দেশের বাইরে থাকি, পরিবার-পরিজন-দেশ এবং মাটি থেকে দূরুত্বের জন্য এমনিতেই মনমেজাজ ভাল থাকেনা। পড়াশুনার বিরক্তির সমান্তরালে দেশের নানান গুরুত্বপূর্ণ ইভেন্ট থেকে দূরে থাকা রীতিমত অসহনীয়। ক্রিকেট দলের পারফরমেন্স ভালো হচ্ছেনা এই দু:খ নিয়ে যখন সময় যাচ্ছে, তখন একটি মৃত্যুর মিছিল দেখা কার্যতই নির্বাক করে দেয়। এই যে নিরীহ মানুষের মৃত্যুর মিছিল, তা আমার মতোই শিক্ষিত (!) এবং সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী শ্রেনীর সম্মিলিত ভুলের ফল।
কী কারণে নিয়মিত এমন দুর্ঘটনা ঘটছে এবং কিভাবেই বা এ থেকে মুক্তি সম্ভব তা নিয়েই একটু আলোচনা করবো এ লেখায়।
সুষ্ঠু নগর পরিকল্পনা এবং ল্যান্ড ইউজ:
আমার আন্ডারগ্র্যাড থিসিসে মোটামোটি অঙ্ক কষে দেখিয়েছিলাম, ঢাকা কেন্দ্রিক গড়ে উঠা বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলকারখানা কীভাবে পিক আওয়ারে ট্রাফিক জ্যাম সৃষ্টি করছে। একই কথা এখন আমি কলকারখানার নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও বলবো। ঢাকাকেন্দ্রিক কলকারখানা গড়ে তোলা আমাদের জাতীয় শিল্প পরিকল্পনার একটি বড় ভুল। এ ভুল যত্রতত্র কলকারখানা শুরু করাকে ত্বরানিত করেছে, এর ফলে নিরাপত্তার নানান দিক না ভেবে যেখানে সেখানে গড়ে উঠছে কারখানা। আমরা দেখতে পাই, একই ভবনে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এবং গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি; এমনকি ব্যাংক, বিপণী বিতানও একই ভবনে স্থান করে নিয়েছে। এই মিক্সড ইউজ প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তার জন্যই হুমকি। একটি দশতলার ভবনের আটতলা পর্যন্ত বিপনী বিতান, অফিস স্পেস, ব্যাংক-বীমা এবং উপরের দুই তলায় কারখানা স্থাপন করে যদি যদি পাঁচ হাজার শ্রমিকের কাজের জায়গা দেয়া হয়, তাহলে এই ভবনের নিরাপত্তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়।
ঢাকায় না হয়ে কলকারখানা যদি বৃহত্তর নোয়াখালী, কুমিল্লা, চট্রগ্রাম, যশোর এবং খুলনা অঞ্চলে গড়ে তোলা হতো, তাহলে বন্দর পর্যন্ত পরিবহন খরচ যেমন কমানো যেতো, ঠিক তেমনি শ্রমিকরা স্বল্প খরচে অপেক্ষাকৃত ভাল লিভিং ফ্যাসিলিটিজ পেতো। এতে করে, বহুতল ভবন এবং কারখানা নির্মানের অনুপযুক্ত জায়গায় ভবন নির্মান করা লাগতোনা।
গ্রাউন্ড ইমপ্রুভমেন্ট ডিজাইন:
নদী-নালা, খাল-বিল-ডোবা পরিবেষ্টিত ঢাকার চারপাশ এবং এসব জায়গাতে নানান ধরনের বজ্র্য-রাসায়নিক দ্রব্য ডাম্প করার কারণে মাটির কাঠামো ধারণ করার ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। এরকম একটি জায়গা ভরাট করে বহুতল ভবন নির্মান করার পূর্বে যথাযথ সয়েল ট্রিটমেন্ট এবং গ্রাউন্ড ইম্প্রভমেন্ট করা আবশ্যক, কিন্তু যতদূর জানি বাংলাদেশে মোটের উপর গ্রাউন্ড ইমপ্রুভমেন্ট ডিজাইন প্রেকটিস নাই, ব্যাপারটিকে কেউ পাত্তাই দেয়না। মানুষ মনে করে, ভাল সিমেন্ট-রড-ইট হলেই বুঝি একটি ভবন নিরাপদ!; এ ধারণা থেকে বের হয়ে এসে ভবন নির্মানে প্রকৌশল শাস্ত্রের পূর্ণ প্রয়োগ না হলে বহুতল ভবনের নিরাপত্তা নিয়ে শংকা থেকেই যায়।
বিল্ডিং মনিটরিং:
একটি বহুতল ভবনের ডিজাইন যখন এপ্রুভ করা হয় তখন ভবন কী কাজে ব্যবহৃত হবে সেটা স্পষ্টভাবে ডিফাইন করা দরকার। সাভারে যে ভবনটি ধ্বসে পড়েছে সেটি গড়ে উঠেছিল একটি শপিং কমপ্লেক্স এবং অফিস স্পেস হিসেবে, ছয়তলার পর বাকি তিনতলা এপ্রুভাল ছাড়াই গড়ে উঠেছে এবং এই ভবনে চারটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিকে জায়গা করে দেয়াও দৃশ্যত নীতিবিরোধী। হাজারো শ্রমিক এবং ভারী যন্ত্রপাতির কথা অনুমোদনহীন এই ভবন নির্মানের ডিজাইনের সময় হয়তো বিবেচনাই করা হয়নি।
বহুতল ভবন নির্মানে একটি জাতীয় নীতিমালার প্রয়োজন, একটি মনিটরিং সেল গঠন করার প্রয়োজন যাদের কাজ হবে নির্মানাধীন বহুতল ভবন পরিদর্শন করা। এমনকি নির্মানের পরও বাত্সরিক পরিদর্শনের একটা ব্যবস্থা থাকা দরকার যে পরিদর্শনের সময় কাঠামো এবং অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থার উপর একটি সার্বিক রিপোর্ট তৈরী করা হবে।
আবাসিক বা বানিজ্যিক ব্যবহারের জন্য নির্মিত একটি ভবনের সাথে কারখানা হিসেবে ব্যবহার করা হবে যে ভবন তার পার্থক্যটা মাথায় রেখেই মনিটরিং সেলকে কাজ করতে হবে।
উন্নত বিশ্বের আদর্শ প্রেকটিস হলো, নির্মান এবং নির্মান পরবর্তী সেফটি ইন্সপেকশন দুটোকেই সমান গুরুত্বের সাথে দেখা। মৃত্যুর মিছিল এড়াতে হলে আমাদেরও শিগ্রই এই প্রেকটিস শুরু করা জরুরী।
ওয়ার্কপ্লেস এবং ওয়ার্কজোন সেফটি:
কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে ওয়ার্কপ্লেস এবং ওয়ার্ক জোন সেফটি নিয়ে জ্ঞান ছড়িয়ে দিতে হবে; সেফটি এডুকেশনের কোন বিকল্প নেই এটা আমাদের অনুধাবন করতে হবে। কোন পরিস্থিতিতে ওয়ার্কপ্লেস এবং ওয়ার্কজোন থেকে দূরে থাকতে হবে সেটা জানা এবং মানা জরুরী, বাঁচতে হলে জানতে হবে।
এই সচেতনতা তৈরিতে শিল্পকারখানার মালিক এবং শ্রমিকদের সংগঠন একযোগে কাজ করতে পারে। এই জয়েন্ট ভেঞ্চার ইন্টারেস্ট গ্রুপ একটি কারখানা চালু করার শুরুতে স্পেশাল ইন্সপেকশন এর ব্যবস্থা করতে পারে যাতে সার্বিক নিরাপত্তার বিষয় খতিয়ে দেখা হবে।
আইনের শাসন-সুশাসন নিশ্চিতকরণ:
যতোই আইন-কানুন করা হোক প্রশাসন এবং বিচার বিভাগ উদ্যমী না হলে বাস্তবে কোন পরিকল্পনার ফল লাভ সম্ভব না এবং বেলা শেষে সবকিছুই রাজনৈতিক নেতৃত্বের সদিচ্ছার উপর নির্ভর করে।
”স্তম্ভ ধরে নাড়াচাড়া ভবনধসের কারণ হতে পারে”
একটি ভবন ধসের পর এই যদি হয় সরকারের দায়িত্বশীল একজন মন্ত্রীর বক্তব্য, তাহলে সার্বিক পরিকল্পনার যথাযথ বাস্তবায়নের উপর সংশয় থেকেই যায়।
সকলের শুভবুদ্ধির উদয় হোক, আমরা সবাই মানুষ হই।
এইতো ক’দিন হলো, বোস্টন বোমা হামলার সন্দেহভাজন একজনকে আহত অবস্থায় ধরা হলো। তখনি, তার অধিকার সম্পর্কিত ‘মিরান্ডা রাইট’ পড়ে শোনানোর ব্যপারে বিতর্ক হলো। একজন খুনির মানবাধিকারের ব্যাপারে তারা সচেতন থাকতে পারলে, আমাদের দেশের কারিগর, গার্মেন্টস শ্রমিকদের অধিকারের ব্যাপারে আমাদের এত অজ্ঞতা কেন?
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে প্রশিক্ষণব্যবস্থা, সবখানে, সেফটি নিয়ে পড়ানো প্রয়োজন। প্রয়োজন, নিজের ও অন্যদের অধিকার নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা।এত বড় বড় দুর্ঘটনার পরও যদি এটা শুরু না হয়, তবে কবে হবে?
লেখাটার জন্য লেখককে ধন্যবাদ।
এই বিষয়গুলা নিয়েই আমাদের আলোচনা দরকার। অথচ আমরা গালির উপর থাকি।
অনেক ধন্যবাদ এই রকম একটা পোস্ট এর জন্য
ভালো এবং বেশ উপকারী একটি লেখা, ভাই। ধন্যবাদ।
আল্লাহ জানেন কবে সুদিন আসবে, শুভবুদ্ধি ও বিবেক খাটিয়ে কাজ করবে তারা…গুরুত্বপূর্ণ এই পোস্টটার জন্য সাধুবাদ… 🙂