বাংলার মানুষের বারো মাসে তেরো পার্বণ। বাস্তবজীবনের মত ভারচুয়াল জগতেও বাঙ্গালির বারো মাসে তেরো ইস্যু নিয়ে লাফালাফি এখন একটা খুব সাধারণ ব্যাপার। সাম্প্রতিককালের গরম ইস্যু হল “তেঁতুল”। আমি নিজে দেশের বাইরে আছি, ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে শুরু করে আরও অনেক পশ্চিমা দেশের লোকজনের সাথে উঠাবসা আছে। আমার মনে হয় না, বাংলাদেশের সোশ্যাল নেটওয়ার্কের মত এইরকম নানান ইস্যুতে গরম নেটওয়ার্ক আর কোন দেশে পাওয়া যাবে। সে যাকগে, আসল কথায় আসি। কুর’আনের অন্য অনেক আয়াতের মত একটা ছোট্ট আয়াত খুব মুগ্ধ করে আমাকে,
“যে সকল বিশ্বাসী সৎ জীবনযাপন করে, হোক না নারী অথবা পুরুষ, জান্নাত তাদের প্রাপ্য, বিন্দুমাত্র অন্যায়/বৈষম্য তাদের সাথে করা হবে না” (আল কুর’আন ৪:১২৪)
এই আয়াত কেবল একটিমাত্র উদাহরণ, এরকম ভুরি ভুরি আয়াত আছে কুর’আনে। কুর’আন থেকেই আমরা জানতে পারি, সাবার রাণী বিলকিসের কথা। একজন সৎ বিশ্বাসী শাসক হিসেবে তাঁর বারংবার প্রশংসা করেছেন মহান আল্লাহ তা’লা। এ তো গেল কুর’আনের কথা, বাস্তব উদাহরণও কিন্তু অসংখ্য। হ্যাঁ,অসংখ্য !
সম্প্রতি একজন শেইখ গবেষণা করে এক অভাবনীয় সত্য উদঘাটন করেছেন। যে মধ্যযুগকে আমরা এত ভয় করি, আমরা কি আসলে জানি সেই মধ্যযুগে আসলে নারীদের কোথায় অবস্থান ছিল? রাসূল (স) পরবর্তী যুগে প্রায় আট হাজার মুসলিম নারী স্কলারের সন্ধান প্রমাণসমেত খুঁজে পেয়েছেন এই শেইখ। আগ্রহীরা বিস্তারিত পাবেন এখানে।
এই যদি হয় মধ্যযুগেই মুসলিম নারীদের অবস্থা, তাহলে এখন কীরকম হওয়া উচিত ? কিন্তু আফসোস আমাদের দেশি কাঠমোল্লাদের জন্য, উনারা নারীকে একটি বস্তু বা নিদেনপক্ষে একটা প্রাণি ব্যতীত আর কিছু ভাবার কল্পনাই করতে পারেন না। আল্লামা শফীর বক্তব্য এক মিনিটের বেশি শোনার সামর্থ্য আমার হয় নাই। আমি নিতে পারি নাই। এই যদি হয় ইসলাম হেফাজতকারী একজন বয়োজ্যেষ্ঠ নেতার ইসলামী জ্ঞানের সীমা তাহলে উগ্র নাস্তিকরা ধর্মবিদ্বেষ ছড়ানোর কেন সুযোগ নেবে না? আমি মুসলিম হয়ে ইসলামের হেফাজত করতে পারি না সেটা আমার ব্যর্থতা, ধর্মবিদ্বেষীদের দোষ না। আমরা যতটাই অশিক্ষিত নিজেদের বিশ্বাস নিয়ে উগ্রপন্থী নাস্তিকরা ততটাই স্বশিক্ষিত নিজেদের বিশ্বাসে। এইভাবে বিশ্বাসের/আদর্শের হেফাজত কি করা সম্ভব ?
মধ্যযুগ ছেড়ে আধুনিকে আসলেও মুসলিম ইসলামসচেতন নারীরা কোথাও পিছিয়ে নেই। অবশ্য হবে না কেন ? আমাদের এই দেশি হুজুরদের মত মূর্খ তো সবাই না। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, জার্মানি, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়াসহ পশ্চিমের অনেক দেশে এখন ইসলামসচেতন নারীরা অনেক বেশি এগিয়ে রয়েছে। সাংগঠনিক, সামাজিক, রাজনৈতিক কাজে নেতৃত্ব দেয়া থেকে শুরু করে কাউন্সেলিং, পাবলিক স্পিকিং, মেন্টরিং কোনকিছুতেই তারা পিছিয়ে নেই। ইসলামিক দাওয়াহ থেকে শুরু করে সমাজকল্যাণমূলক অনেক কাজে হিজাব বেষ্টিত পশ্চিমা, আরবীয় নারীদের সংখ্যাটা বেড়েই চলেছে। তবে আমাদের এত হতাশ হওয়ার কিছু নেই, বাংলাদেশেও এরকম অনেক বড়-ছোট বোনকে আমি চিনি যারা একই সাথে ইসলামসচেতন ও সমাজসচেতন। এইসব দেখে ওপরে দেয়া কুর’আনের আয়াতটা মনে বেজে ওঠে। আসলেই আল্লাহ তো এমনটাই করতে বলেছেন আমাদের। সৎ কাজে নারী-পুরুষ কোন তফাৎ নেই। প্রথম নাযিল হওয়া সূরা আলাকের আয়াতেও বলা হয় নি, ওহে পুরুষেরা পড় তোমার প্রভুর নামে। জ্ঞান অর্জন আর ভালো কাজে যেখানে স্বয়ং আল্লাহ কোন বৈষম্য করেন নি, সেখানে আল্লামা শফী কে মেয়েদের ঘরের বাইরে এক পা বের না হওয়ার কিংবা পড়াশোনা না করার ফতোয়া দেয়ার ?
এখানে একটা বিষয় পরিষ্কার করে রাখা প্রয়োজন, মেয়েদের গৃহ ব্যবস্থাপনার কাজকে কোনমতেই ছোট করে দেখা যাবে না। সমস্যাটা হল, যখন এটাকেই একমাত্র কাজ হিসেবে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়। একজন নারী পড়াশোনা শেষ করে গৃহ ব্যবস্থাপনাকেই বেছে নেবে নাকি পাশাপাশি বাইরেও কর্মক্ষেত্রে যাবে এটা তার স্বাধীন ইচ্ছার উপর ছেড়ে দিতে আমাদের এত গাত্রদাহ কেন?
একথা অনস্বীকার্য নারী-পুরুষ ভিন্নভাবে তৈরি, তাদের শারীরিক-মানসিক অনেক কিছুই ভিন্ন। এই ভিন্নতাকে অস্বীকার করার কোন অর্থ নেই। কিন্তু এই ভিন্নতাকে মেয়েদের দুর্বলতা হিসেবে দেখায় আমার আপত্তি আছে। একটা ছোট্ট উদাহরণ দিই, স্ক্রু ড্রাইভার আর প্লায়ার্স দুইটাই যন্ত্রপাতির মধ্যে পড়ে, কিন্তু দুইটার কাজ ভিন্ন। তার মানে কি এটা যে স্ক্রু ড্রাইভার দুর্বল/খারাপ আর প্লায়ার্স ভালো ? অবশ্যই না।
ভয়ানক দুঃখ লাগে আজকালকার পুরুষের আচরণ দেখলে। ধার্মিক আর অধার্মিক যে-ই হোক না কেন, কারো কাছে নারী মাল, কারো কাছে চিক, কারও কাছে তেঁতুল। জানি বৈজ্ঞানিক গবেষণায় কী পাওয়া গেছে, এইটা দিয়ে কি এখন আপনি নিজেকে জাস্টিফাই করবেন ? গবেষণা একটা ফ্যাক্ট বলেছে খুবই ভালো কথা, কিন্তু সেটা মোটামুটি সব প্রাণির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এখন আপনি ভেবে দেখুন, নিজেকে আর সামনের সুন্দরী/অসুন্দরী মেয়েটাকে শুধু একটা প্রাণি ভাববেন নাকি মানুষ? খুব হতাশ হয়ে দেখেছি, আল্লামা শফীর বক্তব্য এবং এই গবেষণার পরে অনেক শিক্ষিত-উচ্চশিক্ষিত, ধার্মিক-অধার্মিক পুরুষই নারীদের তেঁতুল বলে সম্ভাষণ করতে বেশ মজা পাচ্ছেন।
যেহেতু ইসলাম হেফাজতকারীদের নিয়ে এই পোস্টের অবতারণা, তাই কুর’আনের আরেকটা আয়াত বলি, সূরা নূরের ৩১ নং আয়াতে মেয়েদের হিজাবের আগে ছেলেদের দৃষ্টি নত করতে বলা হয়েছে। কেন হয়েছে জানেন ? কারণ আপনাদের লালা ঝরে। তাই আমি হিজাব করি বা না করি, আপনাকে আগে চোখ নামাতে হবে। ইসলামের কিছু হেফাযতকারী পারলে মেয়েদেরকে “অদৃশ্য” করে ফেলতে চায় আক্ষরিক অর্থেই। কালো পর্দায় চোখ-কান-হাত-পা সব ঢেকে বাইরে বের হয়ে কিংবা ঘর থেকে এক পাও বাইরে না বের হয়ে সে যেভাবেই আপনি আমাদেরকে অদৃশ্য করে রাখতে চান না কেন, আপনার দৃষ্টি যদি নত না হয়, চিন্তাধারা যদি আল্লাহর দেয়া নির্দেশমত না হয়, তাহলে নারী নামক “ফিতনা” (!!) থেকে আপনি কোনদিনও বাঁচতে পারবেন না। উলটো আল্লাহর উপরে মাতবরি করে মনগড়া ফতোয়া দিয়ে আখিরাতে নিজের গুণাহ কামাই করবেন।
সবশেষে, সমাজের সকলশ্রেণির পুরুষ প্রজাতির কাছে বলি, নিজের সাথে নিজেই বোঝাপড়া করুন মেয়েদের কী ভাববেন তেঁতুল, চুইংগাম নাকি মানুষ ?
বি: দ্র: মেয়েদের হিজাব বা আপাদমস্তক ঢেকে পর্দা করাকে কোনভাবেই নেগেটিভলি নেয়া হয় নি। অবশ্যই শালীন পোশাক ছেলেমেয়ে সকলের জন্য উপকারী ও মনুষ্যত্বের পরিচায়ক।
আফগান সহ আমাদের এই উপমহাদেশ কেন জানি মনে হয় ইসলাম নিয়ে খালি পেছনের দিকে ছুটে চলেছে। মোল্লারা নানা রকম অজ্ঞতার ফাঁদে আর তাদের ক্ষমতার জন্য সব কিছু নিজেদের মত করে সাজিয়ে নিতে চায়। ভোগ আর আয়েশ ছাড়া তারা আর কিছু নিয়ে ভাবে বলে আমার মনে হয়না ।
হুজুরদের জীবন দেখলে আমার এটাই মনে হয়। এরা বিমানের আবিষ্কারককে গালি দিবে, তবুও বিমানে চড়া বাদ দিবেনা, ডাক্টারদের গালি দিবে বাট হাসপাতালে দৌড়াবে সবার আগে………
এদের নিয়ে কথা বলতে আর ভাল লাগেনা ।
ভাইয়া কথা না বলতে বলতেই এই অবস্থা ! ধর্ম দিয়ে অপ্রেশন আর না।
মুসলিম নারী স্কলারের সন্ধান দেওয়ার জন্য পোস্টে ৫ স্টার!আর বাদ বাকিটাতে ডাবল প্লাস
অনেক ধন্যবাদ। 🙂
আজকের ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা বলি
“মিরপুর দুই নম্বরে পূনিমা হোটেল বন্ধুদের সাথে ইফতার করছি।আমাদের কয়েকটা টেবিল পরে দেখলাম একজন মহিলা সম্পূন পর্দাশীল।সারা শরীর কালো বোরকা দিয়ে ডাকা এমন কি মুখে ও।শুধু মাত্র চোখ দেখা যাচ্ছে।যখন আযান দিল তখন দেখলাম মহিলাটি মুখের কাপড়টুকু না খুলে মুখে ডাকা কাপড় টা একটু সরিয়ে খারাপ মুখে দেয় আবার মুখ ডেকে ফেলছে।পাশে একজন লোক খুব আয়েশ করে খাচ্ছে।মনে হয় স্বামী হবে।মহিলাটি খাওয়া দৃশ্যটি ছিল দেখার মত।আমি হয়ত লিখে বুঝাতে পারব না।তবে একটুকু বুঝালাম মহিলার খেতে খুব কষ্ট হচ্ছে।ব্যাপারটা দেখে খারাপ লাগল।মুখের কাপড়ের ঢাকনা টা সরিয়ে খেলে কি এমন ক্ষতি হত??”
ঘটনা দুই
তেতুর বিষয়ে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম।তখন একজন হেজাফতের সমর্থক আমার সাথে বিষন তর্ক লেগে গেল।উনার ধারাভাষ্য কিছু এরকম।
“নারীর অনেক দামি,স্বর্ণ,হীরার মত।আমরা কি হীরা ,স্বর্ন বাহিরে নিয়ে যাই।?? যাই না।কই রাখি??ঘরের ভিতরে।অতএব নারীদের ও ঘরে থাকা উচিত।বাহিরে গেলে জেনাচার হয়”
এই হল চিন্তাধারা……নিদিষ্ট মানুষের প্রতি অন্ধ বিশ্বাস থেকে এই ধারনা জন্ম হয়।ওনি যা বলে তাই সঠিক।একটু যাচাই বাচাই করতে আমাদের খুব সমস্যা।কি দরকার।ওনার কথাই তো ঠিক….ওনি এত বড় মোল্লা….
🙁
লেখার পড়ে খুব ভাল লাগল।যুক্তিগুলো পছন্দ হয়েছে :love:
সোনা-রূপা মানুষ ঘরে যত্ন করে রাখে, আবার পরিধানও করে সৌন্দর্য বিকাশের জন্য। সোনা রূপা বেচাকেনা করে তবেই টাকা আসে, ঘরে ফেলে রেখে না। ইসলামে নারীদের অনেক উঁচু মর্যাদা দেয়া হয়েছে কোন সন্দেহ নেই, আর এ কারণেই আমরা এত স্কলার পেয়েছি নবী (স) পরবর্তী যুগে।
এইসব ফাউল যুক্তি দেখলে মেজাজ যেই খারাপ হয় না !!
সূরা নূরের ৩১ নং আয়াতে মেয়েদের হিজাবের আগে ছেলেদের দৃষ্টি নত করতে বলা হয়েছে। কেন হয়েছে জানেন ? কারণ আপনাদের লালা ঝরে। তাই আমি হিজাব করি বা না করি, আপনাকে আগে চোখ নামাতে হবে।
পুরা লেখাই কোট করার মতো হইছে। গ্রেইট পোস্ট।
ধন্যবাদ
ঠিক এরকম একটা লেখা আমারো লেখার প্ল্যান ছিল। অসাধারণ লাগলো আপনারটা আপু। আমি বুঝি না, সব মেয়েই যদি পর্দা করে চলবে তো ছেলেদেরকে কিসের থেকে দৃষ্টি নত করতে বলা হইছে? আমি যদ্দুর জানি কুরআনে মেয়েদের পর্দার আগে ছেলেদেরটার কথাই বলা হইছে আর হাদীসেও নাকি ছেলেদের পর্দার কথা বেশিবার আসছে। তারপরেও সবাই এইটা আশ্চর্যভাবে ওভারলুক করে যায়।
১০০ পারসেন্ট সহমত।
মেয়েদের পর্দা করে/ মডেস্ট ওয়েতে চলতে হবে এটা মুসলিম হিসেবে আমি অবশ্যই মানি। ঠিক যেমন মানি ছেলেদের পর্দা করতে হবে। পর্দার নামে অদৃশ্য বানিয়ে ফেলাটাতেই আপত্তি।
“পর্দার নামে অদৃশ্য বানিয়ে ফেলাটাতেই আপত্তি।”
অসাধারণ বলেছেন আপু…
🙂
আপু, আরেকটা যুক্তিও এখানে যোগ হয়েছে। হাদিসে আছে, “বিদ্যা অর্জন নর-নারী উভয়ের জন্যই ফরয” , তাহলে সফি সাহেব কিভাবে পড়াশোনা না করার ফতোয়া দেন??
তখন তার সমর্থকরা ‘আহা, আহা’ করে বলে উঠেন, “এই বিদ্যা তো ইসলামী শরীয়তের বিদ্যা। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় তো নাকি ধর্মীয় কোন জ্ঞানই দেয়া হয় না…!! ”
তখন তাদের কাছে জ্ঞান আর বিদ্যার সংজ্ঞা কি তাই নিয়েই সন্দেহ হয়। ধর্মীয় আলোচনা, কথাবার্তা, কাউন্সেলিং, ইত্যাদির প্রসার ঘটুক, এটাই প্রত্যাশা।
সেটাই, সবখানেই খালি চিন্তাভাবনার অসারতা… 🙁
খোঁড়া যুক্তি দিয়ে মেয়েদের পিছিয়ে রাখতে চাওয়া ভন্ডের দল ছেলেদের পর্দার কথা ওভার লুক করে যাবেই !
আপনার লেখা খুব ভালো লাগলো আপু !
ধন্যবাদ আপুনি