জীবনের বাঁকে বাঁকে সময়ের রঙ

আমার মন খারাপ হওয়ার জন্য নির্দিষ্ট কোন কারন ইদানিং লাগে না।অনেকগুলো কারন এক হয়ে আমার মনের বিরুদ্ধে বেশ শক্ত যুদ্ধ চালিয়ে যায় সারাক্ষন।একলা বেচারা মন!কতক্ষন আর সামলাবে?মাঝে মাঝেই তাই ব্রেক ফেল করে বসে।

আজকে বিকাল থেকে কেন যেন কিছুই ভালো লাগছিলো না।মাগরিবের নামাযটা খালি ফরয পড়ে উঠে গেলাম।সারাদিন বাইরেও যাই নি,যদিও যাওয়ার দরকার ছিলো।

তো এখন কি করা?

সিম্পল!দরজা বন্ধ,লাইট অফ,ফুল স্পিড ফ্যান,পাতলা কাঁথাটা গায়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে পড়ে রইলাম বিছানায়।এর মাঝে এক গাধারে টেক্সট করলাম।ও মনে হয় ব্যাস্ত।রিপ্লাই পেলাম না।

ঘুম আসছে না।নানা রকম কথা মাথায় আসছে।নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করছিলাম।

হঠাৎ একটা জিনিস মাথায় আসলো।

আচ্ছা,আমি এতো হতাশ হচ্ছি কেন?আমিই কি এই দুনিয়ায় সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছি?আমার চেয়ে অকল্পনীয় খারাপ অবস্থায়ও তো কত হাজারো,লাখো মানুষ আছে।আল্লাহ  তো তাদের তুলনায় আমাকে কত ভালো রেখেছেন।আমি তাহলে কেন কৃতজ্ঞ হচ্ছি না,সন্তুষ্ট হচ্ছি না।আচ্ছা আমার চেয়ে খারাপ অবস্থায় কে কে আছে,একটু খুঁজে দেখি তো !

 

মনে পড়লো একজনের কথা।উনি আমার পরিচিত কেউ না কিন্তু উনার অবস্থা এতোই খারাপ যে,অচেনা এই মানুষটার কথাই আমার মনে এলো সবার আগে।

 

আমার রুমের জানালা দিয়ে তাকালে লম্বা গলিটার ঐ মাথা পর্যন্ত কে আসছে,যাচ্ছে সব দেখা যায়।আর এইদিকে আমাদের বাসার গেইট দিয়ে কেউ ঢুকলে,সরাসরি আমার জানালায় এসে দাঁড়াতে পারে।আমাদের বাসাটা নিচতলায় হওয়ায় এই হয়েছে সমস্যা।মাঝে মাঝে কিছু লোকজন (ফকির বা সোজা সরল টাইপ লোকজন) কলাপসিবল গেইটে না গিয়ে সোজা আমার রুমের সামনে এসে,কিছু না বুঝেই হাত বাড়িয়ে জানালার পর্দা সরিয়ে ভেতরে কে আছেন খোঁজার চেষ্টা করে।তাতে কার প্রাইভেসি কোন দিক দিয়ে গেল নাকি আসলো,তা তারা থোড়াই কেয়ার করে।

 

কিছুদিন আগে দুপুরে বাসায় এসে টায়ার্ড হয়ে শুয়ে আছি।আম্মু রুমে এসে কি জানি গল্প করছে আর আমি চোখ বুঁজে হুঁ,হা করছি।এমন সময় কেউ একজন পর্দা সরালো।খুব মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো।মেজাজ খারাপ করে পাশ ফিরে দেখলাম নিষ্প্রভ,মলিন চেহারার এক মহিলা।চেহারায় কেমন যেন এক লুকানো সাবেকী আভিজাত্য।উনি এভাবে পর্দা উঠানো কি সুন্দর কিছু হলো?কিন্তু মহিলা মানুষ,কি আর বলা যায় উনাকে?আম্মুর উনার সাথে কথা বলছেন দেখে আমি উঠে অন্য রুমে চলে গেলাম।কিন্তু মনে বার বার খটকা লাগছিলো কিছু একটা জানি উনার চেহারার সাথে মিলছিলো না ।

 

উনি কিছুক্ষন আম্মুর সাথে কথা বলে চলে গেলেন।কিছু সময় পরে যখন দেখলাম আম্মু আমার রুম ছেড়ে বেরিয়ে আসছে,তখন আমার রুমে এলাম।আম্মুকে জিজ্ঞাস করলাম,উনি কে?

আম্মু বললেন,উনি এক ম্যাজিস্ট্রেটের বউ!

আমি অবাক হলাম! তো উনি এভাবে কেন?এভাবে কার কাছে এসছিলেন?

আম্মু বললেন, উনাকে আমি চিনি।উনার স্বামীর নিজের ভাঙ্গাচোরা এক বাসা আছে শহরেই।ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব তরুন বয়সেই মারা যান ছোট ছোট দুই মেয়ে রেখে।বেচারী বাচ্চা মেয়েগুলোর দিকে তাকিয়ে আর বিয়ে করেন নি।আজ মেয়েরা উপযুক্ত হয়ে গেছে।মহিলা তার বড় মেয়েকে বিয়ে দিচ্ছেন।উনার আত্নীয় স্বজনদের অবস্থাও খুব বেশী যে ভালো এই রকম না।তারা যতখানি পারে হেল্প করছে।কিন্তু তাতে পুরোটা হয়ে উঠছে না।নিরুপায় হয়ে এই মহিলা শেষপর্যন্ত সবার কাছে সাহায্য চাইছেন!

 

আমি অবাক হয়ে গেলাম!এক ম্যাজিস্ট্রেটের বউ মানুষের দ্বারে দ্বারে সাহায্য চেয়ে ঘুরছেন !! তা ও নিজের মেয়েকে বিয়ে দেয়ার জন্য!কত টাকা লাগে একটা মেয়ের বিয়ের জন্য?

উনার পাড়ার লোকে তবে কি করছে?মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল এই ভেবে।

সাথে সাথে আমার রাগ পড়ে গেলো।আহারে,বেচারি।কতটুকু লজ্জার মাথা খেয়ে উনি সাহায্য চেয়ে বেড়াচ্ছেন,উনার তো কাজ-কর্ম এখন স্বাভাবিক থাকারই কথা না।আমার রেগে যাওয়া চেহারা উনি দেখে ফেলেছিলেন কি না,খেয়াল করি নি।নিজের এই কাজের জন্য খুব লজ্জা লাগছিলো আর অনুশোচনা হচ্ছিলো।

 

আম্মুকে জিজ্ঞাস করলাম,উনাকে কিছু দিসো?

আম্মু বললেন,আমার কাছে ভাংতি নাই।তোর ওয়ালেট থেকে পঞ্চাশ টাকা দিসি।

আফসোস লাগলো,কেন তখন অন্য রুমে চলে গেলাম।ধুরো…

আম্মুরে বললাম,কেন একটা একশো টাকার নোট দিয়ে দিলা না?আম্মু বললো,তোর ওয়ালেটে দেখলাম বেশী টাকা নাই।তাই পঞ্চাশ টাকাই দিসি।আমি আরো মনে করতেসি,বেশী হয়ে গেল কি না।

বললাম,কোন সাহায্যপ্রার্থীরে পঞ্চাশ টাকা দেয়াটা বেশী,তা ঠিক আছে কিন্তু উনার মত সাহায্যপ্রার্থীদের সর্বোচ্চটুকু দেয়া দরকার।টাকার ফিগারটা উনাদের ক্ষেত্রে বিশেষ কোন ব্যাপার হওয়া উচিত না আমাদের কাছে।

এই ঘটনার পরে তখন বেশ খারাপ লাগতেসিলো।

 

আচ্ছা, আমরা এই কেমন দেশে বাস করি,যেই দেশের সরকারকে একজন মানুষ মারা যাওয়ার আগ মূহুর্ত পর্যন্ত সেবা দিয়ে গেলেন,আর তাঁর মেয়ের বিয়ে হচ্ছে কিনা মানুষের দানের টাকায়?আর সেই টাকা তোলার জন্য সরকারের একজন ফার্স্টক্লাস অফিসারের বউকে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘোরা লাগছে আর আত্নসম্মানের মাথা খেয়ে বার বার একই কথা বলে সবার কাছে ভিক্ষা চাওয়া লাগছে!

 

 

এইসব কথা মনে আসতে,সহসাই মন ভালো হয়ে গেলো।মহিলা ছিলেন এক মেজিস্ট্রেটের বউ।কত উঁচু চলাফেরা করেছেন আর সম্মান পেয়েছেন একসময়।সমাজের অন্যদের তুলনায় বেশ খানিকটা সচ্ছল জীবনও তো যাপন করেছেন সে সময়।কিন্তু আজকে উনার অবস্থান কোথায়!

আল্লাহকে বললাম,ধন্যবাদ।আলহামদুলিল্লাহ,অনেক ভালো রাখসো।এই বান্দা তোমার কাছেই সাহায্য চায়,এই কঠিন দিনের যুদ্ধে জিতার জন্য।

এরপর বাইরে বেরোতে ইচ্ছা হলো।বিছানা ছেড়ে উঠে হাতমুখ ধুয়ে তাই স্টেডিয়াম চলে গেলাম।ইচ্ছে হলো কাউকে ফোন করে বলি,দোস্ত আয় তো একটু স্টেডিয়ামে।একটু চটপটি খাবো।

কিন্তু কাছের মানুষজন প্রায় সবার সাথেই কোন এক কারনে বেশ দূরত্ব হয়ে গেছে।যে দু’এক জনকে বলা যায়,তারা আসতে পারবে না কারন এরা বেশ দূরে থাকে,আসতে অনেক সময় লাগবে।কি আর করা?একা একা খেয়ে বাসায় আসলাম।

এসে মনে হলো,এই কথাগুলো লিখে ফেলা যায়।হয়তো ব্লগে পোস্ট দিলে আমার মত কোন একজন একটু সাহস পাবে,ভরসা পাবে।লেপটপ খুলে তাই লিখতে বসে গেলাম।

 

খুব আশাবাদী লাগছে নিজেকে নিয়ে,আল্লাহর প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতাবোধ করছি।সত্যিই,হতাশার কিছু নেই।হতাশা খুব সাময়িক,আশাই স্থায়ী।আমাকে ভালোভাবে বেঁচে থাকতে হবে।হাল ধরতে হবে শক্ত হাতে।ইনশাআল্লাহ,সামনে সুন্দর সময় অপেক্ষা করে আছে।

 

ও হ্যাঁ,আরেকটা জিনিস।আমার খুব ইচ্ছা,আল্লাহ যেন আমাকে সামর্থ্য দেন মানুষকে বেশী বেশী সাহায্য করার আর আমি যেন কারো অভাবের কথা জানলে তাকে আড়াল থেকে যতখানি সম্ভব সাহায্য করে যেতে পারি।আমার মনে হয়,এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্যগুলোর একটা হচ্ছে, মানুষের মুখের সহজ,স্বাভাবিক আর অকৃত্রিম হাসি।

 

সবাই ভালো থাকুন।

এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে অনুপ্রেরণা, ইতিবাচক-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

4 Responses to জীবনের বাঁকে বাঁকে সময়ের রঙ

  1. শারমিন বলেছেনঃ

    আমারও তাই মনে হয় যে এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্যগুলোর একটা হচ্ছে, মানুষের মুখের সহজ,স্বাভাবিক আর অকৃত্রিম হাসি।

    হতাশা খুব সাময়িক,আশাই স্থায়ী।
    সুন্দর লিখা 🙂

  2. একলা পথিক বলেছেনঃ

    কমেন্টের শেষ লাইনের মাধ্যমে আমি খুশী হয়ে যাওয়ায় আপুকে আট আনার কাঁচা ধইন্যা দেয়া হইলো।

  3. মাধবীলতা বলেছেনঃ

    শেষটুকু অনেক ভালো লেগেছে। মানুষের আসলেই কতরকম অবস্থার মধ্য দিয়েই না যেতে হয়।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।