আজ সকালটা শুরু হলো সাভারে ভবন ধ্বসের কথা শুনে।
এটা যেন আমাদের ভাগ্যের সাথে বেঁধে দেয়া হয়েছে। প্রতিদিন আমরা কোন না কোন খারাপ খবর শুনবো। যে দিন শুনবো না সেদিন রাতে ঘুমোতে যাবার সময় মনে হবে, “কী যেন ঠিক নেই।”
সাভারে ‘রানা প্লাজা’য় একটা লাশ আর কংক্রিটের স্তূপ দেখিয়ে যাচ্ছে সবগুলো চ্যানেল সকাল থেকে। সেই স্তূপ থেকে বের করে আনা রক্তমাখা লাশ সবাই দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু, তাতে চাপা পরে ভেঙে যাওয়া পরিবারগুলো দেখতে পাচ্ছি না, আপনজনের বুক থেকে বেরিয়ে আসা হিমালয়ের মতো শীতল দীর্ঘশ্বাসগুলো দেখতে পাচ্ছি না।
হয়তো দেখতে পাচ্ছি না, ইন্সুরেন্সের টাকার জন্য মালিকপক্ষ এরই মধ্যে দৌড়াদৌড়ি শুরু করেছে। হয়তো রাজনৈতিক নেতারা ভাবছেন, ঠিক কী বললে বোকা দেশের বোকা নাগরিকরা আগের মতোই অথর্ব হয়ে শুনে যাবে আমাদের কথা।
প্রতিটা দুর্ঘটনার পরেই ‘ব্রেকিং নিউজ’ হিসেবে দেখানো হয় নিহত-আহতদের সাহায্যের ঘোষণা। যারা মরে গেছে তাদের পরিবারের কাছে ওই সাহায্যের কোন দাম নেই তাদের প্রিয়মানুষটার তুলনায়।
বলতে পারেন, এই দেশে গার্মেন্টসে এ পর্যন্ত কতগুলো দুর্ঘটনা ঘটেছে। একটা ধারণা দেই।
২৫শে নভেম্বর’২০০০ইং-এ নরসিংদীর “সাগর চৌধুরী গার্মেন্টস”-এ মারা যায় ৪৫ জন শ্রমিক যার মধ্যে ১০ জনই ছিল শিশু শ্রমিক।
০৮ই আগস্ট’২০০১ইং-এ ঢাকা মিরপুরের “মাইক্রো সোয়েটার লিমিটেড”-এ মারা যায় ২৪ জন।
০৩রা মে’২০০৪ইং-এ “মাইক্রো সুপার মার্কেট কমপ্লেক্স”-ঢাকাতে মারা যায় আরও ৯ জন, আহত হয় ৫০ জনেরও বেশী।
১১ই এপ্রিল’২০০৫ইং “স্পেকট্রাম গার্মেন্টস”-সাভারে ভবন ধসে জীবন্ত চাপা পড়ে মারা যায় ৬৪ জন, আহত হয় ৭৪ জন আর চাকুরীর অক্ষম হয় শতাধিক।
২৫শে ফেব্রুয়ারি’২০১০ইং-এ গাজীপুরের “গরীব এন্ড গরীব সোয়েটার ফ্যাক্টরী”-তে মারা যায় ২১ জন হতভাগ্য গার্মেন্টস শ্রমিক।
১৫ই ডিসেম্বর’২০১০ইং তারিখে আশুলিয়ার “হা মীম গ্রুপ” এ আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা যায় ৩০ জন, আহত হয় ৫ শতাধিক। যাদের অধিকাংশই মারা যায় ১০ তলা থেকে লাফিয়ে প্রাণ বাঁচানোর জন্য।
২৪শে নভেম্বর ২০১২ তারিখে তাজরীন গার্মেন্টস এ পুড়ে মারা গেছে ১১১ জন।
আজকের ঘটনায় এখন পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ১০০ জন। আরও অনেকদূর গড়াবে এ সংখ্যা চোখ বন্ধ করেই বলে দেয়া যায়।
একটা ভবন যেখানে ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা নিয়ে দাঁড়িয়েছিলো সেটাতে মানুষ কিভাবে ঢুকতে দেয়া হলো, এটা সম্ভবত এ দেশের অনেক অনুচ্চারিত প্রশ্নের মতোই থেকে যাবে।
উপরের এতো দুর্ঘটনায় কাউকে কখনো শাস্তি পেতে দেখেছেন?
মনে হয় না। হয়তো ধরে নেয়া হয়েছে, কোটি কোটি মানুষের দেশে এ ক’টা মানুষের জীবনের কী-ই বা দাম।
মানুষের জীবন ছাড়াও এ দুর্ঘটনাগুলো যে দেশের জন্য ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনছে সেটা জানেন কি? গার্মেন্টস শিল্পের উপর প্রচন্ডরকম নির্ভরশীল এই দেশটায় এমন নিয়মিত দুর্ঘটনায় অনেক ক্রেতাই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন এখান থেকে। একই সাথে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তো আছেই। অচিরেই সম্ভবত এই শিল্প নিজেকে টিকেয়ে রাখার সংগ্রামের মুখে পড়বে।
আজকের মতো দুর্ঘটনা আর কতো ঘটবে? আর কতবার প্রিয়জনকে হারাবে মানুষ। ন্যূনতম মজুরী না পেয়ে যারা কাজ করে, তারা আর কতো জীবন বিলিয়ে দেবে মালিকপক্ষ ও নির্মাণ কোম্পানিগুলোর অবহেলায়?
আজকের দুর্ঘটনার পর যখন ঘোষণা করা হলো, নিহতদের ২০ হাজার আর আহতদের ৫ হাজার টাকা করে দেয়া হবে-এটা কী তাদের সাথে রসিকতা করা হলো?
এছাড়া, পোষাকশিল্পের নীতিনির্ধারক সংস্থাগুলো(BJMEA, BKMEA) এই ব্যাপারে বরাবরের মতো চুপ করে থাকবে কিনা সেটাই দেখার বিষয়। নাকি এতটুকু হলেও মানবতা জেগে উঠবে তাদের মধ্যে?
মাননীয় সরকার, এ বিষয়ে একটু হলেও সচেতন হোন। এমন দুর্ঘটনায় নির্মাণ কোম্পানির লাইসেন্স বাতিল করুন। মালিকপক্ষের ইন্সুরেন্সের টাকা পাওয়া থামান। নিজেদের স্বার্থে হাত পড়লে সবাই লাইনে আসতে বাধ্য।
একটু হলেও ভাবুন। সকালে ঘর থেকে বেরুনোর সময় ওদেরও আজ ঘরে ফেরার আশা ছিলো। ঘরের পথ ভুলে না ফেরার দেশের রাস্তা ধরেছে তারা। আপনাদের কারণেই তারা চাপা পড়ে আছে তারা কংক্রিটের স্তূপে। আপনাদের কারণেই…
নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করাই যেখানে নিয়ম, সেখানে এমন ঘটনা ঘটতেই থাকবে।
এটা না হয়, নিয়ম নীতির কথা, কিন্তু, পোশাকশ্রমিকদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে বাধ্য করানোটা পশুত্বের পর্যায়ে পড়ে। নিহত শ্রমিকদের জন্য ২০’০০০ টাকা প্রদানের নাটক না করে, পুরো ইনস্যুরেন্সের টাকা ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে বন্টন করে দেয়া জরুরী। বিচক্ষণ সাংবাদিকতার মাধ্যমে, রানা গ্রুপের মালিকের সমস্ত সম্পত্তির হিসাব নেবার জোর দাবী জানাচ্ছি।