শিক্ষক না ব্যবসায়ী ?

ছোট মামাতো ভাইটা ঢাকার এক নাম করা স্কুলে ক্লাস সিক্সে পড়ে। একই স্কুল থেকে আমিও নিজেও এস এস সি পাশ করেছিলাম ৭ বছর আগে। সে সময় ওই স্কুলের ছাত্র পরিচয় দিতে গর্ব হতো। কিছুদিন আগে এডমিশন টেস্টে এলাউড হয়ে ছোট ভাইটা যখন স্কুলের ক্লাস শুরু করলো, স্কুল ইউনিফর্মে ওকে দেখে কেন যেন ভীষণ ভালো লাগছিলো। সেই টুপি, সেই ইন-না করা শার্ট, সেই ডায়েরী … নস্টালজিক একটা সিচ্যুয়েশন আর কি !

ছোট বেলা থেকেই দেখেছি, আমার এই ভাইটা পড়াশোনার প্রতি অসম্ভব রকম আন্তরিক।পরীক্ষা আসলে তার দিন রাত এক হয়ে যায়। নিজেও জেগে থাকে, তার মাকেও জাগায় রাখে। যাইহোক, কিছুদিন আগে দেখলাম ওর এই দিবা-নিশি একাকার টাইপ পড়াশোনা চলতেছে। জিজ্ঞেস করে জানলাম, টিউটোরিয়াল এক্সাম নামের নয়া কিসিমের এক এক্সাম চালু হইছে স্কুলে, সেইটারই প্রিপারেশন।

যথারীতি পরীক্ষা শেষ হল, এবং স্ক্রুটিনির পর খাতা দেখতে দেয়া হল। সাবজেক্ট প্রতি ২০ মার্কের সেই মিনি-এক্সামে ছোট ভাইয়ের সেকশনে অনেক ছাত্রের কোন কোন সাবজেক্টে সর্বনিম্ন নাম্বার ১ ! কেউই কোন সাবজেক্টে পূর্ণমান পায়নাই, এমনকি ১৮ ও না ! বাংলা-ধর্ম-সমাজের কথা না হয় বাদই দিলাম, কিন্তু বিজ্ঞান / গণিত ? প্রশ্নের যে ধারা দেখলাম, তাতে তো এইগুলাতে উত্তর সঠিক হলে ফুল মার্ক্স দেয়া ছাড়া উপায় নাই !

তার ভাষায় এতো ভালো পরীক্ষা দিয়েও কোনটাতে ফুল মার্ক্স না পাওয়া কিম্বা কিছু সাবজেক্টে বিস্ময়কর কম মার্ক পাওয়ায় ছোট ভাইটার মন খারাপ দেখে নিজেরও মনটা খারাপ হয়ে গেলো। নিজের ভাই বলেই বলছি না, আমি খুব ভালো করেই জানি- ওর ভালো পরীক্ষা দেয়া মানে আসলেই সেটা অনেক ভালো পরীক্ষা হবার কথা। কিন্তু তারপরেও এই অবস্থা দেখে খারাপই লাগছিলো।কৌতূহল নিয়ে ওর পরীক্ষার খাতাগুলা উল্টাতে লাগলাম, এবং আরেকটা ধাক্কা খেলাম !

কোন ভুল নেই, নেই কোন লাল কালির দাগ, লম্বা-লম্বা রাইট, তারপরেও সমাজ-বিজ্ঞান-ফিজিক্যাল স্টাডিতে প্রায় প্রতিটা প্রশ্নের উত্তরে অর্ধেক নাম্বার দেয়া ! কি কারণ ? ২০ মিনিটের পরীক্ষায় ২০ মার্কের প্রশ্নের উত্তরে ক্লাস সিক্স পড়ুয়া একটা বাচ্চার থেকে এই শিক্ষকেরা কি শাহনামা কিম্বা লিও টলস্টয়ের অনবদ্য সাহিত্য আশা করে ? একটা প্রশ্নের উত্তর যেখানে বইতেই সুন্দর করে দেয়া, সেখানে সেই উত্তর গুছিয়ে নির্ভুল ভাবে হুবহু উত্তরপত্রে তুলে দেয়ার পরেও একটা ছাত্রকে অর্ধেক নাম্বার দেয়ার যুক্তি কি হতে পারে ? – “এর চাইতেও আরও ভালো কিছু হতে পারতো”- কেউ এই টাইপ বুলি আউরালে তার জন্যে নগদে ৫ অঙ্গুলির থ্যাবড়া বরাদ্দ দেয়া উচিৎ।

২০ মিনিটের পরীক্ষা, প্রশ্ন হয় ৪০ মার্ক সমতুল্য ; সেইখানে ওই বুলি স্রেফ শয়তানি যুক্তি। আসল কারণ- এই বাচ্চাগুলা তাদের কাছে প্রাইভেট পড়ে না, তাই এরা যত ভালোই লেখুক, কিচ্ছু যায় আসেনা।

স্যারদের কাছে প্রাইভেট পড়ার এই কালচার আমরাও পার করে আসছি। কিন্তু সেটা এতো নোংরা ছিলোনা। আমাদের শিক্ষকেরা ছিলেন পোড় খাওয়া ও অভিজ্ঞ। উত্তর সঠিক ও উপস্থাপন ভঙ্গি গোছালো হলে নম্বর দেয়ার ক্ষেত্রে তাঁরা কোন ছাত্র কোন স্যারের কাছে পড়ে- এইসব বাছবিচারে যেতেন না। আর এখনকার এই শিক্ষকেরা কি করছে ?   একটু খোঁচাখুঁচির পর ছোটভাইয়ের কাছ থেকে জানলাম, শিক্ষকদের দুর্নীতির অবস্থা এতই প্রকট যে অনেক শিক্ষক ক্লাসে এসে বোবা বনে থাকেন, আর প্রাইভেট পড়তে গেলে মুখে কইতরের খৈ ফোটে ! “শয়তানের বাচ্চা” “হারামজাদা” “কুত্তার বাচ্চা” প্রভৃতি গালি তাদের অনেকেরেই প্রিয় বুলি ! আমাদের সময় পড়া ঠিক মত পারলে, CT-CW ভালো দিলে যে কেউই ডায়েরীতে ৫ এ ৫ বা ৪.৫ সহজেই পেত। আর এখন সাবজেক্ট টিচারের কাছে না পড়লে কারোই এভারেজ মার্কিং ৩ এর উপরে ওঠে না ! অনেক শিক্ষক ক্লাসে এসে হুশিয়ারি দেন, যেন তার সাবজেক্ট অন্যকোন স্যারের কাছে কেউ পড়তে না যায়। স্কুলের পূর্বনির্ধারিত সিলেবাস, টপিকস সিক্যুয়াল ও বুক প্রেফারেন্স থাকলেও অনেক শিক্ষক আগে থেকে না বলে দিয়েই নিজের ইচ্ছে মতো একেক জায়গা বা ভিন্ন বই থেকে পড়াতে যান, ফলশ্রুতিতে  নির্ধারিত  বইটা শিক্ষার্থীদের কাছে থাকেনা প্রায়ই। ব্যাস ! ২৫ মিনিটের ক্লাসের ১৫ মিনিটই চলে যায় বই না আনার দরুন ধোলাইকরণ, ডায়েরীতে শূন্য (!) এবং সাধারণ মন্তব্য প্রদানে । ভাব দেখে মনে হচ্ছে, ছাত্রদেরকে ব্যাগে করে সবসময় সব কটা বই সাথে নিয়ে ঘুরতে হবে, স্যারদের যখন যেটা পড়াতে মন চাইবে, বের করে পড়া মেলাতে হবে !এক সময় যে “বিশেষ মন্তব্যের” ভয়ে ক্লাসের সব চাইতে বদমাইশ ছেলেটাও পর্যন্ত তটস্থ থাকতো, এখন তা এয়ারটেল ইনস্ট্যান্ট বোনাস ! কম বেশি প্রতিদিন সবাই-ই পায় !!

