Before Midnight: আসলেই একটি ভালবাসার গল্প

“একজন পুরুষ যার ভাষা ব্যঙ্গাত্মক , যে নিজেকে ঘিরে রেখেছেন সিনিসিজম দিয়ে, আর একজন নারী যে সবকিছুকে পেশন দিয়ে চিন্তা করে, নারী বাদী ; পুরুষদের সব ইশারা ইংগিত কোন না কোন ভাবে তার জন্য অপমানকর ।তারা দুজনই কিন্তু বিপরীত লিঙ্গ সম্পর্কে অতিমাত্রায় শিক্ষিত এবং সচেতন ।একে অপরের প্রতি যা অনুধাবন করেন তা অসঙ্কোচে প্রকাশ করতে তারা খুব উত্সাহী ।”  একটি ডায়লগবেসড মুভি বানাতে এর চেয়ে আর ভাল কোন ক্যারেক্টর তৈরি করা হয়তবা  সম্ভব নয় । ডিরেক্টর রিচার্ড লিংকক্লেটার এই অসামান্য দুটি চরিত্র তৈরি করেছিলেন ১৯৯৫ সালে তার প্রথম মুভি বিফোর সানরাইজ দিয়ে । পুরুষ চরিত্রের নাম জেসি, নারী চরিত্রের নাম সেলিন । তাদের নতুন মুভির নাম বিফোর মিডনাইট(২০১৩) ।

লিংক্লেটার  এর আগের দুটি মুভিতে এমন কিছু রোমান্টিক মুহূর্ত দেখিয়েছেন যা একজন মানুষ তার যৌবনকালে শুধু স্বপ্নে চিন্তা করতে পারে : স্বপ্ন-বালিকার সাথে অনাকাঙ্ক্ষিত এক মুহূর্তের সাক্ষাত্, কাল বিলম্ব না করে তার প্রেমে পড়া(before sunrise(1995)) এবং নয় বছর পড়ে হটাৎ তার মুখোমুখি হওয়া এবং আবিষ্কার করা যে , গত নয় বছরের তাদের দুজনের জীবনের প্রত্যেকটা প্রতীক্ষার মুহূর্তগুলোর মধ্যে কতটা অকৃত্রিম  সাদৃশ্য  ছিল । এই নবছরের না বলা সব সংলাপ তারা বলে শেষ করেন এক  বিকেলে । এই জন্যই এই মুভির নাম হল Before Sunset(2004) । দিন শেষে তারা বুঝতে পারেন নয় বছর আগে যে আগুন নিজের অজন্তেই ভুল করে তারা জ্বেলেছিলেন , তা এখনও তাদের প্রৌড়ত্বের কাছে কোন অংশে হার মানেনি । আজকে এই মুভি দুটি  নিয়ে কথা বলবনা ।

তারই ধারাবাহিকতায়, নয় বছর পড় লিংক্লেটার দেখিয়েছেন আরও ধারালো  বিফোর মিডনাইট(2013)  এবং রোমান্টিসিজমের গতানুগতিক ধারা থেকে বেরিয়ে তিনি এর বাস্তবতাটাকে এবার হাইলাইট করার চেষ্টা করেছেন । তার অর্থ এই নয় যে চরম বাস্তবতাকে রোমান্টিকতার প্রতিপক্ষ হিসেবে দাড় করিয়েছেন । যেটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় । এটা হয়তবা ভিয়েনার রাস্তায় চাদের আলোয়  হাটার মত নয়   , হয়তবা সন্ধ্যায় পেরিসে ঐ যুগলের অভিমানীয় ঝগড়ার মত নয় , এটা তার চেয়েও সার্বজনীন । এই মুভিটি হচ্ছে আগের সব অসাধারণ প্রণয়ের ক্ষণগুলোকে একত্র করেছে । উপরের উল্লেখিত দুটি মুভি দর্শকদের চাহিদা এত বেশি বাড়িয়ে দিয়েছিল যে মুভি বোদ্ধারা প্রায় অবাক হয়েছেন এরকম একটা পরিণতিতে ।

”অতঃপর তাহার সুখে শান্তিতে বসবাস করিলেন । কেন জানিনা মানুষ মাত্রই প্রত্যেকটি রোমান্টিক মুভির এরকম একটা সমাপ্তি চান ।কিন্তু বিফোর সিরিজকি রোমান্টিক ক্যাটাগরিতে পরে ? হয়তবা , হয়তবা নয় ।  বিফর সিরিজ শুরু থেকেই তার মুভি সমাপ্তির জন্য বিখ্যাত । এবারও তার ব্যতিক্রম নয় । কালক্ষয় বজায় রেখে ঠিক আগের মুভিটা যেখানে শেষ করেছিলেন সেখান থেকে শুরু এই মুভির । যারা উপরের দুটি মুভি দেখেছেন তারা অবশ্যই জানেন যে জেসি এবং সেলিন তারা একে অপরের সাথে তর্ক করতে পছন্দ করেন , যুক্তির বিপরীতে যুক্তিই ছিল বিফর সানরাইজ এর মুল কাহিনী । বিফর সানরাইজের পুরোটা মুভিতে তারা একে অপরের সাথে তর্ক করেছেন , কিন্তু মুভি শেষে একটা জিনিস তারা বেছে নিলেন যা তর্ক দ্বারা নির্ধারণ করা সম্ভব নয় ।

এবার ভিয়েনা বা পেরিস নয় , এবার জেসি এবং সেলিন গ্রীসের একটি দ্বীপে । কেন জানিনা তাদের দু জনের শারীরিক উপস্থিতি কোন এক বিখ্যাত জায়গায় …..এটা এই মুভির ফিঙ্গারপ্রিন্ট । জেসি এবং সেলিনের প্রথম সাক্ষাত্ , অনেকে বলেছেন একটা গতানুগতিক ফ্যান্টাসির গল্প । টিন-এজ এক অ্যামেরিকান ছেলে এক ফ্রেঞ্চ মেয়ের প্রেমে পড়া, তারপর আবোল তাবোল কিছু উদ্দেশ্যবিহীন কাজ । কেন জানিনা ফরাসীরা রোমানি্টক গল্পে কয়েক ধাপ এগিয়ে । এটিও হয়তবা তার ব্যতিক্রম কিছু ছিলনা । এই সব সমালোচনার একটা নির্বাক জবাব দিয়েছিলেন ডিরেক্টর যখন নয় বছর পড়ে তাদের জীবন আবার ফুটিয়ে তুলিয়েছিলেন । এই পর্বে শুধু বাস্তবতা , এবং অভিমান ।

সিরিজের প্রথম মুভিতে যখন একটি ট্রেনে তারা একে অপরের সাথে পরিচিত হয়েছিলেন  তখন তাদের কথোপকথনের ধরনছিল এই রকম ..

সেলিন : আপনিকি শুনেছেন যে দম্পতিরা যখন বৃদ্ধ হতে থাকে , তখন তারা  একে অপরের কথা শুনার সামর্থ্য হারাতে থাকে  ?

জেসি : না …!

সেলিন : অনুমানে বলা যায়ে  , পুরুষরা ধীরে ধীরে উচ্চ পিচের শব্দ শুনার ক্ষমতা হারাতে থাকে .. মহিলাদের বেলায় তারা লওয়ার রেজিস্টারে শব্দ শুনতে পায়না …। আমার মনে হয় তারা একে অপরকে এভাবেই দমিয়ে রাখে ।

জেসি : সত্যি ? তাহলে মনেহয় প্রকৃতিই তাদেরকে একই সাথে বৃদ্ধ করার ব্যবস্থা করে দেয় , যাতে তারা একে অপরকে মেরে ফেলতে না পারে(ঠাট্টার সুরে)

সেলিন : everyone wants to  believe in love…. it sells, right ?

এই দম্পতির এখন দুজনই চল্লিশের কোঠায় । তাদের এখন দুজন যমজ মেয়ে আছে ।  তাই বলে কি সেলিন তার সেই নব্বইয়ের  নারীবাদী বিশ্বাসের সাথে আপোষ করেছে ? জেসি একজন পূর্ণাঙ্গ লেখক । সে কি পেরেছে তার writer’s block  থেকে বেরিয়ে আসতে , নতুন কোন সাহিত্য উপহার দিতে ? একজন নারীবাদী জীবনসঙ্গিনী এবং একজন লেখক কিভাবে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো নিচ্ছেন ? কে পরাজিত হচ্ছেন ….কে সত্যিকার অর্থে পরাজিত হয়েছে…অথবা সংসারে পুরুষ এবং নারী কাউকে কি অবশ্যই পরাজিত হতে হবেই ?

ইথান হক এবং জুলি ডেলপি দুজনই অসাধারণ অভিনয় করেন । তারা জুনই লিংক্লেটারকে সাহায্য করেছিল আগের দুটি মুভির স্ক্রিপ্ট লিখতে । কিন্তু কি এক অদ্ভুত বোঝাপড়া তাদের মাঝে , তারা দুজন যখন কথা বলে তখন মিনিট পার হয়, ঘণ্টা পার হয় কিন্তু দর্শকরা এক মুহূর্তের জন্য ভুললেন না যে মুভিতে মূল অভিনেতা এবং অভিনেত্রী শুধু এই দুজনই । তারা কখনও কথা বলছেন পায়ে হেটে , কখনও ট্রেনে , কখনও গাড়িতে, কখনও বা কোন ক্যাফেতে । তাদের কথোপকথনের বিষয় খুবই বৈচিত্র্যময় , বিশ্বশান্তি থেকে নারী স্বাধীনতা সব কিছু এর মধ্যে আছে । কিন্তু রুমের অতিকায় হস্তিটি বোধহয় এবার তারা বের করবেন । তারা হয়তবা এবার কথা বলবেন তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ।

বিফোর সিরিজের এই বারের পর্বে কিছু ঝাঁঝালো ডায়লগ রয়েছে সবাইকে না হলেও কিছু মানুষকে স্পর্শ করবে । তবে কেন জানিনা প্রজন্মের সাথে প্রজন্ম সম্পর্কিত ডায়লগগুলোই শুধু আমাকে টানে । তার কিছু নমুনা ….

–প্রত্যেক প্রজন্ম ভাবে যে তারা বুঝি ’রোমানটি সিজমের’ আগের ধারনার পরিবর্তন করবে । প্রেমের আদি ধারনার শিকড় উপড়ে ফেলবে ।

–প্রত্যেক প্রজন্ম ভাবে যে তারা হয়তবা এই সভ্যতার শেষ দেখে যাচ্ছে , চলমান এই সভ্যতার ধ্বংস অনিবার্য । কিন্তু আমার মনে হয় , আমরা এর মধ্যেই বেচে থাকি ।

লিংক্লেটার কি পরবর্তীতে এই সিরিজের আর কোন মুভি তৈরি করবেন ? আমার কিন্তু খুব ইচ্ছা জেসি এবং সেলিনের পঞ্চাশ ঊর্ধ্ব জীবন দেখার । জীবনের টানাপোড়নে আগামী নয় বছর পড়ে তাদের জীবন কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা দেখার জন্য অনেকেই অপেক্ষা করছে ।  অবশ্য ডিরেক্টরের হাতে এখনও নয় বছর সময় আছে এই সিদ্ধান্ত নেবার । এই পুরো সিরিজটিকে একটি লাইন দিয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছেন একজন মুভি বোদ্ধা “যদি সানরাইজ হয় তাদের আবেগের প্রজ্বলন, সানসেট হচ্ছে  সেই মুহূর্ত যখন তারা তা অনুধাবন করেছেন ; সবকিছুকে ছাড়িয়ে মিডনাইট হচ্ছে বাস্তবতা , দায়িত্ববোধ এবং পারস্পারিক সম্পর্কের কিছু বোঝা যা আজীবন মানুষকে টানতে হয় ।”

সুখী মানুষ সম্পর্কে

সুনীল আকাশ শ্যামল কানন, বিষাদ জোছনা কুসুম কোমল , সকলি আমার মত তারা, কেবলি হাসে কেবলি গায়, হাসিয়া খেলিয়া মরিতে চায়, না জানে বেদন না জানে রোদন, না জানে সাধের যাতনা যতন, .................................রবি ভাই
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে চলচ্চিত্র-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

3 Responses to Before Midnight: আসলেই একটি ভালবাসার গল্প

  1. মাধবীলতা বলেছেনঃ

    ভালো লাগল রিভিউ। দেখার ইচ্ছা জাগল। 🙂

  2. তুসিন বলেছেনঃ

    মুভিটা নাম কখনো আগে শুনি নি।তবে রিভিউ পড়ে দেখার ইচ্ছা জগল।
    রিভিউ সাথে ডাউনলোড লিংক কিংবা টরেন্ট লিংক দিলে কিন্তু মন্দ হত না ।

  3. রুহশান আহমেদ বলেছেনঃ

    imdb তে দেখেছিলাম টপলিস্টে ছিল। বন্ধুদের কাছেও শুনেছিলাম, আপনার রিভিউ পড়লাম। এবার তো দেখাই লাগে।

    চমৎকার রিভিউ লিখেছেন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।