সে নিরুদ্দেশ কোন দিগন্তের দিকে চেয়ে আছে।
আশির দশকে গড়ে ওঠা পাঁচ তলা বাড়িটার তিন তলার বারান্দায় বালককে দেখা যাচ্ছে- যদি দূর থেকে কেউ লক্ষ্য করে, তার কাছে বালকের উদাস চেহারাই নজরে পড়বে। কিন্তু আসলে বালকের আজ মন খারাপ। তার চোখের কোণে দু-তিন ফোঁটা অশ্রুজল ঝকমক করছে। বিকেলের রোদ ছোট্ট বালকটার মুখে খেলা করছে- অথচ বালকের কোন দিকেই ভ্রূক্ষেপ নেই।
আজ বালকের জন্মদিন। স্বভাবতই আজ তার খুব খুশি থাকার কথা। কিন্তু এই সুন্দর সময়ে বালকের চোখে জল! এর কারণও কিন্তু বেশ ব্যাপক! বালকের বাবা এইতো কিছুক্ষণ আগে বালককে ‘তুচ্ছ’ কোন বিষয় নিয়ে বকা-ঝকা করেছে!
বাড়ি ভর্তি মেহমান, আত্মীয়-স্বজন; চলছে লোকজনের আনাগোনা। বালকের বিছানা গিফটে ভরে গেছে। দু’জন লোক ভিডিও ক্যামেরা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। সারা বাড়ির মানুষজনকে ক্যামেরার ফ্রেমে বন্দী করছে তারা।
জন্মদিনের অনুষ্ঠান ভিডিও করার কথা মনে পড়তেই বালকের রাগ লাগলো। এই কিছুক্ষণ আগেই ওই দু’জন ক্যামেরাম্যান বারান্দায় এসে তার মন খারাপ করা ছবি ক্যাপচার করে নিয়ে গেছে! জন্মদিনে নাকি কাউকে মন খারাপ করে থাকতে দেখা যায় না- তাই ব্যপারটায় নাকি বেশ মজা পেয়েছে তারা! বলে গেছে- এই ছবি দিয়ে ভিডিও ক্যাসেটের কভার করবে! কত্ত বড় সাহস!
নাহ, আর সহ্য হচ্ছে না বালকের- মাকে বিচার দিতে হবে এদের নামে! কই যে গেল আম্মুটা!
*
প্রায় পনের বছর পরের কথা। ১১ আগস্ট, ২০১১।
ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। (নাম বদলানোর রাজনীতি আমি পছন্দ করি না- তাই ইচ্ছে করেই রাজনৈতিক কারণে বদলানো নামগুলো এড়িয়ে যাচ্ছি!) রাতের স্নিগ্ধ আমেজ চারদিকে।
সেই বালক এর মধ্যে বেশ খানিকটা বড় হয়ে গেছে! আজও বালকের মন খারাপ!
আজ বালকের বাবা উমরাহ্ করতে সৌদি আরব যাচ্ছেন। বাবার সাথে কোনকালেই খুব বেশি খাতির ছিল না তার- অথচ বাবার অনেক দিনের জন্য দূরে চলে যাবার কথা শুনেই কেন যেন মন খারাপ হয়ে গেছে, তাই সি-অফ এর জন্য এয়ারপোর্টে এসেছে সে।
বিমানটাকে উড়ে চলে যেতে দেখে মন আরও খারাপ হয়ে গেল বালকের! কি যেন নেই নেই মনে হচ্ছে!
বেশ খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে আকাশে উড়ে চলা বিমানটাকে দেখতে থাকল সে, যতক্ষণ না দূর আকাশের মেঘের মাঝে হারিয়ে যায়! অবশেষে ফেরার পথ ধরল বালক!
