ছোটবেলা থেকে “সম্পর্ক” নিয়ে ভাবি নি কখনো। এমন কি কৈশোরেও কখনো মনে হয় নি আলাদাভাবে সম্পর্ক বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হয়, অনুভব করতে হয়। পারিবারিক, সামাজিক সম্পর্কগুলোর মাঝ দিয়েই আমার এবং হয়তো আমার মত সবার বেড়ে ওঠা। আমার বাবা আমার মাকে ভালোবাসবেন, আমার বড় বোনের কাছ থেকে আমি চাইলেই সবকিছু পাব, কিংবা স্কুলে গেলে আমার অনেক বন্ধু হবে, নানুর কাছে পিঠা খাবার আবদার করলেই তিনি তা বানিয়ে দিবেন, আমার কাছে সম্পর্কের প্রতিকৃতি এমনই ছিলো সব সময়। আমি যে সময়টার কথা লিখছি, সে সময় দৃঢ় এবং মজবুত সম্পর্কের বেশ গল্প শুনতাম। ধীরে ধীরে এক পা দু’পা করে সময়ের সাথে বড় হতে হতে সামনাসামনি দেখতে শুরু করলাম সম্পর্কের নানা রুপ, রঙ, জটিলতা, দ্বন্দ্ব, সংঘাত, বৈচিত্র্য।
একটি সমাজ কতটা সুখী ও সুস্থ তা নির্ধারণের একটি উপায় হচ্ছে সে সমাজের সম্পর্কগুলো বিচার করা। সে সমাজ ও সংস্কৃতি কীভাবে তার সম্পর্কগুলোকে সাজাচ্ছে, সামাজিক সম্পর্কগুলোকে কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে, সম্পর্কের ক্ষেত্রে তার মূল্যবোধগুলো কেমন? সম্পর্ক একটা খুবই নৃতাত্ত্বিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যাপার। সমাজ ও সংস্কৃতির অনিবার্য উপাদান। সামাজিক সম্পর্কগুলো যত উন্নত হবে তার সাপেক্ষেই গড়ে উঠবে সে সমাজসফলতা সুখ। তাই পৃথিবীর জ্ঞানকাণ্ডগুলো সম্পর্কের বিষয়টিকে একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইস্যু বলে বিচার করে এবং এই বিবেচনা থেকেই মানুষের মাঝে সম্পর্কবোধ জেগে ওঠে।
তারা এক মরণে দুইজন মরে…
আমার স্কুলে ইংরেজি শিক্ষিকাকে আমরা সবাই সবচেয়ে বেশি শ্রদ্ধা করতাম এবং ভয় পেতাম। ভীষণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, গম্ভীর এবং শান্ত ছিলেন তিনি। শ্যামবর্ণ গায়ের রঙ। যখন কথা বলতেন মনে হত মুগ্ধ হয়ে শুধু তাঁর কথাই শুনে যাই। আমরা সবাই বড় হয়ে উনার মতো হতে চাইতাম। উনার চশমার ফ্রেম, তাঁতের শাড়ির সাথে এলো খোঁপা করা স্নিগ্ধ রুপ আমাদেরকে মুগ্ধ করতো। আমরা সবাই ভাবতাম ম্যামের ছেলেমেয়েগুলো নিশ্চয় খুব সৌভাগ্যবান। তাদের মা এতো অনন্যা। ক্লাস নাইনে উঠে একদিন জানতে পারলাম আমাদের ম্যাম বিয়ে করেন নি। তিনি তাঁর বাবা-মার সাথে থাকেন। ম্যাম যাকে ভালোবাসতেন সেই ভদ্রলোকের পরিবার ম্যামের সাথে বিয়ের ব্যাপারে সম্মতি দেয় নি। সেই