বই মেরে দেয়া খুবি খারাপ স্বভাব। আমার গত ২০১০, ২০১১ এর বইমেলার কোন বই বাসাতে নাই। ২০১২ এর মেলার অর্ধেক বই নেই। তো, কষ্টটা আমিও বুঝি। গত ক’দিন ধরে নজরুলের সঞ্চিতা বইটি একজনের থেকে এনেছি কিন্তু আর দেয়া হয় নাই। যে দিয়েছে সেও চায়নি, আমি সেঁধে সেঁধে দেবার মতো ভালো মানুষ হতে চাচ্ছি না আর কী! যতোই পড়ছি, ততোই তব্দা খাচ্ছি। আমি নজরুলের বিকট হাসির শব্দও শুনতে পাচ্ছি ! নজরুল কি আসলে তার সময়কার নস্ট্রাডামুস ছিলো ? সে কি আসলে শুধুই কবিতা লিখে গিয়েছে নাকি অলৌকিক ক্ষমতা বলে ভবিষ্যত বানী লিখে দিয়ে গেছে? “মানুষ” নামের কবিতাটি একটু পড়ে দেখি আমরা।
কোথা চেঙ্গিস, গজনী-মামুদ, কোথায় কালাপাহাড়?
ভেঙ্গে ফেল ঐ ভজনালয়ের যত তালা দেওয়া দ্বার।
খোদার ঘরে কে কপাট লাগায়, কে দেয় সেখানে তালা?
সব দ্বার এর খোলা রবে, চালা হাতুড়ি শাবল চালা!
সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে এই যে সাধারণ মানুষকে এক প্রকার দুরত্ব মেপে দিয়েছে, এরা কারা? ধর্ম ব্যবসায়ীরা। এদের কর্মকান্ডে আমরা যুগ যুগ ধরে মেনেই নিয়েছি, যে এরা ধর্মের ইজারা নিয়েছে। ধর্মের সকল দায় দায়িত্ব যেন তাদের। বরং আমরা তাদের কথাই শুনবো। কি মিলাদে, কি মাহফিলে, কি জলসায় এরা যাচ্ছে তাই বলে যাচ্ছে, সমাজ সেভাবে না চললেই বরং আমরা ভ্রু কুঁচকাচ্ছি। কেনো আমাদের তাদের উপর নির্ভরশীল হতে হবে? পিতা-মাতার ঔরসজাত সন্তান বলে আপনি যদি পিতা-মাতা’র প্রতি দাবী রাখতে পারেন, ভালোবাসা পোষন করতে পারেন, তাদের আদেশ নিষেধ শুনতে পারেন অনায়াসে, তবে যে সৃষ্টিকর্তা আপনাকে সৃষ্টি করেছে, কেনো আপনি সরাসরি তাঁর কাছে চাইবেন না? কেনো মাঝখানে মধ্যসুবিধাভোগীদেরকে জায়গা দিতে হবে? সৃষ্টিকর্তা সকলকে সৃষ্টি করেছেন, সকলের প্রতি তার ভালোবাসা বিদ্যমান। নিজের জন্য নিজেই চাইবেন। এই যে মসজিদ-মন্দির গুলো যেনো এক প্রকার তাদের দ্বারা করায়ত্ব্ই হয়ে গেছে। মসজিদ হচ্ছে আল্লাহর ঘর। মন্দির ভগবানের নিমিত্তে উপসনালয়। সবার প্রার্থনা করবার, চাইবার, জানাবার অধিকার সমান।
হায় রে ভজনালয়,
তোমার মিনারে চড়িয়া ভণ্ড গাহে স্বার্থের জয়।
মানুষেরে ঘৃণা করি’
ও’ কারা কোরাণ, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি মরি!
ও’ মুখ হইতে কেতাব গ্রন্থ নাও জোর ক’রে কেড়ে,
যাহারা আনিলো গ্রন্থ-কেতাব সেই মানুষেরে মেরে।
ঠিক এখনকার সময়টাই যেনো লিখে ফেলেছেন ! ধর্মের ইজারাদারেরা মিছিলে কোরান শরিফ নিয়ে আসছে, নিজেদের প্রয়োজনে আগুন দিচ্ছে, তারা বাদে আর কেউ ধর্মগ্রন্থ নিয়ে কথা বললেই তাদের আঁতে ঘা লাগছে, ভ্রুকুটি করছে, তামাশা করছে। যেনো এ শুধু তাদেরই সম্পত্তি আর কারও নয় ! এ গ্রন্থ-কিতাব যাদের মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তা প্রেরণ করলেন, তাঁদের আঘাত করে যতোই মুখে নারায়ে তাকবির চিৎকার করুক, যতোই কিতাবে চুমু দিক, তারা স্বার্থবাদী। নজরুল তাই বলে। আমরাও তাই বলি।
কাহারে করিছ ঘৃণা তুমি ভাই, কাহারে মারিছ লাথি?
হয়ত উহারি বুকে ভগবান জাগিছেন দিবা-রাতি !
আবারও, পার্ফেক্ট ওয়ার্ডস ! যারাই হেফাজতী কিংবা জামাত বিরুদ্ধে, যারাই তাদের মতের বিপক্ষে, যারাই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, যারাই রাজাকারের বিপক্ষে, ধর্ম ব্যবসায়ীদের মতে তারাই নাস্তিক ! নাস্তিক বলে এই যে যত্র তত্র আঘাত করা হচ্ছে, সে কী আদৌ জানে, তার ধর্মীয় দর্শন সম্পর্কে? আমাদের নবী (স) কি বলে গেছেন এই সম্পর্কে? বুখারি শরীফের ৫৭৫২, ৫৭৫৩ নম্বর হাদীসে আছে, “যখন একজন আরেকজনকে কাফির বলে মন্তব্য করে, তখন একটা ব্যাপার অবশ্যই ঘটবে। সে লোকটি যদি আসলেই কাফের হয়ে থাকে, তবে সে কাফের বলিয়াই গন্য হবে। আর যদি সে কাফের না হয়, তবে মন্তব্যটি মন্তব্যকারীর দিকেই ফিরবে“। তারা কি ঠিক একই কাজ করছে না?
এবার আরেকটা কবিতা দেখি, কবিতাটির নাম “পাপ”।
ধর্মান্ধরা শোনো,
অন্যের পাপ গণিবার আগে নিজেদের পাপ গোনো!
আবারও, একেবারে বুলজ আই ! জামাত শিবির এর কর্মীরা, হেফাজতিরা সাধারণ মানুষকে নাস্তিক ট্যাগ দিয়ে সবাইকে ধর্ম শেখাতে স্ব-প্রনোদিত হয়ে যে শুদ্ধিকার্যক্রম চালাচ্ছে, তারা নিজেরাই যে পথভ্রষ্ট, তাদেরকে শুদ্ধ করবে কে? রগ কেটে, খুন করে, নিজের দেশকে মাতৃভুমি না মেনে গণহত্যাকারীদের প্রতি, জেনাকারীদের প্রতি যাদের ভালোবাসা, তারা কি শেখাবে ধর্ম?
৫ তারিখ দেশব্যাপী তান্ডব চালানো হেফাজত কর্মীদের একটা বিরাট আক্ষেপ ছিলো নারীনীতি ও নারীর ক্ষমতায়ন। যে নারীর উদরে জন্ম, তাদেরকে সমান অধিকার দিতে এতো ভয়, এতো নির্লজ্জতা কেনো ! নিজেদেরকে উচু শ্রেণি ভাবা পুরুষেরা, খুব তো মুখ ফুটিয়ে বলো, হাওয়ার ভুলে আইজ আমাদের এই দশা, খুব তো চাপিয়ে দাও মেয়েদের উপর দোষ। দেখো তাহলে নজরুল কি বলে,
নরককুন্ড বলিয়া কে তোমা’ করে নারী হেয়জ্ঞান?
তারে বলো, আদি-পাপ নারী নহে, সে যে নর-শয়তান। (কবিতাঃ নারী)
হ্যা, আদি পাপের ভাগিদার পুরুষ, নারী নয়।
শুধু তারুন্যের কিংবা বিদ্রোহের কবি নয়, নজরুল আরও অনেক বড় কিছু। সে বড় কিছু কি, আমার জানা নেই। ধর্ম ব্যবসায়ীরা, যে নজরুলের দুই-এক চ্ছত্র নিজেদের প্রয়োজনে কাট ছাট করে নিজেদের কাজে লাগিয়ে নাও, আরেকটু পড়ে নাও। দেখো, তোমরা নজরুলের কতো ঘৃনার পাত্র। শেষে নজরুলের আর কয়েকটি চ্ছত্র –
তোদেরই আঘাতে টুটেছে তোদের মন্দির-মসজিদ,
পরাধীনদের কলুষিত ক’রে উঠেছিল যার ভিত!
খোদা খোদ যেনো করিতেছে লয়
পরাধীনদের উপাসনালয়!
স্বাধীন হাতের পূত মাটি দিয়া রচিবে বেদী শহীদ!
টুটিয়াছে চূড়া? ওরে ঐ সাথে টুটেছে তোদের নিদ! (কবিতাঃ হিন্দু-মুসলিম যুদ্ধ)
শুধু তারুন্যের কিংবা বিদ্রোহের কবি নয়, নজরুল আরও অনেক বড় কিছু। সে বড় কিছু কি, আমার জানা নেই। ধর্ম ব্যবসায়ীরা, যে নজরুলের দুই-এক চ্ছত্র নিজেদের প্রয়োজনে কাট ছাট করে নিজেদের কাজে লাগিয়ে নাও, আরেকটু পড়ে নাও। দেখো, তোমরা নজরুলের কতো ঘৃনার পাত্র। >> :huzur:
খুবই ভালো লাগছে পড়ে! একেবারে সোজাসাপ্টা কথা!