১.১৯৪৯ সালে মঠবাড়িয়া কে এম লতিফ ইনস্টিটিউট পরিদর্শনে গিয়েছিলেন আনোয়ারুল কাদির নামের এক পরিদর্শক। মোজাফ্ফর আহমদ তখন সে স্কুলের ছাত্র। পরিদর্শক সাহেব ক্লাসে গিয়ে প্রথম যে প্রশ্ন করেছিলেন তার উত্তর দিয়েছিলেন মোজাফ্ফর আহমদ। তখন পরিদর্শক মোজাফ্ফর আহমদকে জিজ্ঞেস করেছিলেন ‘তুমি বড় হয়ে কী হতে চাও?’ তার উত্তর ছিল, ‘আমি বড় হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের¬ অর্থনীতির শিক্ষক হব।’ শুনে তিনি
খুব চমৎকৃত হয়েছিলেন। অর্থনীতি আর শিক্ষকতার প্রতি তখন থেকেই ঝোঁক ছিল মোজাফ্ফর আহমদের।পরবর্তী সময়ে মোজাফ্ফর আহমদ সত্যিই একজন অর্থনীতিবিদ ও শিক্ষক হিসেবে সুনাম অর্জন করেন।
২.পিএইচডি করার পর জাতিসংঘের ৪০ হাজার ডলারের চাকরি ছেড়ে পিতার কথামতো ৫শ’ টাকা বেতনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতে ফিরে আসেন যিনি; জাতিসংঘের চাকরির প্রস্তাব পেয়ে সিদ্ধান্তের জন্য লেখা চিঠির জবাবে পিতা তাকে লিখেছিলেন, মানি ইজ নট এভরিথিং, ফ্যামিলি নিডস্ ইউ। তিনি আর কেউ নন, অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ।
৩.একজন মানুষ তার এক জীবনে কত কাজ করতে পারেন- এমন প্রশ্নের জবাব খুঁজতে খুব বেশিদূর যেতে হয় না, অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের বিশাল পরিধির কর্মজীবনের দিকে তাকালেই তা বুঝতে পারা যায়।জীবদ্দশায় অর্থনীতিবিদ পরিচয়েই থেমে থাকেননি অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ। তিনি ছিলেন আজীবন শিক্ষক ও গবেষক। অর্থনীতি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ছিল তার বিশেষ আগ্রহের বিষয়। একই সঙ্গে তিনি সক্রিয় ছিলেন অনেক সামাজিক
সংগঠনের সঙ্গে।সৎ ও নির্লোভ ব্যক্তি হিসেবে সুনাম রেখে গেছেন। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের পরিকল্পনা কমিশনে কাজ করেছেন। তিনি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠায় যুক্ত ছিলেন। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের পুনর্গঠনের কাজ করেছেন। তিনি টিআইবি’র সভাপতি ছিলেন। এশিয়াটিক সোসাইটি, বাংলা একাডেমী,
বারডেম, নজরুল একাডেমি, অর্থনীতি সমিতি, অর্থনীতি শিক্ষক সমিতির আজীবন সদস্য ছিলেন। তিনি পরিবেশ আন্দোলনের আজীবন সদস্য ও সভাপতি, সুজন-এর চেয়ারপারসন এবং হিউম্যান রিসোর্স ফাউন্ডেশনের ট্রাস্টি ছিলেন।
নিজের বর্ণাঢ্য কর্মজীবন সম্পর্কে বলতে গিয়ে মোজাফ্ফর আহমদ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পুরোপুরি সময় থাকতে পারিনি। এক সময় রাজনৈতিক কারণে আমাকে এখান থেকে চলে যেতে হয়েছে। আমি ব্যাংকে কাজ করেছি, ইপিআইডিসি-তে কাজ করেছি, প্ল্যানিং কমিশনে কাজ করেছি, পরবর্তীতে উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। জিয়াউর রহমানের প্রথম কাউন্সিল অব অ্যাডভাইজারের সদস্যও ছিলাম।’
