সুখ (গল্প)

তাসফিয়ার মুখে বাবা ডাক শোনা হয়নি মাসখানেক হবে ।আধো মুখে যখন ও বাবা বাবা করে , কি মধুরই না লাগে সেই ডাকটি ।।হাত ধরলে দু এক পা ফেলে হাঁটতে পারে ।এই একমাসে বোধহয় সে অনেক বড় হয়ে গেছে ।এখন হয়ত নিজে নিজে হাটাও শিখে গেছে ।গুটি গুটি পায়ে হয়ত বাবাকে খুঁজছে । আচ্ছা, ও কি সত্যিই বাবাকে খুঁজতে পারে? ওর কি বাবার কথা মনে আছে ।নাকি ভুলে গেছে ওর মায়ের মত,কে জানে?

তাসফিয়া আমার একমাত্র মেয়ে।বয়স দেড় বছর হবে ।ও থাকে ওর মায়ের সাথে নানুবাড়িতে।ওর মা মাস খানেক আগে আমার সাথে ঝগড়া করে ওর বাবার বাড়ি চলে গেছে ।ওরা চলে যাওয়ার পর বাড়িটা কেমন জানি খা খা করে! এ কদিনে ঘর দুয়োর পুরো এলোমেলো হয়ে গেছে ।জানালার কাঁচের উপর পুরো ময়লার আস্তরন পড়েছে । বিছানাপত্র এলোমেলো পরে আছে ।ময়লা কাপর গুলো যেন ধুলোই লুটিপুটি খাচ্ছে। কারো শাসনের অভাব যেন সেগুলোকে আশকারা দিয়েই যাচ্ছে। বেল্কনির টবের গোলাপগাছগুল মনে হয় মরে গেছে ।পানি দেওয়া হয়না বহুদিন।রাত্রি থাকলে নিয়ম করে পানি দিতো । গোলাপ ও খুবই পছন্দ করে ।আমি জানি ,রাত্রি এসে এমনটা দেখলে ভীষণ রাগ করবে ।

ইদানিং শরিরটা প্রচণ্ড খারাপ যাচ্ছে ।ডাক্তার বলেছেন ,লিভার নাকি অসম্ভব রকম বড় হয়ে গেছে ।দিন দিন ক্রমেই হলুদ হয়ে যাচ্ছি ।ঘুম একদম হয় না ।প্রতিদিনই মাঝ রাত্তিরে ঘুম ভেঙ্গে যায়।তারপর আর ঘুম আসে না ।সবসময় খুব টেনশন লাগে ।খেতে ইচ্ছা করে না ।অফিসেও ঠিকমত কাজ করতে পারছি না ।কদিন আগেই বস বড় একটা আসাইনমেণ্ট দিয়েছেন ।সেটা একেবারেই করতে মন বসছে না।অথচ সেটা জমা দেয়ার আর সময় বেশি নাই।যে কদিন সময় আছে এর মধ্যে শেষ করা অসম্ভব।বিছানায় শুয়ে থাকা ছাড়া কিছুই করতে পারছি না ।খুব অসহায় বোধ হয় সবসময় । তবে একটা বিষয় ভেবে এখন খুব অবাক লাগছে ।আগে ভাবতাম,বাসায় সবাই থাকলে একদম কাজ করা যায় না ।আমার খুবই ডিস্টার্ব মনে হতো হয় কাজে ।কিন্ত এখন দেখছি পুরো ব্যাপারটা উল্টা ।সমস্ত পৃথিবী আমার কাছ এখন বিবর্ণ । আগের সেই সময়টায় বোধহয় ভালো ছিল ।শুয়ে একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলি আমি ।

রাত্রির সাথে অনেক বড় অন্যায় করেছি -এই সত্যটা বুঝতে আমার খুব বেশিদিন সময় লাগে নি ।কিন্ত বড্ড দেরি হয়ে গেছিল বোধহয় ।যখন আর কিছুই করার ছিল না ।ওর চাওয়া তো এমন বিশেষ কিছু ছিল না।পরিবারে একটু সময় পেলেই ও অনেক খুশি ছিল ।এই সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে ওর সাথে সেদিন এমন রাগারাগি না করলেও তো পারতাম।আসলেই তো টাকা পয়সার বেশি দরকার নেই জীবনে,দরকার শান্তির। দরকার মিলেমিশে-হাসিমুখে থাকার । প্রথমদিকে পালিয়ে বিয়ে করার পর শহর থেকে বহুদুরে খুপড়ির মত একরুমের ছোট্ট একটা সংসার পেতেছি্লাম, তখন কি ভালবাসাময় জীবন ছিল আমাদের । অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী ।একবেলার খাবার দুবেলা দুজনে ভাগ করে খেতাম তবু তখন তো বেশ ছিলাম আমরা।আর এখন আলিসান ফ্ল্যাটে থাকি। অভাব আমাদের ছেড়ে পালিয়েছে বহুদিন হয়েছে ।সম্মান হয়েছে ,বিত্তও হয়েছে প্রচুর ।কিন্ত যে জিনিসটা হারিয়েছে সেটা হল সুখ ।টাকার নেশায় একরকম অন্ধই হয়ে গিয়েছিলাম বোধহয় ।রাত দিন কাজ নিয়েই মেতে ছিলাম।রাতে অফিস থেকে ফিরে এসে দেখতাম মেয়েটি অপেক্ষা করতে করতে ডাইনিং টেবিলেই ঘুমিয়ে আছে ।পরদিন আবার অফিস । ব্যস্ততার জন্য ঠিকমত কথা পর্যন্ত হত না ওর সাথে ।এভাবেই চলছিল আমাদের জীবন ।প্রথম প্রথম এই জিনিসটা রাত্রি মেনে নিলেও পরে আর মানতে চাইত না ।এই কারনেই মাসখানেক আগে আমাদের দুজনার মধ্যে একচোট ঝগড়া হয়ে যায় ।ফলাফল রাগ করে ও ওর বাবার বাড়ি চলে গেল ।আমি সে সময় তাদের অনেক আটকাতে চেষ্টা করেছি ।কিন্ত সে আমার কোন কথাই শোনে নি ।এর কয়েকদিন পরে আমি আবার ওদের বাড়িতে গিয়েছিলাম ।কিন্ত সে ফেরেনি ।

