সেক্সুয়াল অবজেক্টিফিকেশন: ঐশীদের তৈরির উপায়

“আমার অনেক খারাপ দিক আছে। সেই খারাপ দিকগুলো চালাকি করে বুঝে ফেলা ছাড়া ভালো দিকগুলো কখনও বাবা-মা বোঝার চেষ্টা করেছে কিনা তা সন্দেহ। আমার এ চিঠিখানা তাদের দেখাতে লজ্জা ও ঘৃণা লাগছে।”

১৭ বছর বয়সী ঐশী আত্মহত্যার চেষ্টা করার আগে তার সুইসাইড নোটে এই কথাগুলো লিখে রেখেছিলো। সেই সুইসাইড নোটটা প্রকাশিত হবার পরে অনলাইন জগতে বেশ একটা ঝড় বয়ে যেতে দেখি। যে হইচইটা শুরু হয়েছিলো এতোটুকু একটা বাচ্চা মেয়ের মা-বাবাকে খুন করা নিয়ে, সেটা এরপর গড়িয়ে চলে গেলো মেয়েটা ‘খারাপ’ ছিলো কিনা সেই দিকে! দেশের কয়েকটি প্রিন্ট ও অনলাইন পত্রিকার শিরোনাম হলো- ‘ঐশীর বেপরোয়া জীবনে সঙ্গী ১ ডজন বয়ফ্রেন্ড ‘! (1)

শুধু তাই নয়, কিছু কিছু লেখা এতোটাই কুরুচিপূর্ণ যে সেগুলো পড়বার প্রতি আমার তীব্র অনীহা কাজ করেছে। মাঝে মাঝে আমি অবাক হয়ে ভাবি, আমাদের দেশের সাংবাদিকরা কীভাবে এতোটা ট্যালেন্টেড হতে পারেন যে কোনরকম প্রশিক্ষণ ছাড়াই একটা ঘটনাকে ‘আলোচিত’এর পাতায় উঠিয়ে দিতে একজন এফবিআই এজেন্টের চেয়েও কম সময় নিতে পারেন!

যাক সে কথা, আমার লেখার বিষয়বস্তু ঐশী নয়, ঐশীর অমানবিক কাজের পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি দেয়াও আমার উদ্দেশ্য নয়। ঐশীর ঘটনার পর অনেকের অনেক কথা পড়েছি, অনেক মন্তব্য শুনেছি। আমি শুধু চুপ করে ভেবেছি এতোদিন আর দেখেছি, ‘সেক্সুয়াল অবজেক্টিফিকেশন’ নামের শব্দটা কীভাবে ঐশীদের তৈরি করে, করছে এবং আমাদের মিডিয়াগুলোও কেমন করে কেবল এই শব্দটাকেই ব্যবহার করে দিনের পর দিন তাদের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে!

সেক্সুয়াল অবজেক্টিফিকেশন শব্দটার সাথে যারা পরিচিত নন, তারা সরবে এই বিষয়ে আমার আগের লেখাটি পড়ে আসতে পারেন।

বোঝার সুবিধার জন্যে এক কথায় তবুও শব্দটাকে বিশ্লেষণ করছি আরেকবার- সেক্সুয়াল অবজেক্টিফিকেশন তখনই হয়, যখন মানুষ হিসেবে নারীকে তার ব্যক্তিত্ব ও অনুভূতির বাইরে এনে কেবলমাত্র ‘সেক্স অবজেক্ট’ হিসেবে অন্যের সামনে তুলে ধরা হয় এবং সেভাবেই তাকে মূল্যায়ন করা হয়!

সেক্সুয়াল অবজেক্টিফিকেশনের এই বিষয়টা আসলে ব্যক্তির চেয়ে পারিপার্শিক সামাজিক উপাদানের ওপর তুলনামূলক বেশি নির্ভর করে। সমাজের প্রচলিত বিভিন্ন উপাদানগুলো একসময় মানুষকে সেক্সুয়ালি অবজেক্টিফায়েড হতে বাধ্য করে। ঐশীর বিষয়টাও তাই। তার অনিয়ন্ত্রিত জীবন, একাধিক বয়ফ্রেন্ড এবং মাদকাসক্তির জন্যে ঐ ধরনের পরিবেশ এবং পারিবারিক অবস্থানই প্রধানত দায়ী।

