২০০৬ সাল। বাংলাদেশেরই কোনো একটি অঞ্চলের কথা। সেখানে একটি প্লাজার নির্মাণ কাজ আরম্ভ হয়েছে। একজন টাউন প্ল্যানার ও একজন সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার গেছেন একটা সাইট ভিজিট করতে। তারা সাইট পরিদর্শন করেই বুঝতে পারেন এখানে গাফিলতি আছে, এর কাজ বন্ধ করতে হবে। নির্মাণাধীন প্লাজার মালিককে বলা হয় রাজউক থেকে প্ল্যান পাস করিয়ে আনা হোক। রাজউক স্বাভাবিকভাবে প্ল্যানটা বাতিল করে দেয়। পরের দুই বছরে পর পর চারবার মালিকগোষ্ঠী বিল্ডিং কোড অনুসারে প্ল্যান সংশোধন করতে থাকে, এবং যথারীতি সেগুলো নাকচ হতে থাকে। সম্ভবত ২০০৯ সালে উপজেলা নির্বাচনের পরে ওই এলাকার মেয়র প্ল্যানিং বিভাগকে নির্দেশ দেয় যেন প্লাজাটির ৬ তলা বিল্ডিং কোড অনুযায়ী অনুমোদন করে নেওয়া হয়, দ্রুত। সেক্ষেত্রে আর স্ট্রাকচারাল ডিজাইন এর দায়-দায়িত্ব না রেখে প্লাজার ৬ তলার লে-আউট প্ল্যান অনুমোদনের আওতায় আনা হলো। পাঠক, বুঝতে পারছেন, এতক্ষণ কীসের কথা বলা হলো? এ হলো মৃত্যুকূপ রানা প্লাজার ইতিহাসের বিবরণ সেই টাউন প্ল্যানারের ভাষ্যে যিনি এই ভবন বিনির্মাণ শুরুতেই থামাতে চেয়েছিলেন (https://www.facebook.com/farjana.lisa/posts/10151414508606958)।
২০১৩ সাল। ২৪শে এপ্রিলের সকালবেলা। একটা দৃশ্যপট কল্পনা করি, আসুন। শত শত শ্রমিক দাঁড়ানো প্লাজার নীচে, উদ্বিগ্নমুখে, সন্দিহান দুরু দুরু বুকে। গতকালই ফাটল দেখা দিলো, বিজিএমইএ-র বড়সাহেবরা ইঞ্জিনিয়ার নিয়ে এসে দেখে গেছে (http://prothom-alo.com/detail/date/2013-04-25/news/347577) ! তারা সমস্ত কাজ বন্ধ রাখতে বলে গেল যে ! আজ কি তাহলে ভেতরে যাওয়াটা ঠিক হবে? কেউ কেউ যেতে চাইছিল না, ওদের ধরে জোর করে খোঁয়াড়ে ঢোকানো হলো যেন কীসের একটা কোরবানী হবে আজ ! একটু বাদেই মানুষগুলোর মাথার উপরে পুরো ভবনটাই ভেঙ্গে পড়ল, কে কোথায় যে চাপা পড়ে গেল হদিস নেই। রক্ত আর রক্ত ! অনেকেই স্পট-ডেড। আর যারা তখনও জীবিত তাদের কী ভীষণ আকুতি বাঁচার ! “আমার হাত কেটে ফেল, তবু আমাকে বের করো” – এই চিৎকারটা শুনতে পাচ্ছেন? একটু পরে পৌঁছানো উদ্ধারকর্মীর দল কিন্তু মুহুর্মুহু এরকম আকুতিগুলো শুনছে। উদ্ধারকর্মী কামাল ইসলাম বলেন, ‘‘আমিও পাঁচ তলায় এক মৃত নারীর পাশে বাচ্চা দেখেছি। বাচ্চাটি অনেক ছোট ছিল। আমার অক্সিজেনও শেষ হয়ে যায়। পরে দেওয়ালের একটি খণ্ড পড়ে আমার চোখের সামনে বাচ্চাটি মারা যায়। এত নিষ্ঠুর পৃথিবী হতে পারে বলে আমি জানতাম না।” ভাই কামাল ইসলাম, কী বলছেন আপনি? এটা নিষ্ঠুরতা? যান ভাই, মশকরা কইরেন না। এ তো নিছক দুর্ঘটনা ! কেবল চারতলাতেই পাঁচশ’র মত মৃত ও অর্ধমৃত মানুষ দেখেছে আরেক উদ্ধারকর্মী সুজন (http://banglanews24.com/detailsnews.php?nssl=8c6b50885da7101bab5fff5ed86987d7&nttl=25042013191705)। জানতে ইচ্ছা হচ্ছে আনুমানিক কতজন মরেছে এই হত্যাকাণ্ডে? জ্বী, একে হত্যাই বলবো। জেনেশুনে এত লোককে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া নিশ্চয়ই হত্যা বৈ আর কিছু নয়। আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে ২২৭ জনের লাশ তালিকাভুক্ত করেছে পুলিশ (http://prothom-alo.com/detail/date/2013-04-25/news/347602)। এদেশের পোশাকশিল্প খাতে এটাই সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা, এর আগে তাজরিন গার্মেন্টসের ঘটনায় মারা গিয়েছিল ১১৪ জন।
এখন পর্যন্ত কাজ করে যাচ্ছে মূলত এলাকার সাধারণ মানুষেরা, এনাম মেডিকেলের ডাক্তার-শিক্ষার্থীরা; সাথে আছে ফায়ার সার্ভিস, বিজিবি, র্যাব, পুলিশ। এগিয়ে এসেছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো। অবস্থা ভালো নেই। ব্যাগ ব্যাগ রক্ত লাগছে, ওষুধে টান পড়েছে, অক্সিজেনের অভাবে মরছে মানুষ। এমন সংকটকালে আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাণ্ডহীন কথাবার্তা শুনে বলতে ইচ্ছা হলো, সাধু সাবধান ! ভুলে যাবেন না এই সাধারণ জনতাই কিন্তু গদি নাড়িয়ে আপনাকে একেবারে ‘ভচাং’ করে দিতে পারে ! যদি দায়িত্ব না নিতে পারেন, তবে সরে যান, শুধু শুধু জল ঘোলা কেন করছেন? তার চেয়ে মৃতব্যক্তির পরিবারপিছু যে ২০ হাজার টাকা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন, তা পুনর্বিবেচনা করুন, কাজে দিবে। একটা গরুর দামও কিন্তু বাজারে ২০ হাজার না।
পুকুরভরাট করে অবৈধভাবে তৈরি হওয়া সাভার বাসস্ট্যান্ড-সংলগ্ন এই ভবন উদ্বোধন হয় ২০১৩ সালে। এর মালিক সোহেল রানা স্থানীয় যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক। খবরে প্রকাশ, খুব শিগগিরই রানাকে যুবলীগ থেকে বহিষ্কার করা হবে (http://prothom-alo.com/detail/date/2013-04-25/news/347645)। কিন্তু, প্রশ্ন হচ্ছে শুধু দলগত বহিষ্কারে কী আসে যায়? এমন বহিষ্কারের নাটক বহু দেখা আছে সবার। প্রয়োজন যথাযথ বিচারের। এর আগেও পোশাকশিল্পখাতে বিশেষ করে বহুতলভবনগুলোতে এরকম ম্যাসিভ না হলেও এর কাছাকাছি ধরণের বহু দুর্ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু মালিকপক্ষের টনক কখনও নড়েছে বলে মনে হয় না। গতকালকেই আমি একটা কথা বলেছি, এই একজন মালিককে বিচারের আওতায় এনে এতগুলো নিরীহ মানুষের প্রাণনাশের অপরাধে প্রয়োজনে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে অন্য মালিকরূপী হন্তাকারকদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা দিতে হবে, দিতেই হবে ! উদ্ধারকাজের পাশাপাশি দোষীদের বিচার হওয়াটাও তাই বড্ড বেশিই প্রয়োজন। নাহলে এমনটা চলতেই থাকবে, মরতে থাকবে আরও মানুষ। আচ্ছা, শ্রমিকরা কেউ তো ঢুকতে চায় নাই ভেতরে, তাহলে কেন তাদের জোর করে কাজে ঢোকানো হলো? কেন বিজিএমইএ-র নিষেধ সত্ত্বেও পরদিন গার্মেন্টসের কাজ শুরু করা হলো? এই প্রশ্নগুলোর জবাব দিতে হবে। রাজনৈতিক ক্ষমতাবলে এমন ত্রুটিপূর্ণ কাঠামোগুলো কী সহজেই না অনুমোদন পেয়ে যায় ! তার মানে রাজনৈতিক একটা পরিচয়পত্র থাকলেই একজন অবাধে মানুষ খুন করার লাইসেন্স পেয়ে যায় এই দেশে ! গত কয়েক দশক ধরে এই কাহিনী চলছে। কিন্তু আমরা এসব আর হতে দিতে পারি না। যথেষ্ট হয়েছে !
আজ তাই আমার কিছু কথা বলার আছে। এমন ডেস্ট্রাক্টিভ প্ল্যানগুলো পাস করানো বন্ধ করার জন্য অবিলম্বে কড়া আইন বানাতে হবে। আমার মনে হয়, সরকারের সদিচ্ছা থাকলে সেইটা অসম্ভব কিছু না। বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রশ্রয় বন্ধ করতে হবে। সর্বোপরি, যে কোনো মূল্যে এই খুনি মালিকের যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে, এবং শীঘ্রই ক্ষতিগ্রস্থদের পুনর্বাসনের সুব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে । সময়ের এই দাবীগুলোকে কর্তৃপক্ষ এড়িয়ে গেলে এবারে ফলটা যে ভালো কিছু হবে না বলাই বাহুল্য। বাতাসে লাশের গন্ধ, প্রতিটা লাশের কাছে আমাদের ঋণ জমা হয়েছে, যত তাড়াতাড়ি সেটা শোধ হবে ততই কল্যাণকর …
asole sobar e akhn ek e kotha! ato gula jibon r tader familyr future nosto hoye gelo.. ar culprit gulo sobsomoer moto nistar peye jae.. khub e lojja lage arokm khobor gulo dekte..
এইখানে কালপ্রিটগুলোকে যদি উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া যেত, তাহলেই কিন্তু দ্যাখেন অনেকটা এই একই ধরণের অপরাধের পুনরাবৃত্তির আশংকা হ্রাস নিশ্চিত করা যেত। এখন, আমাদেরই হতাশ না হয়ে সোচ্চার থাকতে হবে, নাহলে কেমনে হবে?
শেষ কথাগুলো খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় ভাইয়া…কিন্তু ঐ যে সরকারের সদিচ্ছার কথা বললেন, ঐটা কি হবে তেনাদের ? আইন করে বন্ধ করার ব্যাপারেও একই কথা…খুব হেল্পলেস লাগে, খুব…আমি আশাহত হতে চাই না…তবু…
সরকারী সদিচ্ছা হবে কি না সরকারই ভালো বলতে পারবে, তবে না হলে কী হবে তা পরবর্তী নির্বাচনের সময় তারা নিজেরাই জেনে যাবে …
সেইটাই … আইন করাটা খুবই জরুরি, কারণ রাজউক থেকে অনুমোদন দিতে না চাইলেও ক্ষমতা আর টাকার জোরে অনেকে এসব অবৈধ স্থাপনার অনুমোদন পেয়ে যায়, যেখানে হয়ত দেখা যাচ্ছে পরিকল্পনার বাইরে আরও কয়েক তলা বিল্ডিং তোলা হয়, কিংবা যেই ধরণের উপকরণ ব্যবহার করা হচ্ছে ইমারত তৈরিতে সেইগুলি ছিল পুরাই থার্ড-গ্রেডেড। এগুলো তো বন্ধ করতে হবে ! ঢাকা শহরে প্রায় সব বহুতল ভবনই নাজুক অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে, এইটাই শংকার ব্যাপার।
তবে না হলে কী হবে তা পরবর্তী নির্বাচনের সময় তারা নিজেরাই জেনে যাবে
এই বিষয়টা খুব অসভ্য একটা ব্যাপার না?
বিম্পি আওয়ামীলীগ জামাত এরশাদ ক্ষমতায় আসবে মিথ্যা কথা বলে।
অথচ এই মিথ্যার জন্য অথবা কাজ না করার জন্য, গণহত্যার জন্য এদের শাস্তি হবে না!
অসভ্য ব্যাপার কোনটা? ব্যালটেই জনগণ তাদের জবাব দেবে এইটা অসভ্য ব্যাপার কীভাবে হলো?
apu, apnar seser para ta bastobe implement hok, eita mone prane bissas korte khub iccha krche…. but amader nirlojjo politician ra ta konodin-o hote dibe bole mone hoy na… mone kore dekhen football khela dekhe ferar pothe dobay pore around 34 jon sisur mrittu’r jonno dayee driver kintu ekhon jamine moner anonde ghuraghuri krtesen… but sundor “consiquence” vittik lekha upohar dewar jonno apnake dhonnobad … :clappinghands:
😀
তোমাকেও ধন্যবাদ পড়বার জন্য।
লেখা ভালো হয়েছে। কিছুটা শক্ত, কিছুটা আবেগী, সাথে তথ্য ও লিংক দিয়ে আরেকটু জোড়ালো। কম্প্যাক্ট একটা লেখা। এটা ছিলো শুধু লেখার কথা। বিষয়বস্তুতে এবার আসি।
একটা নির্দিষ্ট দলের প্রতি আমার ভালোবাসা থাকা মানে এই না যে আমি তার ভুল ধরবো না কিংবা তার ভুল তাকে স্বীকার করতে বাধ্য করবো না। আমি তার ভালো চাই বলেই তাকে শুদ্ধ হবার জন্য জনগনের কাছে নতজানু হয়ে ক্ষমা চাইতে বলবো কোন ভুলে। কিন্তু সে দল পালাতে সাহায্য ‘করেছে’, মানে অতীতকাল বানিয়ে ফেলার পর যখন দেখি অপরাধীকে ধরা হয়েছে তখন ভালো কাজের প্রশংসা না করে “ধরলে কি ? শাস্তি তো হবে না” বলে ফেলি, তখন কোন কথাটার দাম থাকে ? আমরা তো আর পীর না যে ভবিষ্যত বলে দেবো সুরসুর করে ! ধরতে কেনো দেরী হলো, বিচারে কেনো দেরী হচ্ছে, এ জন্য গাল-মন্দ করতে রাজী। তবে, “বিচার করবেই না” বলে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেবার পক্ষপাতি আমি নই।
গার্মেন্টস মালিকেরা আর সরকারের সাহায্য খুবি অপ্রতুল। কিন্তু সেটা প্রতুল ছিলোই বা কবে ? কখনওই না। তারা নিতে জানে, দিতে জানে না। গার্মেন্টস এর রেপুটেশন নিয়ে তাদের কতো চিন্তা, চিন্তা নাই মৃত মানুষগুলো নিয়ে, তাদের পরিবার নিয়ে। সম্ভবত স্যুট পড়তে জানা “বিবেকহীন” পশুদেরই ঐ ভবনে বসবার অনুমতি আছে।
যুদ্ধাপরাধীদের প্রাপ্য বিচার নিয়ে আমাদের আন্দোলন করতে হচ্ছে। কেনো ? এটা কি আমাদের কাজ ছিলো ? সুন্দরবনের পরিবেশ রক্ষার্থে আমাদের চেচাতে হচ্ছে। এটা কি আমাদের কাজ ছিলো? সাভার ট্র্যাজেডির যাবতীয় সাহায্য আমাদের বহন করতে হয়েছে (মন থেকেই সকলে করেছে, এতে কোন সন্দেহ নেই), কিন্তু এটাও কি আমাদের কাজ ছিলো ? সরকার ও আমরাই নির্বাচন করবো, এবং আমরাই সরকারের কাজ নিজেদের ঘাড়ে নিয়ে নিবো। ভুলটা এখানেই, উচিত ছিলো সরকারকে ঘাড় ধরে কাজটা করানো।
জানি না কিভাবে। তবে উপায় নিশ্চয়ই আছে ! উপায় বের হতে একটু সময় লাগতে পারে, তবে একবার তরুনেরা উপায় বের করে ফেললে সোনার বাগ্লা মুহূর্তের ব্যাপার।
সাভারের প্রতিটি মৃত ও জীবিতদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা রইলো। এবং যতোটুক সামর্থ্যে কুলায়, সাহায্য করবার প্রতিশ্রুতি থাকলো।
সরকার বিচার করবেই না এইটা আমি ইম্পোজ করি নাই কোথাও। আমারও আশা বিচার হবে, আমি খানিক আশাবাদী মানুষ কি না। তবে, আশার প্রতিফলন কদ্দুর ঘটে সে ব্যাপারে আমি স্কেপ্টিক।
তোমার মন্তব্যটির কিয়দংশের সাথে একমত হতে পারলাম না। যেমন, সাভার ট্র্যাজেডি ঘটে যাবার সময় যদি আমরা সরকারের অনেকটা দায়িত্ব সমভাবে ঘাড়ে না নিতাম, এতটা তাড়াতাড়ি ত্রাণ বলো, বা উদ্ধারকাজ, সম্ভব হত না, আমি মনে করি। কিছু জায়গায় সরকারের জন্য বসে না থেকে পরিশ্তহিতি বিবেচনা করে নিজেদেরও এগিয়ে আসতে হয়। সরকার বা সিস্টেমকে গালি দেওয়া সহজ, কাজ করা কঠিন।
আর তোমরা, আমরা, তরুণেরাই তো সাহায্য করবে যে যেভাবে হোক। তোমার নিয়ত সফল হোক সেই কামনা রইল। 🙂
*পরিস্থিতি