ছোট্টমনির বরকে নিয়ে তার বাবার চিঠি

[মনস্তাত্ত্বিক ড: কেলি ফ্লানাগানের এই লেখাটির অনুবাদ]

প্রিয় সোনামনি,

সেদিন তোমার মা আর আমি মিলে গুগলে একটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজছিলাম। প্রশ্নটা অর্ধেক লিখে শেষ করতে না করতেই গুগ্‌ল আমাদেরকে তার সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুসন্ধানগুলোর (মানে মানুষ যে প্রশ্নগুলো সবচেয়ে বেশি করে আর কি!) একটা তালিকা দেখালো। তালিকাতে সবার ওপরে কী ছিল জানো মামনি? “তাকে কীভাবে অনুরক্ত রাখা যায়”!

আমি তো দেখে অবাক! তড়িঘড়ি অসংখ্য প্রবন্ধের কয়েকটাতে চোখ বোলালাম, জানলাম – তার চোখে কেমন করে আবেদনময়ী হওয়া যায়, কখন তার হাতে ড্রিঙ্ক্‌স ধরিয়ে দিতে হবে আর কখন স্যান্ডউইচ, সে যে কত চৌকস আর তোমার চাইতে তার অবস্থান যে কত ওপরে সেটা তাকে কীভাবে জানান দিতে হবে…

খুব খুব রাগ হলো আমার।

শোনো ছোট্ট সোনা, তোমার প্রতি “তাকে অনুরক্ত রাখা, আগ্রহী রাখা” কখনোই তোমার কাজ নয়, কখনো ছিল না আর কোনদিন হবেও না।

আমার ছোট্ট সোনা, তোমার একমাত্র কাজ কী জানো? আত্মার গভীরের যেই অনড় জায়গাটিকে প্রত্যাখ্যান, হারানোর ব্যথা কিংবা অহঙ্কার কখনো ছুঁতে পারে না, সেখানে এই কথাটি জেনে রাখা যে তুমি আগ্রহ পাওয়ার যোগ্য। (সেই সাথে যদি এ-ও মনে রাখতে পারো যে অন্য সব মানুষও আগ্রহ পাওয়ার যোগ্য, তাহলে জীবনযুদ্ধে তোমার জয় কেউ ঠেকাতে পারবে না। তবে সেসব কথা আরেক চিঠিতে লিখবো।)

নিজের মূল্য এমন করে যদি তুমি বুঝতে পারো, তাহলে সবচেয়ে চমৎকার উপায়ে আকর্ষণীয়া হবে তুমি: এমন কোন ছেলেকে তুমি মুগ্ধ করবে যে একই সাথে আগ্রহী হতে সক্ষম আর যে তার সমস্ত আগ্রহ তোমার জন্য ঢেলে দিয়ে এক জীবন কাটিয়ে দিতে পারবে।

ছোট্ট সোনা! আমি তোমাকে এমন ছেলের কথা বলতে চাই যাকে তোমার আগ্রহী করতে হবে না, কারণ সে তো জানেই যে তুমি চমৎকার:

সে খাবার টেবিলে কনুই তুলে বসে কিনা তাতে আমার কিছু আসবে যাবে না – যদি সে দেখতে পায়, হাসলে তোমার নাকের কাছটা কেমন কুঁচকে ওঠে আর তারপর তাকিয়েই থাকে, তাকিয়েই থাকে…আর চোখ ফেরাতেই পারে না।

সে আমার সাথে একটুখানি গল্‌ফ খেলতে পারলো কি না পারলো তাতে আমার কিছু আসবে যাবে না – যতদিন তাকে তোমার উপহার দেয়া সন্তানদের সাথে সে খেলতে পারে আর তাদের সাথে তোমার দোষ-গুণের কত যে মিল তা নিয়ে গর্ব করে।

সে মানিব্যাগের কথামত চলে কিনা তাতে আমার কিছু যাবে আসবে না – যতদিন সে হৃদয়ের কথা শুনে চলবে, যে হৃদয় তাকে বার বার তোমার কাছেই ফিরিয়ে আনবে।