** কীভাবে সেক্সুয়াল অবজেক্টিফিকেশন ধীরে ধীরে গড়ে তুলছে ঐশীদের? **

উপরের প্রশ্নটার উত্তর দিতে গিয়ে কেবল একটা-দুটো নয়, বরং আমাদের সমাজে ছড়িয়ে থাকা বেশ অনেকগুলো মাধ্যম আমি খুঁজে পেলাম! আমি এখানে সিদ্ধান্তমূলক কোন মন্তব্য করবো না, বরং যে প্রশ্নগুলো আমার মনে এসেছে, কেবল সেগুলোই তুলে ধরবো, উত্তর খুঁজে নিতে আশা করি আপনাদের সমস্যা হবে না।

 টেলিভিশন

– আমাদের দেশের টিভি চ্যানেলগুলোতে তারুণ্য নির্ভর যে অনুষ্ঠানগুলো হয় যেমন, বিজনেস টক, ক্যারিয়ার, সমসাময়িক বিষয়ে আলোচনা অনুষ্ঠান ইত্যাদিতে পুরুষ এবং নারী অংশগ্রহণকারীদের অনুপাত কেমন থাকে?

– অন্যদিকে মিউজিক্যাল শো, ফ্যাশন এবং বিনোদন নির্ভর অনুষ্ঠানগুলোতে তাদের অনুপাতটা কেমন হয়?

– নারী অংশগ্রহণকারীদের পোশাক, ব্যবহার, বাচনভঙ্গী, দেহভঙ্গী কি সেক্সুয়াল অবজেক্টিফিকেশনকে জাস্টিফাই করে?

মিউজিক ভিডিও

– গানের সাথে নির্মিত মিউজিক ভিডিওগুলোতে ছেলে-মেয়ের পারস্পারিক প্রেমের দৃশ্য ছাড়া অন্যরকম কোন প্রেক্ষাপটে সাধারণত ভিডিওর গল্পগুলো উঠে আসে কি?

– নারীদের পোশাক কি পুরুষদের *তুলনায়* বেশি আবেদনময় হয়?

– নারীদের উপস্থিতি কি গল্পের প্রয়োজনে হয় নাকি কেবল সাজগোজ করা *সরঞ্জামের* মত তারা ব্যবহৃত হয়?

– পুরুষ গায়কদের অনেক সময়েই বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজাতে দেখা গেলেও ভিডিওতে নারীদের মাঝে এমন শিল্পীসুলভ পরিচয়ের দেখা পাওয়া যায় কি?

– টিনএজার নারী শিল্পীকে কি এমনভাবে তুলে ধরা হয় যাতে তাকে প্রাপ্তবয়স্ক মনে হয়? অর্থাৎ নারীর ‘সেক্সুয়াল রেডিনেস’ কি তার ম্যাচিউরিটি প্রকাশ করে?

গানের কথা

– গানের কথা কি সেক্সুয়াল প্রেক্ষাপটকে সমর্থন করছে? (উদাহরণ, দেহরক্ষী সিনেমার গান)

মুভি

– নারী চরিত্রগুলো কি অভিনয়শৈলীর জন্যে দর্শকপ্রিয়তা পায় নাকি সেক্সুয়াল অবজেক্ট হিসেবে নিজেকে তুলে ধরার প্রক্রিয়ায় পায়?

কার্টুন ও অ্যানিমেশান

– বাচ্চাদের কার্টুনের নারী চরিত্রগুলোতে কি পোশাকে-কথায় শারীরিক সৌন্দর্য নিয়ে উদগ্রীবতার ছবি প্রকাশ পায়?

ম্যাগাজিন

– ফ্যাশনের হালচাল কি বিপরীত লিঙ্গকে আকৃষ্ট করার প্রতি ইঙ্গিত দেয় অর্থাৎ এতে কি ‘কস্টিউমিং ফর সিডাকশন’ প্রকাশ পায়?

ইন্টারনেট

– ২০০১ সালে কাইসার ফ্যামিলি ফাউন্ডেশানের (2) এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৫-১৭ বছর বয়সের ৭০ শতাংশ টিনএজারই ভুলবশত পর্নোগ্রাফি দেখে ফেলে, যাদের ভেতর ২৩ শতাংশ প্রায়শই পর্ন দেখা অব্যাহত রাখে। প্রায় ১২ বছর পরে এই ২০১৩ সালে এসে ইন্টারনেটের অবাধ স্বাধীন দুনিয়ায় পর্ন দেখার সংখ্যাটা কি বেড়েছে বলে মনে হয়?

বিজ্ঞাপন

– আমাদের দেশের টিভি মিডিয়া, প্রিন্ট মিডিয়া এবং বিলবোর্ডগুলোতে নারীদেরকে অবজেক্টিফায়েড করে কি ব্যবসা করা হচ্ছে না?

