ঘুম-না-আসা রাতফুল গল্প হয়ে ফোটে

রাত-বিরাতে অন্তর্জালের পাতায় পাতায় কী খুঁজি আমি জানি না।

আমি শুধু পড়তে থাকি। অসংখ্যবার পড়া শব্দগুলো কেন যে আরও পড়ি, জানি না। শব্দের ভিড়ে কোন্‌ অচেনা মানুষটাকে খুঁজে ফিরি, সে-ও জানি না।

এই এত এত ভিড়ভাট্টায় মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার আজকাল।

কখনো কখনো এত কষ্ট হয়!

ক্যাম্পাসে হাঁটাহাঁটির ফাঁকে আমাদের খুব পরিচিত একটা কথাবিলাস – এমন করে একদিন এখানে রাত কাটাতে পারলে কেমন হত বল্‌ তো!

সেই রাত চলে এলো খুব শীঘ্রি। অপ্রত্যাশিত, আর অনাকাঙ্ক্ষিতও ছিল রাতটা। রাতগুলো।

ঘুম জড়ানো, ক্লান্তি কাটানো আড্ডার ফাঁকে ম্যাডাম সেদিন বলেছিলেন – তোমার পৃথিবী যত বড় হবে, জানার পরিধি আর পরিচিত মুখগুলোর বৈচিত্র্য যত বাড়বে, তোমার বিনয়ও ততই বাড়বে। তুমি জানবে যে এ জগতে কোন কিছুই আর পরম নয়, absolute নয়। কাউকে বিচার করার আগে তত বেশি ভাববে তখন।

ইতোমধ্যেই আমাদের মধ্যে যাদের অমন অভিজ্ঞতা হয়েছে তারা সায় দিয়ে মাথা ঝাঁকাচ্ছিলাম।

অন্তত একজন তখন এ-ও ভাবছিল, বিনয় বাড়বে জানি, সাথে অবিশ্বাসও কি বাড়বে না?

সবার ওপর অবিশ্বাস। নিজের ওপরও।

কাউকে ভালো ভাবলে সে ভাবনার ওপর আর বিশ্বাস থাকবে না। কারণ যে কোন মূহুর্তেই খারাপ হয়ে যেতে পারে সে। কাউকে খারাপ ভাবলে – তার বেলাতেও একই ব্যাপার।

তবে ইদানিং শুনতে পাই ভালো-মন্দ নাকি আপেক্ষিক।

ওদের কথা ঠিক বুঝি না আমি। তার মানে কি আমি মিথ্যা বললে সেটা ঠিক হবে না ভুল হবে সে-ও আপেক্ষিক? একজন জলজ্যান্ত মানুষকে মেরে ফেললাম ধরেন, সেটাও?

যাই হোক। অবিশ্বাসের কথা বলছিলাম।

যখন ভাববো এই মূহুর্তে আমি একজনকে যেমন দেখছি পরে তার এমন থাকার সম্ভাবনা শূন্যও হতে পারে, এর চেয়ে যন্ত্রণাদায়ক ভাবনা কি আর আছে?

জানি না আসলে।

আর নিজের ওপর বিশ্বাসের ব্যাপারটা? নিজেই নাকি আমরা নিজের সবচেয়ে বড় বন্ধু। নিজের ওপর অবিশ্বাস চলে এলে আমরা চলবো কীভাবে?

নিজের ওপর অগাধ, অন্ধ বিশ্বাস ছিল এক সময়। এখন আর নেই।

আমার সবচেয়ে আপন বন্ধুটাকে আমি হারিয়ে ফেলেছি কবে যেন। আর কখনো যে ফিরে পাব, সে আশা ক্ষীণ। কী কষ্ট, না?

কষ্টের কথা বলতে গেলে আরও কত কী যে মনে পড়ে যায়!

তোমরা ভাবো আমি কেমন! তোমরাই তো বানিয়েছো এমন।

অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপাতে খুব ভালো লাগে। ছোটবেলা থেকেই। নাচতে না জেনে উঠানকে বাঁকা বলি, বললামই বা! কী হয়?