বালকটা আমি। ছোটবেলা থেকেই বাবার কাছ থেকে আদরের চেয়ে শাসন পেয়েছি বেশি, যদিও সে অভাব পূরণ করে দিয়েছেন আমার মা! আমার মা’র মতন মানুষ হয় না, তাঁর কথা আমি বলে শেষও করতে পারব না- তার চাইতে আজ বাবার কথাই বলি।
আমার বাবা মানুষটা ভীষণ ইন্টারেস্টিং! তাঁকে কখনোই পুরোপুরি বুঝতে পারিনি- পারবোও না মনে হয় কখনো! ছোটবেলা থেকেই ভয় পেতাম তাঁকে- হয়ত শাসনের কাজটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাবা করতেন বলেই। অথচ বাবা-মা’র বিয়ের সাত বছর পরের প্রথম সন্তান ছিলাম বলেই কিনা জানি না- আদরও পেয়েছি অনেক! কখনও কোন কিছুর আবদার করে নিরাশ হয়েছি বলে মনে পড়ে না- এমনকি এখনও হই না! কিন্তু বাবার ভালোবাসা কখনওই সামনাসামনি ছিল না, তাই হয়ত অবচেতনভাবেই বাবার শাসনের একটা প্রভাব পড়েছে মনে, ছোটবেলা থেকেই।
আমার বাবার শাসনে মোড়ানো ভালোবাসার একটা উদাহরণ দেই।
ছবি তুলতে ভীষণ ভালো লাগে আমার। তাছাড়া আমার পড়াশোনার কাজে প্রজেক্টের ছবি তোলাও লাগে। আর সবাই জানেন- ছবি তুলতে DSLR ক্যামেরার তুলনা হয় না কোনভাবেই। ডিপার্টমেন্টে সিনিয়র ভাইয়া-আপুদের কাছে এই ক্যামেরা দেখেই প্রেমে পড়ে যাই! যাকে বলে, love at first sight!! অনেক দামী বলেই বোধ হয় কেউ হাতছাড়া করতে চায় না- তাই একদিন প্রজেক্টের ছবি তুলতে গিয়ে অনেক খুঁজেও পেলাম না।
মন খারাপ ছিল বাসায় ফেরার সময়। মা দেখেই বুঝতে পারলেন- এক সময় কারণটাও জেনে গেলেন। মা বাবাকে বলতেই বাবা আমাকে ডেকে বেশ খানিকক্ষণ বকা-ঝকা করলেন, নিজের ডিজিটাল ক্যামেরা থাকা সত্ত্বেও ‘লোভ’ করার জন্য। কয়েক দিন আগেই আমার খুব প্রিয় একটা বন্ধু সিঙ্গাপুর থেকে একটা DSLR নিয়ে এসেছে- তাই হয়ত বকার মাত্রাটা খুব বেশি হল না।
ঘটনাটা ভুলেই গেসলাম। হঠাৎ একদিন বাবা আমাকে ডেকে বন্ধুর DSLRটার বৃত্তান্ত জানতে চাইলেন- আমি ভাবলাম, কৌতূহল। বিস্তারিত জানাবার পর জানতে পারলাম, বাবা তাঁর সিঙ্গাপুর প্রবাসী এক বন্ধুর সাথে ক্যামেরাটা নিয়ে কথা বলেছেন- এখন মডেল, লেন্স ইত্যাদি ইত্যাদি জানালে আমি একটা DSLR পেতে পারি! আমার অবস্থা কেমন তখন, বুঝতেই পারছেন!
এইতো কিছুদিন আগে আমার লাস্ট জন্মদিনের গিফট হিসেবে পেলাম আমার DSLR- Canon 550D!! গিফটটা ছিল মা’র তরফ থেকে- কিন্তু আমার ‘রাগী’ বাবা না থাকলে এইটা কখনওই সম্ভব ছিল না!
বাবাকে ইন্টারেস্টিং বলার পেছনে অনেক কারণ আছে- শাসন আর তার তীব্রতাই বেশি। আমি ক্লাস নাইন থেকে টেনে ওঠার সময় ফাইনাল পরীক্ষায় সেকেন্ড হয়েছিলাম- আব্বু রাগ করে আমার রেজাল্ট কার্ড ছিঁড়ে ছত্রিশ টুকরা করে ফেলেছিল! তার নয় টুকরা এখনো আমার কাছে আছে!! এই গল্প পরে কোন এক সময় বলব। বাবার হঠাৎ রেগে যাবার এমন অনেক ঘটনা আছে। ছোট বেলা থেকেই বাবার রাগ আর শাসন অনুভব করেছি বেশি, লুকোনো ভালোবাসা বোঝার মত বোধ ছিল না আমার তখন, তাই সত্যি বলতে বাবার সাথে কখনোই খাতির হয়নি। মা’র সাথে আমি অনেক ফ্রি- কিন্তু বাবার সাথে সম্পর্কটা এখনো অনেক দূরের।
আমি পিচ্চিকালে অনেক কাঁদতাম- তখন আমার বাবা আমাকে ঘাড়ে করে বাড়ির সামনের রাস্তার এমাথা-ওমাথা ছুটোছুটি করতেন, আমার কান্না থামানোর জন্য! আমার প্রথম আট বছরের জন্মদিনের অনুষ্ঠান ক্যাসেটে রেকর্ড করা- এইটাও আমার বাবার কীর্তি! এমন অনেক ভালো স্মৃতিও আছে বাবাকে নিয়ে- কিন্তু আমি সন্তান হিসেবে বড়ই অকৃতজ্ঞ, তাই বাবার অপ্রকাশিত ভালোবাসার বদলে রাগ-শাসনই মনে দাগ কেটেছে বেশি! যদিও এখন খানিকটা হলেও বাবাকে, বাবার ভালোবাসাকে বুঝতে পারি, না পারলেও অন্তত চেষ্টা করি!
