“আমারে ক্যামন লাগতাসে?”
আম্মার দিকে তাকিয়ে আমার চোয়াল ঝুলে পড়লো। লাল টুকটুকে একটা শাড়ি পরনে, দু’হাত ভর্তি স্বর্ণের চুড়ি, সকালের রোদ লেগে তাতে ঝিলিক দিয়ে উঠছে, গলায় একটা রূপোর হার, আর মাথায় মুকুট, কোয়েলের ডিমের মতন বড় একটা পান্না মুকুটটার ঠিক মাঝখানে বসানো, সবুজ আলো ঠিকরে পড়ছে সেখান থেকে। এই মুকুটটার আমাদের পরিবারে আসা নিয়ে একটা মোটাসোটা ইতিহাস আছে। আমার বাবার দিদা আলফাকেন্নেসা বিবি ছিলেন লর্ড কার্টারের স্ত্রীর খাস চাকরাণী। একবার লেডি কার্টার পা ফসকে পুকুরে পড়ে গেলে আলফাকেন্নেসা বিবি ঝাঁপ দিয়ে নিজের প্রাণ বাজি রেখে তাকে উদ্ধার করে। লেডি কার্টার তখন খুশি হয়ে তাকে এই মুকুটটা দিয়ে বলেন, “ইহা হাতছাড়া করিয়ো না, সুখ আর সমৃঢঢি সবসময় টোমাডের সাঠে ঠাকবে।” লেডি কার্টারের কথা ফলে যায় দারুণভাবে। মুকুটটা পাওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই আলফাকেন্নেসা বিবির গর্ভে আমার দাদা আসেন। এরপর থেকে তাদেরকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। একটা দোকান দিয়ে, জমি-জমা কিনে বেশ কয়েক বছরের মধ্যেই আলফাকেন্নেসা বিবি ও তার স্বামী মহকুমার মান্য-গণ্য ব্যক্তিতে পরিণত হন। এই পুরো সময়টা মুকুটটা যত্ন করে কাপড়ে মুড়িয়ে ট্রাঙ্কে তোলা ছিল, দিদার হাত ঘুরে যার মালিকানা বর্তেছে আমার আম্মা’র উপর।
“কি রে, কইলি না ক্যামন লাগতাসে আমারে?”
আমি এক ঝটকায় বাস্তবে ফিরে আসি। আমার সামনে আম্মা মৃদু হাসি মুখে তার বিয়ের সাজে দাঁড়িয়ে, আমার অবহেলায় কিঞ্চিৎ বিরক্তিতে ভ্রূ দু’টো কুচকে আছে।আমি দাঁত বের করে বললাম, “তোমারে এক্কেরে ডানাকাটা পরী লাগতাসে!”
“আহ, কি যে কস না! শরম লাগে না আমার?”, আম্মা লজ্জা পেয়ে ঘোমটাটা টেনে দেয় আরেকটু। নাম-না-জানা কি এক ফুলের সুগন্ধ এসে ধাক্কা মারে নাকে। আমার চোখের প্রশ্ন বুঝতে পেরে আম্মা বলে, “তুই যে গত শীতে শহর থিক্কা সেন্ট আইনা দিলি একটা, মনে নাই?”
আমি উত্তর না দিয়ে আম্মার দিকে তাকিয়ে রইলাম। ছোটখাট একটা মানুষ, রং শ্যামলা, একটু কালোর দিকেই বলা যায়-কিন্তু লাবণ্যতা আর কমনীয়তা দিয়ে তা পুষিয়ে দিয়েছে, বয়সের ছাপ পড়েনি বললেই চলে, পাশের গ্রামের রাণুপুর পাশে দাঁড়ালে দুজনকে দিব্যি বোন বলে চালিয়ে দেওয়া যাবে!-অনভ্যস্ত সাজে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে চৌকাঠে, ঘোমটার ফাঁক দিয়ে বড় বড় চোখ মেলে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি অস্ফুটে বলে উঠলাম, “আব্বা আজকে আইয়া তোমারে দেখলে তার চক্ষু ট্যারা হইয়া যাইবো!”