সে শক্তিশালী কিনা তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই – যতদিন সে তোমাকে তোমার হৃদয়ের শক্তি ব্যবহারের জন্য দরকারি জায়গাটুকু দেবে।

সে নির্বাচনে কাকে ভোট দেয় তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই – যদি সে প্রতি সকালে ঘুম ভেঙে জেগে তোমাকে তোমার সংসারে একটা সম্মানের জায়গায় আর নিজের হৃদয়ে ভালোবাসার সিংহাসনে বসায়।

তার গায়ের রঙে আমার কিচ্ছুটি আসে যায় না মামনি – যতদিন সে তোমাদের মিলিত জীবনের ক্যানভাসকে ধৈর্য, ত্যাগ, নির্ভরতা আর কোমলতার রঙে রাঙিয়ে দেয়।

সে কোন্‌ ধর্মে বিশ্বাসী হয়ে বেড়ে উঠেছে কিংবা আদৌ কোন ধর্মে বিশ্বাসী কিনা তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই – যদি তাকে পবিত্রতার মূল্য শিখিয়ে গড়ে তোলা হয় আর তোমার সাথে তার জীবনের প্রতিটি মূহুর্ত, আবারো বলছি প্রতিটি মূহুর্ত যে কী গভীর পবিত্র তা যদি সে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে।

আর ছোট্ট সোনা, অমন কারো সাথে যদি তোমার কোনদিন দেখা হয়ে যায় আর তার সাথে যদি আমার বিন্দুমাত্র মিলও না থাকে, তবু আমাদের সবচেয়ে জরুরি ব্যাপারটাই কিন্তু মিলে যাবে:

সে হলে তুমি

কারণ দিনের শেষে, ছোট্ট মামনি, তোমার প্রতি “তাকে আগ্রহী রাখতে” যেই একমাত্র কাজটি তোমাকে করতে হবে, তা হল ঠিক তোমার নিজের মতই থাকা

ইতি
তোমাতে চিরআগ্রহী পুরুষ
বাবা

লেখকের উৎসর্গ: এই লেখাটি অবশ্যই আমার মেয়ে, আমার ছোট্টমনিকে উৎসর্গ করলাম। সেই সাথে আরো কিছু মানুষের কথা বলতে চাই।
এটা উৎসর্গ করলাম আমার স্ত্রীকে, যে সবসময় নিজের আত্মমর্যাদা ধরে রেখেছে, আর আমাকে ঠিক ঐ রকমের ‘ছেলেটি’ হতে উৎসাহ যুগিয়েছে।
উৎসর্গ করলাম আমার সাথে থেরাপি অফিসের ভেতরে আর বাইরে দেখা হওয়া প্রতিটি নারীকে, যারা কোনদিনও একজন বাবার মুখ থেকে এই কথাগুলো শোনে নি।
এটা আমি লিখেছি ছেলে-থেকে-পুরুষ-হতে-যাওয়া পুরো প্রজন্মের জন্য, যাদেরকে সবচেয়ে জরুরি ব্যাপারটি মনে করিয়ে দেয়া প্রয়োজন – আমার মেয়ে যেন একজন প্রেমময়, চিরজীবনের সঙ্গী পায় সে জন্য তোমাদের একজনকে হলেও এ সত্যকে বুঝতে হবে, জানতে হবে। আমি তোমাদের জন্য প্রার্থনা করছি।

অনুবাদকের উৎসর্গ: আমাতে চিরআগ্রহী পুরুষকে

সামিরা সম্পর্কে

পীচ-গলা তরলে আটকে পা, দুঃস্বপ্ন অন্ধ দুই চোখে/ অসতর্ক হৃদয় পোষ মানে মিথ্যে বলার আফসোসে.../// প্রকাশিত লেখার কপিরাইট সংশ্লিষ্ট লেখক সংরক্ষণ করেন এবং লেখকের অনুমতি ছাড়া লেখা আংশিক বা পূর্ণভাবে কোন মিডিয়ায় পুন:প্রকাশ করা যাবে না।
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে অনুপ্রেরণা, অনুবাদ, চিন্তাভাবনা, সচেতনতা-এ এবং ট্যাগ হয়েছে , , , , , , স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

40 Responses to ছোট্টমনির বরকে নিয়ে তার বাবার চিঠি

  1. বোহেমিয়ান বলেছেনঃ

    LOVED every BIT of it.
    প্রিয়তে।

    একজন সাইকোলজিস্ট এর লেখা। কী অদ্ভুত সুন্দর!

  2. হাসান বলেছেনঃ

    “ইতি
    তোমাতে চিরআগ্রহী পুরুষ
    বাবা”

    চমৎকার…

  3. খেয়ালী কিশোর বলেছেনঃ

    কী চমৎকার কথামালা! ভালো লাগলো লেখাটা পড়ে 🙂
    অনুবাদ বরাবরের মতোই দুর্দান্ত!

  4. মাধবীলতা বলেছেনঃ

    ইইইইইইই…এত সুন্দর এত সুন্দর কেন ?? দেয়ালে বাঁধিয়ে রাখার মত !! দেশি-বিদেশিদের সবসময় ঐ গুগলের মোস্ট সার্চড প্রশ্নগুলোর মত আচরণ করতে দেখে হাঁপিয়ে যাই। দেশিদের মধ্যে তো চেনা অনেকেই আছে, তবে বিদেশিদের মাঝে এইরকম চিন্তার এক-দুইজন ছাড়া কাউকেই আমি দেখি না এখানে !! বরং ওরা মাঝে মাঝেই অবাক প্রশ্ন করে, একজনের সাথেই তোমরা কেমনে থাকো এইভাবে ?

    খুব ভালো লাগে, এইরকম আলোকিত মনের লোকজনকে…

    • সামিরা বলেছেনঃ

      বিদেশিদের মধ্যে এইরকম চিন্তার মানুষ যে আছে সেটা কিন্তু আমরা অনেকে ভাবতেই পারি না, যেখানে আমাদের দেশেই এখন বিলুপ্তপ্রায়। একদম অন্যরকম একটা চারপাশে বাস করেই কীভাবে এমন চিন্তা করতে পারেন ভাবতেই চমক লাগে। আর সে কী ভাবনা!

      কিছুদিন আগে স্টিফেন কিং-এর ‘অন রাইটিং’ পড়েছি, পড়লে আপনি অবাক হয়ে যাবেন। আমাদের স্টেরিওটাইপ্‌ড ওয়েস্টার্ন বিশ্বের কারো চিন্তাধারা যে এতটা মনোগ্যামাস হতে পারে আর কেউ যে চল্লিশ বছর একসাথে কাটিয়ে দেয়া স্ত্রীকে এতটা ভালোবাসতে পারেন সেটা আমি না পড়লে জানতামই না। রীতিমত মুগ্ধ এখনো।

      • মাধবীলতা বলেছেনঃ

        হ্যাঁ আসলেই অবাক করার মত। তবে মনোগ্যামাস চিন্তা যে বিলুপ্ত হয় নাই এটাই আনন্দের বিষয়…

        প্রিয়তে নিয়ে নিলাম। 🙂

  5. দারাশিকো বলেছেনঃ

    লাস্টের লাইনটাই বেশী জোছ্ লাগছে 🙂 🙂

  6. দেশ ও জাতির সকল নারীর হাতে এই লেখার প্রিন্ট কপি পৌছিয়ে দেওয়া হোক!তারা আসলেই হীরা চিনে না

  7. শারমিন বলেছেনঃ

    দারুণ
    :love:

  8. তুসিন বলেছেনঃ

    লাইন গুলো বড্ড বেশি সুন্দর 🙂 :love:

  9. কৃষ্ণচূড়া বলেছেনঃ

    সামিরা, অনেক অনেক ধন্যবাদ!
    দারুণ!
    বাপ্পির মত আমারও মনে অনুভূতি loved every bit of it 😀

