# আইজ গার্মেন্টসে না গেলে হয় না বাজান? মার জ্বরটা আরও বাড়সে, জলপট্টি–মাথায় পানি কোন কিছুতেই জ্বর কমতাছেনা।
–নারে বাজান, ঘরে বইসা থাকলে কি আর জ্বর নামব? আমি বিকালে গার্মেন্টস থেইকা আহনের সময় তোর মায়ের লাইগা ওষুধ নিয়া আমুনে।মায়ের দিকে খেয়াল রাখিস রে বাপ।
ওষুধ লাগবো না, তুমি আমার পাশে থাক। জ্বর একটু বাদে এম্নি নাইমা যাইব। আইজ আর বাজারে যাওন লাগবো না। ঘরে চাইল–ডাইল আছে, দুপুরে পাতলা খিচুড়ি কইরা দিমুনে।
-বউ, তুমি ঘুমানের চেষ্টা কর। আমি বিকালে ফিরনের সময় ওষুধ নিয়া আমুনে। করিমের কাছে কিছু টেকা পাই; দেখি পারলে আধ-সের আঙ্গুর আনমুনে। সাবধানে থাইকো বউ, আমি গেলাম…
# হ্যালো মা, ক্যামন আস তুমি? বাজানের শইলডা কেমন? আমেনা, সলিম অরা ক্যামন আছে?
হেলো কলিম, বাজান তুই কেমন আছত? মায়ের লাইগা তোর পরানডা কি একটুও পুড়ে বাপধন? আমি ভালা আছিরে বাপ।
-পুড়ব না কেন? পুড়ে, খুব পুড়ে কিন্তু কী করমু মা? হপ্তায় সাতদিনই গার্মেন্টস খোলা থাকে। মালিক খুব চাপে রাখে। বাজান, ফাতেমা, সলিম অরা কেমন আছে কইলা না মা?
সবাই খুব ভালা আছে রে বাজান তয় সলিমডা পুরা বান্দর হইয়া সাড়ছে। লেহাপড়া কিছুই করে না। এবার আইলে অরেও তুই ঢাকায় লইয়া যাইস। তোর লগে গার্মেন্টসে কাম করব; অরে দিয়া আর যাই হোক লেহাপড়া হইব না।
-মা তুমি চিন্তা কইর না তো, সলিমের বেরেন আসে। বেরেন না থাকলে কি আর কেলাস ফাইভে পাঁচ গেরামের মইধ্যে ফাস্ট হইয়া বিত্তি পাওন যায়? মা আমার কামে যাওনের টাইম হইসে, মোবাইল রাখতে হইব।
আইচ্ছা বাজান, সাবধানে থাকিস, খাওন-দাওন ঠিকমতো করিস, আর সময় পাইলে বাড়ি আহিস।
-সামনের মাসে এক হপ্তার বন্ধ পাইতে পারি। পাইলে,আমুনে মা। তোমরা ভালা থাইকো, রাখলাম।
হেলো কলিম…
-মা কও, শুনতাসি
ভুইল্লা গেসিলাম রে বাজান তোর বাজানের চশমার একটা আয়না ভাইঙ্গা গেসে। বুড়া মানুষ দ্যাখতে-চলতে কষ্ট অয়…
-আইচ্ছা মা, আমি বাড়ি আহনের সময় নতুন চশমা নিয়া আসমুনে । এহন রাখি মা
আইচ্ছা রাখ…হেলো কলিম?
-আবার কি হইল মা?
বুড়া হইসি রে বাজান, সব ভুইল্লা যাই। সুখবরটা দিতেই তো মনে নাই, রাহেলার পোলা হইসে।
-শুকুর আলহামদুলিল্লাহ, আমি মামা হইসি! তুমি এতক্ষণ পর আমারে এই খবর দিলা!
বইনের ঘরে পরথম বাচ্চা হইসে, সোনার কিছু না হইলেও একজোড়া রুপার বালা না দিলে তো শশুর বাড়িতে তর বইনের ইজ্জত যাইব।
-মা তুমি কোন চিন্তা কইরো না। আহনের সময় আমি ভাইগ্নার লাইগা রুপার বয়লা নিয়া আসমুনে। মা অনেক দেরী হইয়া যাইতাসে, এহন রাখি।
আইচ্ছা বাজান রাখ,শইল্লের যত্ন নেইস……হেলো কলিম?
-মা, আবার কী? তুমি কি আমারে আইজ আর কামে যাইতে দিবা না?
এইডাই শেষ বাজান। কই কি আমেনার তো বিয়ার বয়স হইসে, ঠিক সময়ে বিয়া না দিলে…
-মারে, আমি তো দুধের বাচ্চা না। পাত্র আমার পছন্দ করাই আছে। আমি ছুটিতে আগে বাড়ি আহি, তারপর সব হইব
আইচ্ছা বাজান, শইল্লের যত্ন নেইস আর একবারে রাইত জাগবি না, রাইত জাগলে শইল ভাইঙ্গা যাইব আর আমগো নিয়া বেশী চিন্তা করনের দরকার নাই।
-আইচ্ছা রাইত জাগমু না। মা আমি কামে গেলাম…
# মিজান, বাবা আজ গার্মেন্টসে না গেলে হয় না; আজ শায়লাকে দেখতে আসবে মাত্র একটা দিন ছুটি নেয়া যায়না?
-আব্বা, সুপারভাইজার হয়ে আমি না গেলে শ্রমিকরা কী কাজ করবে? আর আমি বেশীক্ষণ থাকবো না, আসার সময় দই-মিষ্ট নিয়ে আসবো নে।
ফোন করে হামিদকে বলে দে, তাহলেইতো হয়। এমন একটা দিনে তুই থাকবি না…
-আমি থাকবো না কখন বললাম? আব্বা ওরা তো বিকেলে আসবে আমি দুপুরের মধ্যেই ফিরে আসবো। তুমি কোন চিন্তা করো না তো, আমি ঠিক সময় চলে আসব ।
সব দোষ আমার, কার অ্যাকসিডেন্টে আমার একটা পা না কাটা পড়লে আজ তোদের এ অবস্থা হয় না; এসএসসিতে কী ভালো রেজাল্ট করেছিলি তুই…
-বাবা, তুমি আজকেও আবার শুরু করলে? অ্যাকসিডেন্টে কি কারো কোন হাত থাকে; আল্লাহ যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন।
ঠিক আছে বাবা তুই যত তাড়াতাড়ি পারিস চলে আসিস।
-আচ্ছা বাবা চলে আসব। বাবা আমি গেলাম…
‘গেলাম’ বলে কাজে যাওয়া স্বামীটি তার জ্বরে কাঁতর স্ত্রীর জন্য ঔষধ নিয়ে ঘরে ফিরতে পারেনি।
সামনে মাসে ছুটি পাওয়ার আগেই তাকে ছুটি নিতে হল পৃথিবী থেকে। বাবার এক গ্লাস ভাঙ্গা চশমা, বোনের ছেলের জন্য রুপার বালা নিয়ে আর বাড়ী ফেরা হয়নি কলিমের…
‘গেলাম’ বলে কাজে যাওয়া মিজানের দই-মিষ্টি নিয়ে আর ফেরা হল না…
কিছুদিন পরেই হয়তো ঐ স্ত্রীটির অসুখ সেরে যাবে কিন্তু নিয়ে ‘বউ, আমি গেলাম’ আর কি তার স্বামীটি বলবে?
হয়তো কলিমের বাবার চোখে নতুন চশমা জুড়ে দেয়া সম্ভব, সম্ভব বোনের ছেলের হাতে সোনার বালা পড়িয়ে দেয়া, হয়তো আমেনার খুব ভাল একটা পরিবারে বিয়ে দেয়া সম্ভব কিন্তু কলিমকে কি আর ফিরিয়ে দেয়া যাবে তার মা-বাবা, ভাই- বোনের কাছে ?
হয়ত মিজানের চলে যাওয়া আটকে রাখবে না ছোট বোন শায়লার বিয়ে কিন্তু ভাইয়া বলে ডাকার মত আর কাউকে কি পাবে শায়লা?
এটা কোন গল্প নয়। মালিকের লোভের লকলকে জিবের লালায় যবনিকাপাত ঘটলো একজন স্বামীর, বৃদ্ধা এক মায়ের অন্ধের-যষ্টি এক ছেলের, এক ভাইয়ের সহ আরো অনেক গার্মেন্টস শ্রমিকের…
আর কত খাবি তোরা? আর কত খেলে তোদের পেট ভরবে?? আর কতো পেলে তুষ্ট তোদের মন???
বিলগেটস,ওয়ারেন বাফেট, কার্লোস স্লিম হেলু সহ প্রমুখ সকল ধনকুবেরের সারা জীবনের সঞ্চিত ট্রিলিয়ন কোটি ডলার জড়ো করলেও একটা কলিমের প্রাণ দেয়া যাবে না, পারবে না ফিরিয়ে দিতে শায়লার কাছে তার ভাইয়াকে ফিরিয়ে দিতে, পারবে না অসুস্থ স্ত্রীকে তার স্বামীর সাথে একসাথে বসে দুপুরে চাল-ডালের পাতলা খিচুড়ি খাওয়ার সুযোগ করে দিতে…
আর কেউ বলবে না ‘আমি গেলাম’