উপরের সবগুলো মাধ্যম যদি একটা শিশুকে ছোট থেকে নিজেকে অবজেক্টিফায়েড করে গড়ে তুলতে শেখায়, তবে সমাজে ঐশীদের মত মেয়ে তৈরি হওয়া খুব অবাক করা ব্যাপার হবে না। কেন?

কারণ সেক্সুয়ালাইজেশন একজন নারীর উপর বেশ অনেকগুলো মেকানিজমে প্রভাব ফেলে যেগুলোকে আবার বিভিন্ন থিওরি যেমন, সোশিওকালচার, সোশিয়ালাইজেশন, কগনিটিভ থিওরি ইত্যাদি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। আপাতত অত গভীরে যাবার ইচ্ছে নেই আমার। শুধু দু-একটা ব্যাপার সহজ ভাষায় বলি।

অ্যাটকিনের গবেষণায় (3) দেখা গেছে একটা মেয়ে শিশু সাধারণ বিজ্ঞাপন আর নিয়মিত টিভি প্রোগ্রামের মাঝে পার্থক্য করতে পারে না এবং তারা মার্কেটিং নামের বস্তুর নগ্ন শিকার (4) হয়। এমনকি ৮ বছর বয়সের আগ পর্যন্ত (5) সে বুঝতেই পারে না যে বিজ্ঞাপনের মূল উদ্দেশ্য আসলে ‘কেনা-বেচা’ সম্পর্কিত। ফলে টিভি কর্মাশিয়ালগুলোতে যখন সেক্সুয়াল অবজেক্টিফিকেশন চলতে থাকে, তখন কোনরকম ভুল-ঠিক বিচারের আগেই সে ঐ অবজেক্টিফিকেশনকে গ্রহণ করে ফেলে। যে কারণে বাচ্চার সামনেই বাবা-মা হিন্দী সিনেমার উত্তেজক নাচ-গান দেখলে বাচ্চারা সেক্সুয়াল প্রোভোকেশনের ব্যাপারে কিছু না বুঝেই ঈদের শপিং এ গিয়ে চাম্মাক চাল্লো, সানি লিওন ইত্যাদি পোশাক পছন্দ করে, কেনার আবদার করে।

কিন্তু যখন থেকে সেই শিশুটি নিজের পরিচয় খুঁজে পায়, তখন থেকেই তার সেলফ-এস্টিম বা নিজস্বতা হারাতে শুরু করে। গবেষণায় দেখা যায়, মেয়েদের বয়োঃপ্রাপ্ত হওয়া এবং শারীরিক সৌন্দর্যবোধ তাদের নিজস্বতা এবং স্বকীয়তার সাথে অনেকটাই জড়িত (6, 7)। টলম্যানের (8) গবেষণায় জানা যায়, ক্লাস এইটের যে সব মেয়ে নিজেদেরকে সেক্সুয়ালি অবজেক্টিফায়েড হিসেবে চিহ্নিত করে ফেলে, তাদের স্বতন্ত্রতা বোধ অনেক কম থাকে।

ফ্রেড্রিকসনের (9) একটি মজার গবেষণায় উঠে আসে সেক্সুয়াল অবজেক্টিফিকেশনের সাথে স্বাভাবিক কাজের সম্পর্কের ব্যাপারটি। তার গবেষণায় স্কুলের ড্রেসিং রুমে মেয়েদেরকে পোশাক হিসেবে হয় সুইম স্যুট নয় তো সোয়েটার বেছে নিতে বলা হয়। তারপর ১০ মিনিট সময় বেঁধে দিয়ে তাদেরকে অঙ্কের একটি পরীক্ষা নেয়া হয় যেখানে দেখা যায় যে সুইম স্যুট পরিহিত মেয়েরা অপেক্ষাকৃত খারাপ ফলাফল করেছে। অর্থাৎ, একটি মেয়ে যখন নিজেকে শারীরিকভাবে প্রেজেন্ট করার চেষ্টা করবে, তখন তার যৌক্তিক, চিন্তাশীল এবং বিশেষ কোন কাজ করার ক্ষমতা (কগনিটিভ অ্যাক্টিভিটি) কমে যাবে।