৪.মোজাফ্ফর আহমদ যেখানেই কাজ করেছেন সেখানেই নিজস্বতার ছাপ রেখেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষকতা থেকে শুরু করে ট্র্যান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) চেয়ারম্যান পর্যন্ত তার এই পথচলায় যেমন অনেক সংগঠন তৈরি করেছেন, তেমন অনেক প্রতিষ্ঠানকে পৌঁছে দিয়েছেন উন্নতির শিখরে। যে প্রতিষ্ঠানেই কাজ করুন না কেন তার লক্ষ্য ছিল দেশের জন্য কিছু একটা করা।
তার ভাষায়, ‘আমি ঠিক করেছিলাম সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দেব না। শিক্ষক হব। আমার বাবা আশা করেছিলেন আমি সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দেব। আমি যখন বিদেশ থেকে পিএইচডি করে ফিরে আসি তখন আমার বাবা আনন্দিত হয়েছিলেন। সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় ইন্টারন্যাশনাল কম্পিটিশনের মাধ্যমে একটা স্কলারশিপ পাওয়া, বিদেশে যাওয়া, চাকরি করা, ওখানে একটা ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পেয়েও পরিবারের প্রয়োজনে, দেশের টানে
ফিরে আসা এগুলো বাবাকে নাড়া দেয়।’
৫.মোজাফ্ফর আহমদ লেখালেখি শুরু করেছিলেন ছোটবেলা থেকেই। স্কুল থেকে তার সম্পাদনায় একটা দেয়াল পত্রিকা বের হতো। মোজাফ্ফর আহমদের লেখালেখির শুরু কবিতা, গল্প দিয়ে। এরপর অর্থনীতির পাশাপাশি শিক্ষা, নির্বাচন, গণতন্ত্র এগুলো নিয়েও লিখেছেন। তার লেখা প্রায় ৪শ প্রবন্ধ ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন প্রকাশনায়। এছাড়াও রয়েছে ২০০ বুক রিভিউ, আছে শ’খানেক অন্যদের বইয়ের সমালোচনা। সাক্ষাৎকার, কলাম ইত্যাদি
তো অসংখ্য। তাঁর ভাষায়, ‘১৯৮০ সালে আমার ও রেহমান সোবহানের প্রথম বই বের হয়। এর পরে ১৮টি বই প্রকাশিত হয়েছে। আমার বেশিরভাগ বই-ই বিদেশ থেকে প্রকাশিত হতো। বিশেষ করে দিল্লি, শ্রীলঙ্কা, ভারত, ম্যানিলা থেকে বের হয়েছে নানা গবেষণাপত্র। যেগুলো আমি গ্রন্থিত করতে পারিনি।’ মোজাফ্ফর আহমদের ‘বেশিরভাগ বই’ বিদেশ থেকে প্রকাশ হওয়ার আরেকটি বিশেষ কারণ হলো, তিনি এসব দেশে শিক্ষকতা করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, নরওয়ে, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং সংস্থায় ভিজিটিং প্রফেসর বা স্কলার হিসেবে কাজ করেছেন তিনি।
৬.২০০২ সালে মোজাফ্ফর আহমদের শরীরে দুরারোগ্য অসুখ বাসা বাঁধে। নিয়ত ওঠানামা করতে থাকে রক্তের প্লাটিলেট। কিন্তু অফুরন্ত প্রাণশক্তিতে ভরা এই সংগঠককে কোনো কিছুই দমিয়ে রাখতে পারেনি। অসুস্থ শরীর নিয়ে দিন-রাত কাজ করেছেন দেশকে ভালোবেসে।
২০১২ সালের ২২ মে, সারা দিন কাজের মধ্যে ছিলেন কাজপাগল এই মানুষটি। রাতে ধানমন্ডির বাসায় হঠাৎ বুকে ব্যথা অনুভব করেন, আক্রান্ত হন হূদেরাগে। ল্যাবএইড হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানে সবাইকে কাঁদিয়ে ৭৬ বছর বয়সে পৃথিবী ছেড়ে চলে যান কীর্তিমান এই ব্যক্তিত্ব।
তাঁর চলে যাওয়ার এক বছর পরেও তিনি আছেন আমাদের হৃদয় জুড়ে।দেশপাগল-কাজপাগল এই ক্ষণজন্মা অর্থনীতিবিদকে স্মরণ করি গভীর শ্রদ্ধা ও বিনম্র ভালোবাসায়।
তথ্যঋণঃপ্রথম আলো,সাপ্তাহিক ২০০০,দৈনিক সকালের খবরের উদ্বোধনী সংখ্যা ও সামহোয়্যারইনব্লগ.
প্রিয় সরব সদস্য।
আপনাকে সরব এ অনুমোদন দেয়া হয়েছে। অভিনন্দন 🙂
ঘুমুতে যাচ্ছিলাম।তার আগে কি মনে করে লগইন করলাম।ঢুকেই দেখি একেবারে সরবদের একজন করে নিয়েছেন!অনেক ধন্যবাদ।কনফারমেশান মেইলে লিখেছেন-আমরা আশা করছি সরব এর মান এবং পরিবেশ এর দিকে লক্ষ্য রেখে আপনার দুর্দান্ত স্বরকে সরব করে তুলবেন।
সামহোইয়্যায়ার এবং নাগরিক ছেড়ে সরবে আসার বড় কারণ শুধু ভালো একটা আলাপচারিতার পরিবেশের জন্য।আশা করি আপনাদের বিশ্বাস রাখতে পারবো :love:
আরেকটা ব্যাপার লিখতে ভুলে গেছি।আপনাদের ব্লগে অতিথি বা নতুন স্বর থাকা অবস্থায় আমি দুই লেখা পোস্ট করেছিলাম।প্রথমটি হচ্ছে “আল্লামা শফির কাছে খোলা চিঠি “এবং পরেরটি হচ্ছে “চলুন রচনা করি সুন্দরবনের এপিটাফ”।যদি সম্ভব হয় তবে লেখাগুলো আমার প্রোফাইলে যুক্ত করে দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন।আবারও অসংখ্য ধন্যবাদ।
আপনাকেও সরব এ পেয়ে আমাদের দারুণ ভালো লাগছে।
সবাই মিলে একটি সুস্থ প্ল্যাটফর্ম কিন্তু আমরা চাইলেই গড়তে পারি।
স্ট্যাটাস খাওয়ার মেন্টালিটি, বিনোদন এর আগ্রহ না! পড়ার মতো, চিন্তা করার মতো কিছু লেখা চাই
@বোহেমিয়ান ভাই,আমিও একজন সরব হতে পেরে বেশ আনন্দিত।শুধু একটা ব্লগ না,বরং ব্লগের চাইতে বেশি কিছু,একটা পজিটিভ কিছু করার যে মেন্টালিটি এখানে আছে সেটা বেশ প্রশংসনীয়।আমি লেখক হিসেবে বেশি একটা সুবিধার না।তবে সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে পড়ার মত,চিন্তা করার মত লেখা ডেলিভারি দেওয়ার।
অনেক দারুন একটা পোস্ট।
হ্যাপি ব্লগিং
ধন্যবাদ।চেষ্টা থাকবে ভালো কিছু করার
মোজাফফর আহমেদকে নিয়ে খুব বেশি জানতাম না। তথ্যবহুল পোস্ট পড়তে সবসময় ভালো লাগে।
আপনাকে সরবে স্বাগতম। 🙂
গুণীর কদরে আমরা বরাবরই উদাসীন।দোষীর শাস্তি যেমন দিতে জানিনা তেমনি পারিনা অসাধারণদের উপরে তুলে ধরতে।আমাদের পূর্বসূরিরা আমাদের শিখিয়ে যাননি ওইভাবে।জামাল নজরুল স্যারকেও মৃত্যুর আগেও তেমন কেউ একটা চিনতেন না।আরও করুণ দশা জ্ঞানতাপস অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের ক্ষেত্রে।স্পিনার আব্দুর রাজ্জাক বা নায়করাজ রাজ্জাককে সবাই চিনলেও অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক নামে কেউ একজন ছিলেন এটাও হয়তো কালক্রমে আমরা ভুলে যাব।হয়তো আমিও জানিনা অনেক ক্ষণজন্মা জ্ঞানতাপসকে!
যাই হোক,আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ লেখাটা পড়ার ও মন্তব্য করার জন্য।সরবের সাথে থাকার চেষ্টা করবো ।
আমি মনে করি এর জন্য দায়ী আমাদের মিডিয়াগুলো।
এরা ঐশ্বরিয়ার মাইয়ারে চিনাইতে আকুল কিন্তু যাঁরা এই সমাজটাকে বদলে দিচ্ছেন,তাদের কথা এরা ভুলেও বলে না।আবার এঁরা মারা যাওয়ার পরে সেই মিডিয়াই চেহারা বদলে মায়াকান্না শুরু করে।
একলা পথিক,দ্বিমত পোষণের উপায় নাই।এর সাথে আরেকটু যোগ করতে চাই,আমাদের টেক্সট বইগুলোতেও কিন্তু ইনাদের ব্যাপারে তেমন কিছু নাই।তাছাড়া বই পড়া ব্যাপারটা আরেকটু জনপ্রিয় হলে গুণী জনদের আরেকটু ভালোভাবে বেশি করে চেনা যেত
‘ইহারা থাকেন শক্তির পেছনে রুধির ধারার মতো গোপন, ফুলের মাঝে মাটির মমতা রসের মতো অলক্ষ্যে’
নজরুল ইসলামের ‘যৌবনের গান’ প্রবন্ধের এই লাইনটি যেন সহজেই বনে যায়
অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদে, জামাল নজরুল ইসলাম সহ আর কিছু মহান মানুষের সাথে।
:welcome:
ধন্যবাদ :love: