চারপাশে অন্ধকার দেখতে পাচ্ছি। মাথাটা ঘুরছে। মনে হচ্ছে পৃথিবীটা টেনিস বলের মত ঘুরছে।আমি বেঁচে আছি না কি মরে গেছি এটা বুঝতে কয়েক মুহূর্ত সময় লাগল।আমি বুঝতে পারলাম মারা যাচ্ছি।দুইটা বুলেট আমার পায়ের ভিতরে খেলা করছে। আমি তীব্র যন্ত্রনায় ছটফট করছি।কাউকে ডাকার চেষ্টা করলাম কিন্তু কেউ শুনল না।চিৎকার করে ডাকার শক্তিটুকু আমার নেই।চারপাশে গোলাবারুদের তীব্র গন্ধ ও আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।আমি তাহলে সত্যি আজ মারা যাব। চোখের সামনে ভেসে উঠছে ছেলেবেলার ছবি,শৈশবের স্মৃতি।কিন্তু সবগুলো দৃশ্য দেখলাম সাদা কালো।তাহলে কিমৃত্যুর কাছাকাছি চলে গেলে মানুষ সাদা কালো দেখে ।না আমি আর কিছু চিন্তা করতে পারছি না।চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসছে।
নতুন করে বেঁচে উঠা
চোখের মধ্যে তীব্র আলো পড়ছে। চোখ আর বন্ধ করে রাখতে পারলাম না। চোখ খুলে তাকালাম।দেখলাম জানালা দিয়ে সূর্যের তীব্র আলো আমার চোখে পড়ছে।এই রকম সকালের সূর্যের আলো কতদিন দেখি না।আমি প্রানভরে সূর্যের আলো দেখছি। এতদিনের চেনাজানা আলোটা আজ এত ভাল লাগছে কেন??যদি সূর্যের আলোকে বোতলের মধ্যে ভরে সংরক্ষন করা যেত আজ আমি তাই করতাম।
“বাবা কেমন আছে?”
আমি পাশে তাকালাম। একজন মাঝারি বয়সের মহিলা দাড়িয়ে আছে।আমি এখানে কেন??কেমন করে আসলাম বুঝতে পারছি না। মনে হয় কেউ অসুস্থ অবস্থায় আমাকে তুলে এনেছে।
“ ভাল আছি”
এরপর আমাদের পরিচয় পর্ব হল শেষ হল। আমি সংক্ষেপে আমার পরিচয় দিলামা । যুদ্ধের কথা বললাম।আমি অবাক হয়ে দেখলাম এই মহিলা আমাকে চিনে না কিন্তু এমন করে কথা বলছে যেন আমি কতদিনের চেনা।মনে হচ্ছে যুদ্ধ আমাদের আপন হওয়ার শিক্ষা দিচ্ছে।
ভালবাসার প্রথম প্রহর
এই বাড়িতে আমার একটা দিন কেটে গেল।শুধু মাএ মহিলাটিকে ছাড়া এখনো কাউকে দেখলাম না। একজন ডাক্তার এসে বুলেট বের করল। পায়ে এখনো তীব্র ব্যাথা করছে।বিছানা থেকে উঠতে পারছি না। । আজও আমি প্রান ভরে সূর্যের আলো কমল আলোটা দেখছি। এত সাধারন একটা বিষয় আমার কাছে এত অসাধারন মনে হচ্ছে।
হঠাৎ জানাল দিয়ে দেখলাম একটা মেয়ে হেটে যাচ্ছে।অনেক মেয়ে দেখেছি কিন্তু এমন রূপবতী মেয়ে কখনো দেখিনি।সৃষ্টিকর্তা যেন তাকে নিজ হাতে তৈরী করেছে।মেয়েটার বয়স ১৭ কি ১৮ হবে। চুলগুলো অনেক বড়। পরক্ষনে মেয়েটা আমার চোখের আড়ালে চলে গেল।কবির ভাষায় বলতে গেলে আমি যেন নাটোরের বনলতা সেন কে দেখলাম।
আমার পানি পিপাস পেয়েছে। আমি ডাকলাম কেউ কি আছেন আশেপাশে একটু পানি খাব?
কিছুক্ষন পর একজন আমার ঘরে পানি নিয়ে আসল। আমি দেখলাম সেই মেয়েটি হাতে পানি গ্লাস নিয়ে দাড়িয়ে আছে।কখনো কোন মেয়ের দিকে চোখ এমন করে আটকে যায় নি। আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি। ভাবছি একটা কি ঠিক হচ্ছে আমার। মনে আবেগ কে প্রশ্রয় দেওয়া উচিত না আমার।মেয়েটি খুব লজ্জ্বা পাচ্ছে। দ্রুত পানির গ্লাসটি রেখে চলে গেল। ঘটনাটা এত দ্রুত ঘটল যে আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না।আমি কি মেয়েটার প্রতি দুর্বল হয়ে পরছি?? একেই কি প্রথম দেখায় প্রেম বলে??? আমি কি সত্যি মেয়েটার প্রেমে পড়ে গেছি? দূর !! কি ভাবছি আমি এগুলো দেশ জুড়ে যুদ্ধ চলছে আর আমি ভাবছি ?? সারাটা দিন আমি যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। সারাদিন অপেক্ষা করছি মেয়েটাকে একবার দেখার জন্য। জানালার দিকে তাকিয়ে ছিলাম সারাদিন কিন্তু একটি বারের জন্যও দেখলাম না।আমি যেন কি খুজে পেয়েছি এই মেয়েটার মধ্যে?? মাথা মধ্যে শুধু মাএ এই মেয়েটির চিন্তা খেলা করছে। কত স্বপ্ন সাজিয়ে ফেলেছি………..!!!