ভদ্রলোক বিয়ে করেছেন পারিবারিক সম্মতিতে অন্য কাউকে। আর আমাদের ম্যাম নাকি সবসময় বলতেন, যাকে উনি ভালোবাসেন নি বা ভালোবাসতে পারবেন না তার সাথে উনি জীবন কাটাতে পারবেন না। জীবন কাটাতে হলে নাকি পাশে ভালোবাসার কেউ থাকা বড্ড প্রয়োজন। সত্যিকারের ভালোবাসা নাকি জীবনে একবারই হয়। আর উনার তা হয়ে গেছে। ম্যাম বাকি জীবন কাউকে আর ভালবাসতে পারেন নি, তাই একাই থেকেছেন। আমাদের মত অসংখ্য মেয়েদের মাঝে শিক্ষার আলো বিলিয়ে দিয়েই তিনি তাঁর জীবন পার করেছেন।
আমার দূর সম্পর্কের এক চাচা ছিলেন। লতায় পাতায় আমাদের এক ধরণের আত্নীয় হন তিনি। জেনেছিলাম তিনিও অবিবাহিত। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি যেই মেয়েটিকে ভালোবাসতেন সেই মেয়েটির পরিবার উনার পরিবারের থেকে ধনী ছিলো বিধায় তাঁদের বিয়েটা আর হয় নি। সেই চাচা বাকি জীবন একাই কাটিয়েছেন। সারাদিনের নানা ব্যস্ততা আর কাজের শেষে নিজের ভাই-বোনদের সন্তানদের সাথেই তাঁর বেশিরভাগ সময় কাটে।
সম্পর্ককল্পদ্রুম
একটা গাছ যত পুরনো হতে থাকে তার শেকড় ততই মাটির গভীরে প্রবেশ করতে থাকে। এক সময় হঠাৎ করে ঐ গাছটা উপড়ে ফেলা খুব কঠিন হয়ে পড়ে। আমার কাছে মানুষকেও অনেকটা গাছের মত বলে মনে হয়। সে দিনের পর দিন যেখানে থাকে সেখানে ক্রমশ তার ডালপালা ছড়িয়ে দিতে থাকে। আর এই ডালপালাগুলো হয়তো মানুষের সম্পর্ক। সম্পর্ক ব্যাপারটা আসলে কে কীভাবে দেখছে, কীভাবে পালন করছে বা ধারণ করছে তাঁর উপর নির্ভর করে। আমার মতে ভালোবাসার মানেই হলো “ভালোর মাঝে বসবাস” আর তাই প্রকৃত সম্পর্ক বা সুসম্পর্ক সেটাকেই বলা যায় সে সম্পর্কে ভালো বোধ আছে, শ্রদ্ধা এবং বিশ্বাস আছে। একেকজনের দৃষ্টিতে সম্পর্ক একেকরকম হবে, আর স্বভাবতই, যত মত তত পথ। কিন্তু সেসব পথের শেষ কোথায়? শেষ যেখানে, নির্মম সত্য হল- সেখানে খ্যাপা এখনো খুঁজে ফেরে পরশপাথর! তবে এতসব রঙিন বায়োস্কোপের মাঝেও কিছু সম্পর্ক আছে যা এখনো অটুট রয়ে গেছে। এখনো কিছু মানুষ সম্পর্কের মূল্য বোঝে। আমি বিশ্বাস করি কিছু মানুষ আছে যাদের অসাধ্য স্বপ্ন জয় করার অদম্য সাহস আছে, জীবনের প্রতিটি কাজ, দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করার চেষ্টা তাদের আছে। তবে দুঃখ হল হয়ত তারা সংখ্যায় অনেক কম। আর আনন্দের বিষয় হল এখনো পৃথিবীতে, এ দেশে সত্যিকারের মানুষ মিলিয়ে যায় নি, শেষ হয়ে যায় নি। জীবনটা মস্ত বড়। স্বপ্ন দেখার আর তা সত্য করার স্পৃহা তাই মিলিয়ে যায় নি এবং যাবেও না এই কামনাই করি। তবে পাপ- এবং পুণ্যার্থীদের লড়াইটা দিন দিন জটিল হয়ে পড়ছে।