বাবাকে নিয়ে সম্ভবত আরো অনেকবার লিখব, তাই আজ আর লেখা টানছি না।
এই প্রথম ঈদ করলাম বাবাকে ছাড়া- সত্যি বলতে, খুব মিস করেছি তাঁকে। সেপ্টেম্বরের ১১ তারিখ বাবার দেশে ফেরার কথা। বাবার কথা অনেক মনে পড়ছে এখন।
লাভ ইউ, আব্বু!
(লিখেছিলাম ৮ সেপ্টেম্বর, ২০১১ এ- সরব এ আমার ব্লগিং এর সূচনা হোক এই লেখাটা দিয়েই! )
দারুণ লাগলো। ভালো থাকুক সকল বাবা মা 🙂
ধন্যবাদ 🙂
বাবা-মা যেমনই হোক, একটু দূরে গেলেই বোঝা যায় তারা কতটা আপন। 🙂
লেখাটা খুব ভালো লেগেছে। :clappinghands:
সরবে স্বাগতম। :welcome:
ধন্যবাদ, ভাইয়া 🙂
দারুণ লাগল লেখাটা!
দুর্দান্ত সূচনা!
সরবে স্বাগতম :welcome:
ধন্যবাদ, ভাইয়া 🙂
স্বাগতম সরবে! আর দারুণ একটা লিখার জন্য আরেকটা স্বাগতম! বিশেষ করে DSLR এর ঘটনার সাথে আমার গল্পটাও মিলে যায় কিনা!! 😀
অনেক ধন্যবাদ 🙂 DSLR কেনার গল্প মনে হয় সবার জন্যই স্পেশাল 😀
এ স্মৃতিগাহনটা আমার সাথে বেশ মিলে গেছে… কেন জানি হঠাৎ চোখে পানি চলে আসলো
🙁 🙁 🙁
🙁 🙁 🙁
সরবে স্বাগতম! :welcome:
সরবে ব্লগিং-এর যাত্রা শুভ হোক! 😀
ধন্যবাদ, আপু 🙂
সরবে স্বাগতম :welcome:
শুভ ব্লগিং…. 😀
অনেক ধন্যবাদ 😀
স্বাগতম সরবে!
অনেক অনেক ভালো লাগলো পড়ে……… 🙂
অনেক ধন্যবাদ 🙂
লাইকড ইট দোস্ত!! :beerdrink:
:welcome:
থ্যাঙ্কু, দোস্ত :love: :penguindance:
ভীষন ভাল লাগল আপনার লেখাটি……..
আমার বাবার সাথে ও আমি এতটা ফ্রী না যতটা মার সাথে। আচ্ছা আপনার মাকে নিয়ে লিখবেন ?? শেষ করতে পারবেন না জানি । কেউ তার মাকেনিয়ে লিখে শেষ করতে পারবে না। তবুও কয়েকটি লাইন লিখুন। 🙂
ভাল থাকুন এই কামনা
আর আপনার মা-বাবা দুইজনের জন্য রইল রইল শুভ কামান এবং সালাম.
ধন্যবাদ 🙂
আমার মনে হয়- দুই একটা ব্যতিক্রম ছাড়া সব ছেলেরাই মায়ের সাথে ফ্রী, বাবার সাথে সম্পর্কটা কেন জানি অনেক দূরের হয়ে যায়! 😳
আমার অবশ্যি এই প্রথা ভাঙ্গার ইচ্ছে 🙂
মা-কে নিয়ে লিখতে চাইলে আসলেই লেখা শেষ হবে না… কোথায় শুরু করব, কোথায় থামবো- তাও হয়ত ঠিক করতে পারবো না! তবুও চেষ্টা থাকবে 🙂
আপনাকেও শুভ কামনা :beerdrink:
“আমার অবশ্যি এই প্রথা ভাঙ্গার ইচ্ছে ”
আমারও আমি চিন্তা করেছি আমার ছেলেদের সাথে ফ্রী থাকব 😛 😛
“তবুও চেষ্টা থাকবে ”
অপেক্ষায় থাকলাম…..
আর আমার মন্ত্যবের উওরের জন্য আবার ধন্যবাদ…:):)
আপনাকেও ধন্যবাদ- অপেক্ষা দ্রুতই শেষ করার চেষ্টা থাকবে 🙂
:welcome:
পৃথিবীর সব বাবা-মায়ের জন্য অগাধ ভালবাসা!
অসংখ্য ধন্যবাদ, আপু 🙂
contact বোহেমিয়ান ভাইয়া… 🙂