সব মিলিয়ে অর্থটা দাঁড়ায়, সেক্সুয়াল অবজেক্টিফিকেশন একটি মেয়ের স্বাভাবিক চিন্তা ও কর্মশক্তিতে বাধা দেয়। শুধু তাই নয়, এই অবজেক্টিফিকেশন একটি মেয়ের ভেতরে মানসিক হতাশা ও নিজের শরীর নিয়ে সবসময় লজ্জা পাওয়া, খুঁতখুঁতে বা ছোট হয়ে যাবার মত অনুভূতির জন্ম দেয় যে কারণে মেয়েটি কালচারাল স্ট্যান্ডার্ডে নিজের অস্তিত্ব নিয়ে সবসময় চিন্তিত থাকে (10)।

এবার আসি ঐশীর ব্যাপারটায়। শোনা যায়, আইডিয়াল স্কুলে ক্লাস শুরু করেও সে নিজেকে সেখানে মানিয়ে নিতে পারে নি। আধুনিক জীবনযাপনে তার আগ্রহ ছিলো। অর্থাৎ, সে তার পরিবার কিংবা চারপাশ থেকে যেভাবেই হোক, অবজেক্টিফিকেশনের ব্যাপারগুলো অজান্তেই নিজের ভেতর ধারণ করেছে। অক্সফোর্ডে যাওয়া শুরু করে যতদিনে সে বুঝতে শিখেছে, ততদিনে অবজেক্টিফিকেশন তার ভেতরে গেঁথে গেছে। গবেষণার ফলাফলগুলো থেকে যদি ডট কানেক্ট করি, তাহলে অনুমান করে বলা যায়, সে নিজেকে নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারে নি। এ জন্যেই হয়তোবা শারীরিক সৌন্দর্য বাড়ানোর কিংবা ধরে রাখার জন্যে ক্ষুধা নষ্টকারী ইয়াবাতে আসক্ত হয়ে পড়ে সে। ঐশীর বয়ফ্রেন্ডের সংখ্যা যতই হোক না কেন, নিজের জীবনযাপন নিয়ে যে সে অসন্তুষ্ট ছিলো সেটা স্পষ্ট। তার চিঠি থেকেই বোঝা যায় যে নিজস্ব চিন্তাধারায় নিজেকে নিয়ে সে সবসময়েই এক ধরনের হীনমণ্যতাবোধে ভুগতো।

আমি এখানে আবারো আমার এই লেখার একটু সারসংক্ষেপ বলে দিতে চাই।

আমার লেখার বিষয়বস্তু ঐশী কিংবা তার হত্যার জাস্টিফিকেশন করা নয়। বরং সমাজে এমন আরো অনেক ঐশীদের গড়ে তোলা সেক্সুয়াল অবজেক্টিফিকেশন নিয়ে। মনে রাখা ভালো, অবজেক্টিফিকেশন মানেই খোলামেলার বিরোধিতা নয়। একজন নারী সম্পূর্ণ ঢেকে পোশাক পরলেও নিজেকে অবজেক্টিফায়েড হিসেবে প্রকাশ করতে পারেন। কারণ অবজেক্টিফিকেশন মানেই নিজেকে শারীরিক বস্তুর পর্যায়ে ভাবা এবং প্রকাশ করা, মানুষ হিসেবে নিজ সত্ত্বার অস্তিত্বকে হারিয়ে ফেলা। সেক্সুয়ালি অবজেক্টিফায়েড নারী তার দক্ষতা, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনযাপনে নিজের স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলেন। যার জন্যে দায়ী আমাদের পরিবার, আমাদের মিডিয়া ও আমাদের চারপাশের পরিবেশ। আমাদের সমাজে আজ ঐশীর মত শিশুরা কিছু বোঝার আগেই সেক্সুয়াল অবজেক্টিফিকেশনের শিকার হয়। *মানুষ* হিসেবে ভাবতে শেখার আগেই নিজেদেরকে তারা ‘মেয়ে’ হিসেবে ভাবতে শুরু করে।

এক কথায় বলতে গেলে, সেক্স অবজেক্ট হিসেবে মেয়েরা যখন পরিচিতি পাবে, তখন সেক্সুয়াল অ্যাবিউজের  হার বেড়ে যাবে, বেড়ে যাবে ধর্ষণ, অল্প বয়সে প্রেগন্যান্সির মাত্রা, শিশু মৃত্যুহার, অল্প বয়সী মায়ের গর্ভকালীন জটিলতা ইত্যাদি; সাথে সাথে কমে যাবে ভালোবাসা, বিশ্বাস, মূল্যবোধের স্থান, নারীকে স্বতন্ত্র্য মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করার এবং স্বীকৃতি দেয়ার হার। এমনকি নিজের বাবা-মাকে খুন করার মত এক্সট্রিম ঘটনাগুলো ঘটাও হয়তো তখন বিচিত্র হবে না।

