আমার পৃথিবী, তোমার পৃথিবী

আচ্ছা, তোমাদের পৃথিবীটা কেমন হবে একটু বলতে পারো আমাকে? মাঝে মাঝে বড্ড জানতে ইচ্ছে হয় যে!

বলো দেখি, কেমন হবে তোমাদের ছেলেবেলা? যেদিন বৃষ্টি পড়বে, বাইরে খেলতে যেতে না পারলে কি নিজেরাই নিত্যনতুন খেলা বানাতে বসে যাবে ঘরের কোণায়? আমাদের মতন সুর করে বলে উঠবে নাকি, “একটা নতুন কিছু করি…”? আর অন্য দিনগুলিতে, ছুটোছুটি করে খেলতে গিয়ে হঠাৎ আছাড় খেয়ে হাঁটু আর হাতের ছাল উঠে গেলে ঠোঁট ফুলিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠবে? নাকি এই ফাঁকে কেউ ছুঁয়ে দিলেই গোটা খেলাটা বরবাদ হয়ে যাবে, এই ভয়ে ব্যথা ভুলে কোনমতে কান্না গিলে উঠেই আবার পড়ি কি মরি করে ছুটবে? আমরা যেমন করতাম?

আবার ধরো, কোন এক ছুটির দিনে ঘুম ভাঙার পর থেকেই তোমাদের কারো হয়তো মন কেমন করা শুরু হল, হবে তো এমন? সকাল গড়িয়ে দুপুর আসবে, তারপর বিকেল; মাঝরাত অবধি একদম অকারণেই কান্নাটা শুধু শুধু দলা পাকিয়ে উঠতে থাকবে কি গলার মধ্যে? কিছুই ভাল লাগবে না কিন্তু কেন যে লাগবে না সেটাও জানবে না, আমাদের যেমন হয়?

কোন একদিন বাসায় তোমাদের কাউকে একা রেখে সবাই কাজে বেরিয়ে গেলে, বিপুল উত্তেজনায় সেও কি নিষিদ্ধ সব কাজে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠবে? আচারের লুকোনো বয়ামটা, মোড়ের দোকানের লবণ ছিটানো তেঁতুলের ঢেলা কিংবা সাদা আর গোলাপি ডোরার দারুণ মিষ্টি লজেন্সগুলো, অথবা ফেরিওয়ালার ভাণ্ডের রকমারি কটকটি কিংবা ছোট্ট গোল মিষ্টি তুলোর বলগুলো সব – থাকবে তো সে সময়ে? আমাদের সময়কার মতন?

আর স্কুলের পড়াতেও কি একদমই মন বসবে না তোমাদের, শুধুই মনে হবে কখন টিফিনের ঘণ্টাটা বাজবে? কারণ তখন দৌড়ে গিয়ে ভিড় ঠেলে গেটের ফাঁক দিয়ে আমসত্ত্ব কিংবা বার্মিজ আচার কিংবা ফুচকা-চটপটি কে কার আগে নিতে পারে সেই প্রতিযোগিতা চলবে? আবার পড়তে ভাল লাগে না বলে তোমাদের জন্যও কি অমন কোন ছড়াগান থাকবে, ঐ যে, “হঠাৎ যদি পৃথিবীটা এমনি হত, মাস্টারেরা পড়ালেখা ভুলে যেতো…হতো যদি ঘূর্ণিঝড়, উড়ে যেত স্কুলঘর…”? আমাদের যেমনটা ছিল?

আরেকটু যখন বড় হবে, তখন কেমন হবে তোমাদের সেই পৃথিবীটা? আমাদের মতই থাকবে না নিশ্চয়ই?

সে সময় কেমন গান গাইবে তোমরা বলো তো শুনি! কেমন গান শুনবে? মন খারাপ হলে “সকাল আসে না, আয়না হাসে না…” বলে গাইবে কেউ তোমাদের জন্য? আর মন ভাল থাকলে তখন?

তোমাদের কেউ কি কখনো বলে উঠবে যে সে “আজকালকার গানে” সুর খুঁজে পায় না, নাকি সুরের নতুন কোন সংজ্ঞা থাকবে তখন? সুর শব্দটাই কি থাকবে আদৌ?

কোনদিন বৃষ্টির পর আকাশে রামধনু দেখে কি তোমরাও আনন্দে অধীর হবে, আমরা যেমন হতাম? অথবা কখনো ধরো একসাথে দুটো রামধনু দেখা দিল, সেদিন কী হবে? বাঁধ ভেঙে যাবে না আনন্দের? তারপর হয়তো আরেকদিন খটখটে রোদের মাঝেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো, তোমরা কি সেদিন সেই ছড়াটাই কাটবে? আমরা যেটা কাটতাম?

