আমি জন্ম নেওয়ার আগে থেকেই আমার মা ছিলেন ভীষণ অসুস্থ। আমি জন্ম নিয়েছিলাম তাই বেশ শুঁটকো পটকা হয়ে। লিকলিকে এবং ওজন কম থাকার কারণে ছেলেবেলা থেকেই সবাই আমাকে ‘পেন্সিল’ বলে ডাকতো। ছোট মামা আমাকে দেখলেই হেঁড়ে গলায় ছড়া কাটতেন-
‘পেন্সিলের মত হাতটা
কলমের মত পা’টা
নারিকেলের মত মাথাটা
কেয়া লাগতি হে ওয়াহ রে ওয়াহ’
আমার জীবন ছিলো মহা যন্ত্রনাময়। ঝড় আসলে আম্মু বলতো, ওকে ছাদে যেতে দিও না, ও এতই পলকা যে বাতাস এসে এক পলকেই ওকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে। একবার আপু আর আম্মু মিলে সকাল বিকাল খুব রুটিন করে আমাকে অনেকদিন টানা এত এত খাবার খাওয়ালো। আমার স্বাস্থ্য একটু ভালো হল, আমার আম্মু তো মহা খুশি। ঠিক এর তিন দিন পরেই আমার জন্ডিস হয়ে গেলো। অসুখে ভুগে আমি আবারও আগের সেই পেন্সিল হয়ে গেলাম।
ওজন কম থাকার কারণে জীবনে অনেক ভুগেছি। কোন পোষাক পরলে মানাতো না, বান্ধবীর মায়েরা জানতে চাইতো, বাসায় কি ঠিকমত খাওয়া দাওয়া কর না? ডায়েট কর নাকি? জিরো ফিগার রাখতে চাও? বাঙালি মেয়েরা একটু মোটা না হলে ভালো পাত্র পায় না বুঝলে? বেশি করে ভাতের পানি খাবা, সকালে উঠে পান্তা ভাত আর রাতে ঘুমানোর আগে চকলেট খেও…… (ব্লা ব্লা ব্লা)
কলেজ লাইফ থেকে জীবনে অনিয়ম করা বেড়ে গিয়েছিলো। ২০১০ সাল থেকে নিজেকে একটা রুটিন লাইফে নিয়ে আসি। আমাকে গাইড করেন আমার ফ্যামিলি ফ্রেন্ড, আমার ছোট খালু। খাওয়া, ঘুম, বিশ্রাম, কাজ, পড়া সব শুরু করি রুটিন মাফিক। ধীরে ধীরে স্বাস্থ্য ভালো হতে থাকে আমার। ৪২ কেজি ওজন বাড়তে বাড়তে ৫৫ তে গিয়ে ঠেকে। এরপর আবার কথা শুনি, মোটা হয়ে যাচ্ছ তুমি। মোটা মেয়েদের স্থুল বলা হয়, মোটা মেয়েদের বুদ্ধিও নাকি মোটা হয়। হাতি হয়ে যাবে তো কিছুদিন পর। ডাবল চিন দেখা যায় তোমার…… (ব্লা ব্লা ব্লা)
নিজেকে রোজ আয়নায় দেখি আর ভাবি, আমি আসলে নিজেকে কেমন দেখতে চাই? তারপর স্থির হয়ে সিদ্ধান্ত নেই, নিজেকে নিয়ে সতেচন হবো। উঁহু মানুষের কথার জন্যে নয়। বরং নিজের জন্যেই সচেতন হবো, যাতে করে কেউ আমাকে নিয়ে কোন কথা বলার সুযোগ না পায়। নাচ ছেড়ে দিয়েছিলাম পড়ালেখা চাপে। বাসায় আবার নাচের মুদ্রা এবং এক্সারসাইজগুলো চর্চা করা শুরু করি, নিয়ম করে হাঁটি, ফ্যামিলি ফ্রেন্ডের পরামর্শ নিয়ে নিয়ম মেনে মেনে বেছে খাবার খাই, ইউটিউব থেকে দেখে দেখে ব্যায়াম করি। সবকিছুর পর নিজেকে একটা ঠিকঠাক স্বাস্থ্যের অধিকারী হিসেবে দেখতে পাই।
নিয়ম করে ওজন মাপা সে বছর থেকেই অভ্যাস হয়ে যায়। ওজন বাড়ে-কমে, অতিরিক্ত কাজের চাপ বা অসুস্থতার কারণে মাঝে মাঝে মাত্রাতিরিক্ত ওজন কমেও যায়। পৃথিবীর যে কোন বিষয়ের স্থায়িত্বই নিয়মিত চর্চার উপর নির্ভর করে। অনিয়ম করলে আবারো তাই রুগ্ন হয়ে যাই। এভাবেই জীবন চলছিলো। রক্তদান করা বা রক্তদান মূলক বিষয়গুলো নিয়ে আমার মধ্যে কখনই কোন চিন্তা বা সচেতনতা ছিলো না। আমার বান্ধবী এবং এক্স কলিগ শর্মি রেড ক্রিসেন্টের সাথে জড়িত ছিলো, ওর কাজই ছিলো মানুষকে ধরে ধরে রক্তদান করানো। আমরা আড়ালে ওর নাম দিয়েছিলাম রক্তপিপাসু, ড্রাকুলা গার্ল। শর্মি জানতো ওর এই নামের কথা, একদিন আমাকে ডেকে তাই বলেছিলো, আপু আমি নিজে অনেক অসুস্থ থাকি, আমার স্বাস্থ্য ভালো না তাই নিজে রক্ত দান করতে পারি না বলেই অন্যকে উদ্বুদ্ধ করি। আমাকে যে নামেই ডাকেন না কেন আমি এই কাজ ছাড়বো না। যখনই এই ব্যাপারে কোন সাহায্য লাগে আমাকে বলতে ভুলবেন না।
বছরখানেক আগে একবার এক বন্ধুর আত্নীয়র রক্ত লাগবে বলে রক্ত দিতে চাই। আর জানতে পারি ওজন এবং হিমোগ্লোবিন কম থাকার কারণে আমি রক্ত দিতে পারবো না। আমার ওজন কমপক্ষে ৫০ কেজি হতে হবে, তাহলেই রক্ত দিতে পারবো। মন খারাপ করে সেদিন ফ্যালফ্যাল করে অন্যসব মানুষের দিকে তাকিয়ে থাকি যারা রক্ত দিতে পারছেন। আর মনে মনে ভাবি কবে আমি রক্ত দিতে না পারবো?
আমার বেটা, আমার ছোট ভাই নিশম সরকার সন্ধানীর সাথে কাজ করে। কারও রক্ত লাগবে সবার আগে এখন ওকে ফোন করি। দুনিয়া ভেঙ্গে হলেও ছেলেটা সাহায্য করার চেষ্টা করে। আমার দেখতে ভালো লাগে। নিশম একদিন বলেছিলো, একুয়া’পু তুমি কবে রক্ত দিতে আসবা? আমি সেদিন ঢাকা মেডিকেলে গিয়ে ওজন মেপে আবারও হতাশ হয়ে আবিস্কার করি আবারও আমার ওজন কম। 🙁
এ পর্যন্ত যখনই পারি, যেভাবেই পারি রক্ত যোগার করে দিয়ে সাহায্য করেছি অনেককে। রক্তদান এবং গ্রহণ করার গ্রুপ, সন্ধানী, রেড ক্রিসেন্ট, কোয়ান্টামসহ নানা জায়গার সাথে জড়িত মানুষের মাধ্যমে অনেক মানুষের জন্যে রক্ত যোগার করতে সাহায্য করার চেষ্টা করেছি। শুধুমাত্র ফেসবুক স্ট্যাটাস শেয়ারের মাধ্যমে কিছুমাস আগেই ১০ ঘন্টায় প্রায় ৯ ব্যাগ এ নেগেটিভ রক্ত যোগার করে একজন মা ও তার সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুর জীবন বাঁচাতে সাহায্য করেছিলাম। দিন দিন মনের ইচ্ছে বাড়ছিলো কেবলই। একদিন সাহস করে তাই এক বন্ধুকে বললাম, আমার ওজন এখন ৪৮ কেজি। আরেকটু ওজন বাড়লেই আমাকে রক্তদান করাতে নিয়ে যেও। আমি যাবো।