মৃত্যু অনেক সমস্যারই – হয়তো বা সব কিছুরই অতি সহজ – সহজতম সমাধান। তাই নয় কী?

ছোট্ট নিভু নিভু জীবন খামাখা বিষিয়ে তুলে লাভ আছে কোন? ঝামেলামুক্ত জীবন যাপন করতে নাকি হয়। কিন্তু কীভাবে! চাইলেই পারা যায় বুঝি?

আবেগের বুলি আওড়াই না…খুব ভালো করি। আমাদের এত আবেগ, আবেগে চোখ ভেসে যায় – বুক ফেটে যায়, অথচ কেমন সুন্দর করে দুমদাম কাউকে ভুলে গিয়ে অল্প দিনের মধ্যেই স্বপ্ন বদলে ফেলি আর স্বপ্নের মানুষ! অমন আবেগে কাজ নেই, হৃদয়ের ভালোবাসা যদি অমন অদ্ভুত হয় তবে I better love with my brain।

জানি একদিন এই সব লেখাকেই মনে হবে অহেতুক নষ্ট সময়, তারপরও কেন যে লিখি! কিন্তু অন্য কোনভাবে সময় পোড়ানোর চেয়ে তো ভালো।

রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে বাইরে’র কথা মনে পড়ে প্রায়ই। মেয়েদের লক্ষী বলে যে সুনাম, আর ছেলেদের অবিশ্বস্ততার বদনাম, সেসব ভাবতে গিয়ে। আসলে তো মেয়েরা ঘরে বেশি থেকেছে বলেই বদনাম কুড়োতে সময় বেশি লাগছে, তাই তো বলা হয়েছিল। আমারও আজকাল তাই মনে হয়। নাকি, আসলে সবটাতে ছেলেদের দেখাদেখি করতে গিয়েই আজ অবিশ্বস্ত হয়ে উঠছে এরাও?

আজকাল আর আকাশ জুড়ে গান গায় না কেউ আমার জন্য…শরতের মেঘ দেখি না – রঙধনুর রঙ দেখি না – ঝড়ের তাণ্ডব দেখি না…বন্ধুতা নেই মুগ্ধতা নেই অপার আনন্দে উদ্ভাসন নেই…মনের ভেতরটাও একই রকম রঙহীন বৃষ্টিহীন। গল্পহীন।

তোমরা যা বলো তাই বলো, আমার লাগে না মনে।

আমার যায় বেলা, বয়ে যায় বেলা কেমন বিনা কারণে॥

এই পাগল হাওয়া কী গান-গাওয়া

ছড়িয়ে দিয়ে গেল আজি সুনীল গগনে॥

সে গান আমার লাগল যে গো লাগল মনে,

আমি কিসের মধু খুঁজে বেড়াই ভ্রমরগুঞ্জনে।

ওই আকাশ-ছাওয়া কাহার চাওয়া

এমন ক’রে লাগে আজি আমার নয়নে॥ ((রবীন্দ্রনাথ))

শুধু শুধুই। নয়নে লাগে না কিছু। মিছে কথা সবই।

সামিরা সম্পর্কে

পীচ-গলা তরলে আটকে পা, দুঃস্বপ্ন অন্ধ দুই চোখে/ অসতর্ক হৃদয় পোষ মানে মিথ্যে বলার আফসোসে.../// প্রকাশিত লেখার কপিরাইট সংশ্লিষ্ট লেখক সংরক্ষণ করেন এবং লেখকের অনুমতি ছাড়া লেখা আংশিক বা পূর্ণভাবে কোন মিডিয়ায় পুন:প্রকাশ করা যাবে না।
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে হাবিজাবি-এ এবং ট্যাগ হয়েছে , , , , স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

20 Responses to ঘুম-না-আসা রাতফুল গল্প হয়ে ফোটে

  1. মাধবীলতা বলেছেনঃ

    যা যা লিখলে একদম কেন যেন মনে হল আমার মনেই এইসব কথা ঘুরপাক খাচ্ছিল, কেবল ভাষায় আনতে পারছিলাম না। ভাবলেশহীন,নিস্তরঙ্গ, উদাসীন কেমন একটা ছাড়া ছাড়া অনুভূতি…
    “রাতফুল” কথাটা এত এত এত বেশি মনে ধরে গেল যে কী আর বলব ! :beshikhushi:

    • সামিরা বলেছেনঃ

      এইসব ভাবনা বোধ হয় আমরা সবাই ভাবি, তাই না? মানুষ জাতি যেই একরঙা সুতোয় গাঁথা তারই অংশবিশেষ…
      না ঘুমিয়ে মাতাল মাতাল লাগছিল কাল রাতে! তার মধ্যে এই নাম।

  2. খেয়ালী কিশোর বলেছেনঃ

    “শরতের মেঘ দেখি না – রঙধনুর রঙ দেখি না – ঝড়ের তাণ্ডব দেখি না…বন্ধুতা নেই মুগ্ধতা নেই অপার আনন্দে উদ্ভাসন নেই…মনের ভেতরটাও একই রকম রঙহীন বৃষ্টিহীন। গল্পহীন।”
    যে অস্থির সময়ের ভেতর দিয়ে আমরা যাচ্ছি তার অনেকগুলো দিক ছুঁয়ে উপরের লাইনগুলো হয়ে উঠলো শক্ত উপসংহার। এই দুঃসময়ে তবু আশায় বাধি বুক। একদিন ভালোবাসার উদ্ভাসিত আলোয় কেটে যাবে অবিশ্বাসের যত জমানো অন্ধকার। উষর জমিন বৃষ্টিতে ভিজে হবে সবুজের বাগিচা। রঙিন প্রজাপতির ডানায় আমরা আবারও স্বপ্ন উড়াবো।

    • সামিরা বলেছেনঃ

      মানুষ এত সুন্দর মন্তব্য করতে পারে যে কখনো কখনো আমার মনে হয় শুধু এগুলো পড়ার জন্যই কিছু একটা লিখি!
      আমিও আশায় বুক বাঁধতে চাই। খুব খুব চাই।

  3. সুহৃদ বলেছেনঃ

    “নাকি, আসলে সবটাতে ছেলেদের দেখাদেখি করতে গিয়েই আজ অবিশ্বস্ত হয়ে উঠছে এরাও?” — আমারও তাই-ই মনে হয় !

  4. আবার প্রথম লাইনে অসতর্কতা। অন্তর্জাল হবে রে। লেখকের মন যদি স্থির না হয়, যদি এমন লাফালাফি করে এক চিন্তা থেকে আর এক চিন্তায় তাইলে পাঠকের কী অবস্থা হয়? প্রকাশের ভাষা চমৎকার। কিন্তু এই ভাবনাগুলোকে একটা কাঠামো দিতে কিছু খাঁটা-খাঁটুনি যে করতে হবে। “জানি একদিন এই সব লেখাকেই মনে হবে অহেতুক নষ্ট সময়, তারপরও কেন যে লিখি! কিন্তু অন্য কোনভাবে সময় পোড়ানোর চেয়ে তো ভালো।” এই কথাটা এই লেখার ভিতে একটু আঘাত করল না? যখন কিছু লিখব সবকিছু উজার করে দিয়ে লিখব। কোনদিন সেটা নিয়ে আফসোস করব না। কারণ এটাই আমার এইসময়ের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট চিন্তা। আমি আমার শৈশবকে যেমন ভালোবাসি, ভুলে ভরা কৈশোরকে যেমন ভালোবাসি তেমনি ভালোবাসি সেই সময়ের চিন্তাগুলোকে, সেইসময়ের পাগলামিগুলোকেও। আজ আমি যা সেটা তাদের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা যেমনটা ভবিষ্যতের আমি নির্ভর করে আজকের আমির উপর।

    • সামিরা বলেছেনঃ

      অন্তর্জাল? আমি আগে সেটাই জানতাম, পরে ভুল ভেবে আন্তর্জাল বলা শুরু করেছি।
      ইন্টারন্যাশনাল – আন্তর্জাতিক
      ইন্টারনেট – আন্তর্জাল
      এমন না?
      অলস মানুষ, এই জন্যই এরকম এলোমেলো লেখা! খাটুনি করার মত কর্মঠ একদিন হবো বলে আশা রাখি।
      “যখন কিছু লিখব সবকিছু উজার করে দিয়ে লিখব। কোনদিন সেটা নিয়ে আফসোস করব না। কারণ এটাই আমার এইসময়ের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট চিন্তা। আমি আমার শৈশবকে যেমন ভালোবাসি, ভুলে ভরা কৈশোরকে যেমন ভালোবাসি তেমনি ভালোবাসি সেই সময়ের চিন্তাগুলোকে, সেইসময়ের পাগলামিগুলোকেও। আজ আমি যা সেটা তাদের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা যেমনটা ভবিষ্যতের আমি নির্ভর করে আজকের আমির উপর।” – তাই তো! এই কথাগুলো খুব বেশি ভালো লাগলো।

      • নারে, প্রকৃতি প্রত্যয় জনিত কারণে এইটা অন্তর্জালই হবে। কোন শব্দের পরে ইক প্রত্যয় যুক্ত হলে সেটাতে আ কার যুক্ত হয়। যেমনঃ পক্ষ+ ইক= পাক্ষিক। এই নিয়মেই আন্তর্জাতিক হয়েছে।ইক নাই তাই অন্তর্জালই হবে।তবে আন্তর্জালিক শব্দটা শুদ্ধ হতে পারে।

        “যতই উপরে যাই নীল, যতই গভীরে যাই মধু” ।

  5. গাঙচিল বলেছেনঃ

    আমার যাবতীয় দার্শনিক চিন্তা-ভাবনার আবির্ভাব হয় কেবল পরীক্ষার সময়েই! সে হিসেবে গত কয়েক দিনে মাথায় উঁকি দিয়ে যাওয়া অসংখ্য টুকরো টুকরো ভাবনার কয়েকটার সাথে প্রথম দিকের কিছু অংশের অদ্ভূত মিল পেলাম।

    “তোমার পৃথিবী যত বড় হবে, জানার পরিধি আর পরিচিত মুখগুলোর বৈচিত্র্য যত বাড়বে, তোমার বিনয়ও ততই বাড়বে। তুমি জানবে যে এ জগতে কোন কিছুই আর পরম নয়, absolute নয়। কাউকে বিচার করার আগে তত বেশি ভাববে তখন।”…………হুমমম।
    কোন এক মনীষীরও বোধহয় এই রকম একটা কোটেশন দেখেছিলাম- “The more you have knowledge, the less you become judgemental.”

    • সামিরা বলেছেনঃ

      আবারো লিখি – এইসব ভাবনা বোধ হয় আমরা সবাই ভাবি, তাই না? মানুষ জাতি যেই একরঙা সুতোয় গাঁথা তারই অংশবিশেষ…

      কথাটা আসলেই সত্যি! নিজ নিজ বুদবুদে ফুঁ দিয়ে বড় করাটা খুব বেশি দরকার।

  6. কৃষ্ণচূড়া বলেছেনঃ

    এতো ভাল লাগলো লেখাটা পড়ে!!!
    মনে হল আমার কথাগুলো কেউ লিখে দিয়েছে!!

    অসংখ্য ধন্যবাদ সামিরা! 🙂

  7. অনাবিল বলেছেনঃ

    পড়তে পড়তে মনে হলো নিজের সাথেই কথা বলা…… সময়ের প্রয়োজনে’র কথা মনে হচ্ছিল…নিজের সাথে কথকতায় মগ্ন হয়ে যেতে যেতে ভাবি একদিন চেনাসব ছেড়ে বহুদূর যদি হেঁটে যাওয়া যেত আপনাআপনি …… এই সব অবোধ ভাবনাকল্প থেকে ছাড়া পেতাম বুঝি!!

    অনেক বেশি ভালো লেগেছে…… ভালোবাসা নিও……

  8. বোহেমিয়ান বলেছেনঃ

    অন্য রকম ভালো লাগছে

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।