১৯৭১ সালে যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়,আমার বড় খালা তখন ২০-২২ বছরের এক বিবাহিতা তরুণী।১৫ বছর বয়সেই বিয়ে হওয়াতে ইতিমধ্যেই এক ছেলে-এক মেয়ের মা।বড় খালু তখন শেল পেট্রোলিয়ামের চাকুরে।চট্টগ্রামে মোটামুটি ঝুটঝামেলা বিহীন একটা নিরুপদ্রব জীবন।কিন্তু যে-ই না যুদ্ধ শুরু হল,তখন আমার খালা-খালুর অকুল পাথারে পড়ার দশা।চট্টগ্রামে আপনজন বলতে কেউ নাই।নিরাপদ আশ্রয় মানে কেবলই নোয়াখালী।কিন্তু যুদ্ধের ডামাডোলে সেখানে যাওয়াটা আর নিজের মাথা গিলোটীনে পেতে দেওয়া একই কথা।এমন সময় যেন দেবদূত হয়ে এলেন উনাদের পাশের ফ্ল্যাটেরই বাসিন্দা মহিলা।তিনিই প্রস্তাব করলেন,তাঁর সাথে বাবার বাড়ি বাঁশখালি যাওয়ার।মাত্র বছরখানেকের পরিচয়ে এক তরুণীকে এই মহিলা কেন এমন বড়বোনের স্নেহে নিজ বাড়িতে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন সেটাই এক রহস্য।যেহেতু অন্য কোন উপায় ছিল না,আমার বড় খালা তাঁর দুই সন্তানকে নিয়ে এক রাতে রওনা হলেন সেই মহিলার পরিবারের সাথে।বিশাল এক ছইওয়ালা নৌকায় তিনদিনের ভয়ার্ত এক ভ্রমণের পর পৌঁছালেন বাঁশখালি।সেই বাড়িতেই এক সম্মানিত অতিথি হিসেবে আমার খালা ছিলেন প্রায় দুই মাস।নিজের আপনজনের দুশ্চিন্তা যাতে খালার মাথায় ভর না করে কিংবা কখনোই যেন এই বাড়িকে পরের বাড়ি মনে না হয় সেজন্য সেজন্য এই দুইমাসে পুঁথিপাঠের আসর,লাঠিখেলা,যাত্রাপালা সহ নানা স্থানীয়-লোকজ আয়োজনে সময়টাকে আনন্দময় করে রেখেছিল তারা।পরে যুদ্ধের প্রচন্ডতা কিছুটা কমতেই নোয়াখালি ফেরত গিয়েছিলেন আমার খালা।খালা যেদিন বিদায় নিচ্ছিলেন সেই বাড়ি থেকে,সেদিন শুধু খালার সম্মানার্থেই আয়োজন করা হয়েছিল এক ফিস্টের।আমার দুই খালাত ভাই বোনের হাতে গুঁজে দেওয়া হয়েছিল তখনকার ১০+১০=২০ টাকা।
শুনতে কিছুটা অস্বস্তিকর যে সারা দেশ যখন পাকিস্তানি হানাদারদের হাত থেকে মুক্তির জন্য পাগলপারা হয়ে আছে তখন একটা পরিবার আনন্দ-ফুর্তির মধ্যে সময় কাটাচ্ছে।কিন্তু আমার কাছে এর একটা অন্য মানেও আছে।কারো মনের দুশ্চিন্তা দূর করতে এমন প্রাণান্ত চেষ্টা মানুষের প্রতি আমার দৃষ্টিভঙ্গিই বদলে দিয়েছে।চট্টগ্রামের মানুষগুলোই হয়তোবা এমন!আমার নিজের অভিজ্ঞতা ও এমনটাই বলে।আমার কেন জানি মনে হয়,কোন জায়গার ভৌগলিক অবস্থানের সাথে সে এলাকার মানুষের মন-মানসিকতার কোন একটা যোগসূত্র থাকে।