আজকের রোদটা প্রায় চামড়া পুড়িয়ে দেবার মতো। একটু থেমে কপালের ঘামটা হাতের তালুতে মুছলো রাতুল। প্রায় বেলা পড়ে এলো, অথচ রোদ কমার কোন লক্ষণই নেই, শ্রাবণের প্রায় শেষ চলে এলো, অথচ এবার বৃষ্টির নাম গন্ধ নেই। অবশ্য এসব দিকে খুব যে বেশি খেয়াল করে রাতুল তা নয়। বরাবরই সে একটু কাঠখোট্টা স্বভাবের বলেই বেশ একটা দুর্নাম আছে ওর। আর এটা বলেই ওকে সারাক্ষণ খোঁচায় সন্ধি। সেই পরিচয়ের পর থেকেই, কতটা সময় গেলো? ছয় কিংবা সাত বছর? দিনক্ষণের ব্যাপারে অনেক বেশি উদাসীন রাতুল। কিছুই মনে থাকতে চায় না, সকালে কী দিয়ে নাস্তা করেছে জিজ্ঞেস করলেও অনেকটাই ভেবে উত্তর দিতে হয় ওকে! সারাক্ষণই আনমনা থেকে কী যেন একটা ভাবতে থাকে, কতবার সন্ধির আঙ্গুলের খোঁচা খেয়ে বাস্তবে ফিরে আসতো ও। ভীষণ ধরণের অদ্ভুতুড়ে একটা ছেলে রাতুল, অন্তত সন্ধির ভাষ্যমতে তো অবশ্যই। আজকাল হিসেবটুকু অনেক বেশি গোলমেলে লাগে রাতুলের, এতগুলো বছরের ফেলে আসা সময়টুকু এখন কেন জানি নিতান্তই স্বপ্নের মত মনে হয়। ধোঁয়াশা, একটা কেটে যাওয়া ঘুড়ি, কিংবা ছেঁড়া সময়ের পরতে পরতে ডুবে থাকা।
রিকশার ঝাঁকিতে সম্বিত ফিরে ওর। কিছুক্ষণের জন্য ভুলে যায়, সময়টা কোথায়, কিংবা ওর কোথায় যাবার কথা ছিলো। “আস্ত ভুলো একটা…” চমকে পাশ ফিরে তাকায়, কেউ থাকার কথা বুঝি রিকশায়, অনেকখানি যেন বা সন্ধির কন্ঠ মনে হলো, কিন্তু হিসেব যে আগের মতো নেই। কি করে হবে তা? সময়ক্ষণের হিসেব এখন আর আগের মতো মেলে না, এরকমই একটা সময় ছিলো কি? হবেও বা, আজকাল আর ভাবতে ইচ্ছে করে না, একটুতেই কেন জানি মাথার ভেতর একটা অদ্ভুত ব্যাথা জানান দেয়, কিছুতেই আর হিসেব মেলে না রাতুলের। এমন একটা রোদেলা দুপুরই তো ছিলো মনে হয়। ঈদের ঠিক পরপরই, রাস্তাটা ভীষণ ধরণের ফাঁকা ছিলো, বেশ ভালো লাগছিলো বাতাসটুকু, সন্ধির কোলে ছিলো ওদের তিন বছরের ভালোবাসা “আদর”। দু’হাতে মায়ের হাতের লাল চুড়িগুলো নিয়ে খেলছিলো, সন্ধির লাল শাড়ির সাথে লাল টিপ, দুহাতে লাল চুড়ি, চমৎকার লাগছিলো সেদিন। সবুজ গাছের ফাঁক দিয়ে দুপুরবেলার রোদটুকু সন্ধি আর আদরের গালে লালচে আভা ফেলছিলো বার বার।
অদ্ভুত তো! এইসব স্মৃতি এতো নিঁখুতভাবে মনে পড়ে কেন? মাথাটা দপদপ করে ওঠে রাতুলের। নিজের উপর একরাশ বিরক্তি কিংবা হতাশায়, ঝলসানো রোদ্দুরে চোখ কুঁচকে তাকায় দূরে। সেদিন অনেকদিন পর দূরে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার জন্যে বেরিয়েছিলো ওরা। আদর হবার পর তেমন করে আসলে বেরানো হয়ে ওঠে নি রাতুল আর সন্ধির। আদরের মতো জ্যান্ত একটা খেলনা নিয়ে খেলতে খেলতেই কেমন জানি সময়টুকু পেরিয়ে যেতো ওদের। মাঝে মাঝে অবাক লাগতো রাতুলের, সন্ধিকে বলতো, কেমন না ভাবনাটা বলো, আমাদের ভালোবাসায় আদরের জন্ম, আদরের প্রতিটা স্পর্শে মনে হয় বুঝি তুমি আমায় ছুঁলে, অদ্ভুত সুন্দর না সন্ধি? সন্ধি একটুক্ষণ ওর দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে থেকে বলতো, তুমি আসলেই একটা পাগল রাতুল, আসলেই…
ট্রাফিকের বাঁশিতে আবার ভাবনা থেকে ফিরে এলো রাতুল। রিকশা চলা শুরু করেছে। বিড়বিড় করে বললো, “তুমি আসলেই একটা পাগল রাতুল…” সেদিনও তো তাই ছিলো, না? দুপুর, উথালপাথাল বাতাস, সূর্য আর মেঘের লুকোচুরি কিংবা খবরদারি, লম্বা ফাঁকা হাইওয়ে, দুপাশে ঝুঁকে আসা গাছ, কেমন যেন একটা ঘোরলাগা স্বপ্নের মতো সবকিছু। গতির কাঁটা ৮০ ছুঁইছুঁই। বাতাস কেটে যাচ্ছে সাঁইসাঁই। আদরের তার মাকে শক্ত করে ধরে বসে থাকা, আলতো করে বাজতে থাকা গান,
“আমার খেলা যখন ছিল তোমার সনে
তখন কে তুমি তা কে জানত।
তখন ছিল না ভয়, ছিল না লাজ মনে,
জীবন বহে যেত অশান্ত।
তুমি ভোরের বেলা ডাক দিয়েছ কত
যেন আমার আপন সখার মতো,
হেসে তোমার সাথে ফিরেছিলাম ছুটে
সেদিন কত-না বন-বনান্ত…”
অনেক বেশি প্রিয় গান ছিলো সন্ধির। আচ্ছা, এখনও কি এ গানটা সন্ধির প্রিয় গান? ভীষণ জানতে ইচ্ছে করে রাতুলের। পালটে যাওয়া সময়ের টুঁটি চেপে ধরে কেন জানি ভীষণভাবে বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে ওর, তবু কোথায় যেন বাঁধে, তবুও কোথায় জানি থেমে যায় গল্পগুলো, একলাই, অযথাই…
রাগে ভেতরটা কেঁপে ওঠে রাতুলের, কেন অমন করে বলতে গেলো সন্ধি? কেন অমন করে আরেকবার রাগিয়ে দিলো রাতুলকে? কেন? বাতাসটুকু আবার নতুন করে অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে গেল রাতুলকে। প্রায় গুলির বেগে একটা পাজেরো রাতুলের গাড়ির প্রায় গাঁ ঘেঁষে বেরিয়ে গেলো। চমকে উঠে হাত স্টিয়ারিং এ একটু কেঁপে উঠলো রাতুলের। বিচ্ছিরি একটা গালি দিয়ে বসেছিলো আরেকটু হলেই। সন্ধি রাতুলের হাত আলতো করে ছুঁয়ে বললো, “আস্তে চালিও রাতুল।” রাতুল দাঁতে দাঁত চেপে কিছু বললো না, কিন্তু গতির কাঁটা আরেকটু উঠে ১০০ তে নিয়ে এলো, পাজেরোটা প্রায় সামনেই আছে এখনো, বোঝাই যায় বড়লোক বাবার ছেলে, আজকে প্রথম গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছে। রাতুলের মেজাজ খারাপ লাগছে। ছেলেটাও টের পেয়েছে, গাড়িটা পিছু ছাড়ছে না, আরেকটু সামনে এগিয়ে গেলো পাজেরোটা, রাতুল আরেকটু পা রাখলো একসেলেটারে। টের পেলো হাতের নীচে স্টিয়ারিংটা একটু নড়ে উঠলো, প্রায় নতুন কেনা গাড়িটা, জমানো টাকা অনেকটাই চলে গেছে এখানে। তবু গাড়িটা চমৎকার, এখনো বেশ কথা শোনে, প্রায় পাশে চলে এসেছে পাজেরোটার। আশপাশ থেকে বাতাস ছুটে বেড়িয়ে যাচ্ছে, সন্ধি একবার শুধু বলেছে, “রাতুল…” রাতুল ঠোঁটে ঠোঁট চেপে রেখেছে, আরেকটু শুধু, এইবার পাজেরোটাকে পার করবেই সে, চোখ রাস্তায়, বেশ কাঁপছে গাড়িটা, ১২০ স্পীডোমিটারে। প্রচন্ড বাতাস, গানটা প্রায় হারিয়েই গেছে গাড়ির গর্জনে, ছুটে আসা সামনের গাছগুলো, আরেকটু দূরে একটুকরো মেঘের সাথে রোদের লুকোচুরি খেলা, তারপর একটা বাঁক, আর একটু, এইতো প্রায় পার করে ফেলেছে পাজেরোটাকে, হঠাৎ করেই পিছিয়ে গেলো পাজেরোটা, চমকে উঠলো রাতুল, একটা নয় দশ বছরের বাচ্চা পেল্লায় একটা সাইকেলে করে রাস্তা পেরোচ্ছে, আর একটু পর, তারপরই রাতুলের গাড়ির সামনে, থামার কোন উপায় নেই, গাড়িটা প্রচণ্ড জোরে ছুটছে, আর একটু দূরেই যে সাইকেলটা। রাতুল প্রাণপণে ব্রেক কষলো, স্টিয়ারিং যতখানি পারলো ডানে কাটলো, প্রচণ্ড শব্দ তুললো টায়ার পীচের রাস্তায়, কাঁধে বুঝি বা সন্ধির হাত, যেন অনন্তকালের মতো থেমে গেলো সময়টা, রাতুল দেখতে পাচ্ছে, গাড়িটা আস্তে আস্তে কাত হয়ে যাচ্ছে, আদরের চোখে বিস্ময়, টের পাচ্ছে রাতুল, পালটে যাচ্ছে সবকিছু, আদর বুঝি একবার ডাকলো…বাবা……নাকি মা?
“নামেন না ক্যান?” রিকশাওয়ালার প্রশ্নে আবার ঘোর কেটে গেলো রাতুলের, এসে পড়েছে হাসপাতাল। রিকশাটা থেকে সাবধানে নামলো, ক্র্যাচটা ধরে সামলে নিলো নিজেকে। টাকা বাড়িয়ে দেবার পর রিকশাওয়ালা বললো, “মামা, ঈদের জন্য পাঁচটা টাকা বেশি দিবেন না?” রাতুল চমকে তাকালো, ঈদ পেরিয়েছে দু’দিন হল! সেদিনটাই এমনই ছিলো। কেন মনে থাকে এসব? কেন এতো নিখুঁত ভাবে মনে পরে যায় সবকিছু? যতক্ষণ জ্ঞান ছিলো টের পাচ্ছিলো, ভিতরে কোথাও কিছু ভেঙ্গে গেছে, প্রচণ্ড যন্ত্রণা বুকের ভিতর, বহু কষ্টে মাথাটা ঘুরিয়ে তাকালো, সন্ধি কখনো সিটবেল্ট বাঁধতো না, ওর নাকি দম বন্ধ লাগে। ঐ যে, পাশেই আছে সন্ধি, লাল রঙের পরী একটা বুঝি। হঠাৎ একটা ঠাণ্ডা স্রোত নেমে এলো শিরদাঁড়া বেয়ে, সন্ধির কপাল থেকে বৃষ্টির মত ফোঁটায় ফোঁটায় লাল রক্ত, সমস্ত শরীর লাল হয়ে গেছে, শাড়ির সাথে মিলেমিশে একাকার সবটুকু। আর আদর? এমন চুপ করে আছে কেন? কথা বলে না কেন? জ্ঞান হারালো রাতুল। শুধু একবার মনে হলো, আদর কি ওকে ডেকেছিলো? নাকি সন্ধিকে? বাবা নাকি মা? অনেকটাক্ষণ বুঝি চুপ করে দাঁড়িয়েছিলো রাতুল, রিকশাওয়ালা অধৈর্য প্রায়। দশটা টাকা বাড়িয়ে দিলো রিকশাওয়ালার ঈদের আনন্দে। তারপর ক্লান্ত শরীরে ক্র্যাচে ভর করে এগিয়ে গেলো হাসপাতালের দিকে, আর তো কেউ নেই, নিজের জন্যেই না হয় বাঁচা এবার, গাড়িটা দুমড়ে মুচড়ে গিয়েছিলো দুইটা ডিগবাজি খেয়ে, পাজরের তিনটা হাড় ভেঙ্গেছিলো রাতুল, শুধু সিটবেল্ট পড়া ছিলো বলেই নাকি বেঁচে গিয়েছে, ডাক্তার তাই বলেছিলো। আর বলেছিলো মাথায় ব্যাথা পেয়েছিলো সন্ধি, বাঁচাতে পারে নি ওরা, অনেক চেষ্টা করেও, আর আদর নাকি তারও আগে ঘুমিয়ে গিয়েছিলো। শক্ত মোজাইকের মেঝেতে শব্দ করে এগিয়ে চলে ক্র্যাচে ভর করা একটা মানুষ। ডাক্তাররা সেদিন সবই বলেছিলো।
শুধু……
শুধু বলে নি, আদর শেষবারের মতো কাকে ডেকেছিলো? ওর আব্বুটাকে, নাকি ওর নিতান্ত অভিমানী আম্মুটাকে। শুধু এটুকুই বলতে পারলো না। একটা জীবনের জন্য বেঁচে থাকাটাকে অর্থহীন করে দিয়ে, থেমে গেলো আর সব কিছুই……
আদর আর সন্ধির সাথে……
পৃথিবীর সেরা গল্পগুলোর বেশীর ভাগই নাকি ট্র্যাজেডি।
ভালো লেগেছে লেখাটা।
শিরোনামটা এমন কেন? এটা কি আসলেই গল্প নয়?
কিছু কিছু যন্ত্রনা আসলেই ভোলা যায়না।
গল্প বিভাগে দিয়ে দে। ভাল্লাগছে 😀 বহুত দিন বাদে