বেশ কিছুদিন পরের ঘটনা ।

আমি সম্ভবত ঘুমিয়ে ছিলাম ।কিন্ত একি আমার খাট এরকম কেন?চারপাশে তাকাই । না এটা আমার বাড়ি বলে তো মনে হচ্ছে না ।স্যালাইন স্ট্যান্ড আর হাতে লাগানো কানুলা দেখে নিশ্চিত হলাম ,আমি হাসপাতালে আছি ।কিন্ত কেন?আমার নড়াচড়া দেখে একজন নার্স এগিয়ে আসছে ।নার্সের পেছনে দেখি গুটি গুটি পায়ে হেটে আসছে আমার মেয়ে ,তাসফিয়া ।ওর মায়ের হাত ধরে আছে সে ।আমি রাত্রির দিকে তাকাই ।বেচারির চোখ ফোলা ফোলা ।মনে হয় কেঁদেছে প্রচুর।ধীর পদক্ষেপে ও আমার পাশে এসে বসলো ।এরপর আমার হাত টা শক্ত করে ধরে সে বলতে লাগল ,তুমি এমন করো কেন সবসময় ?তোমার কিছু হলে আমার কি হবে?তাসফিয়ার কি হবে?তুমি হয়ত আমাদের ভালোবাসো না , কিন্ত আমরা তো তোমায় ভালবাসি ।তাসফিয়ার মাথায় হাত রেখে বল,এভাবে তুমি কখনও হারাবে না,বল?আমি ওর হাতটি মুঠোর মধ্য এনে শক্ত করে ধরে বলি, আমি খুব সরি ।খুব খুব ।আমায় আর একটি বারের মত সুযোগ দেয়া যায় না ? হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে মৃদু হেসে সে বলে,দেয়া যায় ।তবে এর জন্য তোমাকে তাড়াতাড়ি সেরে উঠতে হবে ।বাসায় চল। এরপর আমরা মা মেয়ে দুজনে মিলে তোমাকে আরও বেশি করে জ্বালাতন করবো ।বলেই সে কি হাসি । আমি মনে মনে ভাবি,আহ! জীবনটা এতো সুন্দর কেন? আমার আরও অনেকদিন বাঁচতে হবে ।কারন এতো ভালবাসা ছেড়ে হারিয়ে যাওয়াটা একদম ঠিক হবে না।হওয়া উচিত নয় ।

শুকপাখি সম্পর্কে

নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করার অভিপ্রায় বুকে লালন করি সবসময়ই।তাই হয়ত নিরানন্দ মেডিকেল লাইফের বাইরের জগত সম্পর্কে আমার জানার আগ্রহে কমতি নেই,বরং বোধহয় একটু বেশিই।জানতে, জানাতেই লেখার চেষ্টা করি।লেখা সুখপাঠ্য হয় কিনা জানি না,না হলে না হোক;নিজের আনন্দ লাভের এ উপলক্ষ ছাড়তে চাই না কখনই।
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে গল্প, বিবিধ-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

10 Responses to সুখ (গল্প)

  1. শারমিন বলেছেনঃ

    সুন্দর গল্প 🙂

  2. মাধবীলতা বলেছেনঃ

    কিছু মানুষ টাকা, ক্যারিয়ার, ফেইমের জন্য কী অবলীলায় সম্পর্ককে ফেলে দেয় তা চিন্তা করে পাই না। যেটুকু বুঝতে পারি, এরা জীবনে ঐ জিনিসগুলো সবই হয়তো পায় কিন্তু ভেতরে ভেতরে কোনদিনও সুখী হতে পারে না, অন্যের মনে কষ্ট দিয়ে তা হবার কথাও নয়। শেষমেষ যদি বোধোদয় হয় গল্পের মত করে তাহলে তো ভালোই, তবে বাস্তব তো তিক্ত।

    বেশ ভালো লেগেছে জীবনমুখী এই গল্পটা…

  3. হাসান বলেছেনঃ

    ভালো লাগলো গল্পটা…..

    জীবন সত্যি অনেক সুন্দর, তবে এই সৌন্দর্যটাকে খুঁজে নিতে হয়…

  4. অনাবিল বলেছেনঃ

    গল্পটা সুন্দর হয়েছে।।কিন্তু গল্পের ‘আমি’ টাইপের মানুষদের উপর প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হয়…খুব কম-ই সত্যিকারের বোধদয় হয় এদের………

  5. হৃদয় বলেছেনঃ

    ‘কারন এতো ভালবাসা ছেড়ে হারিয়ে যাওয়াটা একদম ঠিক হবে না। হওয়া উচিত নয়’
    বেশ ভাল লেগেছে 🙂

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।