[সরব আইডিয়া ৪] সময় গেলে হয় না সাধন…জীবিত থাকতেই গুণের কদর …

## ঘটনা ১ ছোটবেলায় আমাদের মফস্বলের এলাকায় একজন মানুষ ছিলেন, আমরা তখন ছোট ছিলাম, অনেক কিছুই বুঝতাম না বড়োদের ব্যাপার স্যাপার, শুধু দেখতাম উনি যখন পথ দিয়ে হেঁটে যান মানুষ জন পথ ছেড়ে দিতেন উনার জন্য…আমরা ছোট আন্ডা বাচ্চারা কখনো বুঝতাম না প্রকৃত ঘটনা, পরে জেনেছিলাম উনি এখানকার হাই স্কুলের শিক্ষক, দারুণ ছিলেন গণিতে, উনার ক্লাসে নাকি উনি সবাইক যেয়ে যেয়ে বুঝিয়ে দিয়ে আসতেন…শুধু দোষের মধ্যে একটা দোষ ছিলো উনার, উনি কোচিং করাতেন না, আর সে কারণেই হাই স্কুলের বাকি শিক্ষকরা উনাকে খুব একটা পছন্দ করতেন না। উনি একলাই বসে থাকতেন কমন রুমে, কারো সাথে খুব একটা কথাও বলতেন না, খুব বেশি একলা ছিলেন বুঝি মানুষটা, সারাদিন নিজের মনেই কী জানি ভাবতেন। উনি কমনরুমে থাকলে বাকি শিক্ষকরা কোচিং নিয়ে পারতপক্ষে কথা বলতেন না! চক্ষুলজ্জা বলে তো একটা ব্যাপার ছিলো, অন্তত তখনও…

একদিন সকালে হঠাৎ মাইকিং হলো শহরে, সেই মানুষটা আর নেই, গতকাল রাত্তিরে হঠাৎ করেই মারা গেছেন উনি। ততদিনে আমরা একটু বড়ো হয়েছি, তৃতীয় শ্রেণীতে মনে হয় উঠেছিলাম তখন। আমরা সবাই স্কুল মাঠে গেলাম, উনার জানাজা পড়ানো হলো, তার আগে স্কুলের অনেক শিক্ষক কাঁপা কাঁপা গলায় বলে গেলেন উনার কথা, কতো ভালো মানুষ ছিলেন উনি। উনি না থাকাতে স্কুলের কত ক্ষতি হলো, এমন একজন মানুষ আমরা আর পাবো না, উনি ছিলেন গণিতের পথিকৃৎ এই স্কুলে এইসব কিছু। আমরা ছোটরা শুধু অবাক হয়ে ভেবেছিলাম, এই কথাগুলো কেন উনারা শুধু মাত্র কেন এতোদিন পরেই টের পেলেন, কেন বললেন না এতোদিন, যতদিন উনি বেঁচে ছিলেন?

## ঘটনা ২ আমি তখন এই ব্লগের জগতে প্রায় নতুন, তখনো অনেক মানুষের লিখা পড়ে বেড়াই, ঘুরে বেড়াই অন্তর্জালের অসংখ্য ব্লগের ভিড়ে, একজন মানুষের নাম জানলাম ইমন জুবায়ের। লেখালেখি করেন বেশ ভালো, উনার কথা জানলাম তখন। উনার ডায়াবেটিস আর ইনসমনিয়া, তাই রাতের পর রাত জেগে লিখে যেতেন অক্লান্ত। ২০১১ সালে বর্ষসেরা ব্লগার নির্বাচিত হন তিনি। খুব হিংসে হতো, উনার মতো যদি কখনো লিখার মতো সাহস কিংবা ক্ষমতা কোন একটা হতো। ব্লগে সর্বোচ্চ পোস্ট, সর্বোচ্চ মন্তব্যদাতা সব কিছুতেই ইমন ভাইকে খুঁজে পাওয়া যেতো…মানুষটা পাগলের মতো লিখতেন, লিখতে ভালোবাসতেন, হয়তো রাতের বিশালত্বে উনি ডুবে যেতেন উনার লিখাতে…অনেকটা বেশি……

তবু, তবু হঠাৎ ৩রা জানুয়ারি প্রায় ৪৬ বছর বয়সে আচমকাই কোন কথা না বলে নগরঋষি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন, রেখে গেলেন শুধু উনার কয়েক হাজার পোস্ট, অসংখ্য মন্তব্য আর পাঠককে…তারপর হঠাৎ দেখলাম আমরা সবাই খুব বেশি ব্যস্ত হয়ে গেলাম ইমন ভাইকে নিয়ে স্ট্যাটাস দিতে, আমরা ব্যস্ত হয়ে গেলাম উনাকে নিয়ে কভার ফটো দিতে, উনার লিখে যাওয়া লাইন সাজিয়ে উনাকে অনেকখানি খুঁজে নেবার চেষ্টা করতে…

জীবন মানে শুধুই যদি প্রাণ রসায়ন/জোছনা রাতে মুগ্ধ কেন আমার নয়ন…….

