আজ ৩০শে এপ্রিল, সাভার ট্রাজেডির সপ্তম দিন। এ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ৩৮৭ জন এবং জীবিত উদ্ধারকৃত লোকের সংখ্যা ২৪৩৭ জন ও নিখোঁজ প্রায় চারশো জন। সুত্রঃ বিবিসি বাংলা, 29 এপ্রিল, 2013। আজকে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে গিয়েছিলাম, সাভারে আহত রোগীদের সাথে কথা বলতে। অধিকাংশের চোখে মুখে এখন ও ভয়, আতংক। কেউ কেউ ঘুমাচ্ছিলো, চোখ-মুখ কুঁচকানো। শতকরা ৯৫ জনেরই কিডনীজনিত সমস্যা দেখা দিয়েছে, প্রায় সকলেরই কিডনী ডায়ালাইসিস চলছে।
যে যে ওয়ার্ডে রোগী ভর্তিঃ ১০১, ১০২, ১০৩ এবং ২০৪, ২০৬।
- ওয়ার্ড ১০১:
বেড নাম্বার বয়স নাম
২০ ২৬ আব্দুল লতিফ
২১ ১৮ আশরাফুল
২২ ৩৭ ঝন্টু
২৩ ৩০ আরিফুল ইসলাম
২৪ ৪০ সাহাবুদ্দিন
২৫ ৪০ ইউসুফ (পুর্বে ইব্রাহিম নামের একজন ছিলেন, তাকে ছুটি দেয়া হয়েছে)
কথা হলো ৪০ বছর বয়স্ক মোঃ সাহাবুদ্দিনের সাথে। ডান হাত ভেঙ্গে গিয়েছে তার। পা কেটে গিয়েছে, মাথায় ও আঘাত পেয়েছেন। জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম তিনি ছিলেন ৭ তলায়। রানা প্লাজা ভাঙ্গার সাথে সাথেই টের পেয়ে তিনি দৌড় দেন, কিন্তু বেশী দূর যেতে পারেননি তিনি। এ সময় তার উপর ছাদ ভেঙ্গে পরে। আধা ঘন্টার মাঝেই তাকে উদ্ধার করা হয়।
আগ্রহ বশতঃ জিজ্ঞেস করলাম, তাকে উদ্ধার করেছেন কারা, মনে আছে? কোন বিশেষ বাহিনীর পোশাক পরা কেউ? জানালেন ভিন্ন কিছু। না, তাকে উদ্ধার করেছে আমার আপনার মতোই সাধারণ কিছু মানুষ।
- ওয়ার্ড ১০২:
বেড নাম্বার নাম
৯ উজ্জ্বল
১০ মোঃ সেলিম
১১ সোহেল রানা
১৩ জুয়েল (মোজাম্মেল নামের একজন ছিলেন,
তিনি গতকাল সকালে মৃত্যুবরন করেছেন)
১৪ মোকতার
কথা হলো মোঃ সেলিমের সাথে। ভাত খাচ্ছিলেন বাবা’র হাতে। এ সময় এসে উপস্থিত হয় এটিএন বাংলার ক্যামেরা। অভ্যাসবশত তাদের প্রথম প্রশ্ন ছিলো, কেমন আছেন। দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিলো, এখন আপনার অনুভূতি কি? সেলিম সাহেব খুবি বিরক্ত হয়েছিলেন, যদ্দুর বুঝতে পারলাম। ক্যামেরা ম্যান ও সাংবাদিক সাহেব যাবার পরে আমরা তার সাথে কথা বলবার ইচ্ছা পোষন করলাম। তিনি সাগ্রহেই কথা বলতে চাইলেন। পায়ে ব্যথা ও কিডনীতে সমস্যায় ভুগছেন তিনি। গত ৩ দিন তার ডায়ালাইসিস করা হয়েছে, আমরা আসার সময় তাকে আবার ডায়ালাইসিস করাতে নিয়ে যাওয়া হলো। তার থেকে জানতে পারলাম, তিনি ৬ তলায় ছিলেন। বিল্ডিং ভেঙ্গে পড়বার সময় তিনি দৌড়ে সিড়ির দিকে যাবার চেষ্টা করেন। কিন্তু ছাদের বড় অংশ ভেঙ্গে তার উপর পরে। সেদিনই বিকেল ৪টায় তাকে “সাধারণ মানুষ/ civilian” জন উদ্ধার করেন।
- ওয়ার্ড ১০৩:
বেড নাম্বার নাম
১ আমজাদ হোসেন
৪ মোঃ রফিকুল ইসলাম (বয়স ২৯)
কথা হলো, মোঃ রফিকুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি মাথায় প্রচন্ড ব্যথা পেয়েছেন। উনার অভিজ্ঞতা ছিলো ভয়াবহ। ৭ তলায় তিনি লাইন চালাতেন, তার সাথে আরও ৫৪-৫৬ জন কাজ করতেন। যখন বিল্ডিং ভেঙ্গে পরা শুরু হয়, তিনি দৌড়ে বের হবার চেষ্টা করেন, এ সময় তার উপর ছাদ ভেঙ্গে পরে। ভয়াবহ ব্যাপার হলো, এ সময় তার পায়ের নিচের মেঝেও ভেঙ্গে পরে এবং তার কোমড়ের অর্ধেক নিচে ঝুলন্ত ছিলো এবং বাকি অর্ধেক উপরে ভেঙ্গে যাওয়া ছাদের অংশে চাপা পরা ছিলো। উনার ভাষ্য অনুযায়ী, শুধু চোখ দুটো অক্ষত থাকায় উনি ভালো করে লক্ষ্য করেন এবং আস্তে আস্তে টেনে টেনে গায়ের উপর থেকে ইট পাথর টেনে টেনে সড়ান।
সবচেয়ে আশ্চর্য হলাম, যখন তাকে জিজ্ঞেস করলাম আপনাকে কে উদ্ধার করেছে। তিনি উত্তর দিলেন, “কেউ না” ! তিনি সম্পুর্ন নিজ চেষ্টায় বের হয়েছেন। তার সারে গায়ে ইট পাথর টেনে সড়ানোর আচড়ের দাগ। তাকে সাহস দিতে চাইলাম, উপলব্ধি করলাম, তার যথেষ্ট সাহস। আমার কিংবা আমাদের উচিত তার থেকে কিছুটা সাহস নিয়ে আসা।
- ওয়ার্ড ২০৪:
বেড নাম্বার বয়স নাম
০২ ২২ আঙ্গুরি
০৩ ১৮ শিউলী
০৪ ২৫ লাবনী
আইসিইউ জানা যায়নি স্বপ্না
- ওয়ার্ড ২০৬ (ফিমেল ওয়ার্ড):
বেড নাম্বার বয়স নাম
OR-৪ ২৫ শিরীন
OR-৫ ১৮ শিমা
OR-৬ ৩২ রুপালী
OR-৭ ৩০ রোজিনা
OR-৮ ২০ শিউলি
৭ ২১ শিল্পী
৮ ২৫ শিরিনা
১১ ৩৮ আক্তার বানু
১৮ ২০ শিল্পি
১৯ ২০ রেহানা
২০ ২২ রিক্তমনি
২১ ৪৮ মমতা
২২ ২৫ রোজিনা
২৩ ২২ জিয়াসমিন
২৪ ২৫ রহিমা
২৫ ১৫ এয়ারুল
২৬ ২১ তাসলিমা
২৭ ২৪ স্বর্না
২৮ ১৫ রিনা
B-X-1 ২০ সিমা আক্তার
কথা বললাম, ১৫ বছর বয়েসী রিনা’র সঙ্গে। ওরা তিন বোন। ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহন করেছিলো রিনা। এরপর আর পড়াশোনা করেনি। কাজ করতে এসে যোগ দেয় গার্মেন্টসে। বাড়ি রংপুর। রিনা’র মাথায় ব্যথা আর হাতে প্রচন্ড ব্যথা, ফুলে গিয়েছে অনেকখানি (head injury, Lt. 5th metacarpal), রিনারও কিডনীতে সমস্যা হচ্ছে, তাকে ডায়ালাইসিস করানোর কথা আজকে।
কথা বলে জানতে পারলাম, রিনা ৭ তলায় লাইন টানার কাজ করতো। যখন বিল্ডিং ভাঙ্গা শুরু হয়, সে সিড়ি দিয়ে নামতে চেষ্টা করে। কিন্তু এ সময় সিড়িই ভেঙ্গে পরে। সে ৭ ও ৬ তলার মাঝামাঝি এসে আটকে যায়। রিনা আল্লাহকে ধন্যবাদ জানায়, তার ঠিক কয়েক ইঞ্চি পাশেই একটা বড় পিলার ভেঙ্গে পরে, হয়তো আরেকটু হলেই সে মারা যেতো, রিনা জানালো। রিনা বলতেই থাকে, সে জানতো যে বিল্ডীং ভাঙ্গা, কিন্তু কেউ কাজে যেতে নিষেধ করে নাই। তাই সে গুরুত্ব দেয় নাই, সে ভেবেছিলো সবাইই যখন যাচ্ছে, সে যাবে। ইটের নিচে চাপা পরেছিলো রিনা, ইট ভেঙ্গে জায়গা করে তাকে বের করা হয়। ইট ভাঙ্গার সময় তার হাতে ও মাথায় আঘাত পায়। রিনাকে উদ্ধার করা হয় সন্ধ্যা ৭টার পরে।
রিনা বার বার জিজ্ঞেস করছিলো, তার এই মুখের দাগগুলো যাবে কি না। আমি আশ্বস্ত করলাম, অবশ্যই যাবে ! ১০০ বার যাবে! সে তাও খুব খুত খুত করছিলো, জানালাম এই যে আমার মুখে কতো দাগ দেখেছো? এইগুলাও থাকবে না। এখানে খুব ভালো স্কিন বিশেষজ্ঞ আছেন। আমি তোমাকে কালকেই উনাদের কাছে নিয়ে যাবো। সে বেশ আস্বস্ত হলো বলে মনে হলো। সরল মেয়েটার জন্য অন্যরকম একটা মন খারাপ লাগা শুরু হলো। আমি এই কষ্টের সংজ্ঞা জানি না, আমি মুর্খ।
অন্য সবার মতো রিনাকেও আগ্রহ বশতঃ জিজ্ঞেস করলাম, তাকে কারা উদ্ধার করেছে। রিনা জানালো, তাকে এক সেনাবাহিনীর লোক উদ্ধার করেছে। তাকে উদ্ধার করে সেনাবাহিনীর ওখানে, অর্থাৎ CMH এ নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর তাকে রক্ত দেয়া হয়। রাতে তাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসা হয়।সেই অফিসার তার স্ত্রীকে নিয়ে রিনাকে দেখতেও এসেছিলেন।
আরও কতো কতো রোগী ! সবার সাথে কথা বলার ইচ্ছে ছিলো, বেশীরভাগ রোগীই ঘুমিয়ে ছিলেন। এরপর মর্গে গেলাম। সে এক বিভিষীকা, সে এক অন্য আতংক ! মর্গে এর আগে বহু বহুবার গিয়েছি। কিন্তু এ কেমন গন্ধ ! আমার মস্তিষ্ক এই গন্ধ চেনে না। আমি ছিটকে বের হয়ে গেলাম। আবার দম আটকে গেলাম ভেতরে, দম শেষ হতেই আমি দম নিতে পারলাম না। দৌড় দিয়ে বের হয়ে এলাম। এ গন্ধের পরিচয় আমি আমার জীবনে পাইনি। গলিত পঁচিত লাশ আর লাশ। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এইসব লাশের এই অবস্থা কেনো ! নষ্ট হয়ে যাচ্ছে সব লাশ, সংরক্ষন করা হচ্ছে না কেনো ! আশা যা করেছিলাম, উত্তর তাই পেলাম। সরকার এতোই গরীব কিংবা “নিরুতসাহী”, যে ফরমালীন কেনার টাকাটাও দেয়নি।
আজকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত প্রাপ্ত লাশ ছিলো ২৯টি। এর মধ্যে হস্তান্তর হয়েছে ৪টি।
১) মোঃ সোরাব আলী। থানাঃ পার্বতীপুর। জেলাঃ দিনাজপুর
২) মোঃ নাসিম উদ্দিন, থানাঃ বদরগঞ্জ, জেলাঃ রংপুর
৩) নাজনিন আক্তার বৃষ্টি (বয়স-১৮), থানাঃ মোল্লাহাট। জেলাঃ বাগেরহাট
৪) জুলেখা (বয়স ৩৫), বাড়ি নং-৪৭, আরুয়াপাড়া, সদর, কুষ্টিয়া
বিদায় নেবার সময় সবাইকে আশ্বাস দিয়ে এসেছিলাম যে, আপনাদের পুনর্বাসনের জন্য, পরবর্তীতে চিকিতসার জন্য আমরা কাজ করছি। সরকারের দেয়া প্রতিশ্রুতি যেনো বাস্তব হয়, আমরা সেদিকেও খেয়াল রাখবো, আপনারা আমাদের জন্য দোয়া করবেন। নিজেদের খেয়াল রাখবেন। আর মনে রাখবেন, আমরা আপনাদের পাশে আছি। সবাই বোধ হয় বিশ্বাস করলো, আমি ভাবতে লাগলাম, তাদেরকে এই দিয়ে আশা কথা কি আমরা ঠিকঠাক মতো পালন করতে পারবো? পারবো, ৪০০টি প্রান, স্বজন হারানোর বেদনাকে সম্মান জানাতে হলে এই দিয়ে আসা কথা’র বাস্তবায়ন করতে হবেই। আমি করবোই।
(হাসপাতালে ঘুরবার সময়ে সার্বক্ষনিক সঙ্গী ছিলো আমার সাথে ঢাকা মেডিকেলে অধ্যনরত আসফার জাহান। ক্যামেরাটিও তার। মর্গে আমি গন্ধ সহ্য করতে পারি নি, মর্গের ছবিগুলোও তার তোলা। আসফারকে সাথে থাকবার জন্য ধন্যবাদ)
বিঃ দ্রঃ প্রতিটি রোগী ও রোগীর আত্মীয়র কাছে অনুমতি নিয়েই তাদের সাথে কথা বলা হয়েছে। ছবি তুলবার সময়েও অনুমতি সাপেক্ষে তোলা হয়েছে।
ইশ! গড় বয়স কত্ত কম!
তাজা কতগুলা প্রাণ 🙁
টেলিগ্রাফের নিউজ পড়ছিস না? বিবিসিতেও আসছে
পড়েছি। ডেভিড বার্গম্যান এর সম্পৃকততার জন্য গলা ছাড়ছি না। কয়েকটা দিন যাক।
যারা চলে গেছে তো গেছেই,
কিন্তু যারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে বেচে রইলেন। তাদেরকে পর্যাপ্ত সহযোগীতে না করা হলে যে কি বিভীষিকার মধ্যে জীবন কাটাতে হবে… আফসোস…
কার পাপের ফল ভোগ করছে এই নিরপরাধ নিরীহ মানুষগুলো?
যার যন্ত্রণা হয় শুধু সেই বোঝে, তবু যার যার সাধ্যমত পাশে আছি ইনশাআল্লাহ…খুব ভালো একটা কাজ করেছ ভাইয়া ওদের সাথে এইভাবে কথা বলে।