  10. ঝরা পালক বলেছেনঃ

    “আর ছোট্ট সোনা, অমন কারো সাথে যদি তোমার কোনদিন দেখা হয়ে যায় আর তার সাথে যদি আমার বিন্দুমাত্র মিলও না থাকে, তবু আমাদের সবচেয়ে জরুরি ব্যাপারটাই কিন্তু মিলে যাবে:

    সে হলে তুমি

    কারণ দিনের শেষে, ছোট্ট মামনি, তোমার প্রতি “তাকে আগ্রহী রাখতে” যেই একমাত্র কাজটি তোমাকে করতে হবে, তা হল ঠিক তোমার নিজের মতই থাকা।”
    …….অনুবাদ বরাবরের মতই প্রানবন্ত. ভালো লেগেছে আপু :love:

  11. একুয়া রেজিয়া বলেছেনঃ

    অসাধারণ লাগলো।
    মুগ্ধ মুগ্ধ মুগ্ধ…

  12. Aiman Hamid বলেছেনঃ

    অসাধারণ
    অনুবাদের এসেন্স চমৎকার হয়েছে মাশাল্লাহ

  13. Dr. Kelly Flanagan
    যখনে খসখস করে লিখছিলেন তখন
    আকাশটাও ভালো ছিল
    বাতাসটাও ভালো ছিল

  14. আরাফ করিম বলেছেনঃ

    অসাধারন, শুভকামনা আপনার জন্য ।

  15. অনাবিল বলেছেনঃ

    :happy:

    মূল লিখাটা আগে পড়েছিলাম…… :happy:

  16. তুমি এই লেখাটাই আরেকবার লিখিও তোমার নিজের মত করে। দেখবা আরো সাবলীল হয়েছে। অনুবাদ করতে গেলে একটা অসুবিধা হয় যে মাথার উপর সবসময় মূল স্ক্রিপ্টটা ভর করে। অনুবাদক তখন পরাধীন হয়ে যায়। অনুবাদকের চ্যালেঞ্জ হলো এই পরাধীনতা থেকে নিজেকে মুক্ত করা। সে কতটুকু স্বাধীন হতে পারল এর উপর নির্ভর করে তার অনুবাদের সার্থকতা। অনুবাদকের আরেকটা বড় চ্যালেঞ্জ হলো নিজের ভাষায় মানবীয় অনুভূতিগুলোকে কিভাবে প্রকাশ করা হয় সে বিষয়ে সম্যক ধারণা থাকা।

    মাসরুর আরেফিন নামের এক অনুবাদক ফ্রানৎস কাফকার গল্পগুলো অনুবাদ করার জন্য সেই গল্প মূল জার্মান ভাষায় পড়েছেন। পাঁচ ছয়টি ইংরেজি অনুবাদ পড়েছেন। জার্মানিতে কাফকা যেখানে ছিলেন সেই জায়গাটা ঘুরে এসেছেন। তার অন্যান্য সব লেখা পড়ে ফেলছেন। শুধু তাকে, তার চিন্তা, তার কথাগুলোর মর্মটুকু বোঝার জন্য ।অনুবাদে অনেস্ট থাকার জন্য ।তারপর অনুবাদে হাত দিয়েছেন। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় নিজে কিছু সৃষ্টি করার চেয়ে অনুবাদ করা সহজতর। কিন্তু অনুবাদও সৃষ্টিশীল কাজ। অনেক পরিশ্রমের কাজ । এটা আমার থেকে তুমি ভালো জানো। তোমার পরিশ্রম সার্থক হোক।

    স্ক্রিপ্ট সিলেকশন বরাবরের মতই চমৎকার। কিছু জায়গায় খটকা লেগেছে, কিছু জায়গায় অস্বস্তি লেগেছে, কিছু জায়গায় ভালো লেগেছে। ক্যারি অন।

    • সামিরা বলেছেনঃ

      অনেক ধন্যবাদ গঠনমূলক সমালোচনার জন্য। প্রতিটা বাক্যের সাথে পুরোপুরি একমত। সার্থক অনুবাদ আসলেই খুব পরিশ্রমের কাজ।

  17. নূহা চৌধুরী বলেছেনঃ

    কি চমৎকার প্রতিটা বাক্য ! :love:

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।