চট্টগ্রামে পাহাড় আর সাগর আছে বলেই হয়তো কে জানে এখানকার মানুষগুলোর আচরণ ও বোধহয় অন্যরকম উদার।আপাতদৃষ্টিতে এখানকার মানুষের ভাষা-ব্যবহার কর্কশ মনে হলেও এরা কাউকে যদি একবার পছন্দ করে,তবে তার জন্য হয়তো জীবন ও দিতে পারবে।অনেকটা মুখে বিষ,অন্তরে মধু টাইপ অবস্থা! মানুষকে বিশ্বাস করার অবিশ্বাস্য একটা ক্ষমতা আছে এদের মধ্যে।মাত্র কয়েক বছর আগেও কোটি কোটি টাকার ব্যবসা কেবল মৌখিক কথা আর বিশ্বাস এর উপরেই করতেন খাতুনগঞ্জ-আসাদগঞ্জ এর পাইকারি ব্যবসায়ীরা।চাঁটগাবাসীর অতিথি আপ্যায়ন আর ভোজনবিলাসিতার সুনাম তো সারাদেশ জুড়েই বিস্তৃত।আরেকটা ব্যাপার না বললেই নয়,চিটাগং এর মানুষের পারিবারিক বন্ধন।সারা পৃথিবী জুড়ে যেখানে একক পরিবারের সংখ্যা কিংবা জনপ্রিয়তা বাড়ছে,সেখানে চিটাগং দেখবেন যৌথ পরিবারের প্রাণচাঞ্চল্য!এই বন্ধন কতটা দৃঢ় আর শক্তিশালী সেটা বুঝার জন্য চিটাগং এর কোন সামাজিক-পারিবারিক অনুষ্ঠানে আসলেই বুঝবেন।চাচাত কিংবা অন্য সব দূরের আত্মীয়ের সাথে এদের যে হৃদ্যতা,সেটা অনেক স্থানের আপন ভাই বোনের মধ্যেও আপনি কল্পনা করতে পারবেন না।
মানুষগুলো এমন বিশ্বাসী, চমৎকার আর প্রাণখোলা বলেই হয়তো চট্টগ্রামের উন্নয়ন হয়না।দেশের অর্থনীতির বেশ উল্লেখযোগ্য অংশ চট্টগ্রাম বন্দরের উপর নির্ভরশীল হলেও এর আয়ের খুব ছোট একটা অংশই খরচ হয় এখানে।নামকাওয়াস্তে ‘বাণিজ্যিক রাজধানী’!ঢাকা নিয়ে যত জল্পনা- কল্পনা তার অর্ধেকটা যদি এই সবুজ শহরকে নিয়ে হতো,তাহলে দেশের অবস্থাটা ও হয়তো অন্য রকম হতো।ছোটবেলা থেকে যে চট্টগ্রামকে দেখতে দেখতে বড় হচ্ছি,সেটা কেমন জানি বদলে যাচ্ছে।প্রচুর মানুষ,ট্রাফিক জ্যাম,ক্রমক্ষয়িষ্ণু সবুজ,যত্রতত্র নোংরা আবর্জনা এইসব মিলিয়ে একটা প্রাণউচ্ছল শহর কেমন জানি ধুসর হয়ে যাচ্ছে।তারপরেও এই শহরটা কেমন জানি মায়াবতী টাইপ।পাহাড়-নদী-সাগরের এই শহরে কখনো মন খারাপ হয় না!কখনো যদি শহর ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে হয়,মনটা যেন কেমন করে।সিটিগেইট যখন পিছনে ফেলে আসি,মনে হয় কিছু একটা ফেলে যাচ্ছি।কে জানে,নিজের শহর নিয়ে সবার অনুভূতিটাই হয়তো এমন।তা না হলে পৈতৃকবাড়ি নোয়াখালী আর সিলেটের কোম্পানিগঞ্জের পুলিশ কোয়ার্টারে জন্মানো একটা ছেলের চিটাগং নিয়ে এমন অনুভূতি থাকবে কেন?
পুনশ্চঃবিনা হেতুতে এত কিছু লেখার কারণ আমার প্রিয় এই নগরীর সিটি করপরেশান ১৫০ বছরে পা দিয়েছে।১৮৬৩ সালে মাত্র চারটা ওয়ার্ড নিয়ে যাত্রা শুরু করা চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যালিটি এখন ৪১ ওয়ার্ডের চট্টগ্রাম সিটি করপরেশান।একটা মফঃস্বল শহর যখন পৌরসভা বা সিটি করপরেশানএ রূপ নেয় তখন আমার মনে হয় এর মধ্যে যান্ত্রিকতার আমদানি হয়।আর ধারণা করা হয় ছোট্ট গ্রাম থেকেই চট্টগ্রাম নামের উদ্ভব!
খুব সুন্দর লিখেছেন।
শুধু চিটাগং না, ঢাকার বাইরে কোন জায়গাতেই আমাদের চোখ থাকে বলে মনে হয় না।
একটা দেশের উন্নতির জন্য এই জন্য দক্ষ পলিসি মেকার দরকার।
চাঁটগাবাসীরা সেই রকম পছন্দ করার কথা এই লেখা!
ভাইয়া আপনি যদি লেখা আহবান করেন,দেখবেন সবারই নিজ শহর নিয়ে এই ধরনের একেক্টা গল্প আছে।সবগুলো একত্র করলে দেখা যাবে সবাই নিজ শহরকে কতটা ভালোবাসে।কিন্তু এদের কেউ যখন ঢাকায় পলিসি মেকারের চেয়ারে বসে,তখন কেন জানি এরা বেমালুম ভুলে যায় কিংবা হাত-পা বাঁধা অবস্থায় বসে থাকতে হয়।এক ঢাকার উপরে প্রেশার দিতে দিতে আমরা এমন একটা অবস্থায় নিয়ে দাঁড় করেছি যে ঢাকা যে এতদিনে নিচের দিকে যে ডেবে যায়নি-এটাই অনেক বেশি!আমি মাঝে মধ্যে ঢাকায় গেলে অবাক হয়ে থাকি।সকাল বেলা যখন কর্মমুখী মানুষ কাজের জন্য বের হয় আমার ভাবতে অবাক লাগে এত মানুষ থাকে কোথায়?গোটা দেশের সব কাজের অফিস ঢাকায় নিয়ে তুলে রাখা হয়েছে।কেউ না চাইলেও তাঁকে ঢাকায় যেতে হয়,যেতে বাধ্য! 🙁
‘একজন’ যদি দক্ষ পলিসি মেকার দরকার হয় তবে একনায়ক ছাড়া আর কোন উপায় নাই।আর স্থিতিশীল উন্নয়নের জন্য পুরো সরকারযন্ত্রটাকেই একটিভ হওয়া ছাড়া আর কোন বিকল্প রাস্তা নাই।
এটা আর কি এমন ছাইপাশ লেখা!তবে চিটাগং-চিটাগং এর মানুষ সব কিছু খুবই ভালোবাসি।লেখা দিয়েও অনেক সময় ভালোবাসাটা পুরোপুরি তুলে আনা যায় না :love:
শুরুতে ভেবেছিলাম মুক্তিযুদ্ধের কোন গল্প ! সেটা গিয়ে ঠেকল চাটগাঁয় ! এই শহরে খুব অল্প কিছুদিন থাকার সুযোগ হয়েছিল, পাহাড়-নদী-সাগর তিনটার চূড়ান্ত ভক্ত হওয়ায় ভালো লেগে গেছে সেইরকম। দুঃখ এটাই, বিদেশে কত কত শহর গড়ে তোলে একটা দেশের মাঝেই, আর আমাদের এই ঢাকামুখীতা কবে ছাড়বে ! মানুষে উপচে গেছে শহরটা, ট্রাফিক জ্যামে সময় নষ্ট হচ্ছে কত কত। অমন পলিসি মেকার যে কবে পাব আমরা যিনি কিনা বিভাগীয় শহরগুলোকে অন্তত আধুনিক করে তোলার চেষ্টা চালাবেন। :crying:
এই মুহূর্তে তেমন কিছু করার সুযোগ নেই।তবে কখনো যদি ‘কিছু একটা’ হয়ে যাই,তবে সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে এই শহরটার জন্য কিছু করার।আমার প্রিয় শহরকে ভালোবাসার জন্য ধন্যবাদ 🙂