সবচেয়ে দুঃখ পেয়েছি যে ব্যাপারটায়, যার কারণে এই তেঁতো বিষয়টি নিয়ে কী-বোর্ডে আঙুল চালাতে বাধ্য হয়েছি, তা হলো, ঐশীর এই ঘটনার পর ফেইসবুকে আমরা ঐশীর ফ্যান’ নামে একটি পেইজের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া; যেখানে তারা দাবী করছে যে ঐশীর সাথে তার বাবা-মা নির্যাতন করতেন এবং এই নির্যাতনের বিরোধিতায় খুনের মত কাজ করে ঐশী ঠিকই করেছে! অসম্ভব আহত হয়েছি, যখন এই পেইজটিতে শতাধিক লাইক দেখেছি অর্থাৎ পেইজে দাবী করা কথাগুলোর সাথে কিছু মানুষ সমর্থন পোষণ করেছেন। তারা কারা? ধরে নেয়া যায়, তারাও অল্পবয়সী ছেলেমেয়ে যারা মা-বাবার বিধি-নিষেধকে নির্যাতন মনে করছে। ব্যাপারটা এটুকুতেই শেষ হলে ভালো হতো, কিন্তু কেবল নিজেদের নির্যাতিত মনে করাই নয়, তারা বাবা-মাকে খুন করার মত একটি অমানবিক বিষয়কেও সমর্থন করছে!

আমি খুব আশাবাদী একজন মানুষ। আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় যে এই লাইকগুলো কোন ফেইক প্রোফাইল থেকে দেয়া, অথবা অর্থের বিনিময়ে কিনে নেয়া, অথবা অনলাইন চুরিবিদ্যা ব্যবহার করে পাওয়া লাইক। বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়, পৃথিবীতে এমন কোন সন্তান থাকতে পারে না যারা নিজের মা-বাবাকে খুন করার মত ভাবনায় জীবনে ১ সেকেন্ড সময়ও ব্যয় করতে পারে।

ঐশীর মত এই সন্তানদের কথা ভাবতে ভাবতে মনে হলো, সমাজের প্রতিটি ঘরেই আজ তারা বেড়ে উঠছে কারো সন্তান অথবা বোন হয়ে, এই তারাই আগামীতে কোন একদিন মা হবে। কিন্তু নিজেকে মানুষ হিসেবে মর্যাদা না দেয়া এমন একজন সেক্সুয়ালি অবজেক্টিফায়েড অর্ধাঙ্গী কিংবা মা কি আদৌ আমাদের কাম্য? সমাজে পুরুষ নামের অর্ধাংশ *মানুষ* হিসেবে আর নারী নামের অর্ধাংশ কেবল *মেয়ে/ সময় কাটানোর আনন্দদায়ক সঙ্গী* হিসেবে বেড়ে উঠলে, ‘সেক্সুয়াল অ্যাবিউজ, হত্যা-ধর্ষণ’ মুক্ত সমাজ আশা করাটা কি খুব বেশি বোকামী হয়ে যাবে না?

বিশেষ দ্রষ্টব্য

  • এই লেখাটি কোন ব্যক্তি, মিডিয়া বা প্রতিষ্ঠানকে হেয় করার জন্য লেখা নয়। তারপরেও লেখার মাধ্যমে কেউ অনিচ্ছাকৃত আঘাত পেয়ে থাকলে লেখক হিসেবে আমি ক্ষমাপ্রার্থী।
  • লেখার সাথে কোন ব্যক্তি নিজেকে মিলিয়ে কোন সাদৃশ্য খুঁজে পেলে তার দায়ভার সেই ব্যক্তির ওপর বর্তাবে, কোনভাবেই লেখকের ওপর নয়।
  • লেখার সাথে যুক্ত সবগুলো ছবিকে ঝাপসা করে ছবির মান ইচ্ছাকৃতভাবে কমিয়ে দেয়া হয়েছে। লেখক হিসেবে আমি চাই নি যে ছবির ব্যক্তিদের কেউ  আমার লেখনীর মাধ্যমে ছোট হোক বা সেক্সুয়ালি অবজেক্টিফায়েড হোক। ছবির প্রয়োজনে আমার এই লেখা নয়, বরং লেখার প্রয়োজনেই ছবিগুলো এসেছে।
  • লেখায় উল্লেখিত গবেষণাগুলো সমকামী, বাইসেক্সুয়াল ও ট্রান্সজেন্ডারদের জন্যে প্রযোজ্য নয়।
  • ছেলেরাও সেক্সুয়ালি অবজেক্টিফায়েড হতে পারে, কিন্তু মেয়েদের তুলনায় তার অনুপাত কম বলে এখানে সাধারণভাবে মেয়েদের জন্যেই কথাগুলো উঠে এসেছে।
  • লেখাটি পাঠকপ্রিয়তা পেলে অর্থাৎ পাঠক চাইলে সেক্সুয়াল অবজেক্টিফিকেশনের নেতিবাচক দিক ও এর থেকে বেরিয়ে আসার জন্যে ইতিবাচক উপায়গুলোর বিস্তারিত  নিয়ে পরবর্তী সিরিজ লেখার কথা চিন্তা করা হবে। সম্পূর্ণটাই নির্ভর করছে পাঠকের চাওয়া ও ইচ্ছের ওপরে।