এক মুহূর্তের জন্য আম্মা কেঁপে উঠে কেমন যেন, চোখে একটা দিশেহারা ভাব। ওই এক মুহূর্তের জন্যই, হয়ত আমার দেখার ভুল। নি:শব্দে কেটে গেল অনেকটা সময়, সেই নি:শব্দতার মধ্য দিয়ে কি কথা হয়ে গেলো মা-ছেলের মাঝে, দুনিয়ার কেউ জানলো না! হঠাৎ সপ্রতিভ হয়ে আম্মা নিস্তব্ধতা ভাঙে, “তোর না কাম আছে মাঠে? জলদি যা! হারাদিন তো খালি কামে ফাঁকি দেওনের তালে থাকস!” তারপর চোখ লুকোনোর চেষ্টা করতে করতে আম্মা ঘরের ভেতর ঢুকে যায়।
লাল গাইটা সাথে নিয়ে আমি মাঠের দিকে রওনা দেই। ভাবতে থাকি আম্মার কথা, বিয়াল্লিশ বছর আগে শ্রাবণ মাসের এক রাত্তিরে আব্বা ঘর ছাড়ে। কথা ছিল দেশ স্বাধীন করে ঘরে ফিরবে। আব্বা ফিরেনি, আম্মা তবু আশা ছাড়েনি, প্রতি বছর শ্রাবণ মাসের এক তারিখ আম্মা সেজেগুজে আব্বার প্রিয় খাবার রান্না করতে বসেন। অপেক্ষা করে থাকেন ছাতা মাথায় আড়াই হাত লম্বা ইলিশ মাছ নিয়ে সেই চিরপরিচিত প্রিয় মানুষটা কাচুমাচু মুখ নিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়াবে বলবে, “কমে পাইয়া গেলাম, তাই লোভ সামলাইতে পারলাম না!” আম্মার অপেক্ষা আর শেষ হয় না।
২.
রাস্তার পাশের দেবদারু গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে লোকটা জামালের চোখের আড়াল হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে। তারপর বাড়ির দিকে নজর ফেরায়। সুরমা মাখা কালো কুতকুতে চোখে বাড়ির দিকে তাকিয়ে থেকে লোকটা শব্দ করে মাটিতে পানের পিক ফেলে, পাঞ্জাবির পকেট থেকে রুমালটা বের করে মুখটা মুছে নেয় একবার। বেড়ার ফাঁক দিয়ে জামালের মা’কে দেখা যায়, এদিক পেছন ফিরে উঠোন ঝাড় দিচ্ছে। জিভে চলে আসা লোলটা সুড়ুৎ করে টেনে গিলে নেয় লোকটা। ‘মাগীর শইলে তো ভালই রং লাগসে দেহি’, নীরব হাসিতে লোকটার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠে। ঠোঁট বেয়ে এক ফোঁটা পানের রস গড়িয়ে পড়ে। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে সেটা মুছে নিয়ে লোকটা বাড়ির দিকে পা বাড়ায়।
খুট করে একটা শব্দ শুনে জামালের মা পেছন ফিরে তাকায়। লোকটা জিভ দিয়ে তার ঠোঁট দু’টো ভিজিয়ে নেয়। লকলক করে কোনও শব্দ হয় কি?
৩.
আমি শিষ দিতে দিতে ঘরের দিকে যাচ্ছি। মাঠে গিয়ে খেয়াল হলো, পানির মালশাটা সাথে নেই। অতএব, পিছটান।
উঠোনে পা রেখেই আমার মনে হল, কি যেন একটা ঠিক নেই। ওই তো চূলোয় ভাত চড়ানো, পাশে অর্ধেক মাছ কুটে রাখা, ভাতটা নামিয়েই মাছের তরকারিটা বসিয়ে দেওয়া হবে। উঠোনে ধুলোর সাগরে ঝাড়ুটা লুটোপুটি খাচ্ছে। আমি সতর্ক হয়ে উঠি। হঠাৎ আমার মেরুদণ্ড দিয়ে ভয়ের একটা স্রোত শিরশির করে নিচে নেমে যায়। ঝাড়ুটার অদূরেই সবুজ একটা কি যেন জ্বলজ্বল করছে। ওটা যে লেডি কার্টারের মুকুট সেটা বুঝতে আমার কাছে যাওয়া লাগলো না। কিন্তু এটা মাটিতে কি করছে? আমি বাড়ির দিকে দৌড়ে গেলাম, দরজা থেকে পাঁচ হাত দূরে আম্মার লাল টুকটুকে শাড়িটা পরে আছে। আমার বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটাতে লাগলো, মাথার শিরাটা দপদপ করে উঠানামা করতে লাগলো। দরজার ওপাশ থেকে চাপা একটা গেঙানির শব্দ ভেসে আসে।
প্রচণ্ড রাগ, ভয় আর ভয়ংকর আশঙ্কার আতঙ্কে আমি দিগ্বিদিক জ্ঞান হারালাম। কোনওকিছু না ভেবেই দৌঁড়ে গিয়ে দরজা ভেঙ্গে ঘরে ঢুকলাম। আমার তীব্র দৃষ্টি সুরমা মাখা কালো কুতকুতে দু’টো চোখে গিয়ে স্থির হল।
৪.
লুঙ্গির গিঁটটা ঠিকমত লাগাতে লাগাতে লোকটা ঘর থেকে বের হল। আমি দৌড়ে গিয়ে একটা চেয়ার এনে দিলাম।
“কাকা, একটু আরাম কইরা বসেন।”
কাকা বসতে বসতে বললেন,
“তা বাবা জামাল, তোমার খবর কও, আছো কেমন?”
আমি হাত কচলাতে কচলাতে বলি,
“এইতো কাকা, আপনাদের দোয়া। আপনি আইবেন জানলে মন্টুরে কইয়া কয়ডা আম পাইড়া রাখতাম।”
“আহ, এত ফাল পাইড়ো না তো। আহো, বহো, তোমার লগে সুখ দু:খের আলাপ করি।”
“কাকা, আপ্নের কোনও তকলিফ হয় নাই তো? ঘামে তো পাঞ্জাবিটা ভিইজ্যা গেসে অ্যাকবারে, আপ্নে বন, আমি পাখাডা লইয়া আসি”
পাখা নিয়ে এসে কাকার পায়ের কাছে বসতে বসতে আমি মুখ কাচুমাচু করে বললাম,
“আসলে হইসে কি, ঘরের ফ্যানডা দুইদিন ধইরা ডিস্টাব দিতাসে, গোস্তাখি মাফ নিবেন”
কাকা এবার একটু ইতস্তত করে বলার চেষ্টা করে,
“বাবা জামাল, আজকে ঘরের ভেতর যা হইলো…..”
আমি জিভে কামড় দিয়ে তাকে কথার মাঝখানে থামিয়ে দিলাম,
“আপ্নে আমারে আর শরম দিয়েন না কাকা! আপ্নে আমার বাড়িতে আইসেন এইডা যে আমগো কত বড় সম্মান! আশপাশের দশ গেরামে আপ্নের মত মুরুব্বী আর দুইডা আছে নি? আমি তো বাড়িত আসিলাম না, আমার মায়ে ঠিকঠাকমত আপ্নের খেদমত করসে নি?”
কাকার ফর্সা গালে গোলাপি আভা দেখা যায়। আমি দেখে মুগ্ধ হই! কাকা লাজুক হেসে বলেন,
“ফুলবানু মাশাল্লাহ চেষ্টার কোনও ত্রুটি রাখে নাই, বিলকুল লাজওয়াব। তবে…”
“তবে কি কাকা? আপ্নে মুখ ফুইট্টা খালি কন।”
“তবে তোমগো খাটিয়াটা আরেকটু আরাম হইলে ভালা হইতো, আমার আবার বাতের ব্যাথাটা….. হে হে, বুঝোই তো!”
লজ্জায় আমার মাথা কাটা গেল। আমি হাত কচলাতে কচলাতে বললাম,
“গোস্তাখি মাফ করবেন কাকা। আমি কাইলকাই লোক দিয়া শহর থিক্কা ভাল তোশক আনামু। পরেরবার আইসা আপ্নেরে আর কষ্ট পাইতে হইবো না, এই আমি কথা দিলাম।”
কাকা কৌতুকের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন,
“পরেরবার?”
আমি মাথা নুইয়ে কাকার পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকায় প্রশ্নের পেছনের হাসিটা চোখে পড়লো না। বললাম,
“বেয়াদপি মাফ করবেন, অবশ্যই যদি এই গরীবের ঘরে পা দিতে হুজুরের আজ্ঞা হয়”
কাকা এবার চেয়ারের হাতলে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। আমি হাত বাড়িয়ে সাহায্য করতে গেলে হাত নাড়লেন, বললেন, “আমার লাঠিটা নিয়ে আসো তো বাবা জামাল।”
আমি বারান্দা থেকে লাঠিটা আনতে আনতে তিনি আপনমনে বলতে থাকলেন, “তুমি অনেক ভালা একটা পুলা জামাল। তোমার বাপের মতন না। কত কইরা ইসমাইল্যারে কইলাম বউ-বাচ্চা রাইখ্যা ওই ভেজালের মইধ্যে যাইস না, মরবি, এইহানে থাক, আমার লগে কমিটিতে কাম কর। হালায় হুনলোই না! কয় কিনা, ‘আমার পরিবার নিয়া আপ্নেরে ভাবতে হবে না, আজম ভাই’ কত্তবড় আস্পর্ধা চিন্তা কর! আমার মুখের উপর কথা! পরদিন আইয়া দেখি তোর বাপ তোরে আর তোর মা’রে নিয়া উধাও। পরে হুনলাম তোগোরে তোর নানার কাসে দিয়া হারামজাদাটা যুদ্ধে গেসে। মা***দ”
“কাকা?”
কাকার হঠাৎ সম্বিত ফেরে। আমি লাঠিটা বাড়িয়ে দিতে আমার দিকে তাকিয়ে তার মুখে মিষ্টি একটা পবিত্র হাসি ফুটে উঠৈ। আহা, ওই মাসুম হাসি দেখলে শয়তানেরও দিল ঠান্ডা হয়ে যাবে, চরম শান্তিতে। কাকা আমার মাথায় একবার হাত বুলিয়ে দিলেন। আমি গদগদ স্বরে বললাম,
“আসসালামুআলাইকুম, কাকা। আবার আসবেন।”
কাকা পেছন না ফিরেই একটা হাত তুলে সালামের জবাব দেন।
আমি আবারও মুগ্ধ হই! সময়কে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে এই মানুষটা নব্বইটা বসন্ত পার করে এসেছে, এ কী চাট্টিখানি কথা? তারপরেও দেখো কী দাপট! কী স্বচ্ছ তার চিন্তাধারা, কী দৃপ্ত তার পদক্ষেপ, কী সুন্দর শিশুর মত শুভ্র পবিত্র তার হাসিখানি!
আমি তাকিয়ে দেখি, আজম কাকা তার ৯১ বছরের ভারি শরীরটা লাঠিতে ব্যালেন্স করতে করতে আঁকাবাঁকা মেঠো পথ ধরে সামনের দিকে হাঁটা দিয়েছেন। তার সাদা পাঞ্জাবিতে শেষ বিকেলের আলো পড়ে অপার্থিব এক দ্যুতি ছড়াচ্ছে। আমার চোখ ঝলসে যায়, আমি তবু তাকিয়ে থাকি।
পেছনে বাড়ির ভেতর থেকে একটা চাপা কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে।
“আহ্”, বিরক্তিতে আমার ভ্রূ কুচকে উঠে।
কী ভয়াবহ। কী ভয়াবহ।
কী নির্লজ্জ। কী নির্লজ্জ।
:dhisya:
এত লজ্জা কোথায় রাখি 🙁
:dhisya: :dhisya: :dhisya:
দুনিয়াতে সবচেয়ে ইতিবাচক দিক আপাতত তোর লেখালেখি শুরু করা, অনেক গুতানোর পর অবশেষে!! :welcome:
হে হে :beerdrink:
কয়দিন কনটিনিউ হয় দেখ!
আরে হবে হবে! আমি তো ব্যাপক অনিয়মিত, আমার চেয়ে বেশি নিয়মিত থাকার চেষ্টা করিস! :dhisya:
লেখনী অসাধারণ, দারুণ, দুর্দান্ত, ঝরঝরে!!
লেখা পড়ে লজ্জায়-ঘৃণায় ভেতরটা কী হয়ে যাচ্ছে লিখে বোঝাতে পারব না!!
শুরুতেই ছক্কা মেরে ফাটিয়ে দিলেন দাদা!!
এমন লেখা আরো আরো চাই! :huzur:
অবশেষে পড়লা তুমি! যে কয়টা মানুষের জন্য আজকে হাতে কলম তোলার সাহস হয়েছে, তার মধ্যে তুমি একজন। সেই ফিনিক্সাপু বলেছে লেখা ভাল হইসে!! ইয়েপ্পিইই!! :yahooo:
awesome ending .. i really like this kind of unexpected stories. :clappinghands: