মানবতা মরে নি

গত জানুয়ারির কথা।
প্রচন্ড শীতে কাবু সারাদেশের মানুষ। আমরা বাসার ভিতরে থাকলেও সুয়েটার, জ্যাকেট, মাফলার, কানটুপিতে নিজেকে মুড়িয়ে রাখতাম। লেপের ভেতরে উষ্ণতা খুঁজতাম। সেই সময় জীর্ণ চেহারার, শীর্ণ শরীরের মধ্যবয়সী এক লোক ডা. শামসুদ্দিন ছাত্রাবাসের গেটের পাশে ময়লা কাঁথা জড়িয়ে দিন-রাত শুয়ে থাকত। ঠিক শুয়ে থাকত না, লোকটির আসলে নড়াচড়া করার কোন শক্তি ছিল না। তার চার হাত-পা প্যারালাইজড হয়ে ছিল। মুখেও কিছু বলতে পারত না। দীর্ঘদিন নোংরা জায়গায় একইভাবে পরে থেকে থেকে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় পচন ধরেছিল। তাতে বাসা বেঁধেছিল পোকা-মাকড়ের দল। ছড়িয়ে পড়েছিল দুর্গন্ধ। আশেপাশের মানুষ নাক চেপে জায়গাটা অতিক্রম করত। আমিও বোধহয় লোকটাকে পাশ কাটিয়ে গেছি দু-একবার। লোকটি হয়ত চোখে একরাশ বিস্ময় নিয়ে দেখত তার চারপাশে এত দু’পেয়ে জন্তু কিন্তু কোন মানুষ নেই।

আমরা দু’পেয়ে জন্তুরা মোটেও অবাক হই নি। তৃতীয় শ্রেণীর খাদক মানুষকে কিছু পোকামাকড়রূপী বিয়োজক খাচ্ছে এটাই তো স্বাভাবিক। এটাই তো খাদ্য শৃঙ্খলের স্বাভাবিক ঘটনা। আমাদেরকে তো তাই শেখানো হয়েছে।

দু’পেয়ে জন্তুদের মাঝেও কিছু মানুষ থাকে। আমাদের মেডিকেলেরই তিন বছরের জুনিয়র ৫০তম ব্যাচের মামুন। শামসুদ্দিন হোস্টেলে থাকত। মামুন এই মৃতপ্রায় লোকটাকে রিকশায় করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। ভর্তি করায়। নিজেই দৌড়াদৌড়ি করে রোগীর পরীক্ষাগুলো করায়, ওষুধ কিনে, খাবার আনে, খাইয়ে দেয়। যখন ওষুধ বা কোন কিছু কেনার দরকার পড়ে ইন্টার্ন ডাক্তার, মেডিকেল অফিসার, রেজিস্টার সবাই মিলে টাকা তুলে কিনে ফেলে। মেডিকেল স্টুডেন্টদের ওয়ার্ডে ক্লাস শুরু হয় থার্ড ইয়ার থেকে। সেকেন্ড ইয়ারে পড়া মামুনকে ঘন ঘন হাসপাতালে যেতে দেখে সিনিয়ররা বলত, “মামুন হাসপাতালে কি তোমার কোন রোগী আছে?” মামুন উত্তর দিত, “জ্বী ভাইয়া আমার এক আত্নীয় ভর্তি আছে।”

ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে আমাদের  প্লেসমেন্ট ছিল সার্জারি ওয়ার্ডে। একদিন রাতের ক্লাসে লতিফ স্যার আমাদেরকে লোকটির কথা বলেন। ক্লাস শেষে আমরা সবাই মিলে ওয়ার্ডের শেষ মাথায় পেশেন্টাকে দেখতে গেলাম। কালো রঙের হাড় জিরজিরে শরীর। চোখ কোটরের মধ্যে ঢুকে গেছে। চোয়ালের হাড় বরাবর দাঁড়ি, থুঁতনিতে দাঁড়ির পরিমাণ একটু বেশি। গোঁফও আছে। স্বাস্থ্য ভালো থাকলে ‘জ্যাঙ্গো আনচেইনড’ এর জ্যাঙ্গোর মত দেখতে লাগতো। অসহায় দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিল। জ্যাঙ্গোর মতো তারও হয়ত কোন ‘ব্রুমহিল্ডা’ আছে। পর্বতের উপরে আগুনমুখো ড্রাগনের পাহারায়, নরকের অগ্নিচক্রের মাঝখানে। এখান থেকে সুস্থ্য হয়ে লোকটা ঠিকই তার ব্রুমহিল্ডার কাছে যাবে।

আমাদের ব্যাচের সবাই মিলে একটা ফান্ড রেইজ করার চেষ্টা করলাম। ফান্ড থেকে লোকটার চিকিৎসার জন্য খরচ করা হলো। ইন্টার্নির ভাইয়া-আপুরা, অন্যান্য ডাক্তাররা তো প্রথম থেকেই সাধ্যমত সহযোগিতা করে আসছিলেন। মামুন প্রতিদিন দুই-তিনবার করে এসে খাইয়ে দিয়ে যেত। লোকটার অনেকগুলো সমস্যা ডায়াগনোসিস করা হয়েছিল। গুরুত্ব অনুসারে একটার পর একটার চিকিৎসা চলছিল। ক্লাসে লতিফ স্যার আমাদেরকে নিয়ে প্ল্যান করতেন লোকটার রিহ্যাবিলিটেশনের জন্য এরপর কোথায় পাঠানো যায়।

দেখতে দেখতে আমাদের সার্জারি ওয়ার্ড শেষ হয়ে যায়। মার্চের মাঝামাঝি সময়ে ওয়ার্ড ফাইনাল পরীক্ষা দেই। শুরু হয় আই ওয়ার্ড।  লোকটার কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। একদিন আমি সার্জারি ওয়ার্ডে গিয়ে দেখি উনি নেই। মামুনের সাথে দেখা হলে লোকটার অবস্থা জিজ্ঞেস করি। মামুন বলে, “ভাইয়া, উনিতো গত মাসের ১৯ তারখ মারা গেছেন।”
লোকটার মারা যাওয়ার কথা শুনে কিছু সময় চুপ ছিলাম। পরক্ষণেই মনে হলো মরার আগে হলেও উনি দেখে যেতে পেরেছিলেন এই পৃথিবীতে মানুষ নামে যে প্রজাতি আছে আর ‘মানবতা’ নামে তাদের যে স্বাভাবিক প্রবৃত্তি আছে তা এখনো মরে যায় নি।

মানবতা বেঁচে থাকুক এই পৃথিবীর শেষ দিনটি পর্যন্ত।

মুবিন সম্পর্কে

দেয়ালে দেয়ালে মনের খেয়ালে লিখি কথা। আমি যে বেকার, পেয়েছি লেখার স্বাধীনতা।।
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে অনুপ্রেরণা, ইতিবাচক, উদ্যোগ, চিন্তাভাবনা, সচেতনতা-এ এবং ট্যাগ হয়েছে , , , , স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

6 Responses to মানবতা মরে নি

  1. মাধবীলতা বলেছেনঃ

    🙁 কিছু বলার খুঁজে পাচ্ছি না। কিন্তু কেন যেন মনে হয় দোপেয়ে জীবেরাই ডমিনেটিং, মানুষ সংখ্যালঘু…তবু একটু একটু করেই হয়তো এগিয়ে যাওয়া যাবে অন্ধকার থেকে আলোর পথে…এই আশায় থাকি।

  2. শারমিন বলেছেনঃ

    মানবতা বেঁচে থাকুক এই পৃথিবীর শেষ দিনটি পর্যন্ত
    এইটাই আজকের চাওয়া

  3. একলা পথিক বলেছেনঃ

    🙁

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।