-কেমন আছ?
-ভালো, এত দেরী করলে কেন?
-খুব বেশী দেরী করেছি নাকি?
-প্রশ্নের উত্তরে প্রশ্ন করা, আমার একদম ভাল লাগে না।
-তোমার যা ভালো লাগবে সবসময় যে তাই হবে, এমনটা ভাবা কি ঠিক?
-তুমি মনে হয় ঝগড়া করার প্রিপারেশন নিয়েই এসেছ?
-ঝগড়া করার মত কিছু হয়নি, যেটা ফ্যাক্ট সেটাই বললাম।
-আমাকে ফ্যাক্ট শিখানোর দায়িত্ব কবে থেকে নিলে? আর আমিই-বা কবে তোমাকে এই দায়িত্ব দিয়েছি?
-সব কিছু তোমাকে বলে দিতে হবে কেন? আমি কি নিজ থেকে কিছু দায়িত্ব বুঝে নিতে পারিনা? বলেই অন্য দিকে তাকিয়ে হেসে দিল অর্ক।
-এই তুমি হাসছো কেন?
-হাসাও যাবে না? আমি কি রামগরুরের ছানা যে হাসা যাবে না? নাকি তুমি তাই ভাবো আমাকে?
-হড়বড় করে এত কথা বলা কবে থেকে শিখলে? চুপ করে বসে থাক, বলেই মুখ ভার করে চুপ মেরে যায় আদ্রিতা।
-চুপ করে বসে থাকলে পার্কে আসলাম কেন? আচ্ছা যাও, সরি, আর এমনটা হবে না।
-এই তোমার সমস্যা কী, বলতো? চুপ করে বসে থাক নয়তো হলে গিয়ে পড়তে বস। ঐ একটা জিনিসই তোমাকে দিয়ে হবে; সারাদিন চোখের সামনে একটা বই ধরে বসে থাকা আর গরুর মত জাবর কাটা, তোমার দৌড় অতটুকুই। অরজিনালি আঁতেল একটা…
আদ্রিতার মুখ বাকিয়ে ‘আঁতেল’ ডাক শুনে শব্দ করে হেসে উঠে অর্ক।
এক নিমেষেই সব অভিমান দূরে সরে যায় আদ্রিতার। এতো সুন্দর করে একটা মানুষ হাসতে পারে!
-আমি তো সরি বললাম, আচ্ছা বাবা এমনটা আর কক্ষনো হবে না, এবার ঠিক আছে? জরুরী কথা বলবে বলে ডাকলে, এখন তাড়াতাড়ি সেটা বলে ফেলো-তো ? পরশু আমার থার্মোডিনামিক্স এক্সাম- হলে গিয়ে ‘ওয়ালডেন ইনভার্শন’ ভাজা-ভাজা করতে হবে।
-আবার শুরু হয়ে গেল? কেমন মানুষ হে তুমি? গার্লফ্রেন্ডের সাথে পার্কের বেঞ্ছিতে বসে আছ, কই কিছু রোমান্টিক কথাবার্তা বলবে- হাত ধরে কিছুক্ষণ বসে থাকবে তা-না মন পড়ে আছে ‘ওয়ালডেন ইনভার্শন’ ভাজা-ভাজা করার ফ্রাই-প্যানে মানে পড়ার টেবিলে। এহেন আঁতেল তো আমি আমার জীবনে দেখি নাই! যাও আপাতত পপকর্ণ ভাজা কিনে আনো, খেতে খেতে গল্প করি।
নিতান্ত অনিচ্ছা নিয়ে উঠে গেল অর্ক। আদ্রিতা মুগ্ধ চোখে অর্ক’র হেঁটে যাওয়া দেখতে থাকে। আর ভাবতে থাকে, দু’বছর আগের এ দিনটির কথা। সেদিন অর্ক নামের এই সরল স্বভাবের, অসম্ভব পড়ুয়া ছেলেটি না থাকলে আজ-ও এ অবস্থায় থাকতে পারত না।
খুব বেশী কিছু মনে নেই আদ্রিতার। বইমেলা থেকে সদ্য কেনা বই হাতে নিয়ে শাহাবাগের ব্যস্ত মোড় পার হতে যাওয়া, হঠাৎ একটা বেপরোয়া প্রাইভেট কারের সাথে ধাক্কা; আর কিছু মনে নেই ও’র। জ্ঞান ফিরে জানতে অর্ক নামের এই ভারী চশমা পরা বোকা- বোকা চেহারার ছেলেটাই ও’কে হাসপাতালে নিয়ে আসে। অ্যাকসিডেণ্টে প্রচুর ব্লিডিং হয় কিন্তু কোথাও ‘বি’ নেগেটিভ রক্ত পাওয়া যাচ্ছিলো না…
হ্যাঁ, সেদিন অর্ক না থাকলে আজ এত সুন্দর বিকেলটা দেখতে পারতো না ও। মুহূর্তের মধ্যেই চোখ ভিঝে উঠে আদ্রিতার এবং মনে মনে শপথ করে, জীবনের শেষ মুহূর্তটি পর্যন্ত এমন করেই ভালোবেসে যাবে ও।
ঐ’ত পপকর্ণ নিয়ে চলে আসছে অর্ক, ও’কে কিছুতেই চোখের জল দেখানো যাবে না ভাবতেই পরক্ষনেই ওড়না দিয়ে নিজের আদ্র চোখ মুছে নেয় আদ্রিতা।
-এই নাও, গরম-গরম ভেজে দিয়েছে, মজা লাগার কথা।
-‘আই লাভ ইউ অর্ক’ বলে, মুহূর্তের মধ্যেই অর্ককে জড়িয়ে ধরে আদ্রিতা…নাহ, এবার আর নিজের লোনা জল লুকাতে পারে নি আদ্রিতা।
-আরে-আরে করছ কী? আশেপাশের সবাই আমাদের দিকে চোখ বড় করে তাকিয়ে আছে, আমার ভীষণ লজ্জা লাগছে; আহা, ছাড়ত, বলতেই অস্বস্তি আর লজ্জায় লাল হয়ে উঠে অর্কের গাল।
কিন্তু তাতে বোধয় আদ্রিতার উৎসাহ আরও বেড়ে যায়, দ্বিগুণ উৎসাহে আরও শক্ত করে ধরে রাখে অর্ককে, আর শব্দ করে বলে, মাঝে মাঝে লজ্জা পাওয়া খারাপ না, হি হি হি।
অর্ক আরও অস্বস্তি জোড়ানো গলায় বলে, আচ্ছা, তুমি কি শুধু জড়িয়ে ধরে বসে থাকা আর খাওয়ার জন্যই আমাকে ডেকে এনেছ নাকি? এটাতো পরশু’র পরদিনও করতে পারতে মানে এক্সামটা শেষ হলে আমাকে ডাকতে পারতে। আমি’তো আর উড়ে যাচ্ছি না, তুমিও আরও কিছুক্ষণ আমাকে জড়িয়ে বসে থাকতে পারতে, আমার যে এখন যেতেই হবে।
মুহূর্তেই আর্ককে ছেড়ে দিয়ে কিছুটা রাগী দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়েই শব্দ করে হেসে ফেলে আদ্রিতা।
-হুম, তোমাকে জড়িয়ে ধরার আনন্দটুকও পাওয়ার জন্যই ডেকেছি। আমার পক্ষে দুই গুনন ছিয়াশি হাজার চারশো সেকেন্ড অপেক্ষা করা সম্ভব নহে।
-বাহ, তুমি’তো ডিজিট ভালোই মনে রাখতে পারো হাসি মুখে বলে অর্ক।
-হুম, তাইতো মনে হচ্ছে। আচ্ছা, তুমি এখন যাও, আজ আর আমাকে এগিয়ে দিয়ে আসতে হবে না, তুমি গিয়ে ‘ওয়ালডেন ইনভার্শন’ ভাজা-ভাজা কর।
-সত্যি এগিয়ে দিয়ে আসতে হবে না? জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে, খুশীতে চকচক করতে থাকে অর্ক।
-হুম, সত্যি বলছি। তবে তার বিনিময়ে যাওয়ার আগে ঐ’টা খেতে হবে, আশে পাশে কেউ নেই তাড়াতাড়ি দিয়ে চলে যাও, বলেই মিটমিটিয়ে হাসতে থাকে আদ্রিতা।
পার্কে!!! তোমার দেখি মুখে কিছুই আটকায় না, মাঝে মাঝে পাগলের মত কি-সব বল তুমি? আচ্ছা, আমি এখন যাই তাহলে?
-হুম এসো, আর হ্যাঁ, ‘ওয়ালডেন ইনভার্শন’ ডিপ ফ্রাই করতে গিয়ে সারারাত জেগে আবার জ্বর বাঁধিয়ো না যেন? তোমার জ্বরের’তো আবার মা-বাপ নাই, হুদাই যখন-তখন চলে আসে।
আচ্ছা, মুচকি হেসেই জোরে জোরে হাঁটতে থাকে অর্ক।
অর্ক হেঁটে যাচ্ছে আর অজান্তেই আদ্রিতার চোখ সিক্ত হয়ে উঠে জলে, দু’ফোঁটা জল আপনাতেই গড়িয়ে পড়ে চিবুক বেয়ে…শেষ বিকেলের আলোয় তা চিকচিক করছিল।
এ লোনা জলের উৎস কোন কিছু হারানোর ব্যথা নয়, কাউকে না পাওয়ার কষ্ট নয়, শুধু নির্মল আনন্দের বহিঃপ্রকাশ। প্রকৃতিও যেন তা সানন্দে উপভোগ করছিল।
সত্যিকারের ‘ছোট গল্প’ হয়েছে। চট করে শুরু, চট করে শেষ… এবং আরো কিছু বাকী থেকে গেলো… 🙂 🙂
বাকীটুকু না-হয় কল্পনাতেই থাক। ছোটগল্পের আচমকা শেষ হয়ে যাওয়ায় মনে কিছুটা অতৃপ্তির রেশ থকে গেলও বাকিটা কেমন হতে পারে, সেটা কল্পনা করে নিতে মন্দ লাগে না 🙂
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ 🙂
চরিত্র, পরিবেশ সবই বেশ জীবন্ত মনে হয়েছে।
ভাষাও চমৎকার।
অনেক ভালো লেগেছে।
শুভকামনা রইল।
অসংখ্য ধন্যবাদ এতো সুন্দর মন্তব্যের জন্য 🙂 মানে মুখে যাই বলি না কেন, নিজের প্রশংসা শুনতে কার না ভাল লাগে 😛