তুমি ভেবেছ এ গল্পের শুরু বড় একটা ট্রাজেডি দিয়ে? বড় একটা ধ্বংস দিয়ে? পুঁজিতান্ত্রিকতার অদৃশ্য মচ্ছোব দিয়ে? ভেবেছ স্রেফ, ফাটল ধরে যাওয়া এক দালানের ‘লজ্জায় ভেঙ্গে পড়া’র গল্প এটি? হ্যাঁ ঠিক, নিরব নিথর মৃত্যুপুরীর গল্প এটি। প্রতি প্রিয়জনের বুকে বুকে মেখে দেয়া কষ্টের নীল দিয়ে গড়া। এটা নীল দর্পণ। নীলকরদের দাদন ধারার শতরঞ্জি খেলায়, কর্মীদের হত্যাযজ্ঞ দিয়ে। কিন্তু, এ গল্পের শুরু যে এটা নয়। অন্য কোথাও, অন্য কোনখানে তার জন্ম।
আজ হতে বহু বছর পর, এ গল্প পড়া হবে। অনেক ভার্সন হতে পারে এর। খুবই সাবলীল তাত্ত্বিক ভাষায় কেউ এ গল্প শুরু কবে, দেশকে নিয়ে। এক গরীব দেশের বড়লোক হবার স্বপ্ন নিয়ে। শিল্পবিহীন এক দেশের একমাত্র গণমানুষের শিল্প নিয়ে এ সেলাই আর কাপড়ের কারুকাজ। অঢেল অঢেল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের চাবিকাঠি।
যে দেশের মানুষ পড়ালেখা করতে পারে না পয়সার অভাবে, খেতে পায় না, সে দেশের প্রধান রপ্তানি দ্রব্য নিয়ে গল্প শুরু তো হতেই পারে।
কেউ হয়তো গণমানুষের কাছ থেকে গল্পটা স্টার্ট করবে। বলবে, দিনের পর দিন, নামমাত্র বেতনে, অসুস্থ পরিবেশে, কোন ধরনের পেনশন ফান্ডের নিশ্চয়তা ছাড়া, ‘একদিন কাজ না করলে তিনদিনের বেতন কাটা’-র মত সান্ধ্য আইনের মাঝে কাজ করে যাওয়া সেসব ক্ষুদ্রমানবদের কথা। হয়তো ভাববে, তার শৈশবে স্কুলে যাবার পথে দেখা, মলিন ওড়না জড়িয়ে, ঝাঁকে ঝাঁকে, অপুষ্টিতে ভোগা সেলাই-দিদিদের লাইন ধরে মাইলের পর মাইল পথচলা। অথবা, মুড়ির টিনের মত চার চাকার দৈত্যের উপর চেপে, ঠাসাঠাসি করে, কাঁধে একটা সিলভার কালারের টিফিন পট নিয়ে, সস্তায় শার্ট-প্যান্ট-আর বুটের মাঝে সৌখিনতা খোঁজার ব্যর্থ চেষ্টা করা ছেলেগুলোর কথা। হয়তো কেউ কান পেতে শুনেছে, তারা তাজরীন নামে এক ফ্যাক্ট্রিতে পুড়ে যাওয়া পরিচিতজনের কথা বলতে। দীর্ঘশ্বাস ফেলতে, কবে সুদিন আসবে?
এত আবেগ হয়তো দেখবে না কেউ গল্পটার শুরুতে। রাজনৈতিক হতাশার কথা হয়তো আনবে সে। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে একটা ত্রুটিপূর্ণ নকশার স্থাপনা জায়েজ করে নেবার নোংরা খেলা নিয়ে হবে তার প্রারম্ভিকা। কেউ হয়তো অতটা মনে রাখবে না। কেবল মনে রাখবে, আসন্ন বিপদের টিভি রিপোর্ট, বিশেষজ্ঞদের সতর্কতা সত্ত্বেও ভবন মালিকের কেয়ারলেস সাফাই,”সামান্য প্লাস্টার খসে পড়া”-র দুর্দান্ত ব্যাখ্যা।
গল্পটা যেভাবেই শুরু করুক না কেন, যে কথা সবাই বলবে, না বলে পারবে না, তা হলো, দালানে ফাটল ধরার পরও, বিশেষজ্ঞের সতর্কতাকে মধ্যাঙ্গুলি দেখিয়ে, হাঁড় জিরজিরে রোগা অপুষ্টিতে ভোগা মানুষগুলোকে পিটিয়ে কাজে পাঠানোর ঘটনা। কর্মস্থলে গতর খাটিয়ে দেশের রেমিট্যান্স বাড়ানোর কাজে গিয়ে মাথার উপর ছাদ নেমে পড়ার ঘটনা। এক নিমিষে হাজারটা প্রাণ হঠাৎ নিভে যাবার হরর মুহূর্তের কথা।
এখানে গল্পের সব ভার্সন এক হবে। তারপর আবার দুইভাগ হবে গল্পের কাহিনী।
এক ভাগ লিখবে, একটা দেশের পরিচালকদের গা বাঁচিয়ে চলার কথা। অপরাধীদের আত্মগোপনের কথা। স্মার্টফোন দামের ক্ষতিপূরণ দিয়ে মৃত্যুর মূল্যায়ন করার কথা।
হাজার হাজার পঙ্গুর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ব্যাপার পাঁচ হাজার টাকায় রফা করার আশ্চর্য ক্ষমতার কথা।
সর্বোপরি, একটা রূপকথার মত অবিশ্বাস্য ভার্সন থাকবে গল্পটায়। যেটায় কোন রাজনীতি নেই। ব্যবসায়ীক লোভ নেই। এমন কি নিজের জীবন বাঁচানোর স্বার্থপর তাগিদ নেই।
সেই অবিশ্বাস্য রূপকথায় থাকবে, সাহসী দৈনিক জীবনযোদ্ধাদের জীবন বাঁচানোর যোদ্ধায় পরিণত হবার কথা। গ্রীক, রোমান, ভারতীয় মহানায়কদের বাদ দিয়ে লোকে শুনবে, রক্ত দেখে ভয় পাওয়া শত শত ভিতু মানুষের তাৎক্ষণিক বেডে শুয়ে রক্তদানের কথা। হাজার হাজার মানুষের অচেনা নাম্বারে ফোন দিয়ে, অচেনা একাউন্টে টাকা পাঠিয়ে, গায়েবী সাহায্য করার কথা। ‘বাতাসের অক্সিজেন’ যেখানে পৌছে না, সেখানে অক্সিজেন পাঠানোর দু:সাহসের কথা। লোভী ব্যবসায়ীদের কথা থাকবে সে রূপকথায়, যারা নিজেদের রসদ কেনা দামের চেয়েও সস্তায় ছেড়ে দিচ্ছে, কেবল তা সাভার যাবে বলে।
মানুষ শুনবে, সকল ধার্মিক মানুষের স্রষ্টার কাছে কান্না। মসজিদের মাইকে ঘোষিত প্রার্থনা, ‘নবী ইউনূসকে যেভাবে মাছের পেট থেকে বাঁচিয়ে এনেছো খোদা, সেভাবে আমাদের মানুষগুলোকে বাঁচিয়ে আনার তওফিক দাও’। আসবে বিচক্ষণ সেনাবাহিনীর প্রকৌশলী কোরের কথা। আসবে, ‘কসাই’ অপবাদে জর্জরিত ডাক্তারদের নির্ঘুম পরিশ্রমের কথা। এপ্রন পরিহিতা ডাক্তার, উদ্ধার কর্মীদের ডাকে দৌড়ে ধ্বংস স্তুপে নেমে পড়ার কথা। নাম না জানা শত শত বীরের কথা, যারা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে যাবার আগ পর্যন্ত, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে একের পর এক মানুষকে উদ্ধার করে এনেছেন। সেই সব মানুষের কথা, যারা প্রায় নিশ্চিত মৃত্যু জানার পরও, ধ্বংস স্তুপের নীচ থেকে কথা বলে, আশা জাগিয়ে রেখেছে কিছু নেশাগ্রস্থ মানুষের চোখে।
এদের সবার চোখে মুখে নেশায় ধরেছে। নেশা মানুষ বাঁচানোর। বিন্দু স্পন্দন থাকা পর্যন্ত একটা মানুষকেও মরতে দিব না।
(এ গল্প অনাগত ভবিষ্যতের জন্য তোলা রইল, পড়ে দেইখো)
গল্প ভালো লাগছে
(বানান দেইখেন শিল্প)
এমনি করে কি জগত জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?
এরকম সহস্র গল্প রোজ লেখা হয়, সহস্র স্বপ্ন রোজ দেখা হয়। অনেক বড় স্বপ্ন আর যথাসাধ্য চেষ্টার উপরইতো দেশটা টিকে আছে। বার বার ঘুরে দাড়াচ্ছে অসংখ্য প্রতিকূলতা থেকে।
শুভকামনা বাংলাদেশ।
ঘুরে দাঁড়াতে গিয়ে আবার পড়ে যাচ্ছে সে। চারপাশে কেবল অপরিচিত আলো আঁধারি।
যে গল্প এখন লিখছি, তার শেষটা জানা নেই। তারপরও অনেক দিন মনে রাখবে মানুষ। কিছুটা তো পরিবর্তন আসবে।