নূরা পাগলা

খুব সাবধানে গ্রামের ভেতরে ঢুকে পড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝারি আকারের দলটি।

দলনেতা আজাদ। সে কখনও কল্পনাও করতে পারে নি, তার গ্রামে প্রত্যাবর্তনটি এমন হবে। পাক বাহিনীর এক কুখ্যাত অফিসারকে(ইউনুস) ট্র্যাক করছিল তারা। শেষমেষ তার নিজের গ্রামে এসে তাকে ছোঁয়া যাবে মনে হচ্ছে।

হারামজাদাগুলা কাম শুরু কইরা দিসে মনে হয়।

বলে ওঠে আনিস দূরে জ্বলতে থাকা ঘরবাড়ি দেখে। আজাদ কয়েকভাগে ভাগ করে দেয় তাদের দলকে। দুশ্চিন্তা তাকে চেপে ধরেছে। তার কথা সে রাখতে পারবে আর একটু হলেই। কিন্তু এই একটু স্তরটাই অনেক গভীর।

 

 

এক ঘণ্টা আগে।বর্তমান ঘটনাস্থল থেকে এক কিলোমিটার দূরে

 

-বউমা?

-জ্বি আব্বা?

-দেহতো বাছুরটারে পোলাপাইন কই দৌড়ান দিসে?

-আইচ্ছা আব্বা দেখতাসি।

নার্গিস উঠোন পেরিয়ে বাড়ির বাইরে আসে। আশেপাশের বাড়ির ছোট বাচ্চাগুলো তাদের বাছুরটাকে নিয়ে খেলতে বড়ই আনন্দ লাভ করে। তাদের আনন্দের সাথে নার্গিসের কষ্টও সমান্তরালভাবে চলছে। আজাদের কোন খবর নেই দুই মাস হল। শেষ চিঠিটা এসেছিল দুই মাস আগে। চিন্তায় নার্গিসের কিছু ভালো লাগে না। বৃদ্ধ শ্বশুরের সেবা করতে করতে আর ঘরদোর সামলে রাখতে রাখতেই তার সময় কেটে যায়। আর এই বাড়তি কাজগুলোও করতে হয় তাকে।

মাঠের সামনের নারিকেল গাছটার নিচে এসে চারদিক তাকায় সে। কোথাও তার লক্ষ্যবস্তুর কোন চিহ্ন নেই। সাতপাঁচ ভেবে বামদিকে এগোয় সে। বেশ খানিকটা পথ যাওয়ার পর সেই বাদাম গাছটা চোখে পড়ে তার। দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাকিয়ে থাকে সে।

 

যুদ্ধের ঠিক আগে। ওরা বিয়ের আগে লুকিয়ে দেখা করত এখানে অনেকদিনই। তুলনামূলকভাবে নিরাপদ ছিল জায়গাটা। বিয়ের অল্প কয়দিন পর একদিন আজাদ তাকে নিয়ে আসে এ গাছের নিচে। আজাদ সেদিন কেন জানি একটু গম্ভীর ছিল ,নার্গিসের হাতটা এত জোরে চেপে ধরেছিল যে প্রায় ব্যথা পেয়ে গিয়েছিল সে।

-কী হইসে, এত জোরে চাপ দাও ক্যান, হ্যাঁ?

-এই নার্গিস, তোর মনে আছে, আমরা যে এইহানে বইসা একলগে গান গাইতাম?

-আছে না আবার! তোমার যেই গানের গলা, আমি চাইলেও তো ভুলতে পারুম না!

হিহি করে হাসে নার্গিস , মুগ্ধ দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকে আজাদ।

হাসলে তোরে অনেক সুন্দর লাগে রে…

হ  হ জানি, আর আপনের গান শুনলে ডরে কাক পক্ষী সব উইড়া যায়, এইজন্যই ত এইহানে বসতাম, কেউ জ্বালাইত না!

নার্গিসের হাসিমুখটা যেন অদ্ভুত এক মায়ায় বেঁধে রাখতে চায় আজাদকে। নিজেই বিশ্বাস করতে পারছে না যে এটাকে ছেড়ে তাকে চলে যেতে হবে। ভালোবাসার মানুষটিকে যখন শোনানো হয় যুদ্ধে যাওয়ার কথা, তার ভেঙে পড়া অন্তরের অশ্রুবন্যা সামলাতে শক্ত করে ধরে রেখেছিল বাঁধ আগে থেকেই আজাদ। সেই বাঁধকে নাকানিচুবানি দিয়ে যখন থামল নার্গিস, তখন আজাদ ওর চোখের দিকে তাকাল সরাসরি।

-আমি চইলা আসুম, তোরে কথা দিতাছি। শুধু বল, তুই আমারই থাকবি?

-থাকুম, আমি তোমারই, তুমি কিন্তু সাবধানে থাকবা।

 

শারমিনের ধাক্কায় বাস্তবে ফেরে নার্গিস।

“ভাবি জলদি পালাও, মিলিটারি আইসে গেরামে!”