একটি স্বপ্নের সমাপ্ত
রাতের বেলা বুটের শব্দে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়।মাহিলাটা আমার পাশে এসে ফিসফিস করে বলে,”বাবা হাকিম রাজাকার কয়েকজন মিলিটারী নিয়ে এই দিকে আসছে””
আমার নিজের গলা শুকিয়ে যেতে লাগল গেল।সাথে নিজেকে অনেক অপরাধী মনে হতে শুরু করল। আমার জন্য এই পরিবারটির জন্য সমস্যার সৃষ্টি হল।
কিছুক্ষনের মধ্যে হাকিম রাজাকার ও হায়েনারা ঘরে ঢুকে আমাকে ও মাহিলাটাকে টেনে বের করে উঠানো খুটির সাথে বেধে ফেলে। আমার কাছে জানতে চায় আমার সাথে আর কেউ আছে কি না??? আমি কিছু না বলে চুপ করে থাকি। ঘরে তল্লাশি করছে কয়েকটার হায়েনা।
একটা হায়েনা মেয়েটার চুলের মুষ্ঠি ধরে ঘর থেকে টেনে বের করছে। আমি চিৎকার করে বললাম ওকে ছেড়ে দেন। আমি মুক্তিবাহীনির লোক এরা কেউ না। রাজাকারের মুখে একটা হাসি আভা দেখলাম।
মহিলাটি চিৎকার করে বলতে থাকে,” তিথির কোন দোষ নেই ওকে ছেড়ে দাত্ত”
একজন হায়েনা বন্দুক দিয়ে আঘাত করে মহিলাটিকে। রাগে আমার সারা শরীর কাঁপতে থাকে।
মিলিটারীর লিডার তিথিকে নিয়ে ঘরের ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। আমার মনে হল কেউ আমার চামড়া তুলে গরম তেলে ভাজি করছে।
ভিতর থেকে তিথীর আর্তচিৎকার শব্দ শুনতে পাচ্ছি। আমার রক্তগুলো ছিটকে পড়ছে সারা শরীরের । মৃত্যুর যন্তনা থেকে যেন আমি এখন আরও বেশি কষ্ট পাছি। সৃষ্টিকর্তার প্রতি বড়ই অভিমান হচ্ছে কি পাপ করেছে এই নিষ্পাপ কমল মায়াবী মেয়েটা।আর আমাকে কেন এত নিষ্ঠুর একটা দৃশ্য দেখতে হচ্ছে। জীবনের প্রথম ভালবাসার মানুষটি আর্তচিৎকার করছে আর একদল নরপশু আনন্দ করছে ভাবতে আমার সারা শরীর কাটা দিয়ে যাচ্ছে।এর আগে কেন মারা গেলাম না। আমি কিছুই করতে পারছি না। বারবার তিথীর মায়াবী মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে……………সেই মায়াবী লজ্জা পাত্তয়া মুখখানা।
অর্তচিৎকারের শব্দটা যেন আর বাড়তে থাকে…………..
শেষ হয়েত্ত যেন হয় না শেষ
ঘটনাটা ৩৮ বছর আগের । এখন আমার বয়স হয়ে গেছে। বিয়ে করেছি। ছেলে -মেয়ে হয়েছে। দাদু হয়েছি। সাদা দাড়ি সারা মুখে। তবুও আমার সেই আবেগ মাখা প্রথম ভালবাসার মানুষটির কথা আমি ভুলতে পারিনি একটুকুও। এখনো মাঝেমাঝে রাতে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায় আর আমি শুনতে পাই সেই আর্তচিৎকারের শব্দ। এখনো আমার ভাবতে ভাল লাগে তিথি বেচেঁ আছে……………সকালের কমল সূর্যের আলো আমি প্রতিদিন সকাল দেখি জানালার পাশে বসে। ভাবি একদিন না একদিন আবার দেখব সেই মুখ খানা………………
বি:দ্র:লেখাটা অনেকদিন আগের।আজ ব্লগের পুরানো লেখাগুলো পড়ে গল্পটা আবার পড়লাম।কিছুটা নষ্টালজি হলাম।সরবে লিখা প্রকাশ করতে একটু দ্বিধায় থাকি।কত ভাল ভাল লেখা, কত সুন্দর সুন্দর লেখা এর মাঝে কি আমার লেখাটি কাউও ভাল লাগবে।যদি ও লিখতে পারি না কিছুই।বানান ভুল হয়।আশা করি ভুল থেকে শিখব।বানান ভুল হয়ে ক্ষমা দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইল এবং ভুলগুলো ধরিয়ে দিলে আরও ভাল হয়…..
পূর্ব প্রকাশ:তুসিনেবর জল-জোছনায়
তিথিরা মরেনা, মরতে পারেনা। বাংলাদেশ যতদিন থাকবে, ততদিন তারাও থাকবে।
চমৎকার লিখেছেন।
হুম। ধন্যবাদ মন্তব্য করার জন্য:)