বই পরিচিতির আগে বই প্রাপ্তি সম্পর্কে একটু কথা বলি। কলেজের লাইব্রেরী থেকে সেবার পুরনো কিছু বই বিক্রি করে দেয়া হচ্ছিলো, আমাদের বলা হল কেউ চাইলে ওখান থেকে বই নিতে পারে। পুরনো বইয়ের নেশাটা ভালো লাগে, কিন্তু সব সময় হয়ত সুযোগ হয়ে উঠে না । তাই এক বান্ধবীসহ গেলাম ঢুঁ মারতে। আর তাতেই ২০ টাকা দিয়ে এই বইটা পেয়ে গেলাম। বইটার প্রকাশকাল বাংলা ১৩৫১ অর্থাৎ ইংরেজি ১৯৪২। আমার কাছে প্রথম সংস্করণেরটাই আছে। বর্তমানে বইটা পাওয়া যায় কিনা আমি জানি না, যদি কেউ জেনে থাকেন তাহলে মন্তব্যে জানালে উপকৃত হবো।
এবার বই প্রসঙ্গে আসি। বইয়ের লেখক শ্রীপ্রমথনাথ বিশী, শান্তিনিকেতনের সাবেক এবং বিশ্বভারতীর প্রথম ছাত্র। বইয়ের নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে এটা স্মৃতিচারণামূলক । রবীন্দ্রনাথের পরিচর্যা আর সাহচর্যে বেড়ে ওঠা একজনের অভিজ্ঞতা অবশ্যই অন্যদের চেয়ে ভিন্ন হবে। আর প্রকৃতির অপার রূপের মধ্যে গড়ে উঠা শান্তিনিকেতনের বর্ণনা আছে বইটির পরতে পরতে।
“ফল কথা শান্তিনিকেতনের প্রকৃতি রবীন্দ্রকাব্যের টীকাকার; এখানকার আকাশ বাতাশের সঙ্গে রবীন্দ্রকাব্য মিলাইয়া লইলে তবেই তাহার সঠিক সংস্করণ হওয়া সম্ভব। আর স্বয়ং বিশ্বপ্রকৃতি সমগ্র রবীন্দ্রকাব্যের মল্লিনাথ ; সে ফুলে ফলে লতায় পাতায় মেঘে মেঘে বনে বনে ঋতুতে ঋতুতে রবীন্দ্রকাব্যের সঞ্জীবনী টীকা লিখিয়া চলিয়াছে। কবির লেখনী থামিয়াছে, কিন্তু টীকাকারের লেখনীর কোনোদিন আর থামিবার উপায় নাই। ”
সত্যি কথা বলতে বইটা পড়তে গিয়ে হিংসেই লেগেছে। 😛
“ রবীন্দ্রনাথের এই মূর্তিটিই আমার কাছে সবচেয়ে পরিচিত। কারণ তখন আমি বিশ্বভারতীতে কেবল প্রবেশ করিয়াছি, তখনো বহু ছাত্রের সমাগম হয় নাই, তাহার কাছে যাইবার অবাধ সুযোগ ছিল এবং সে সুযোগের সদব্যবহার কখনো ত্রুটি হয় নাই। বোধকরি তখনকার দিনে এমন দুপুর ছিল না যখন আমি না যাইতাম। বিশেষত দুপুরবেলা তিনি আমাকে পড়াইতেন, সে জন্যও যাইতে হইত।……… আমি হয়ত সামান্য কারণে বা বিনা কারণে গিয়াছি, কিন্তু কখনো বিরক্ত হইতে দেখি নাই। আর্ট যাহার কাছে মানুষের চেয়ে বড় সে বিরক্ত হইতে পারে। কিন্তু মানুষ যতই নগণ্য হোক না কেন, তিনি বিরক্ত হইবেন কেন?”
মাঠের মাঝে কিংবা আম গাছের ছায়ায় আসন পেতে ক্লাস করা এখন তো রীতিমত ভয়ংকর ব্যাপার, যদিও শান্তিনিকেতনে এই রেওয়াজ এখনো আছে। তখনকার বিভিন্ন নিয়ম নিষ্ঠা , আচার ব্যবহার, সর্বোপরি শান্তিনিকেতন আর রবীন্দ্রনাথকে বেশ ভালভাবে বোঝা যায়। আছে খেলাধুলার কথা, সাহিত্যচর্চার এদিক সেদিক, ছাত্র- স্বরাজ নামক বিশাল জিনিস। বিশাল কেন বলছি তার কারণ কবি চাইতেন এই বিদ্যালয় একটি আদর্শ ছাত্র স্বরাজ হোক, ছাত্রের হাতেই থাকবে ছাত্রকে পরিচালনার ক্ষমতা আর তার জন্য তাঁকে অনেক বাধাও পেরুতে হয়েছিল কেননা ছাত্রদের এতোটা স্বাধীনতা তখন অভাবনীয় ছিল সকলের কাছে।
“ছাত্রদের কার্যপরিচালনার জন্য একটি সভা ছিল। ইহার নাম আস্রম সম্মেলনী। ইহাকে ছাত্রদের পার্লামেন্ট বলা যাইতে পারে। সমস্ত ছাত্র ইহার সদস্য। সকলে মিলিয়া একটি কার্যনির্বাহক সমিতি নির্বাচিত করিয়া দিত। এই সমিতিই প্রকৃতপক্ষে শাসনকর্তা। সম্মেলনির একজন সম্পাদক থাকিত। কাপ্তেনগণ ভীতিকর ছিল বলিয়াছি, আবার সম্পাদক কাপ্তেনগণের পক্ষে ভীতিকর ছিল। আমার যতদূর মনে পড়ে , আশ্রমসম্মেলনির প্রথম সম্পাদক ছিলেন সরোজরঞ্জন চৌধুরী। ”
এছাড়া আছে গান্ধীজীর কথা, নোবেল পাবার ঘটনাও। শরতকুমার রায়, জগদানন্দ রায়, হরিচরণ চট্টোপাধ্যায় – এমন অনেক শিক্ষকেরই বর্ণনা মিলবে। অনেকেই রবিঠাকুরের নোবেল প্রাপ্তি কিংবা গ্রহণ করাকে নিয়ে ব্যঙ্গ করেন, কেন অবিভক্ত ভারতে ইংরেজদের উপহার গ্রহণ করলেন- তা নিয়ে উপহাসের শেষ নেই। নোবেলকে তিনি কেমন গ্রহণ করেছিলেন দেখুন,
“নোবেল প্রাইজ লাভের সংবাদ বহন করিয়া বোলপুরে যখন টেলিগ্রাম আসে তখন রবীন্দ্রনাথ নেপালবাবু প্রভৃতি আরও দু-একজন অধ্যাপকের সঙ্গে কাছেই কোথাও বেড়াতে গিয়াছিলেন- সেখানে টেলিগ্রামখানা পাঠাইয়া দেয়া হয়। তিনি নিরবে টেলিগ্রামখানা পরিয়া নেপালবাবুর হাতে দিয়া বলিলেন, “নিন নেপালবাবু, আপনার ড্রেন তৈরি করবার টাকা।” তখন আশ্রমের টাকার টানাটানি চলিতেছিল, একটা পাকা নর্দমা অর্ধখনিত অবস্থায় পড়িয়া ছিল। ” :slap:
পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে অভাবিত আবেগতাড়িত হওয়া এমনকি আত্মহত্যার মতো সিদ্ধান্ত নেয়া নতুন নয়। সে যুগেও এমন ছিল বৈকি । তবে লেখাপড়াটা সে কালে আসলেই জ্ঞানভিত্তিক ছিল, কে কতটা জেনে বের হচ্ছে- সেটাই গুরুত্ব পেত বেশি। আর তাই শিক্ষকবিহীন পরীক্ষাই চালু ছিল, যা আজকে রীতিমত ভয়ংকর। যার যেখানে খুশি সেখানে বসে পরীক্ষা দিত, পরীক্ষা শেষে খাতা কাপ্তেনের কাছে খাতা জমা দিত, ব্যস !!!
ছাত্র জীবনের একটা বড় অংশই কাটে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে। তাই এর স্মৃতি বরাবরই মধুর। এই বই ও এর বিচিত্র নয়। তবে সব ছাপিয়ে মনে দাগ কাটে রবীন্দ্রসুধা। তাই এই কথায় আমিও একমত।
“ এক- একজন যুগাবতার সাহিত্যিক জন্মগ্রহণ করেন যাঁহারা যুগের সমস্ত সাহিত্যিক সম্ভাবনাকে নিঃশেষে পান করিয়া সাহিত্যসৃষ্টি করিয়া যান- দুর্বলদের জন্য আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না। রবীন্দ্র বনস্পতি বাংলাদেশের চিত্তের সমস্ত রস শুষিয়া পুষ্পে পল্লবে ফলে ঐশ্বর্যে সমৃদ্ধ। এই বনস্পতির তলদেশে যে সমস্ত দুর্ভাগ্য সম্ভাবিত বনস্পতির জন্ম তাহাদের প্রাণরসের আর প্রত্যাশা কোথায়? ” :huzur:
রিভিউটা ভালো লেগেছে ।
বাহ ভালোই তো চালিয়ে যাচ্ছিস 😀
আর বইটা দিস পড়ব।
ধইন্নাপাতা :happy:
বইটার অবস্থা খুবই করুণ, আমার জানের টুকরাও। 🙁
ভালো রাখতে পারস যদি সেই শর্তেই দিতে পারি। 😛
তুই কি বই পড়ার উপর এখন শর্ত প্রযোজ্য আরোপ করলি নাকি? :haturi:
আমি বই এমনিতেই অনেক যত্নে রাখি তাই চিন্তা করিস না 8)
বইটা আমাকে পড়তে দিয়ে যাস :love:
আইসা নিয়া যাবি তাইলে, ঠিক আছে?? 😐
দারুণ তো! পড়তে ইচ্ছা করছে বইটা।
ছাত্র স্বরাজ মনে হয় তখনই চালু করা যায় যখন মানুষ যা কিছু পড়তে যায় সেটা পড়ে মনের আনন্দে। আমাদের দেশে আমরা যেই হারে অপছন্দের জিনিসপত্র নিয়ে পড়ি, তাতে স্বরাজ প্রতিষ্ঠা করতে দিলে হিতে বিপরীত হইতে পারে (দুই-এক জায়গায় অলরেডি উদাহরণ দেখা যাচ্ছে)। 😛
হ্যাঁ আপি, বইটা আসলেই দারুণ, পড়তে পড়তে নিজের স্কুল জীবনের কথা মনে পড়ে যাবে। 🙂
হুম, আমাদের এখানে পড়াটা এখনো আনন্দের হয় নাই, আর রবিঠাকুরের ছাত্র-স্বরাজ কিছুটা ক্যাডেট স্টাইলের, ছাত্ররা নিজেরাই নিজেদের সব কাজ করবে, লেখাপড়া থেকে শুরু করে কাপর-ধোয়া পর্যন্ত !!!
এই বইটা আবার প্রমাণ করবে রবীন্দ্রনাথ তার সময়ের তুলনায় কতটা আধুনিক ছিলেন।
ভালো লেগেছে রিভিউ।
“এই বইটা আবার প্রমাণ করবে রবীন্দ্রনাথ তার সময়ের তুলনায় কতটা আধুনিক ছিলেন।” – সহমত…
ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য… 🙂