একদিন হঠাৎ একটু সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে আর কোন কাজ না পেয়ে যখন কী করা যায় ভাববে তোমাদের কেউ, তার কি তখন হঠাৎ মনে পড়বে যে কতদিন পরিষ্কার আকাশে ঘুড়ি উড়তে দেখে নি সে? অথবা মেঘেদের পাল্লা দিয়ে রঙ আর আকার পালটানো নিয়ে গবেষণা করা হয় না কতদিন? আবার সে রাতেই তারাজ্বলা আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে হবে কি, কতদিন আকাশ দেখি না? নাকি আকাশ কাকে বলে তা-ই জানবে না তোমরা?

আমাদের অদেখা তোমাদের সেই পৃথিবীর সবকিছুই কি বদলে যাবে সেদিন, পালটে যাবে নাকি অনুভূতিগুলো? সেই পরিবর্তনের কথা তোমরা জানবে হয়তো বা কোনভাবে, বই পড়ে অথবা তা না থাকলেও তেমনি কিছু পড়ে কিংবা শুনে; কিন্তু বুঝতে পারবে না, বুঝবে কেবল তারাই আমাদের মাঝ থেকে যারা তখনো টিকে থাকবে? কিন্তু সত্যি সত্যি সবই কি বদলে যাবে, নাকি এমনটা হওয়া সম্ভব, বলো তো?

আমরা তো চাই তোমাদের চোখও অকারণেই ভিজে উঠুক কখনো, আর মনটা শুধু শুধুই খারাপ হয়ে থাকুক। তোমাদের কারো অভিমান হোক অন্য কারো ওপর আর তখন তা ভাঙাতে ব্যস্ত হয়ে উঠুক সেই অন্যজন। পথে হেঁটে যেতে যেতে দখিনা বাতাস ছুঁয়ে যাক তোমাদেরও, আর তখন কেউ বা কারা সে বাতাস নিয়ে গান-কবিতায় ভরে তুলুক তোমাদের জীবনটাকে। তারাজ্বলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে নস্টালজিক হয়ে পড়ুক তোমাদের বিবর্তিত মন।

সারাজীবন একলার ভেবে আগলে রাখা মনটায় ভাগ বসাতে আসুক তোমাদেরই কেউ। চলতে-ফিরতে-গাইতে পুরনো পৃথিবীর শব্দ-বর্ণ-গন্ধ চিহ্ন এঁকে দিক তোমাদের শরীরে আর মনে। আদি থেকে অন্তের যত সব পৃথিবীর স-অ-ব বাসিন্দাদের সাথে তোমরাও একই সুতোয় গাঁথা হয়ে থাকো অনন্তর…থাকবে তো?

সামিরা সম্পর্কে

পীচ-গলা তরলে আটকে পা, দুঃস্বপ্ন অন্ধ দুই চোখে/ অসতর্ক হৃদয় পোষ মানে মিথ্যে বলার আফসোসে.../// প্রকাশিত লেখার কপিরাইট সংশ্লিষ্ট লেখক সংরক্ষণ করেন এবং লেখকের অনুমতি ছাড়া লেখা আংশিক বা পূর্ণভাবে কোন মিডিয়ায় পুন:প্রকাশ করা যাবে না।
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে বিবিধ-এ এবং ট্যাগ হয়েছে , স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

26 Responses to আমার পৃথিবী, তোমার পৃথিবী

  1. স্বপ্ন বিলাস বলেছেনঃ

    “আমরা তো চাই তোমাদের চোখও অকারণেই ভিজে উঠুক কখনো, আর মনটা শুধু শুধুই খারাপ হয়ে থাকুক। তোমাদের কারো অভিমান হোক অন্য কারো ওপর আর তখন তা ভাঙাতে ব্যস্ত হয়ে উঠুক সেই অন্যজন। পথে হেঁটে যেতে যেতে দখিনা বাতাস ছুঁয়ে যাক তোমাদেরও, আর তখন কেউ বা কারা সে বাতাস নিয়ে গান-কবিতায় ভরে তুলুক তোমাদের জীবনটাকে। তারাজ্বলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে নস্টালজিক হয়ে পড়ুক তোমাদের বিবর্তিত মন।” :clappinghands:

    চমৎকার। থাকবে তো এমন……

  2. বোহেমিয়ান বলেছেনঃ

    দুর্দান্ত একটা লেখা!

    প্রিয় স্বরে নিলাম!

    (আমার কাছাকাছি প্যাটার্নের একটা লেখা লেখার প্ল্যান ছিল। ভাষার কারুকাজ পারি না তেমন! তোমারটা অসম্ভব সুন্দর! )

  3. ম্যানীফোল্ড বলেছেনঃ

    আমাদেরও একথা বলেছিলো কেউ… আরো সুন্দর করে…

    এভাবে বলতে পারবে কি ভবিষ্যত প্রজন্ম?

  4. মাসরুর বলেছেনঃ

    “আদি থেকে অন্তের যত সব পৃথিবীর স-অ-ব বাসিন্দাদের সাথে তোমরাও একই সুতোয় গাঁথা হয়ে থাকো অনন্তর…থাকবে তো?”

    চমৎকার। :dhisya: :beshikhushi:

  5. প্রজ্ঞা বলেছেনঃ

    ইশ আপু! যেন পুরো শৈশবটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো!
    অসাধারণ লেখনী! সত্যি অসাধারণ!

    এই ক’দিন আগে এক বড় আপু বেশ ভাবুক হয়ে বলছিলেন, “আমি আমার শৈশবটা অনেক মিস করি, তুমি করো না?” 🙁
    আমি কি উত্তর দেবো বুঝতে না পেরে বললাম, “আমি হয়তো এখনও শৈশবেই আছি তাই মিস করাটা কাকে বলে বুঝিনা!” 😐
    আজকে বুঝলাম সামিরাপু! 🙁

    পিচ্চিকালে যখন মাঝে মাঝে দাদাবাড়ি/নানাবাড়িতে বেড়াতে যেতাম তখন দেখতাম পরিষ্কার আকাশে ঘুড়ি উড়তে, মোড়ের দোকানের লবণ ছিটানো তেঁতুলের ঢেলা কিংবা সাদা আর গোলাপি ডোরার দারুণ মিষ্টি লজেন্সগুলো, অথবা ফেরিওয়ালার ভাণ্ডের রকমারি কটকটি কিংবা ছোট্ট গোল মিষ্টি তুলোর বলগুলো সব! এখন দেখি না আর! এখন আর খুঁজে পাই না সেই জীবনটা!
    কি জানি কেন! সময়টাই হয়তো এমন! বদলে যায়, বদলে দিয়ে যায়! 🙁

    • সামিরা বলেছেনঃ

      বদলে যায়, বদলে দিয়ে যায়! 🙁
      আমিও তো ভুলে যাই মাঝে মাঝেই ছোটবেলার কত কী যে এখন আর নেই সেটা। লিখতে গিয়ে মনে পড়লো কিছু, কিছু হয়তো একবারেই ভুলে গেছি। 🙁

  6. সাথী বলেছেনঃ

    অসাধারণ অসাধারণ অনেক বেশি অসাধারণ একটা লিখা……!!!
    অনেক ভাল লাগল । 🙂

  7. শিশিরকণা বলেছেনঃ

    অসাধারণ অসাধারণ, অনেক ভাল লাগল ।
    শব্দ ব্যবহার এর সৌন্দর্যে মুগ্ধ…. 😀

  8. অনাবিল বলেছেনঃ

    মুগ্ধ!
    স্যালুট!

  9. ফিনিক্স বলেছেনঃ

    কেন তোর সব লেখাই আমার প্রিয়তে নিতে ইচ্ছা করে বলতে পারিস?

    তোর সাথে একদিন পুরো দিন কাটাতে ভীষণ রকমের লোভ হচ্ছে রে! তোর অনুভূতিগুলোর সাথে কী অসম্ভব মিল আমার!

    একদিন তারাভরা আকাশের নিচে আমরা একসাথে শুয়ে থাকব। আমার চোখ দিয়ে জানি অকারণেই জল পড়বে, হয়ত আনন্দের কিংবা কষ্টের জল- বুঝতে পারব না কোনটা। তবু অকারণেই ঝরে পড়বে। তোকে তখন বলব, ‘দেখ, এত অসম্ভব সুন্দর দেখেও কেন আমার মন কেঁদে উঠছে? কেন অকারণ কষ্ট হচ্ছে ভীষণ? তোর সেই ‘আমার পৃথিবী, তোমার পৃথিবী’র লেখাটার মতন?’

  10. ঠিক যেন ছোট্টবেলাটা হঠাৎ করে দরজা দিয়ে উঁকি মেরে গেল…কি অসাধারণ লেখনী তোমার আপু! মাথা আর মন দু’টাই কেমন ভালো লাগা খারাপ করে দিলে……
    অসাধারণ লিখার হাত! কিঞ্চিৎ হিংসাইলাম… 😛

  11. নিলয় বলেছেনঃ

    মারাত্মক! অসাধারণ! fabulous! দারুণ লেখার হাত! 🙂

  12. সামিরা বলেছেনঃ

    লজ্জা পেলুম! 😳

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।