আজ ২২ শে আগস্ট ২০১৩ সাল। আমি অফিস শেষ করে কোন প্রকার পরিকল্পনা ছাড়াই কোয়ান্টাম ল্যাবে দিয়ে রক্তদান করে এলাম। কিছুটা নার্ভাস লাগছিলো। আমার ওজন ৪৯ কেজি এ ব্যাপারটা নিয়েও কিছুটা চিন্তিত ছিলাম। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার সবকিছু মিলিয়ে চমৎকারভাবে রক্তদান করার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়ে গেলো। আমার খারাপ তো লাগেই নি, বরং অসম্ভব শান্তি লেগেছে। যিনি রক্ত নিয়েছেন উনার নাম শাহেদ ভাই। রক্ত দেওয়া শেষ করে আমি উনাকে বললাম, ভাইয়া, সবই ঠিক আছে শুধু আপনাদের মেডিকেল সায়েন্সের রক্ত নেওয়ার সিরিঞ্জটা আরেকটু চিকন করার দরকার ছিলো। এমন মোটা সিরিঞ্জ তো দেখলেই ভয় ভয় লাগে। 😛
আমার পাশের বেডেই আরেকজন আপু আজকে প্রথম রক্ত দিতে এসেছেন। আমাকে ভীত কন্ঠে প্রশ্ন করলেন, রক্ত দিয়ে কি আপনার মাথা অনেক ঘুরাচ্ছে? আমি একগাল হেসে মহা আত্নবিশ্বাস নিয়ে বললাম, কিসসু হবে না আপনার। একদম খারাপই লাগবে না। রক্ত দেওয়া শেষ করে আমার মত আপনিও আপনার দেওয়া রক্তের ব্যাগটি স্পর্শ করে দেখবেন। এই রক্ত হয়তো কোন মানুষের জীবন বাঁচাবে এইটা ভাববেন। দেখবেন, মনে অনেক শান্তি লাগবে।
আমি ফিরে আসার সময় শাহেদ ভাই বললেন, অনেক বড় সওয়াবের কাজ করলেন আজকে। হাসপাতালে গিয়ে যদি দেখেন যে রোজ কত কত মানুষের রক্তের প্রয়োজন হয় তাহলে এমনি এমনি স্বেচ্ছায় আরও অনেক বেশি রক্ত দিতে আসতেন। আপনার আর কোন ভয় থাকতো না। আমি অল্প একটু হেসে বললাম, আমার একদম ভয় লাগে নি। প্রথমে শুধু একটু নার্ভাস ছিলাম। আর কিছু না।
আজ রাতে বাসায় ফিরে এলাম ফুরফুরে মন নিয়ে। মন জুড়ে আছে শান্তি, ভালোলাগা। এখন থেকে আমিও চার মাস অন্তর অন্তর রক্তদান করবো। ইনশাল্লাহ। নিজের সুস্থতা এবং স্বাস্থ্য নিয়েও সচেতন থাকবো। বাড়ি এসে ভাইয়ার কাছ থেকে জানলাম, বিশ্বের উন্নত দেশের বেশিরভাগ রক্তদাতাই হলেন স্বেচ্ছায় রক্তদাতা, যারা সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে রক্তদান করেন। দরিদ্র দেশগুলোতে স্বেচ্ছায় রক্তদাতার সংখ্যা বেশ কম, সেখানে বেশিরভাগ রক্তদাতাই কেবল তাদের পরিচিতজনদের প্রয়োজনে রক্তদান করে থাকেন। আমি মনে মনে স্থির করেছি, আজ আমাকে যেমন কেউ রক্তদানে উৎসাহিত করেছে, আজকের পর থেকে আমিও আমার পরিবার এবং অন্যান্য সবাইকে আরও বেশি করে রক্তদানে উৎসাহিত করবো।
আমি দিন গুনছি আমার ভাগ্নিদের যখন ১৯ বছর বয়স হবে তখন ওদেরকে আমিই প্রথম রক্তদান করাতে নিয়ে আবো। কারণ আজকে আমি নতুন করে অনুভব করেছি, রক্তদান শুধু রক্তদান নয় একজন মুমূর্ষু রোগীকে একটা নতুন জীবন দান করা। তাঁকে পূর্ণভাবে জীবন দান করা। এর মাঝে যে আত্মতৃপ্তি পাওয়া যায় তা আর কিছুতেই পাওয়া যায় না।
আজকে আমিও রক্ত দিয়ে এসেছি আপু 🙂
ওমা বলিস কি? একদম মিলে গেলো 😀
তুই রক্ত দিয়েছিস? জ্বর নিয়ে? বাহ বাহ বাহ … খুব ভাল করেছিস :haturi: :haturi:
😐
মহতী উদ্যোগ তবে আপু, খানা-পিনা টা ঠিক মত চালিয়ে যায়েন কিন্তা। আর আপনার ভাগ্নিদেরও খাওয়া-দাওয়ায় আরও উৎসাহিত করবেন…স্বাস্থ্যই সকল সুখের রুট 😛
ধন্যবাদ হৃদয়। ঠিকমত খাওয়া-দাওয়া করছি। আমার আশেপাশে ডাক্তার এবং হাফ ডাক্তারের অভাব নেই বুঝলে? 😉
অনেকেই আসলে ভয় পায়। আমি নিজেও প্রথম যেবার দিয়েছিলাম ভালো ভয় পাইছিলাম। নিয়মিত রক্তদানের মতো সহজে ভালো কাজ করার উপায় কমই আছে।
আমি মোটা গুটলূ গাটলু ছিলাম! আর আমার বউ হইলো… হাওয়া মে উড়তা যায়ে মার্কা 😛
আমি একদমই ভয় পাই নি। মজা লেগেছে আমার ভাইয়া। 8) আপনি কিন্তু এখনো আবার গাল্টু গোলটু হয়ে গিয়েছেন। 😀
আমারো রক্ত দেয়ার খুব ইচ্ছে। কিন্তু আমার রক্ত শুন্যতা রয়েছে। একবার দিতে গিয়েছিলাম। কিন্তু অর্ধেক ব্যাগ ভরার পরই অসুস্থ হয়ে যাই। দিতে পারিনি আর। কিন্তু আরা সুস্থ আর স্বাভাবিক আছে তাদের দিতে বলি সব সময়।
সুপ্তি আপুনি,
আমি নিজেই আন্ডার ওয়েট ছিলাম অনেকদিন। আল্লাহর রহমতে এখন থেকে যেহেতু রক্ত দিতে পারছি আর দেওয়া থামাবো না। 🙂
ভালো লেগেছে আপু। আমার ওজন অনেক কম। ‘ঠিকঠাক’ যদি কখনো হই তাহলে ইনশাআল্লাহ্ রক্ত দিব। 🙂
আচ্ছা উচ্চারণটা টোয়াইলাইট না আপু? শিওর হয়ে নিয়েন। 🙂
উচ্চারণটা টোয়াইলাইট হবে, কিন্তু বেশ কিছু জায়গায় দেখলাম টোয়ালাইট এর বদলে টুইলাইট লিখেছে তাই এই নামই দিলুম।
***ইনশাল্লাহ তোমার ওজন ঠিকঠাক হবে। 🙂
ওজনের কারনে আমিও রক্ত দিতে পারছি না।আশা করি যেদিন ওজন এবং সব ঠিক থাকবে রক্ত দিব 🙂 :happy:
লেখাট ভাল লাগল 🙂
‘লেখাট’ আবার কী জিনিস? 😛
হা হা মন্তব্যের জন্যে থ্যাঙ্কুস।
লেখাটা খুব ভালো লাগল।
মেয়েদের ক্ষেত্রে ৬ মাস পর ব্লাড দেওয়া যায়; আর ছেলেদের ৪ মাস।