♦ মার্চ ১৬ , ১৯৮৮ সাল। সুন্দর সকাল।
পৃথিবীর আরও অনেক ভুমধ্য সাগরীয় জনপদের মত ঘুম ভাঙ্গলো ইরান প্রভাবিত দক্ষিণ কুর্দিস্তানের হালাবজা শহরের জনগণের। ইরাক-ইরান যুদ্ধের সবচাইতে গোলযোগপূর্ণ এই সীমান্তবর্তী এলাকাটি যথেষ্ট রক্তস্রোত দেখেছে। ১০ মার্চ কার্যকর হওয়া সাময়িক যুদ্ধবিরতি তাই ক্ষতবিক্ষত এই জনপদে ক্ষণিকের জন্যে বয়ে এনেছিল স্বস্তির ছোঁয়া। কে জানতো, ১৬ মার্চের ঐ সকালই হবে হালাবজার অধিবাসীদের জন্যে শেষবারের মত ঘুম ভাঙ্গা কোন সকাল ?
সুসজ্জিত ইরাকি আর্মির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মুষ্টিমেয় রেগুলার সোলজার এবং অদক্ষ মিলিশিয়া বাহিনীর অকুতোভয় প্রতিরোধে একসময় তৎকালীন স্বৈরশাসক সাদ্দাম-বাহিনী ইরান সংলঘ্ন সিমান্তবর্তী শহরগুলোতে পিছিয়ে গিয়ে পরবর্তী আক্রমণের জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ইরানি শিবিরেও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে জড়ো হওয়া সাধারণ নাগরিকদের নিয়ে তৈরি স্বল্প প্রশিক্ষিত মিলিশিয়ান ট্রুপসের দল পরবর্তী আক্রমণে আগ্রাসী সাদ্দাম বাহিনীকে ইরাকের আরও ভিতরে তাড়িয়ে নিয়ে যেতে বদ্ধ পরিকর।
♦ হাজার মাইল দূরে, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে হোয়াইট হাইজ তথা গোটা আমেরিকার অধীশ্বর প্রেসিডেন্ট রিগ্যানের সামনে CIA -এর একটা ইন্টেল রিপোর্ট, যার সারমর্মঃ ইরাক-ইরানি যুদ্ধের মোড় ঘুরে যেতে পারে যে কোন সময়। ইরানি মিলিশিয়াদের সাথে আমেরিকারই অস্ত্রে সজ্জিত ইরাকি সেনাবাহিনী কুলাতে না পেরে পিছু হটে নিজেদের সীমান্তবর্তী শহরে অবস্থান নিয়েছে। পরবর্তী আক্রমণ ইরাক নয়, ইরানিরাই করবে- এবং তাদের ইরাকি ফ্রন্ট লাইন গুঁড়িয়ে যেতে বেশি সময় লাগবেনা। এবং তারপর ইরানিদের বসরা-বাগদাদ দখল এবং আমেরিকান মিত্র সাদ্দামের পতন সময়ের ব্যপার মাত্র।
প্রেসিডেন্ট রিগ্যান ইউ এস ডিফেন্স সেক্রেটারির উদ্দেশ্যে একলাইনের বার্তায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পারমাণবিক হামলার মত আরেকটি যুদ্ধাপরাধ সংগঠনের আদেশ দিলেন এভাবে –
“Iranian victory is not acceptable”.
♦ দক্ষিণ কুর্দিস্তান সংলঘ্ন ইরাক-ইরান সীমান্ত। ইরাকি সেনাবাহিনীর কম্যান্ডারের কাছে সেন্ট্রাল কম্যান্ড থেকে একটি নির্দেশ এলো। ওপাশের নির্দেশ শুনে হতভম্ব হয়ে গেলেন কম্যান্ডার। তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো নিজের বাড়িতে ফেলে আসা সন্তানদের উচ্ছল কোলাহল, সাজানো গোছানো সংসার! কিছুক্ষণ চুপ থেকে কম্যান্ডার দৃঢ় ভাবে জানিয়ে দিলেন, এই নির্দেশ মানতে হলে তার ইরানিয়ান আর্মির সঠিক অবস্থান জানা লাগবে, যা তার পক্ষে সম্ভব নয়। ঘণ্টাখানেকপরই স্যাটেলাইট-স্ন্যাপসহ ইরানিয়ান ট্রুপসের অবস্থান জানানো হল তাকে। ১৪ মার্চ নাগাদ ইরাকি ফ্রন্ট লাইনে এলো ক্যানভাসে ঢাকা ট্রাক ভর্তি অস্ত্রের নতুন চালান। সোলজারদের জানানো হল, সেগুলো সাধারণ আর্টিলারি ও বম্বার প্লেনের জন্যে আনা সাপ্লাই শেল। কিন্তু ফ্রন্ট কম্যান্ডার জানতেন, ঐগুলো বিষাক্ত সেরিন এবং মাস্টারড গ্যাস বোম।
১৬ মার্চ ভোর। নিজের অস্ত্রে আত্নহত্যা করার আগে ইরাকি কম্যান্ডার স্ত্রী ও সন্তানদের জন্যে লেখা একখানা চিঠিতে জানিয়ে গেলেন মানবতার ইতিহাসে সংঘটিত হতে যাওয়া আরেক ঘৃণ্যতম গনহত্যার কথা। চিঠিটা জায়গামত পাঠানোর নির্দেশ দিয়ে গেলেন সার্বক্ষণিক সঙ্গী এক রেডিওম্যানকে। ফ্রন্ট কম্যান্ডারের স্থলাভিষিক্ত সেকেন্ড ইন কম্যান্ডের নির্দেশে ১৯৮৮ সালের ১৬ মার্চ সকাল ১০টায় শুরু হল অসতর্ক ইরানিদের উপর রাসায়নিক হামলা।
CIA-র দেয়া ইরানি ট্রুপসের সেই অবস্থান সংক্রান্ত রিপোর্টে সিভিলিয়ান-মিলিশিয়ানদের অবস্থানের কোন আলাদা রিমার্ক ছিলোনা। কারণ, CIA জানতো, এই সিভিলিয়ানরাই দেশের দুঃসময়ে এগিয়ে এসে মিলিশিয়াতে যোগ দেয়ায় ইরানি প্রতিরোধ এতো তীব্র হয়েছিলো। অতএব, এদের বাচিয়ে না রাখাই ভালো !
♦ ১৯৮৮-র ১৬ মার্চ সকালে দক্ষিণ কুর্দিস্তানের হালাবজা শহরে পাঁচ ঘণ্টাব্যাপী ইরাকি স্থল ও বিমান বাহিনীর সেই রাসায়নিক হামলায় তাৎক্ষণিক ভাবে “খুন” হয়েছিল নারী-বৃদ্ধ-শিশুসহ ৭ হাজার নিরীহ ইরানি। পরবর্তী দেড় বছরে ঐ হামলায় আহত আরও ১২ হাজার ইরানি ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যু বরণ করেছিলো। ইতিহাসে এই হামলা “হালাবজা ম্যাসাকার” নামে পরিচিত।
♦ ফিরে আসি ২০১৩-তে। ভূমধ্য সাগরীয় আরেক জনপদ এখন যুদ্ধ বিধ্বস্ত। নাম তার সিরিয়া। অভিযোগ উঠেছে, ২২ আগস্ট সিরিয়ার একনায়ক বাশার-আল-আসাদ তার দেশের সাধারণ জনগণের উপর নাকি রাসায়নিক হামলা করেছেন। এই অভিযোগ ওঠার পরদিনই কিছু ক্যামিকাল এক্সপার্ট সহ ইউএন ইন্সপেকশন টীম পাঠানো হল, ক্ষতিগ্রস্ত দক্ষিণ দামেস্ক ঘুরে এই অভিযোগের সত্যতা যাচাই করার জন্যে।
♦ ২০১১-১২তে চলা লিবিয়ার যুদ্ধের সময় ত্রিপলি ও সামরিক শহর বেনগাজীতে “ম্যাসিভ ম্যাসাকার” চলার অজুহাতে ইন্সপেকশনের নামে ইউএন মিশন ঢুকেছিল। এরপরের ঘটনা আমাদের সবার জানা। মানবতার সাহায্যের ধুয়া তুলে ফ্রেঞ্চ এয়ারফোর্স বেছে বেছে লিবিয়ান আর্মির অস্ত্রগুদাম এবং ভূগর্ভস্থ সেনা ব্যারাকগুলোতে বোমা ফেলেছিল। গ্যাস বা রাসায়নিক অস্ত্র দিয়ে গনহত্যাই যদি চালাতে হবে, তবে সেটা কেন ক্ষমতাসীনদের নিয়ন্ত্রণে থাকা রাজধানী বা এর আশেপাশের সামরিক এলাকাগুলোতেই চালানো হবে – সেই প্রশ্ন সেসময় কেউই করেনি। ইউএন মিশনের নামে গুপ্তচরবৃত্তির একই ঘটনা ঘটেছিল ইরাক আগ্রাসনের সময়েও।
আর ঠিক একারণেই সিরিয়া এতদিন রাজধানীর নিকটবর্তী দক্ষিণ দামেস্ক ও হোমসের মত গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে কোন আন্তর্জাতিক ইন্সপেকশন টীম অবাধে ঢুকতে দেয়নি। দক্ষিণ দামেস্কের চাইতেও সিরিয়ান নিয়ন্ত্রণ হোমসে আরও দুর্বল। বাইরে থেকে শহর ঘিরে রাখলেও সেখানে বিরোধীবাহিনীর সাথে সকাল-সন্ধ্যা সেনাবাহিনীর যুদ্ধ হয়। বিরোধপূর্ণ এলাকা বাদ দিয়ে নিজেদের নিয়ন্ত্রিত এলাকাতেই কেন রাসায়নিক হামলা চালাতে যাবে সিরিয়ার একনায়ক- সেই প্রশ্নটা এবারও সবাই এড়িয়ে গেল।
এখন পর্যন্ত ইউএন টীম ঐ হামলায় নিহত মৃতদেহ বা কোন অকাট প্রমাণ না পেলেও “রাসায়নিক হামলা হয়েছে” ঘোষণা দিয়ে আমেরিকা প্রস্তুত সিরিয়ার উপরে যে কোন ধরনের হামলা চালাতে ! ৮৮-তে ইরাকি রাসায়নিক হামলার রেশ কাটতে দেড় বছর লাগলেও আমেরিকার ভাষায়, সিরিয়া নিজের জনগণের উপর হামলার প্রমাণ রাতারাতি মুছে ফেলেছে । উপরন্তু, সিরিয়ার উপর আমেরিকার এই সম্ভাব্য হামলা নাকি মানবতার পক্ষে তাদের লড়াইয়ের অংশ ! আসলে সিরিয়ার উপর হামলার জন্যে বাশারের রাসায়নিক হামলার প্রমাণ নিয়ে জোর তর্ক চলছে আন্তর্জাতিক মহলে। ধরে নেয়া যায়, খুব শীঘ্রই ইউএন ইন্সপেকশন টীম “প্রমাণ” খুঁজে পাবে, CIA ঠিক যেমনটি পেয়েছিল ইরাক আগ্রাসনের সময়!
♦ ক্ষমতাবান মুসলিম দেশগুলোর ধনাঢ্য আমীর-ওমরা-মন্ত্রী-এমপিরা যখন বুরজ আল দুবাইয়ে পশ্চিমা ব্র্যান্ডি-হুইস্কি আর সাদা নারী নিয়ে ফুর্তি করে বেড়ায়, বিলিয়ন ডলারের মার্সিডিজ বেঞ্জ হাঁকায়, নিজের ভাইদের খুনে লাল হওয়া মিসরীয় সেনাবাহিনীর জন্যে মিলিয়ন ডলার অনুদান দেয়,
তখন ৮৮-র ১৬ মার্চের মত মধ্যপ্রাচ্য-আফ্রিকা-এশিয়াসহ গোটা পৃথিবী জুড়ে অসংখ্য গণহত্যা চালানো আমেরিকা মানবতার কাণ্ডারি বনে যাওয়াটাই স্বাভাবিক।
_________________________________________
তথ্য সুত্রঃ
২. http://rt.com/news/syria-crisis-live-updates-047/
৩. http://www.presstv.ir/detail/2013/08/26/320538/cia-involved-in-iraq-gas-attack-on-iran/
৪. http://rt.com/news/chemical-weapons-iran-iraq-980/
৫. http://en.wikipedia.org/wiki/Halabja_poison_gas_attack
পুরোটার সাথে এগ্রি করতে হলে আরও পড়তে হবে।
কিন্তু দারুণ লেখা।
নানান সমস্যায় এড়িয়ে গিয়েছিল এই লেখা।
btw আপনি লিঙ্ক এইভাবে দিতে পারে [১]
[১] http://shorob.com/?p=15505
এইভাবে…
ঠিক আছে। পরামর্শের জন্যে ধন্যবাদ। 😀
সবার কথা শুনি আমি , আমার শ্রোতা নাই … আপনার শ্রোতা আমি 🙂 পরের পোস্ট গুলোর অপেক্ষায় আছি
ধন্যবাদ ! 😀
এক নিঃশ্বাসে পড়ে গেলাম…কী আর বলব। বিশ্বমোড়ল আমেরিকা, আর ঐদিকে আমাদের সৌদ বংশ। লজ্জার শেষ নাই.. ধ্বংস হোক এরা…
আরও এমন লেখা চাই।
আর লেখালেখি … । 🙁