আরো কিছু সম্পর্কের বিশ্লেষণ করা যাক, ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি আমাদের বাড়িতে সবসময় আত্নীয়দের ভীড়। গ্রাম থেকে কেউ ব্যবসার কাজে ঢাকায় এসেছে, কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে এসেছে, কেউ হয়তো কোন আর্থিক সাহায্যের জন্যে এসেছে, কেউ বা এসেছে চিকিৎসা করাতে। আত্নীয় ছাড়াও কোন না কোনভাবে পরিচিত বা অপরিচিত অনেকেই বিভিন্ন কারণে আমার বাবার শরণাপন্ন হয়েছে। আমার বাবাও সবসময় মানুষের সমস্যায়, আপদে-বিপদে সাহায্য করতেন। অথচ বর্তমানে গ্রাম বা গ্রামের আত্নীয়দের সাথে শহুরে আত্নীয়দের মেলামেশার মাঝে এক বদ্ধ দেয়াল গড়ে উঠেছে।
অর্থাৎ একটা সময় মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কগুলো পারিবারিক অবস্থান, সামাজিক অবস্থান, পারিবারিক সম্মতি, প্রতিশ্রুতি, অনুভূতি, নীতি, এই বিষয়গুলো দ্বারা আবদ্ধ বা প্রভাবিত ছিল। সম্পর্কের একাল এবং সেকালে এসেছে অনেক পরিবর্তন। তবে এসবের কতটুকুই ভালো আর কতটুকুই মন্দ, তা নিয়ে তর্ক বির্তক রয়েছে।
প্রচলিত অর্থে বলা যায়, একটি সম্পর্ক বন্ধন, বিশ্বাস, সম্মান ও যত্নের মাধ্যমে গড়ে ওঠে। কিছু সম্পর্ক মানুষের জন্মের সাথে সাথেই তৈরি হয়ে যায়। যেমন- বাবা, মা, ভাই, বোন ও আত্নীয়দের সাথে সম্পর্ক। এবং কিছু সম্পর্ক সময়ের সাথে সাথে মানুষের জীবন, প্রয়োজন, কর্ম, ধর্ম ও সামাজিকতার কারণে তৈরি হয়। যেমন- সহপাঠী, সহকর্মী, বন্ধু, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক। Don Miguel Ruiz-এর মতে, “সম্পর্ক একটা শিল্প। একার স্বপ্নের চাইতে দুজন মানুষের তৈরি স্বপ্নকে অক্ষুণ্ন রাখাটা কঠিন।”
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী…
উপমহাদেশের সমাজ মূলত পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। অনেক কাল আগে থেকে পুরুষরাই পারিবারিক সম্পর্কগুলো নিয়ন্ত্রণ করে এসেছে। তবে সম্প্রতি এক আন্তর্জাতিক গবেষণায় দেখা গেছে, পারিবারিক জীবনে সম্পর্কের বিষয়গুলো নারীরাই নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। সব ক্ষেত্রে পুরুষের প্রাধান্য থাকলেও ভালোবাসার সম্পর্কগুলোর গতিপ্রকৃতি নারীর মানসিক পরিবর্তনের সঙ্গে যুক্ত। তাই বিশ্বের সমাজব্যবস্থা আবারও মাতৃতান্ত্রিকতার দিকে যাচ্ছে বলে গবেষকরা মনে করছেন। গবেষণা দলের সদস্য যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক রবিন ডানবার বলেন, এ গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে যে জুটির বন্ধনের বিষয়টি পুরুষদের চেয়ে নারীদের জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর নারীরাই ভালবাসার সম্পর্কের গতি নির্ধারণ করে বলে বেশ নির্ভরযোগ্য প্রমাণও পাওয়া যায় এতে। মানব সমাজ ধীরে ধীরে আবার মাতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে এ গবেষণায়।
নৃতাত্ত্বিকদের মতে মানব সমাজ সিংহভাগই পিতৃতান্ত্রিক, কারণ পুরুষরা যেখানে জন্ম নেয় সেখানেই অবস্থান করে এবং নারীদের নতুন স্থানে এসে বসবাস করতে হয়। তবে ডানবার এ-ও বলেন, বর্তমানের জ্ঞানভিত্তিক সমাজের দিকে যদি আমরা তাকাই তাহলে দেখা যাবে, আমরা অনেক বেশি মাতৃতান্ত্রিক হয়ে উঠছি। হয়তো পুরুষ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে উচ্চ পর্যায়ে নেতৃত্ব দিচ্ছে, তবে শেষপর্যন্ত সামাজিক ব্যবস্থা মাতৃতান্ত্রিকভাবেই চলছে।
সম্পর্কের একাল-সেকাল
পরিবারই একজন মানুষকে প্রথম শিক্ষা দিয়ে থাকে। আগের দিনের মতো বাবা-মার সাথে সন্তানদের সম্পর্ক আর এখনকার দিনের সম্পর্ক এক নেই বা থাকবে না এটাই স্বাভাবিক, বর্তমান সময়ের বাস্তবতায়। কিন্তু সময়ের সাথে পারিবারিক শিক্ষার ভালো ও গুরুত্বপুর্ণ দিকগুলো যদি সন্তানদের না শেখানো যায় তবে তারা সমাজ কতুটুকু ভালো-মন্দ মানুষের দেখা পাবে সেটাও এখন প্রশ্ন। আফ্রিকায় যে ছেলেটি বয়োঃসন্ধিতে হাতে অস্ত্র নিয়ে লড়াই করছে তার জীবন আর মার্কিন এক ছেলের জীবন মিলবে না তা-ই স্বাভাবিক। তবে পৃথিবীর অধিকাংশ ধর্ম বা সামাজিক চেতনায় কিছু অদৃশ্য শর্ত রয়েছে, যখনই সেখানে হাত পড়বে তখনই অশান্তি শুরু হবে। অদ্ভুত হলেও সত্যি, আমাদের সমাজে এমন অনেক শর্তে আঘাত আসছে। আমরা হয়তো কাশ্মীর বা পেশোয়ারের অস্থিরতায় নেই, তবে ঢাকা ও আশেপাশের শহরতলী এলাকা এখন অনেক থমকে গেছে মানব চাপে।
আমাদের এক বা দু দশক আগের প্রজন্মের অনেকেই বিদেশে গিয়ে দীর্ঘ মেয়াদে থাকছেন। বিদেশের নাগরিকত্ব পাবার জন্যে সেখানে বিয়ে করেন, আবার নাগরিকত্ব পেয়ে গেলে সম্পর্ক ভেঙ্গেও ফেলেন। অনেকে দেশে মফঃস্বল বা গ্রামের কোন সহজ-সরল মেয়েকে বিয়ে করে রেখে চলে যান, আর যোগাযোগও করেন না। অনেকেই বিদেশ থেকে দেশে এসেও বাংলার চেয়ে ইংরেজিতে বেশী স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন। বাংলা বললে বুঝতে পারছেন কিন্তু জবাব দিচ্ছেন ইংরেজিতে। প্রশ্ন হলো, এদেশের মাটির দেনার শোধ কীভাবে করবে তারা? তাহলে আবারো প্রশ্ন ফিরে আসে আমরা এমন কেন? কোন উত্তর নেই।
নির্মম সত্যকে ছুঁয়ে দেখতে গেলে দেখা যায়, বিজ্ঞান যত এগিয়েছে মানুষের জীবনে তত আবেগ কমেছে। সময়ের সাথে ভালোবাসা তার প্রকাশভঙ্গি পাল্টেছে, নির্মাণ পদ্ধতি পাল্টেছে। কিন্তু প্রাচীনতম অনুভূতি এই ভালোবাসার ফলাফল কতটুকু অপরিবর্তনীয় আছে তা নিয়ে কি তেমন কেউ ভাবে নি? অতীতের প্রেম-ভালোবাসা কতটুকু সুখ এনে দিত আর এখনকার প্রেমই বা কতটুকু দিতে পারে এই প্রশ্নগুলো আসলে আপেক্ষিক। প্রযুক্তির কারণে মানুষের মাঝে আজকাল অহরহ গড়ে উঠছে ভার্চুয়াল সম্পর্ক। ফেইসবুক, মুঠোফোন, টুইটার, মেসেঞ্জার নানান মাধ্যম থেকে মানুষ প্রতিনিয়ত একে অন্যের সাথে সম্পর্কে জড়াচ্ছে, মোহগ্রস্ত হচ্ছে। এসব সম্পর্কের পতনও ঘটছে খুব দ্রুত। মন ভাঙছে আর সেই সাথে সম্পর্কের প্রতি শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসও কমছে। আমাদের দেশের তরুণ-তরুণীদের অনেকেই মিডিয়া অঙ্গনে কাজ করছে। এই সব ঠুনকো আর কৃত্রিম সম্পর্কের ভিড়ে তাদের জন্যে আসলে কী দৃষ্টান্ত থেকে যাচ্ছে? তারকাখ্যাতি মানেই কিন্তু সম্পর্ক বা পরিবারকে অবহেলা করার ক্ষমতা পেয়ে যাওয়া নয়।
বর্তমানে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একেকটি বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠছে স্বার্থের প্রয়োজনে। কথায় বলে- “কাজের সময় কাজী, কাজ ফুরালেই পাজি”, বর্তমানে সম্পর্কগুলোও যেন এই নীতিতেই বিশ্বাসী। কে বেশি সুন্দর, কে বেশি ধনী, কে বেশি মেধাবী এই সব বিষয়ের দিকে নজর রেখেই স্বার্থের কারণে গড়ে ওঠে সম্পর্ক। আর সঙ্গত কারণেই সেই সব সম্পর্কের স্থায়িত্বও হয় ভীষণ কম। এগুলোকে বলা যায় সম্পর্ক নামধারী অসম্পর্ক। এছাড়া আগের দিনে একজন শিক্ষক বা শিক্ষিকার অবস্থান ছিলো বাবা-মার পরেই। শিক্ষক-শিক্ষিকার প্রতি ছাত্রছাত্রীদের সম্মানও ছিলো অগাধ। বর্তমান সময়ে ছাত্রছাত্রীদের মাঝে সেই সম্মানবোধ আর আগের মত নেই। অথচ আমরা পড়েছিলাম “শিক্ষকই মানুষ গড়ার কারিগর”। মানুষ গড়ার কারিগরদের প্রতি সেই বিশ্বাস বা সম্মানটুকুই যদি ধরে না রাখা যায় তবে মানুষের মত মানুষ গড়ে উঠবে কীভাবে?
আরেকটি উদাহরণ দেয়া যাক। মেয়েটি আমার সহপাঠির সাথে সম্পর্ক ভেঙ্গে দিয়েছিল কোন কারণ ছাড়াই। তারপর ছয় মাসের মাঝেই দেশ ছেড়ে চলে গেছে লন্ডনে। দিব্যি আছে এখন, পড়াশোনা করছে, খুব উত্তরাধুনিক গোছের এক ছেলের সাথে সম্পর্ক হয়েছে তার। মাঝে মাঝে ফেইসবুকে তাদের অন্তরঙ্গ ছবিও দিয়ে রাখে। আমার সহপাঠী যে কিনা পড়ালেখায় সবচেয়ে ভালো ছিল, সে তার ভাঙা সম্পর্ক জোড়া লাগাতে না পেরে দিনে দিনে আসক্ত হয়ে যায় মাদকে। পড়ালেখার নাম নেই। অনেক দিন হল তার খবর কেউ জানে না। আমাকে সে একদিন বলেছিল– “মেয়েদের চাইতে সিগারেট, অ্যালকোহল অনেক বেশি বিশ্বস্ত, কারণ মেয়েরা ছেড়ে চলে যায়, সিগারেট এলকোহল সাথেই থেকে যায়”। বর্তমান সময়ের অনেক ঠুনকো সম্পর্এভাবেই হয়ত অনেক মেধাবীর জীবন থামিয়ে দিচ্ছে। আমার কথা হল, যে মানুষটি অন্যায় করেছে সে তো অনেক ভালো আছে। কিন্তু যে কষ্ট পেয়ে নিজের জীবনটাকে নষ্ট করল তার কী হবে! পরিবারের কতই না স্বপ্ন ছিল তাকে নিয়ে। প্রতিদিনই তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে এমন গল্পের।
আমার কলেজের পরিচিত আরেক ছোটবোনের কাছ থেকে জানতে পারলাম, সে যে প্রাইমারী স্কুলটিতে পড়াচ্ছে তাতে একেকটা ক্লাশের প্রায় ১৫%এরও বেশি শিশু এসেছে ব্রোকেন ফ্যামিলি থেকে। পারিবারিক কাঠামো, একক ও যৌথ পরিবারের দ্বন্দ্ব, জীবনযাত্রার মান উন্নত হওয়া, স্বামীর পাশাপাশি বর্তমানে স্ত্রীদের চাকরী করে অর্থনৈতিকভাবে সবল হওয়াসহ নানা কারণে এই পারিবারিক বিচ্ছেদগুলো ঘটছে। এছাড়াও আগে মানুষের মধ্যে একাধিক বিয়ে নিয়ে এক ধরনের নেতিবাচক ধারণা ছিলো। শ্রম এবং সাধনার মাধ্যমে সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখার একটা প্রয়াস ছিলো। বর্তমানে পারিবারিক বিচ্ছেদ একটি সাধারণ ঘটনার মতই হয়ে গিয়েছে। তাঁদের অজুহাত একটিই, বনাবনি হচ্ছিল না, তাই সমঝোতার ভিত্তিতে সম্পর্ক ভাঙ্গা হয়েছে। অনেকেই এর মাঝে দেখতে পারছেন না যে এই বিচ্ছেদের কারণে তাদের সন্তানদের ওপর কী রকম প্রভাব পড়ছে। এভাবে আসলে সম্পর্কের ভাবমূর্তিও নষ্ট হচ্ছে। সামাজিক অবক্ষয়ও ঘটছে।
আগেই বলেছি সম্পর্ক একটা খুবই নৃতাত্ত্বিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যাপার। বর্তমানে আমাদের দেশের সংস্কৃতি অনেকটুকুই পাশ্চাত্য দেশের সংস্কৃতির অনুকরণে মত্ত। আমাদের দেশে মিডিয়ার ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে বিবাহ বিচ্ছেদ, একের পর এক সম্পর্ক, একাধিক বিয়ের প্রবণতা। হঠাৎ জনপ্রিয় হয়ে ওঠা কিছু কিছু শিল্পীর নৈতিক চরিত্রের যে অধঃপতন ঘটেছে তাতে মাঝে মাঝে জানতে ইচ্ছে করে আসলে আমরা কোথায় যাচ্ছি? মানুষের জন্যে সম্পর্ক নাকি সম্পর্কের জন্যে মানুষ? বিশ্বায়নের যুগে সংস্কৃতির অনুকরণে কী আসে যায় কিংবা নৈতিকতার সংজ্ঞা কী এই নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন কেউ কেউ। তার উত্তরে মনস্তাত্ত্বিক এবং সমাজবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই পরিবর্তনগুলোর বিশ্লেষণ এবং মানুষের মনে তার প্রভাব নিয়ে পড়াশোনা করার অনুরোধ রইলো।
শেষে এসে শুরুর কথা
পারস্পরিক ভালোলাগা থেকে জন্ম নেয় ভালোবাসা। আর ভালোবাসার শুভ পরিণতি বিয়ে। বিয়ে সামাজিক রীতি হলেও এই সম্পর্ক স্থায়ী ও সুখী করতে উদ্যোগী হতে হয় দুজনকেই। যদি একজনও সম্পর্কের ক্ষেত্রে কিছু বিষয় মেনে চলে, তাহলে বিবাহিত জীবন আরও সুন্দর এবং সুখী হবে। তাই সম্পর্কে সততা, ক্ষমা, বোঝাপড়া, বিশ্বাস, বন্ধুত্ব, ধৈর্য, ভালোবাসা থাকা খুবই জরুরি। আর মানুষ মাত্রই অনুকরণপ্রিয়, তাই চারপাশে মজবুত এবং স্বচ্ছ সম্পর্কের দৃষ্টান্ত থাকলে সম্পর্কের ব্যাপারে তারা সচেতনও হবে।
একটি দেশের সাথে আরেক দেশের মানুষের সম্পর্ক তাদের সমাজ, অনুভূতি ও দেশপ্রেমের মাধ্যমে গড়ে ওঠে। অথচ এখনকার তরুণ সমাজে দেখা যায়, তাদের দেশ নিয়ে লক্ষ্য আছে কিন্তু কোন ফলাফল নেই। দেশের জন্যে ‘এই করবো সেই করবো’ অনেকেই বলবে কিন্তু কাউকে উদ্যোগ নিতে দেখা যাবে না। হাতে তুড়ি বাজিয়ে অনেকেই বলবে বিদেশে গিয়ে উচ্চ শিক্ষিত হয়ে দেশের উন্নয়নের জন্যে দেশে ফিরে আসবো, দেশের জন্যে কিছু করবো। কিন্তু খুব কম সংখ্যক মানুষই শেষ পর্যন্ত তার দেশের জন্যে কিছু করতে ফিরে আসে বা সংকল্পবদ্ধ থাকে।
সময়টা আমাদের বা তারুণ্যের। জীবন তাদের জন্যই যারা সুন্দর করে বাঁচতে জানে। তারুণ্যের সংজ্ঞা এ কারণেই বয়সের ছকে মাপা যায় না। “Yo man! Wassup? We are the facebook generation. Yeah!”, সর্বদা মজা করা, “পলিটিক্স দেশটাকে শেষ করে দিল”- এইভাবেই চলে সবার জীবন। কিন্তু এই জীবনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা পরিপূর্ণ দার্শনিক রূপকে কি দেখেছে কেউ? খুব কমসংখ্যকই দেখেছে। পৃথিবী থেকে গুরুরা সব বিদায় নিচ্ছে, অথচ নিজেকে যে গুরু হতে হবে সে চেষ্টাই বা কোথায়? বস্তুগত চাহিদা, সামষ্টিক অর্থনীতি আর আধ্যাত্মিক বোধকে চর্চা করার মানুষ কমে যাচ্ছে। পৃথিবীকে ঠকালে কিন্তু নিজেকেও ঠকতে হবে! জীবনে গাড়ি, বাড়ি, চাকরি, নারীর মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসে এ শহরে একজনকে স্টিভ জবস হতে হবে, শহরে কেউ ভগত সিং বা মাস্টার দা সূর্যসেনের মতো জীবনের গতি প্রকৃতি পাল্টাতে নামবেন, কেউ ওয়ারেন বাফেটের মতো তুখোড় উদ্যোক্তা হবে অথবা কেউ সাকিবের মতো বাংলাদেশের ক্রিকেটকে পরাশক্তিতে রুপায়িত করবে এমন উদ্যোগের সময় কিন্তু আমাদের এসেছে, তবে বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে?
সময় এখনো ফুরিয়ে যায় নি, তাই আমি বিশ্বাস করি, “স্বপ্নের পেছনে ছোটার সাহস যদি আমাদের থাকে, তবে সব স্বপ্নই একদিন সত্যি হতে পারে।”
“আমরা এবং আমাদের সম্পর্ক” লেখাটি অমর ২১ শে বইমেলা, ২০১৩ -তে “তারুণ্যের ২০ কুড়ি” নামক বইতে প্রকাশিত হয়েছে। যদিও এ লেখাটি বইতে প্রকাশিত হয়েছে তারপরও যেন বেশিরভাগ মানুষ সম্পর্কের ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক বিশ্লেষণ এই লেখাটির মাধ্যমে জানতে পারে তাই লেখাটি আন্তর্জালে শেয়ার করা হল।
তারুণ্যের বিশ কুঁড়ি বইটির রকমারি লিঙ্ক
অনুপ্রেরণা / কৃতজ্ঞতা- সরব ব্লগ ও নুরুদ্দিন আহমেদ বাপ্পি।
এডিট করেছেন- সামিরা মুসলেহ
পোষ্টটি চতুরে পড়া ছিল। এখন আবার সম্পূর্ণ নতুন ভাবে পড়লাম। এই ধরণের লিখা গুলি কখনই পুরাতন হয়না। অনেক কিছু জানা এবং বুঝার পোষ্ট।
শুভ ব্লগিং, ভালো থাকা হোক অবিরত।
ধন্যবাদ করিম ভাই,
লেখাটি “তারুণ্যের ২০ কুড়ি” বইটিতে ছিলো। মনে আছে আমি পাঠিয়েছিলাম? :happy:
দুঃখিত উপরে একটি তথ্য ভুল হওয়াতে। লিখাটা পড়েছি“তারুণ্যের ২০ কুড়ি” নামক বইতে । আমি লিখেছি চতুরে।
—-
সরবের মন্তব্য কি সম্পাদন করা যায় না???
দুঃখিত। সরবের মন্তব্য কি সম্পাদন করা যায় না ভাইয়া 🙁
সবাই মিলে চাইলে অসাধারন কিছু যে করা যায় তার একটা চমৎকার উদাহরণ সরব এর বই।
এই লেখা একটু কম বয়স্কদের পড়া মাস্ট। বাকিদেরও কাজে লাগবে আসলে। বিগ থাম্বস আপ।
রকমারির লিঙ্ক যোগ করে দিতে পারেন আপু।
ঠিক আছে ভাইয়া যোগ করে দিচ্ছে।
সময়টা বড় কঠিন, মানুষের কাছে বেঁচে থাকার চেয়ে টিকে থাকাই মুখ্য হয়ে পড়েছে।
টিকে থাকাকে মজবুত করতেও কিন্তু অনেক কিছু প্রয়োজন পড়ে।
সব কিছুর পরেও সত্য এটাই মানুষ সামাজিক জীব। মানুষ একা থাকতে পারে না, এই একা থাকতে না পারা থেকেই আসে সম্পর্কের চাহিদা।
শুভকামনা।
কত সহজ এবং সাবলীল ভাষায় সম্পকের ব্যাপারটা তুলে ধরেছেন। (y)
খুব ভাল লাগল।
লেখাটি পড়েছিলাম আগে এখন আবার পড়লাম।এই ধরনের লেখাগুলো কেন যেন বার বার পড়তে ইচ্ছা করে।
চমৎকার মন্তব্যের জন্যে অনেক ধন্যবাদ তুসিন।
পড়েছিলাম! আবারও পড়লাম! কত যে ভালো লাগলো বলে বোঝাতে পারবো না আপু! একগাদা কথা মাথায় গিজ গিজ করছে- লিখে ফেললে এই কমেন্ট বিশাল হয়ে যাবে… ভেবে আর লেখা হলো না!
কখনও সময় পেলে অবশ্যই লিখে ফেলো। আমি অপেক্ষায় থাকবো :beshikhushi: