কোথায় যেন কিছু একটা হয়েছে, সেদিন দেখলাম অনেকগুলো বুনো পিঁপড়ারা সারি বেধে হাঁটছে। এই অঞ্চলে প্রায় প্রতিদিনই একটু আধটু বৃষ্টি হয়। আর বৃষ্টিগুলো খুব বিচ্ছিরি টাইপের সুন্দর, বলা যায় বিরক্তিকর উপভোগ্য। বড় বড় কিন্তু পাতলা ফোঁটাগুলো খাড়া ভাবেই মাটিতে জোরসে আঘাত হানে, আর তাতেই কাঁদা ছিটকে উঠে অনেক উপর পর্যন্ত। গবাদি পশুগুলোকে লাঠির আগায় করে ঘর্মাক্ত রাখাল আর পিঠে বাচ্চা নিয়ে তার পাশে গল্প করতে থাকা রেড ইন্ডিয়ান নারীগুলো এই বাদল থেকে বাঁচতে খুব কাছাকাছি কোন ঝুপড়ি খুঁজে যাচ্ছে। কখনো পাহাড়ের ভাঁজের নিচে যে প্রাকৃতিক ঘাঁজ তৈরি হয়ে আছে সেগুলোর আড়ালে দাঁড়ায়, আবার একটু কমতেই ছোট গ্রাম্য শহরের নাড়াকুটোর আপন আবাসে ফিরে আসে।
সাধারণত বৃষ্টির সময় দূর থেকে থেমে থেমে কাউকে কাঁদতে শুনি, বিষয়টি আসলে কি তা বুঝতে পারছিনা। নিজের মধ্যে নিজেই কি নিজেকে গুলিয়ে ফেলছি? আসলে কি কিছুই শুনছিনা? নাকি আমার শ্রবণশক্তি নিয়ে কেউ খেলছে? দুনিয়াতে তো খেলোয়াড়ের কোন অভাব নেই, এ ওকে নিয়ে খেলে, আবার সুযোগ পেলে ও একে নিয়ে খেলছে। আনমনে এইসব ফ্যকাশে আকাশ কুসুম ভাবনাগুলোকে চিন্তার অস্তিনে সযত্নে রান্নাবান্না করতে করতেই এগিয়ে চলছে মধ্যবয়স পেরুতে থাকা হাড়জিড়জিড়ে কাঠমিস্ত্রির যুবক সন্তান।
হাঁটতে হাঁটতে বাজারটা ওর দিকেই এগিয়ে চলছে। সব কিছুই বুঝি একটু থমথমে। বৃষ্টির দিনে সাধারণত এখানের দোকানগুলো জমে উঠে, এটা একটু উলটো নিয়ম। আশপাশে মার্কেটগুলো বেশ দূরে থাকায় সবাই এদিকটাতেই আসে। আর বৃষ্টি হলে পথঘাট এক হাঁটু সমান কাঁদা জমে যায়। কাঁদাগুলোর রঙ মেটে কিংবা গেরুয়া নয়, একেবারে সবুজ। ঘটনা যে কি তা বুঝা মুশকিল। লোকজন সব আটকা পড়ে, আর তাতেই সবাই তাদের ভুলে যাওয়া কিংবা সখের জিনিশগুলো কিনতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে।
নর্থ ওয়েস্ট কোষ্টাল এড়িয়া থেকে আসা নতুন দুজন অতিথি তিসিমশিনিকে বকর বকর করে যাচ্ছে। শহুরে শব্দ হলে এবিজুন্দিও কিছুটা বুঝতে পারতো, কিন্তু একেবারেই গেঁয়ো। তবে খুব যে বুঝতে পারছেনা তা নয়, গতকালের ঔ লুটের বিষয়টিই সবার মুখে মুখে। কেউ বলছে এটা এস্কিমো যে ৪জন নতুন এসে গত সপ্তাহে মোটেল ভাড়া নিয়েছিলো ওদের কাজ। আবার অনেকের চোখ এবিজুন্দির দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের শালা সম্পর্কিত এলজিক ছেলেটির দিকে। কিন্তু হাবাগোবা ঐ ছেলেটির চেহারা দেখে এক লহমায় এবি বলে দিতে পারে ওকে দিয়ে এমন কাজ সম্ভবই না।
সে যা’ই হোক নিজের দোকান লুট হওয়ার পর- কে শত্রু কে মিত্র তা ক্যেমন যেন তালগোল পাকিয়ে গেছে। আগের সেই উজ্জ্বলতায় প্রচুর ভাটা পড়েছে। আজকাল যে কাউকে দেখলেই কুটিল সব আজগুবি টাইপের কথাবার্তা মনের মধ্যে ডানা ঝাপটায়। ভাবনা গুলোর ঘাড়টা ধরে মট করে ভেঙ্গে দেয় যুবক এবি। এরপর মনের ভেতরের ঐ অশালীন কথাগুলো কাটা মুরগীর মত তাপড়াতে থাকে। একসময় এমনিতেই হাওয়া হয়ে যায়।
দক্ষিণে কফি হাউজটার সামনে একটি টুলে ভায়োলিন নিয়ে বসে আছে এবেলিনো। বার্ধক্য তাকে এমনভাবে জেঁকে ধরেছে যে তার ভায়োলিনের হাতলটা ধরে টানার সময় একটা অন্যরকমের কাঁপুনি সৃষ্টি হয়। একসময় বাদক দলের সাথে বাজাতো, আজ বয়স পরে যাওয়ায় কেউ আর সাথে নিতে চায়না। বউটাও মরেছে গত বছর, ছেলেপেলে টেক্সাসের কোন খামারে কাজ করে বহুদিন হল খোঁজ নেই। কালো চশমার ওপাশের অন্ধকারে হয়তো যৌবনের সোনালী দিনগুলোকেই জাবর কাটছিল দন্তহীন কালো বুড়ো। চুলের মধ্যে জটা ধরে আছে, গায়ের আশেপাশে কিছু বড় সাইজের মাছিও উড়া-উড়ি করছে। পেছনে হাউজটার ছাঁদ চুইয়ে টপ টপ করে বৃষ্টির পানিগুলো পড়ছে। ভায়োলিনের তারগুলোতে পানির ফোটারা অনায়াসেই দোল খাচ্ছে।
এবি খুব নিকট দিয়েই অতিক্রম করে এই মানব বৃক্ষকে। বৃক্ষ না তো কি? ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। পা দুটো মনে হয় যেন থাম। তবে পাটকাঠির চেয়ে ইঞ্চি খানেক মোটা হবে, এর বেশী মোটেই নয়। ধীরে লোকটা ভায়োলিন বাজাচ্ছে, তারে জমা ফোঁটা পানিগুলো কেঁপে কেঁপে উঠছে। একটা দুটা করে ঝরে পরতে না পরতেই বৃষ্টির জল আবার শূন্য স্থান পূরণ করে নেয়। হঠাৎ এবির মাথাটা চক্কর মেরে উঠলো। প্রতিটি দোকানের সামনেই এক একজন এবেলিনো। একই বুড়ো সমস্বরে সবাই যেন ভায়োলিন বাজাচ্ছে। ধুপ করে পুরো শহরের গ্রামীণ বাতিগুলো নিভে গেলো। একটু আগে তো দিনই ছিল। এখন কি তাহলে রাত? রাত ক’টা হবে? দিন হলে সময়টা যা হতো রাত হয়েও কি একই?
স্বজনেরা সব কোথায়? বুড়ো মা বোধহয় ডাকছে, সেকি? মা তো মরে গেছে কতকাল আগেই, এটা তাহলে কার ডাক? এটা কি এব্রেলী? সেই কিশোরী মেয়েটা? যার ডাগর ডাগর চোখ দেখে ঘুম হয়নি বহুকাল?
টন করে একটা শব্দ হয় মস্তিষ্কের ভেতরে। কে যেন বিশাল এক হামার দিয়ে আঘাতের পর আঘাত করে যাচ্ছে। লুট হওয়া দোকানটাকে দেখে বুকের ভেতর হু হু করে উঠে। এইসব ঘটনার পরই পৃথিবীটা অস্বাভাবিক ঠেকে। আচ্ছা!! প্রাণের সাথে প্রাণের সম্পর্ক হয়। কিন্তু প্রাণের সাথে বস্তুর সম্পর্ক কেন হয়? এটা কি অবাস্তব নাকি অবস্তুগত টান বস্তুর সাথে? অথচ সব কিছু ছাপিয়ে কষ্টের দিনে ঐ মেয়েটার কথাই কেন মনে পড়ছে? সেই বিষণ্ণ কণ্ঠের গুনগুন, চাচার দোকানে কাজ জমে থাকা ব্যস্ততায় জানালায় আড় চোখে তাকালেই দেখত সে তাকিয়ে আছে। এবি আর ভাবতে চায়না। কেননা বুড়ো লোকটার ভায়োলিন বাজলেই অন্যরকম ঠেকে পরিচিত পৃথিবী। এব্রেলী নামক কাউকে আর কোনদিন লোকে খুঁজে পায়নি সেই বিশাল হ্যারিকেনের পর।
হাঁটছেই এবি, এখনো হাঁটছে। সব কিছুই শেষ হয়, তেমনি এই পথটাও বাজার ছাড়িয়ে বিরাট খাদে গিয়ে শেষ হয়েছে। খাঁদের একেবারে প্রান্তে দাঁড়িয়ে এবিজুন্দি। পায়ের সাথে লেগে দু চারটা নুড়ি খসে পড়ে নিচের বিশাল শূন্যতায় বিলীন হয়ে যায়। কুয়াশা ঢাকা খাঁদ। কিচ্ছু দেখা যায়না। আলগোছে জীবনটাকে ছেড়ে দেয় এবি। মহাকালের বক্র রেখায় সমান্তরাল হাটতে পারেনি সে কোনদিন। মেক্সিকোর এই ছোট্ট শহরে আর কখনো কেউ শুনেনি সেই বুড়ো বাদকের ভায়োলিন।
(এটা কোন অনুবাদ নয়)
এটা কোন অনুবাদ নয় !! হজম করতে কষ্ট হল। এত সুন্দর করে কীভাবে প্রেক্ষাপট আনলেন ? আর লেখার ধরন নিয়ে নাই বললাম। অসাধারণ !! সত্যিই মনে হচ্ছিল বিদেশি একটা উপন্যাসের অংশবিশেষ ! এইটার পরের পর্ব দেন পারলে, পড়তে ইচ্ছে হচ্ছে আরও।
পরের কোন পর্ব লেখা হয়নাই যে, আপনি বিশ্বাস করতে না চাইলে আমি কি করবো? আমি তো কেবল সত্যই বলি।
আমার লেখা একেকটা একেক রকম হয়।
দারুণ। অদ্ভুত সুন্দর
ধন্য হলাম
লেখাটা পড়তে পড়তে নচিকেতার একটা গান বার বার মনে পড়ছিল
“আমি বৃষ্টি দেখেছি
বৃষ্টির ছবি একেছি”
বৃষ্টি নিয়ে সুন্দর লিখা।পড়ে নল্টালজি হয়ে গেলাম।
আমার ভুল না হলে, এটা অঞ্জনের গান
হুম।এটা অঞ্জনের গান
এইজন্যই লেখকদের হিংসা করি! 🙁
কী ঘোরলাগা শব্দচয়ন …
যাক, হিংসা তো করেন… অনেকে তো কিছুই করেনা। কেবল ড্যাব ড্যাবা চোখে তাকিয়েই থাকে। বুঝসো? বলে হ্যা, বুঝোনাই? বলে না… যা বলি তা’ই।
“প্রাণের সাথে প্রাণের সম্পর্ক হয়। কিন্তু প্রাণের সাথে বস্তুর সম্পর্ক কেন হয়? এটা কি অবাস্তব নাকি অবস্তুগত টান বস্তুর সাথে?” – খুব সুন্দর প্রশ্ন।
কী সুন্দর লিখেন আপনি! আর কিনা বলেন আমার লেখা ভালো লাগে। অন্য দেশের কথা কীভাবে লিখেন? কল্পনা?
হ্যা, কিছু কল্পনা কিছু গুগল ম্যাপ