আমার এক শুভাকাংক্ষীর কাছে পেনড্রাইভ দিয়েছিলাম কিছু ফাইলের জন্য। তিনি ফাইলগুলোর সাথে আরউইন স্রডিঞ্জারের ‘হোয়াট ইজ লাইফ’ বইটা দিয়ে দিলেন। বললেন, পড়ে দেখো ভালো লাগবে। বইটার নাম আগে শুনেছি, একদিন লাইব্রেরীতে পড়তে শুরু করেছিলাম। কি ভেবে বইয়ের পেছনে স্রডিঞ্জারের বায়োগ্রাফি পড়া শুরু করতেই দেখি কঠিন কঠিন নামের নানান ব্যাক্তিকে শুধু ধন্যবাদ জ্ঞাপনে ভরপুর। তাই সেদিন আর পড়া হয়নি। এখন বাসায় এসে দেখি মাত্র ৩০ পৃষ্ঠার একটা পিডিএফ। তখনই মাথায় ভূত চাপলো। অনেকদিন থেকেই ভাবছি কিছু ইংরেজি আর্টিকেল অনুবাদ করব। কিন্তু, সেটা প্র্যাকটিস করার মত বস্তু এতদিনে পেলাম। তবে তাই হোক… এই পোস্টে বইটার প্রথম অধ্যায়ের প্রথম তিনটি অনুচ্ছেদ দেয়া হল। এটা পড়ে যদি আপনার মনে কৌতুকের উদ্রেক ঘটে তবে স্রডিঞ্জারের আত্মা কষ্ট পাবে, আমার কিছু হবেনা। এই বইটাই সম্ভবত প্রথম প্রচেষ্টা যার মাধ্যমে বায়োলজির ক্ষেত্রে পদার্থবিজ্ঞানীদের ইনভ্যাশন শুরু হয়।
অধ্যায় এক
একজন শাস্ত্রীয় পদার্থবিজ্ঞানীর পদক্ষেপ
কিছু পাবলিক লেকচারের সমন্বয় হল এই বইটি। লেকচার গুলো ছিল নিরস, আপাত দুর্বোধ্য এবং পদার্থবিজ্ঞানীদের কাছে আকর্ষনীয় গানিতিক পদ্ধতিতে সিদ্ধান্তগ্রহন মুক্ত। তবুও প্রায় ৪০০ জন শ্রোতা নিয়মিত শুনে গেছেন। বিষয়টা এত সহজ নয় যে গনিত ছাড়াই এর ব্যাখা দান করা সম্ভব, বরং গণিত এর সাথে এত নিবিঢ় ভাবে মিশে আছে যে একে নাগালের মধ্যে আনাই কষ্টকর। পদার্থবিজ্ঞান এবং জীববিজ্ঞান যেখানে একাকার হয়ে গেছে, সেই মৌলিক ধারনা গুলো পদার্থবিজ্ঞানি এবং জীববিজ্ঞানীদের কাছে পরিষ্কার করাই ছিল লেকচার গুলোর উদ্দ্যেশ্য। লেকচারগুলো নানা বৈচিত্র্যে ভরপুর থাকলেও , মূল উদ্দ্যেশ্য ছিল শুধু একটি ধারনা সবার কাছে পৌছে দেয়া, একটি বিশাল গুরুত্বপূর্ন প্রশ্নের সহজ একটি উত্তর খোজা। পাঠকের ধৈর্য হারানোর পূর্বেই সংক্ষেপে জানিয়ে দিচ্ছি। সে বিশাল গুরুত্বপূর্ন এবং বহুল আলোচিত প্রশ্নটি হচ্ছেঃ জীবদেহের স্থানিক সীমার মধ্যে স্থান কালের মাঝে যেসব ঘটনা ঘটছে, তার ব্যাখা কিভাবে পদার্থবিজ্ঞান এবং রসায়নের মাধ্যমে দেয়া যায়। প্রাথমিক একটি উত্তর, যা এই বইতে ব্যাখা এবং প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হয়েছে তা হলঃ সেসব ঘটনা ব্যাখ্যার জন্য সাম্প্রতিক পদার্থবিজ্ঞান এবং রসায়নের স্পষ্ট অপারগতার জন্য অবশ্যই পদার্থবিজ্ঞান বা রসায়ন দায়ী নয়!
পরিসংখ্যানিক পদার্থবিজ্ঞানঃ মূল গাঠনিক পার্থক্য
এটা সত্যিই ভূল হবে যদি ধারনা করা হয় যে আমাদের কাজের অর্থ শুধু আশার সঞ্চার করা, যা অতীতে অর্জিত অর্জিত হয়নি তা ভবিষ্যতে হবে এই বলে। আমরা বলতে চেয়েছি, এখন পর্যন্ত এই ব্যার্থতার জন্য দায়ী বর্তমান সময়। ধন্যবাদ জীববিজ্ঞানি এবং বিশেষ করে জীনতত্ববিদদের বিগত ৩০–৪০ বছর ধরে তাদের অসাধারন সব কাজের জন্য। তাদের কারনে জানা গেছে জীবসত্বার বস্তুগত গঠন এবং কাজের প্রকৃয়া এবং এখন এটা স্পষ্ট, কেন সমসাময়িক পদার্থবিজ্ঞান এবং রসায়ন জীবসত্বার অভ্যন্তরে স্থান–কালের মাঝে কি হয় তার ব্যাখ্যা দানে অপারগ। দেহের সবচেয়ে অপরিহার্য অংশসমূহে পরমাণুর বিন্যাস এবং পারস্পরিক প্রতিক্রিয়ার সাথে যা নিয়ে এযাবত পদার্থবিজ্ঞানী অথবা রসায়নবিদগন পরীক্ষা চালিয়েছেন বা গবেষনা করেছেন তাদের পরমাণুর বিন্যাসে কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। এই পার্থক্য একজন পদার্থবিজ্ঞানী বাদে সবার কাছে খুবই তুচ্ছ মনে হবে, কেননা একজন পদার্থবিজ্ঞানী শুরু থেকেই জেনে এসেছেন পদার্থবিজ্ঞান এবং রসায়নের সূত্রগুলো আগাগোড়া পরিসংখ্যত। তাই, পরিসংখ্যানিক দৃষ্টিকোন থেকে দেহের অপরিহার্য অংশগুলোর গঠন , এবং যা নিয়ে পদার্থবিজ্ঞানীরা প্রত্যক্ষ ভাবে নাড়াচাড়া করেন ল্যাবে বা মানসিক ভাবে লেখার টেবিলে, তাদের গঠন সম্পুর্ন আলাদা। যেসব বস্তুর আচরনের ভিত্তিতে কিছু সূত্র এবং নিয়ম প্রতিষ্ঠিত, সেই একই সূত্র যে ভিন্ন গাঠনিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন বস্তুর উপরও কাজ করবে সেটা তো চিন্তা করাই ঠিক নয়। একজন ব্যাক্তি যিনি পদার্থবিজ্ঞানের সাথে জড়িত নন, তার কাছে এই ‘পরিসংখ্যানিক পার্থক্যের‘ প্রাসঙ্গিকতা বুঝা, এমনকি একা এটা বুঝার চেষ্টা করা বেশ কষ্টকর। কারন ব্যাপারটা এখন যে কথা গুলো বলা হল তারই মত বিমূর্ত।এই বিমূর্ত ব্যাপারটাকে একটা মূর্তি দান করার জন্য এমন কিছু জেনে নেয়া যাক, যা পরবর্তিতে আরো বিষদ ভাবে ব্যাখ্যা করা হবে। যেমনঃ কোমোজোম তন্তু যা জীবকোষের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন একটি অংশ একে যথার্থভাবে পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় বলা যায় ‘অবিন্যস্ত স্ফটিক‘। কিন্তু, এখন পর্যন্ত পদার্থবিজ্ঞান যা নিয়ে কাজ করেছে তা হল ‘সুবিন্যস্ত স্ফটিক‘। একজন আন্তরিক পদার্থবিজ্ঞানীর কাছে এটা বেশ চমকপ্রদ পূর্ন বস্তু। এরা এমনই আকর্ষনীয় ভৌত গঠন তৈরি করে , যার দরুন জড় প্রকৃতিও পদার্থবিজ্ঞানীর বুদ্ধিকে বিভ্রান্ত করে দেয়। যদিও ‘অবিন্যস্ত স্ফটিক‘ এর তুলনায় এরা নিতান্তই সাদামাটা। পার্থক্যটা ঠিক এরকম, যেমন একটি সাধারন বিছানার চাদর; যাতে একই ছাচের নকশা নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে বারবার এসেছে, এবং একটি নকশী কাথা; যাতে কোন পুনরাবৃত্তি না থাকলেও, শিল্পির করা সম্প্রসারিত, সুসংগত, অর্থপূর্ন নকশা রয়েছে যা আমাদের মুগ্ধ করে। প্রকৃত পদার্থবিজ্ঞানের জটিলতম গবেষনাসমূহের একটা হচ্ছে এই ‘সুবিন্যস্ত স্ফটিক‘। তবে, জৈবরসায়ন আরো জটিল এবং জটিলতর অণুসমূহের তদন্ত করার মাধ্যমে এই ‘অবিন্যস্ত স্ফটিক‘ বা ক্রোমোজোম, যা আমার মতে জীবনের ভৌত বাহক এর বেশ কাছা কাছি চলে এসেছে। এটাই আশ্চর্যের বিষয়, জৈব রসায়ন ইতোমধ্যে সেই জীবনের সমস্যা মাধানে বিশাল গুরুত্বপূর্ন অবদান দাড় করিয়ে ফেলেছে, যেখানে পদার্থবিজ্ঞান কিছুই করেনি।
সাধাসিধা পদার্থবিজ্ঞানীর পদক্ষেপঃ
আমাদের অনুসন্ধান সম্পর্কে আপাত ধারনা বা চূড়ান্ত লক্ষ্য সুনির্দিষ্ট করার পর এখন জানাবেন আমাদের কর্মপরিকল্পনা। প্রথমেই যেটি দরকার, তা হল জীবসত্তা সম্পর্কে ‘সাধাসিধা পদার্থবিজ্ঞানী‘র ধারনা যা তাকে জীবসত্তার আচরন এবং প্রকৃয়া সম্পর্কে চিন্তা করা শেখাবে এবং সচেতনভাবে প্রশ্ন করে যাবে তিনি নিজে, তার জ্ঞান, বা তার অপেক্ষাকৃত সহজ এবং স্বচ্ছ বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোন কি আদৌ আমাদের সেই প্রশ্নের ব্যাপারে কোন অবদান রাখতে পারে? তিনি অনুভব করবেন যে, তিনি পারেন। পরবর্তীতে তার তত্বীয় অনুমানের সাথে জীববৈজ্ঞানিক তথ্যের তুলনা করবেন। এতে দেখে যাবে, তার অনুমান বেশ বিচক্ষন হওয়া সত্বেও এর ভালো রকম সংশোধন প্রয়োজন। এইভাবে, ধীরে ধীরে আমরা সেই সঠিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পৌছাব, যা আমি বিনীত ভাবে সঠিক বলে বিশ্বাস করি। তবে একটা ক্ষেত্রে আমি সঠিক যে, আমি জানিনা এই পদ্ধতি কি সেরা এবং সহজ কিনা। তবে অল্প কথায়, এটা আমারই পদ্ধতি। এই ‘সাধাসিধা পদার্থবিজ্ঞানী‘ আমি নিজেই। লক্ষ্যে পৌছানোর জন্য আমার এই ক্রুর পদ্ধতি ছাড়া ভালো এবং স্পষ্ট কিছু আমি খুজে পাইনি।
“Classical physicist: শাস্ত্রীয় পদার্থবিজ্ঞানী
Statistical physics: পরিসংখ্যানিক পদার্থবিজ্ঞান
Statistical difference: পরিসংখ্যানিক পার্থক্য
Organism: জীবসত্বা”
এই টার্মগুলো কি ঠিক আছে? যেকোন ভূল ধরিয়ে দিলে খুশী হব।
ব্যক্তিগত ভাবে আমার কাছে অনুবাদ বেশ কঠিন কর্ম মনে হয়! আমি নিজে মূল ভাষায় পড়তে আগ্রহী। [যেমন ধরেন, আলকেমিস্ট এর অনেক রস ইংরেজিতে হারিয়ে গিয়েছিল]
চলুক এটা।
আর আমি বাংলার্থ কম পারি। সামিরা/ ফিনিক্স পারে!
বইটার সাল উল্লেখ করে দিলে আরও ভালো হত/ হবে। এইটা বেশ প্রভাবশালী একটা লেখা যতদূর মনে পড়ে [এমনটাই কোথাও পড়েছিলাম]
অনেক ধন্যবাদ। মূল ভাষায় পড়ার মজা কোথাও হবেনা। যেমন দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো অসম্ভব।
এটা ১৯৪৪ সালে প্রকাশিত একটা বই।
হোয়াট ইজ লাইফ দেখে প্রথমে ভাবলাম অনন্ত ভাইয়ার কোন গুণগান কিনা 😛
বায়োলজি আর ফিজিক্সের মিলনের বিষয়টা ইন্টারেস্টিং ! মনে হচ্ছে বইটা ভালোই হবে।
“ভুল” বানানটা একটু ভুল হয়ে গেছে।
মজার কমেন্টটির জন্য ধন্যবাদ।
বইটা আসলেই বেশ ইন্টারেস্টিং। তবে, বাংলায় ইন্টারেস্টিং করার জন্য চেষ্টা চলছে। ভুল ধরিয়ে দেবার জন্য আরেকবার ধন্যবাদ।