এক সময় যে স্কুলটা দেশের শীর্ষস্থানীয় স্কুল ছিল, এস এস সিতে ভিকারুন্নেসা-রাজউক-হলিক্রসের  সাথে যাদের তুমুল লড়াই হতো, সেই প্রতিষ্ঠানটি গত ৪ বছর ধরে পাতিলের তলায় পড়ে ছিল ! এবার অবশ্য সৌভাগ্যক্রমে আবার এক নম্বরে চলে এসেছে এই প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু পরের বছরেও এই স্থান ধরে রাখা সম্ভব হবে কিনা- কে জানে ! স্কুল সেকশন তাও যেমন-তেমন চলছে, মেয়েদের কলেজ সেকশনের দশা তো শুনি আরও করুন !  কলেজে পড়ুয়া কোন আপু এই লাইনটা দেখে মুখিয়ে ওঠার আগে একবার ভেবে দেখোতো, আশেপাশের নাম করা কলেজগুলোর তুলনায় কি পাচ্ছ তোমরা ?

এখন প্রশ্ন হল- স্বনামধন্য একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এই দৈন্য দশার কারণ কি ?
আগের চাইতে কি এখনকার পোলাপানদের মেধা কম ?
আগের চাইতে এখনকার পোলাপান অধিক পড়া-বিমুখ ??
নাকি তারা আগের আগের চাইতে অধিক ত্যাঁদড় বিশেষ ???

কোনটাই না।

বরং, সমস্যা সিস্টেমের গোড়াতে থাকা শিক্ষক নামের কিছু ধুরন্ধর ধান্ধাবাজের মাঝে।না, এইসব লোকদের শিক্ষক বলে  আর দশজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষককে অপমান করতে চাইনা।এইসব ধান্ধাবাজরা নিজেদের আখের গোছানর জন্যে অসংখ্য শিশুর পড়াশোনার স্পৃহা নষ্ট করে দিচ্ছে, দুর্বল করে দিচ্ছে ওদের ভবিষ্যতের ভীত ! তাদের নোট না পড়লে, এবং সেই অনুযায়ী না লিখলে ইচ্ছামত নাম্বার কাটার এই কালচার শিক্ষার্থীদের  নিয়মমাফিক পড়াশোনার প্রতি আন্তরিকতা গলা টিপে খুন করছে। সন্তানের রেজাল্ট ভালো করানোর আশায় সাবজেক্ট ওয়াইজ ভিন্ন ভিন্ন স্যারের কাছে সন্তানকে পড়াতে গিয়ে নাজেহাল হচ্ছেন অসহায় অভিভাবকরা ! যাদের আর্থিক সঙ্গতি কম, তাদের সন্তানদের দুরাবস্থার কথা সহজেই অনুমেয়। তবে ব্যাতিক্রমী কিছু মানুষ যে এখানে নেই, তা বলছি না। সৎ ও একনিষ্ঠ কিছু শিক্ষক-শিক্ষিকা  অবশ্যই আছেন, কিন্তু সেই সংখ্যাটা খুবই কম, হাতে গোনা। আগে ছিল ঠিক এর উল্টোটা !

প্রতিবার সরকার আসে, সরকার যায়। নতুন নতুন শিক্ষা মন্ত্রী আসেন, দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে দুর্নীতিমুক্ত ভাবে গড়ে-পিটে সাইজ করার প্রত্যয় নিয়ে। অথচ সেই মন্ত্রীর মন্ত্রণালয়ই আবার “সঠিক তত্ত্বাবধানের” জন্যে নামীদামী স্কুল গুলোর গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান করে স্থানীয় এমপি-সাংসদদের। ফলাফল শেয়ালের কাছে মুরগী বর্গা দেয়ার মতোই। সেই চেয়ারম্যান ও তাদের চ্যালা চামুণ্ডুরা বয়স-অভিজ্ঞতার বাছবিচার না করে  ইচ্ছা মতো চ্যাংড়া-ট্যাঙরা শিক্ষক নিয়োগ দেয়। আর এর ফলাফলও তো দেখতেই পাচ্ছি !

আমাদের সময়েও ক্লাসের বদ পোলাপানগুলা মজা করে অনেক শিক্ষকের “কোড নেইম” দিত, ধোলাই খেলে অথবা মন মত নাম্বার না পেলে সেই “কোড নেইম” ধরে শিক্ষকদের স্মরণ করাটা বেশ পুরনো ট্র্যাডিশন।কেন যেন তখন খুব একটা ভালো লাগতো না ব্যাপারটা।আবার  বেশির ভাগ শিক্ষক-শিক্ষিকাই এমন ছিলেন যে, চাইলেও তাঁদের নামে বাজে কিছু মুখে আসতো না ছাত্রদের। আন্তরিক শ্রদ্ধাবোধ এমনই একটা জিনিস !

আর এখন ?

ছোটভাইয়ের কাছে শুনলাম, বড় ক্লাসে পোলাপান তো আছেই,  ক্লাস ফাইভ-সিক্স-সেভেনের পিচ্চি-পাচ্চিরাও নাকি তাদের অনেক শিক্ষককেই “বাচ্চা” তুলে গালি দেয় পেছনে ! আশ্চর্য হলেও সত্যি, কেন যেন একটুও খারাপ লাগলো না ! বরং মনে হচ্ছে, এইসব শিক্ষা ব্যবসায়ীদের এটাই প্রাপ্য !!

আমাদের সমাজ-জীবনে সমাধানহীন অনেক সমস্যাই প্রতিনিয়ত বয়ে বেড়াচ্ছি আমরা। শিক্ষাঙ্গনে দুর্নীতি তন্মধ্যে প্রকট আকার ধারণ করা সমস্যাগুলোর একটা। বিশেষত স্কুলের আঙ্গিনা- যেখানে একটি শিশু তার শৈশব ও কৈশোরের কিছু বুনিয়াদী সময় অতিবাহিত করে। সেখানে যদি তাদেরকে এমন নোংরা ও নীতিবিবর্জিত অভিজ্ঞতা অর্জন থেকে আমরা রক্ষা করতে না পারি, তবে কিভাবে এদের কাছ থেকে সুদূর ভবিষ্যতে একটা সৎ, যোগ্য ও নৈতিকতার বলে বলীয়ান ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আশা করবো ? “সততা”, “শ্রদ্ধাবোধ”, “নৈতিকতা” তো আর লিকুইড সল্যুশন না যে সিরিঞ্জে ভরে যে কোন সময় শিরায়-উপশিরায় প্রবেশ করিয়ে দিলেই হবে !

সুহৃদ সম্পর্কে

সবার কথা শুনি আমি , আমার শ্রোতা নাই ... ।।
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে সচেতনতা-এ এবং ট্যাগ হয়েছে স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

2 Responses to শিক্ষক না ব্যবসায়ী ?

  1. লিখাটা পড়ে আসলে কষ্ট লাগলো, চোখের সামনে নিজের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে মিলে যেতে দেখলে কষ্ট তো লাগেই……

    • সুহৃদ বলেছেনঃ

      কেমন যেন অসহায় লাগে ভাইয়া !
      এতো ভালোবাসা, এতো স্মৃতি বিজড়িত স্কুলটার একটু একটু করে এই শেষ হয়ে যাওয়া চুপ চাপ দেখা ছাড়া কিচ্ছু করার নেই ভেবে …।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।