চিরঅনির্বাণ বহ্নিশিখারা (২)

বাংলাদেশের ইতিহাসে বিভিন্ন স্বাধীনতা সংগ্রামে সরাসরি অংশ নেয়া নারীদের মাঝে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারকে আমরা সবাই চিনি। সূর্যসেনের সাথে চট্টগ্রাম দখলের সেই ঘটনা সবারই জানা। আবার ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বীর প্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত তারামন বিবি আর লাখো বীরাঙ্গনার স্মৃতি এখনও দগদগে। তবে একাত্তরে নারী যোদ্ধাদের নিয়ে আরেকটা রিসার্চ করার বাসনা আছে, সেই প্রসংগ আপাতত তোলা থাক। এই ব্লগপোস্টটি আমি লেখা শুরু করেছিলাম মূলত তাদের নিয়ে কিছু কথা বলার জন্য, যাদের সম্পর্কে আমাদের খুব একটা জানাশোনা নেই। ব্রিটিশ শাসনামলের নারী বিপ্লবীদের মধ্যে লীলা নাগ, ইলা মিত্র, হেনা দাস এমনই কয়েকটি নাম।

 

লীলা নাগ

লীলা নাগের জন্ম আসামে। কলকাতার বেথুন কলেজ থেকে অত্যন্ত ভালো ফলাফল নিয়ে বি.এ. পাস করে একমাত্র নারী হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সে ভর্তি হন। শুধু নিজে শিক্ষাগ্রহণ করে থেমে থাকেন নি এই মহতী নারী, বরং সমাজে নারী শিক্ষার বিস্তারে তাঁর অসামান্য ভূমিকা ছিল। তিনি  বর্তমান আরমানীটোলা বালিকা বিদ্যালয়, কামরুন্নেসা গার্লস হাই স্কুল এবং শেরে বাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা। পড়াশোনা ছাড়াও খেলাধুলা, ছবি আঁকাসহ অন্যান্য সহপাঠ্যক্রমিক কর্মকাণ্ডেও তাঁর ছিল অনেক আগ্রহ। বিপ্লবী জীবনে তিনি ছিলেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর সহকারী। বড়লাটপত্নীকে নতজানু হয়ে কুর্নিশ করার বিরোধিতা করে একটি আন্দোলন গড়ে তোলেন। অনেকবার কারাবরণ করতে হয়েছে তাঁকে। কারাগারে অনশন করেছেন দিনের পর দিন কিন্তু অন্যায়ের সাথে আপোষ করেন নি। তিনি ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে প্রথম বিচারবহির্ভূত নারী কারাবন্দী। ১৯৩৭ সালে কারামুক্তি লাভের পর সিলেটে এক নারী সম্মেলনে তাঁকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও এ সময় তাঁকে একটি চিঠি লেখেন। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত লীলা নাগ সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ে সংগ্রাম করে গেছেন। ১৯৭০ সালে দেহত্যাগ করেন বাংলার এই মহিয়সী মেধাবী নারী।

এমনই আরেকজন মহিয়সী সংগ্রামী নারী ইলা মিত্র। ইলার জন্ম কলকাতায়, বেড়ে ওঠাও এখানেই। বেথুন স্কুল, বেথুন কলেজ ও পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ. পাস করেন। খেলাধুলায় ইনিও ছিলেন প্রচণ্ড পারদর্শী, এতটাই যে প্রথম বাঙালি মেয়ে হিসেবে অলিম্পিকের জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন রাজ্যের জুনিয়র এথলেটিক চ্যাম্পিয়ন। রমেন্দ্র মিত্র নামে এক জমিদারপুত্রের সাথে ইলা মিত্র বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এরপর থেকে তিনি তৎকালীন মালদহের রামচন্দ্রপুর হাটের জমিদারবাড়ি অর্থাৎ তাঁর শ্বশুরবাড়িতে থাকা শুরু করেন। সেখানে থাকাকালীন সময়ে নিরক্ষর মেয়েদেরকে একটি স্কুলে পড়ানোর সুযোগ হয় তাঁর। রক্ষণশীল হিন্দু জমিদারবাড়ির রীতিনীতি কিছুটা শিথিল করে এই কাজটি করতে তাঁর স্বামী সাহায্য করেন। ইলার চেষ্টায় অল্প কিছুদিনের মধ্যেই স্কুলের ছাত্রীসংখ্যা তিন থেকে পঞ্চাশে বৃদ্ধি পায়। এইভাবে সমাজসেবার মাঝে মাঝে তিনি সাধারণ কৃষকদের উপর জমিদার জোতদারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। কৃষক সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন। এই আন্দোলন ইতিহাসে “তেভাগা আন্দোলন” নামে পরিচিত। গ্রামে তাঁর জনদরদী এই কাজগুলোর জন্য সকলের ভালোবাসায় “রাণীমা” উপাধি পেয়েছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর ইলা মিত্র নোয়াখালীতে গিয়ে দাঙ্গা পরবর্তী পুনর্বাসনে কাজ শুরু করেন। দেশ বিভাগের পরেও কৃষকদের জন্য তাঁর সংগ্রাম অব্যাহত রাখেন এবং সরকারি কোপানলে পড়েন। ব্যাপক ধড়পাকড়, হত্যাযজ্ঞ শুরু হলে পরে ইলা মিত্র নাচোলের একটি গ্রামে স্বামীর সাথে আত্মগোপন করে থাকেন। কিন্তু তাঁর শেষ রক্ষা হয় নি। সাঁওতাল ছদ্মবেশে থেকে পালানোর চেষ্টা করার সময় তিনি গ্রেপ্তার হন। থানায় থানায় অমানসিক অত্যাচার ও ধর্ষণ ছিল নিয়মিত ব্যাপার। নারীদেরকে কাবু করার এই এক পথ বোধ হয় কোনদিনও থামবে না। কিন্তু তিনি বিচলিত হন নি, বরং কোর্টে সত্য সাক্ষ্য দিয়ে গেছেন। এক সময় প্যারোলে মুক্তি পান তিনি।

ইলা মিত্র

ইলা মিত্র অনুবাদক হিসেবে সাহিত্যকর্মেও অবদান রেখেছেন। কয়েকটি রাশিয়ান বই তিনি অনুবাদ করেন। ২০০২ সালে অন্যায়ের সাথে আপোষহীন এই নারী মৃত্যুবরণ করেন।

বাংলার জাগ্রত নারী সমাজের আরেক পথিকৃৎ হেনা দাস। তিনি সিলেটের এক সম্ভ্রান্ত শিক্ষিত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। সিলেটে স্কুল-কলেজ পেরিয়ে টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে বি.এড. পাস করেন। এরপরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। স্কুলজীবন থেকেই ব্রিটিশ শোষণবিরোধী বিভিন্ন আন্দোলন তাঁর উপর প্রভাব বিস্তার করেছিল। পড়াশোনা শেষ করে শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৯৩৮ সাল থেকে রাজনীতির সাথে যুক্ত হন। এরপর নানা সময়ে অন্যায় ও শোষণের বিরুদ্ধে রাজপথে ও কলমে  সোচ্চার ছিলেন।

হেনা দাস

অনেক প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করেছেন তিনি। অনেক সময়েই চাকরি ফেলে আত্মগোপন করে থাকতে হয়েছে। শিক্ষাদীক্ষায় অবদানের জন্য বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষা কমিশন “কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন” এর সদস্যপদ লাভ করেন।১৯৮৯ সালে তিনি অবসরে যান। এরপর ২০০০ সালে মহিলা পরিষদের সভানেত্রী হিসেবে নির্বাচিত হন। সম্মাননা হিসেবে আরও পেয়েছেন রোকেয়া পদক। ২০০৯ সালে এই জাগরুক নারী ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।

এভাবেই যুগে যুগে বাংলার নারীরা সমাজ সংস্কারে, অন্যায় ও শোষণের বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার। শিক্ষা-দীক্ষা, ত্যাগ-তিতিক্ষার জ্বলন্ত উদাহরণ এই মহিয়সীদের জন্ম যে ভূখণ্ডে সেই ভূখণ্ডের মেয়ে ও মহিলারা শিলা-মুন্নী-সোহানাদের দেহসর্বস্ব জোয়ারে কিংবা সিরিয়ালের অনন্ত চক্রে ভেসে যাবে এটা কোনদিনই কাম্য নয়। বাংলার প্রতিটি নারী নিজ মর্যাদা নিয়ে পরিবার ও সমাজে বহ্নিশিখার আলো হয়ে জেগে উঠুক।

তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া

 

মাধবীলতা সম্পর্কে

"অনিমেষ অবাক হয়ে দেখল মাধবীলতাকে । মাধবীলতা কোন রাজনীতি করেনি কখনও, শুধু তাকে ভালবেসে আলোকস্তম্ভের মত একা মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে । খরতপ্ত মধ্যাহ্নে যে এক গ্লাস শীতল জলের চেয়ে বেশি কিছু হতে চায় না । বাংলাদেশের এই মেয়ে যে কিনা শুধু ধূপের মত নিজেকে পোড়ায় আগামীকালকে সুন্দর করতে । দেশ গড়ার জন্যে বিপ্লবের নিষ্ফল হতাশায় ডুবে যেতে যেতে অনিমেষ আবিষ্কার করেছিল বিপ্লবের আরেক নাম মাধবীলতা ।" - সমরেশ মজুমদারের "কালবেলা" উপন্যাসের মুখবন্ধের অংশবিশেষ থেকে উদ্ধৃত এই কথাগুলো আমার খুব বেশি আপন । কোন এক অনিমেষের মাধবীলতা হতে পারাটা আসলেই বড় বেশি সৌভাগ্যের।
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে অনুপ্রেরণা, ইতিবাচক, ইতিহাস-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

4 Responses to চিরঅনির্বাণ বহ্নিশিখারা (২)

  1. হাসান বলেছেনঃ

    এত চমৎকার মানুষগুলো যে দেশে জন্মাতে পারে সেই দেশকে নিয়ে এগিয়ে যাবার স্বপ্ন দেখতেও আজকাল অনেকে ভয় পায়।

    আপু অনেক ধন্যবাদ মানুষগুলোর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য…

  2. শারমিন বলেছেনঃ

    বাংলার প্রতিটি নারী নিজ মর্যাদা নিয়ে পরিবার ও সমাজে বহ্নিশিখার আলো হয়ে জেগে উঠুক।এইটাই আমাদের কাম্য
    ভালো লেগেছে 😀 :love:

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।