 

তথ্য:::

  1. http://www.mzamin.com/details.php?nid=NjcyOTU=&ty=MA==&s=MTg=&c=MQ
  2. Kaiser Family Foundation. (2001, December). Generation Rx.com: How young people use the internet for health informa-tion. Menlo Park, CA: Kaiser Family Foundation
  3. Atkin, C. (1982).Television advertising and socialization of consumer roles. In D. Pearl (Ed.), Television and behavior: Ten years of scientific progress and implications for the eighties (pp. 191-200). Rockville, MD: National Institute of Mental Health
  4. Borzekowski, D. L. G., & Robinson T. N. (1999).Viewing the viewers: 10 video case studies of children’s television viewing behaviors. Journal of Broadcasting and Electronic Media, 43, 506-528
  5. Kunkel, D., & Roberts, D. (1991).Young minds and mar-ketplace values: Issues in children’s television advertising. Journal of Social Issues, 47, 57-72
  6. Harter, S. (1998).The development of self-representations. In W. Damon (Series Editor) & N. Eisenberg (Vol. Ed.), Handbook of child psychology:Vol. 3. Social, emotional, and personality development (5th ed., pp. 553-617). Hoboken, NJ:Wiley
  7. Major, B., Barr, L., & Zubek, J. (1999). Gender and self-esteem: A meta-analysis. In W. Swann, J. H. Langlois, & L. Gilbert (Eds.), Sexism and stereotypes in modern society:The gender science of Janet Taylor Spence (pp. 223-253). Washington, DC: American Psychological Association
  8. Impett, E. A., Schooler, D., & Tolman, D. L. (2006).To  be seen and not heard: Femininity ideology and adolescent girls’ sexual health. Archives of Sexual Behavior, 35, 129–142
  9. Fredrickson, B. L., Roberts,T., Noll, S. M., Quinn, D. M., & Twenge, J. M. (1998).That swimsuit becomes you: Sex differences in self-objectification, restrained eating, and math performance. Journal of Personality and Social Psychology, 75, 269-284
  10. Slater, A., & Tiggemann, M. (2002). A test of objectification theory in adolescent girls. Sex Roles, 46, 343-349

ফিনিক্স সম্পর্কে

"প্রিয় পতাকার লাগি // জটায়ুর মত রক্ত ঝরাতে // আমিও প্রহর জাগি..." https://www.facebook.com/phoenix.chhanda
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে ইতিবাচক, চিন্তাভাবনা, সচেতনতা-এ এবং ট্যাগ হয়েছে , , স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

41 Responses to সেক্সুয়াল অবজেক্টিফিকেশন: ঐশীদের তৈরির উপায়

  1. ইকু বলেছেনঃ

    সুন্দর লিখা দিস … অনেক কিছু বুঝার আছে , ভাবনার খোরাক আছে ।

  2. জিহাদ বলেছেনঃ

    চমৎকার একটি লেখা……

  3. বোহেমিয়ান বলেছেনঃ

    অসাধারণ বরাবরের মতো।
    আসুন এই লেখাটি ছড়িয়ে দেই আমরা।

  4. শারমিন বলেছেনঃ

    অসাধারণ লিখা আপুনি

  5. পাজিকাজী বলেছেনঃ

    ভালো লেগেছে। এবং আমি খুব খুব চাই যেন সিরিজটা কন্টিনিউ হোক।

  6. অনুজ বলেছেনঃ

    দারুণ লিখেছিস! :clappinghands: :clappinghands: :clappinghands:
    পরবর্তী লেখাটির জন্যে খুব করে অপেক্ষা করে থাকব, বুবু… 🙂

    • ফিনিক্স বলেছেনঃ

      হাহাহ, চেষ্টা করবো প্রত্যাশা পূরণের। কতটুকু পারবো জানি না। এখন একটু একটু ভয়ই হচ্ছে, সবার প্রত্যাশা যেভাবে উপরে উঠে যাচ্ছে! এতোটা পূরণের সামর্থ্য আমার থাকবে তো? আমি পারবো তো? :voypaisi:

      • অনুজ বলেছেনঃ

        তুই ভালো, সুন্দর, সবার চেয়ে আলাদা – জীবনে এই বোধশক্তি থেকে পিছিয়ে পড়িস না। আমি জানি, তুই পারবি! 🙂

        • ফিনিক্স বলেছেনঃ

          আমার প্রতি এতোটা বিশ্বাস রাখার জন্যে অন্তর থেকে অনেক অনেক ভালোবাসা আর দোয়া। :beshikhushi:

          আমি আপ্রাণ চেষ্টা করবো আমার এই প্রিয় পাঠকদের প্রত্যাশা পূরণের। আমার সমস্ত লেখালেখি শুধু তাদেরই জন্যে যে! :beshikhushi:

  7. আদিব বলেছেনঃ

    তথ্যবহুল একটা লিখা। খুব কমই আপনার মত করে চিন্তা করতে পেরেছে। সবাইই কেমন যেন ঐশীকে নিয়েই লাফালাফিতে ব্যস্ত। সে এই করেছে সেই করেছে। কিভাবে এসব থেকে পরিত্রান পাওয়া যায় সেদিক কারোই ভ্রূক্ষেপ নেই। এরকম ঐশী এই সমাজে হাজারটা আছে। সমাজ যে কিভাবে চলছে তা বুঝতে গাদা গাদা উদাহরন লাগে না একটা ঐশীই যথেষ্ট। তাই আমাদের সমস্যা থেকে পরিত্রানের পথে খুঁজতে হবে। একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সমাজকে এসব থেকে মুক্ত করতে হবে। ভালো লাগলো আপু। চালিয়ে যান। ধন্যবাদ 🙂

    • ফিনিক্স বলেছেনঃ

      এতো সুন্দর করে গুছিয়ে মন্তব্য করার জন্যে অনেক অনেক কৃতজ্ঞতা ভাইয়া। আপনাদের মত পাঠকের জন্যেই আমি লেখালেখির সাহস পাই, আগ্রহ পাই। 😐

      অসংখ্য ধন্যবাদ ভাইয়া। :beshikhushi:

  8. সামিরা বলেছেনঃ

    খুবই উচিত কথা লিখেছো। ভালো লিখেছো কিনা সেটা বলার দরকার নাই মনে হয়, অনেকেই আছে সেটা নিয়ে বলার!
    শেষে ফুটনোটগুলি সরবের মত করে দিলে না? তাহলে ক্লিক করলেই চলে আসতো। অবশ্য এভাবেও ভালো।

  9. দারাশিকো বলেছেনঃ

    হুম। শেয়ারে গেল।

  10. ইসতিয়াক বলেছেনঃ

    ‘সেক্স অবজেক্ট হিসেবে মেয়েরা যখন পরিচিতি পাবে, তখন সেক্সুয়াল অ্যাবিউজের হার বেড়ে যাবে, বেড়ে যাবে ধর্ষণ, অল্প বয়সে প্রেগন্যান্সির মাত্রা, শিশু মৃত্যুহার, অল্প বয়সী মায়ের গর্ভকালীন জটিলতা ইত্যাদি; সাথে সাথে কমে যাবে ভালোবাসা, বিশ্বাস, মূল্যবোধের স্থান, নারীকে স্বতন্ত্র্য মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করার এবং স্বীকৃতি দেয়ার হার। এমনকি নিজের বাবা-মাকে খুন করার মত এক্সট্রিম ঘটনাগুলো ঘটাও হয়তো তখন বিচিত্র হবে না।’
    দারুণ লিখসেন ভাই…….

  11. শিব্বির আহমদ বলেছেনঃ

    অনেক অনেক সুন্দর একটা লেখা…। সবার পড়া উচিত।

  12. সিমান্ত বলেছেনঃ

    প্রায় সকল অপরাধীই পরিবেশ-পরিস্থিতির শিকার হয়ে অপরাধীতে পরিনত হয়, অপরাধ করে।

    তাহলে কি সব অপরাধের জন্য সমাজ দায়ী, নাকি অপরাধী দায়ী?

    • ফিনিক্স বলেছেনঃ

      দুইজনেই দায়ী।
      অপরাধ করার জন্যে অপরাধী দায়ী। অপরাধ করার প্ররোচনা দেয়ার জন্যে সমাজব্যবস্থা দায়ী।

  13. হাসান বলেছেনঃ

    Excellent writing for this time…
    Pathetic thing “objectification” er main je karon “marketing” ta thamano jabena jodio maximum consumer conscious hoy, jotokkhon na it is strictly controlled by our government/state. Tobe tar sathe sathe obossoi arokom likhar dara attitude change er chestao thakte hobe.
    Thanks a lot for such writing.

    • ফিনিক্স বলেছেনঃ

      বন্ধ করাটা তো কঠিন তবে চেষ্টা করলে নিয়ন্ত্রণ আনা যায় বোধহয়।
      পড়ার জন্যে অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া। 🙂

  14. ইতস্তত বিপ্লবী বলেছেনঃ

    ” স্লো পয়জনিং ” এর মত আসলে ব্যাপারটা…স্টীলথ মোডেই মার খেয়ে যাচ্ছি, সমস্যার গোড়া অগোচরে থাকলে সমাধান কেমনে হবে?
    এধরনের লেখা আরো আসা দরকার, চিহ্নিত করতে হবে এসব আপদকে, তার আগে কোন অ্যাকশনেই কিছু হবে না।

    “ফিনিক্স প্রোডাকশন”
    আর অন্য প্রশংসার দরকারই পড়ছে না 🙂
    :dhisya: :dhisya: :dhisya:

  15. জন বলেছেনঃ

    বরাবরের মতই চমৎকার লিখেছেন। পরবর্তি লেখার অপেক্ষায় থাকলাম।

    • ফিনিক্স বলেছেনঃ

      অসংখ্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা ভাইয়া।
      চেষ্টা করবো যত দ্রুত সম্ভব পরবর্তী লেখা নিয়ে আপনাদের সামনে আসতে। 🙂

  16. ইউনিক! এমন করে তুমিই লিখতে পারো আপু।

    লেখাটা এত শেয়ার হয়েছে মাশা আল্লাহ। আ’ম ফিলিং প্রাউড! আমার এক বান্ধবী টেক্সট করেছে তোমার লেখাটার লিঙ্ক দিয়ে- যেন অবশ্যই পড়ি- (আমি তো যেদিন পাবলিশ হইছে ওইদিনই পড়ছি!) তারপর এটা নিয়ে একটা গ্রুপ ডিসকাশন করতে চাচ্ছিলাম ক্যাম্পাসে। আমি ভাবছি আমাদের পয়েন্টগুলো তোমাকেও জানিয়ে দেবো।

    যাহোক, একটা ব্যাপারে জিজ্ঞাসা রইলো আপু, চিঠিটার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছে, ওরা যেই যুক্তিগুলো দেখিয়েছে সেগুলো ফেলনা নয়। তোমার কী মত? :voypaisi:

    • ফিনিক্স বলেছেনঃ

      ফেইসবুকেও লেখাটায় এতো রেসপন্স এসেছে, এত্তগুলো কমেন্ট যে সব ধৈর্য ধরে পড়া হয়ে ওঠে নি, উত্তর তো দেয়াই হয় নি সেভাবে। 🙁

      চিঠিটা কয়েকটি দৈনিকে এসেছিলো। সত্যতার বিপরীতের যুক্তিগুলো ঘেঁটে দেখি নি এখনো। তাই বলতে পারছি না। দুঃখিত।

      এই লেখার মূল বিষয় কিন্তু ঐশী নয় বা ঐশীর কাজগুলোর জাস্টিফিকেশনও নয়। বরং ঐশীর মত মেয়েরা যেন তৈরি না হয়, যেন ঐশীর ধারেকাছ দিয়েও তাদের সাইকোলজি না যায়, সেই চেষ্টা থেকেই লেখাটা উপস্থাপন করা হয়েছে। এই জায়গাগুলোতে তোর কোন মতপার্থক্য আছে কি?

      থাকলে আলোচনা করতে আগ্রহী! 🙂

      আর প্রথম দিনেই লেখাটা পড়ে ফেলার জন্যে তোকে তিন কেজি ধইন্যা দিলুম, ভর্তা করে ঝাল দিয়ে মেখে খেয়ে নিস। 😛

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।