নির্বাক হয়ে যায় এক মুহূর্তের জন্য নার্গিস, মিলিটারি কী এবং তারা কী করে থাকে তা জানা আছে তার। শুধু জানা নেই মিলিটারি আসলে কী করতে হয়।

না, সে জানে। পালাতে হবে তাকে। কিন্তু আব্বা? বুড়ো মানুষটাকে একলা কই রেখে যাবে সে? আব্বাকে নিয়েই পালাতে হবে। চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞা নিয়ে বাড়ির দিকে ছুটে যায় নার্গিস। সে আজাদকে কথা দিয়েছে, সে শুধু তারই থাকবে। আর কারো হবেনা।

আল্লাহ আজকে খুব বড় ধরনের পরীক্ষা নিচ্ছে নার্গিসের। নাহলে সে ঘরে ঢোকা মাত্রই পাক বাহিনীর আসা লাগবে কেন? দরজা জানালা লাগিয়ে রেখেছে সে, চারদিক ঘিরে ফেলেছে ওরা সে জানে। কোনমতেই ওদের হাতে পড়বে না সে।

 

আজাদের বাবা টয়লেট থেকে বের হয়ে বুটের লাথি খেলেন। পাক অফিসার ইউনুস তার কুৎসিত দাঁতগুলো বের করে তার পিঠে লাথি মারল। তারপর এক সাধারণ সৈনিকের হাতে বৃদ্ধকে সোপর্দ করে ঘরের দরজার দিকে তাকাল সে। অবস্থাটা একটু জটিল। বৃদ্ধ বাঙালি নির্যাতন আর বাঙালি মেয়ে ধর্ষণ- দুটোই সমানভাবে উপভোগ করে সে। কোনটা রেখে কোনটা করবে ভাবনার বিষয়।

 

খেপা কুকুরের চেয়েও জোরে ছুটে চলেছে আজাদ। সে এখন জানে ইউনুস কোন দিকে গিয়েছে। এই দৌড়ে তাকে জিততেই হবে তাই। তার সহযোদ্ধারা তার সাথে তাল মেলাতে পারছে না তার গতির কারণে।

 

সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে ইউনুস। দরজার ওপাশের অজানা রহস্যটাই তাকে টানছে বেশি। তাই দরজা ভাঙার কাজটাই করবে সে। বৃদ্ধকে শেষ করে ফেলার হুকুম দিয়ে কাঠের পাতলা দরজায় লাথি হাঁকায় সে।

উঠোনে নেতিয়ে পড়া বৃদ্ধটির মাথার দিকে বন্দুক তাক করে পেটমোটা পাকসেনাটি। কিন্তু ট্রিগারে চাপ দেওয়ার আগের মুহূর্তে তার মোটা পেট ফুটো হয়ে যায় একটি বুলেটে। আজাদের দ্বিতীয় গুলিটি ইউনুসের অবাক হয়ে যাওয়া দুই চোখের মাঝ দিয়ে চলে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই গেরিলা আক্রমণে ধরাশায়ী হয় প্রত্যেকটি পাকসেনা।

 

বাবা কে তুলে বসিয়ে দরজার দিকে ছুট লাগায় আজাদ।

“নার্গিস? এই নার্গিস? আমি, আমি আসছি, তোরে কইসিলাম না? দরজা খোল, আর ভয় নাই!”

কোন সাড়াশব্দ নেই।

দরজা ভেঙে ফেলা হয়।

গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে থাকা নার্গিসের শরীরের প্রত্যেকটি কোষ যেন চিৎকার করে আজাদকে বলে ওঠে, “দেখ, আমি কথা রাখসি! আমি শুধু তোমার, আর কারো  না!”

আজাদ নার্গিসের নাম ধরে ডাকার চেষ্টা করে। পুরো নামটি অনেক কষ্ট করেও সে উচ্চারণ করতে পারেনা।

 

 

২০১৩ সাল। পাগলদের ওপর একটা ডকুমেন্টারি করতে সেই গ্রামে এসেছে একদল তরুণ-তরুণী। এলাকার লোকদের কাছে জানা গেল এই গ্রামের সবচেয়ে বয়স্ক পাগলের নাম হল নূরা পাগলা। দলনেতা আবিদ জিজ্ঞেস করে এক গ্রামবাসীকে, “আচ্ছা নূরা পাগলা নামটা আগেও শুনেছি অনেক পাগলের, আমাকে ইনার নামকরণের কাহিনীটা বলতে পারবেন? কীভাবে এই নাম হল উনার?”

“আরেধুর! এইডা কিছু হইল? আপনে নিজেও বুঝবেন, সারাদিন খালি নার্ নার্ করতে থাকে, গ্রামেই মাইনষে নাম দিয়া দিসে নূরা পাগলা। আর হ্যাঁ সারাদিন খাড়ায় থাহে, ঘুমায়ও মনে হয় খাড়ায়া খাড়ায়া।”

 

আবিদ এবং তার দল দূর থেকে লক্ষ্য করে একটা মানুষ ঘাড় বাঁকা করে অদ্ভুতভাবে দাঁড়িয়ে আছে, তার দাড়িগোঁফের জংগলের মাঝখানে দুটি চোখ জ্বলজ্বল করছে। কাছ থেকে দেখলে মনে হবে লোকটিকে যেন ফাঁসি দেওয়া হচ্ছে। তাই সে এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে।

আর সারাক্ষণ বলে যাচ্ছে, নার্ নার্…”

 

কিছু একটা বলতে চাইছে নিশ্চয়ই। কী, সেটা আবিদের মাথায় খেলল না।

 

ইতস্তত বিপ্লবী সম্পর্কে

যদি কখনো আমায় মনে পড়ে যায়,খোলো দুয়ার আকাশের-আমি তারাময়!
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে গল্প, সাহিত্য-এ এবং ট্যাগ হয়েছে , , , স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

4 Responses to নূরা পাগলা

  1. মাধবীলতা বলেছেনঃ

    গল্পটা বেশ ভালো লাগল। যুদ্ধের সময় জন্ম নিলে কী যে হত মাঝে মাঝে এই ভেবে যাই…

  2. সত্যান্বেষী বলেছেনঃ

    তোর লেখা আস্তে আস্তে সুখ থেকে সুখতর পাঠ্য হচ্ছে। গুড সাইন! 😀

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।