আমরা অনেক কিছুই করলাম, শুধু কষ্ট রয়ে গেলো একটা জায়গাতেই, ইমন ভাই দেখে যেতে পারলেন না, একজন অদ্ভুত ধরণের ঘোরলাগা ব্লগারকে আমরা উনার জীবদ্দশায় কতখানি শ্রদ্ধা জানালাম আর কতখানি উনি চলে যাবার পর। ব্লগে তারপর দুর্দান্ত সব ব্লগার এসেছেন, এসেছে অসাধারণ সব পোস্ট, শুধু…শুধু ইমন ভাই আর আসবেন না! এটাই ধ্রুব সত্য হয়ে গেলো…

 দুটো ঘটনা হয়তো মিলিয়ে দেখবার মতো না তবু একটা সুতো বাঁধা থেকে যায় কোথাও, আমরা খুব বেশি ক্ষেত্রেই…খুব বেশির ভাগ সময়েই এই কাজটা করি। একটা মানুষ আমাদের ছেড়ে চলে যাবার পরই আমরা টের পাই আমরা কি অসাধারণ একজন মানুষকে হারালাম। একটা মানুষ আমাদের ছেড়ে চলে যাবার পরই হঠাৎ করে আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়ি উনি কী করেছেন আমাদের জন্য, উনি কেন দেশের জন্য একজন যোদ্ধার মতো ছিলেন, উনার কেন আরো কিছুদিন বেঁচে থাকা উচিত ছিলো, উনার কেন চলে যাওয়া উচিত হয় নি এইসব কথা বলে উঠি…আমরা প্রোফাইল পিকচার পাল্টাই, আমরা বিশাল বিশাল স্ট্যাটাস দেই, আমরা টের পাই হঠাৎ করে…

যেই মানুষটা চলে গেলেন উনি কখনো আর ফিরে আসবেন না, উনি আর কখনো দেখবেন না কী অসাধারণ ভালোবাসা নিয়ে উনার জন্য এক একটা মানুষ শব্দমালা সাজিয়েছিলো…

হুমায়ুন আহমেদ স্যারকে নিয়ে আমার খুব প্রিয় একটা মানুষের কথাটি এখনো আমার কানে বাজে…

এই মানুষটিকে আমি বইমেলায় দেখেছি, এই আমার পাশ দিয়েই উনি হেঁটে গিয়েছেন হয়তো কখনো, কেন আমি স্যারের কাছে গিয়ে বলি নি,

“স্যার, আমি কি আপনার হাতটা একবার ছুঁয়ে দেখতে পারি? আমি কি এই হাতটা ছুঁয়ে দেখতে পারি, যেই হাত দিয়ে আপনি এমন অসাধারণ সব উপন্যাস লিখেছেন?”

আমি তো আর চাইলেও এখন উনাকে ছুঁতে পারবো না, কেন তখন করলাম না কাজটা…কেন…কেন…কেন?

কেন? এমনকি হতে পারতো না, আমরা সেই মানুষটাকে জীবদ্দশাতেই জানাতাম, উনি এই দেশটাকে কতকিছু দিয়ে গেছেন, একটা মানুষ এক জীবনে ঠিক কতখানি কাজ করলে তাকে সম্মান জানাতে হয় আমরা জানি না, তবে আমরা সরবের পক্ষ থেকে অন্তত এইটুকু বিশ্বাস করি…

“একটা মানুষকে তার জীবদ্দশায় অন্তত জানতে দেয়া উচিত, উনি এই দেশটাকে ঠিক কোথায় নিয়ে গেছেন, কতোটুকু স্বপ্ন দেখিয়েছেন এই আমাদেরকে, কতটুকু বুঝতে শিখিয়েছেন, চাইলে দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি এই আমরাই…”

২০১১ থেকে আজ এই দিনটা পর্যন্ত আমরা অসংখ্য মানুষকে হারিয়েছি। হারিয়েছি তারেক মাসুদকে, মিশক মুনীরকে, হঠাত করেই চলে গেলেন হুমায়ুন ফরীদি, চলে গেলেন কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ, জামাল নজরুল ইসলাম স্যার। হঠাৎ করেই আমরা টের পেলাম আমরা অল্প অল্প করে আমাদের সেই স্বপ্ন দেখতে সাহায্য করা মানুষগুলোকে হারিয়ে ফেলছি, আমরা যাদের চিনতাম, তবু কোনদিন মুখ ফুটে বলতে পারি নি…

“এই আপনারাই আমাদের নতুন করে স্বপ্ন দেখালেন, এই আপনাদের দেখে আমরা বিশ্বাস করি বাংলাদেশ একদিন পালটে যাবে…”

এবং একইসাথে টের পেলাম আমরা চাই নতুন একটা কিছু করার, সরব আইডিয়া এর পক্ষ থেকে, আমরা চাই, আমাদের দেশের সেই মানুষগুলো, যারা এখনো অক্লান্ত কাজ করে যাচ্ছেন এই দেশটাকে আরেকটূ নতুন করে চেনাতে বহির্বিশ্বের কাছে, কিংবা একটু নতুন করে জানাতে আমাদের কাছেই, তাদের তুলে ধরতে সবার সামনে।

এমন বলবো না আমরা তাদের জানি না, আমরা তাদের চিনি না, এখন যাদের কথা বলবো তারা এই আমাদের খুব চেনা মানুষ, শুধু বলা হয়ে ওঠে নি কখনো, আমরা আপনার কাছে কৃতজ্ঞ, বলা হয়ে ওঠে নি…

আমরা আপনাদের সম্মান জানাতে চাই এই এক্ষণি, এই মুহুর্তে, আপনাদের জানাতে চাই, আমরা বিশ্বাস করি,

“মানুষ বেঁচে থাকতেই তার কাজের মূল্যায়ন হওয়া উচিত…”

আমার বিশ্বাস এই দেশকে নিভৃতে অনেক কিছু দিয়ে যাচ্ছেন এমন অসংখ্য মানুষ আছে…

আলোকিত মানুষ তৈরির কারিগর আব্দুল্লাহ আবু সাইয়িদ স্যার, ছোট ছোট বাচ্চা আর তরুণদের স্বপ্নদ্রষ্টা মুহুম্মদ জাফর ইকবাল স্যার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত শ্রদ্ধেয় রাব্বানী স্যার, প্রানরসায়ন বিভাগের জেবা ইসলাম ম্যাডাম, ডঃ আবেদ চৌধুরি, হানিফ সংকেত, মাটি ও মানুষের শাইখ সিরাজ……এই তালিকা শেষ হবার নয়। তবু আমরা চেষ্টা করতে চাই, তবু আমরা দেখাতে চাই এই মানুষগুলোকে একটিবার, আমরা বিশ্বাস করি এখনো, একজন মানুষ এই দেশটাকে ভালোবেসে যা করে যাচ্ছেন আমরা তার মূল্যায়ন করি…

সরব বিশ্বাস করে জন্মদিন স্টাইলে, সরব বিশ্বাস করে রিসাইক্লিং এ, সরব বিশ্বাস করে মানুষকে স্বপ্ন দেখাতে, আর স্বীকার করে নিতে স্বপ্নদ্রষ্টাদের…

আমরা ব্যানার করেছিলাম হুমায়ূন আহমেদ স্যারকে নিয়ে, আমরা ব্যানার করেছি আব্দুল্লাহ আবু সাইয়িদ স্যারকে নিয়ে। আমরা বের করেছিলাম ই-বুক হুমায়ূন আহমেদ স্যারের জন্মদিনে।

সেই প্রচেষ্টারই অংশ হিসেবে আমরা এগিয়ে নিতে চাই সরবের এই বৈশিষ্ট্যকে, ছড়িয়ে দিতে চাই সবার মধ্যে…আমরা চাই সবাই এগিয়ে আসুক, জীবদ্দশায় একটি মানুষকে জানাতে, আমরা জানি, আপনি আপনার দায়িত্বটুকু পালন করেছেন। এবার সময় আমাদের……

নিস্তব্ধ শৈশব সম্পর্কে

জন্মেছি যখন মানুষ হয়ে, লড়ে যাবো ভালোর হয়ে, এক নতুন ভোরের অপেক্ষায়...
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে অনুপ্রেরণা, ইতিবাচক, উদ্যোগ, চিন্তাভাবনা, সচেতনতা-এ এবং ট্যাগ হয়েছে , , , , , , , , , স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

3 Responses to [সরব আইডিয়া ৪] সময় গেলে হয় না সাধন…জীবিত থাকতেই গুণের কদর …

  1. বোহেমিয়ান বলেছেনঃ

    চমৎকার ৪ টি আইডিয়া। এইভাবেই একটু একটু করে বাংলাদেশ বদলাবে।

    শুধু মুখ ফুটে বলা না। অনেক সময় থাকতে মর্ম বুঝি না এমন ব্যাপার হয়! হানিফ সংকেত এর কথাই ধর! কত্ত কিছু দিল দেশকে অথচ তাঁকে কতটা সন্মান দেই?
    জাফর ইকবাল স্যারের কথাই বল?

    গ্রেইট জব।

  2. এখনও শিশু বলেছেনঃ

    খুবই ভালো একটি লেখা। এই ধরণের লেখা বেশ অনেকদিন ধরেই খুঁজছি।

    তবে তারেক মাসুদ আর মিশুক মুনীর কি গত বছরে মারা গিয়েছেন? ২০১১ তে না? “২০১২ থেকে আজ এই দিনটা পর্যন্ত আমরা অসংখ্য মানুষকে হারিয়েছি। হারিয়েছি তারেক মাসুদকে, মিশক মুনীরকে …” এই জায়গাটা কেমন গোলমেলে হয়ে গেল না?

  3. বাবুনি সুপ্তি বলেছেনঃ

    জীবিত থাকতে কারোই নাম নেই।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।