নিকৃষ্টতম নগরের ভাবনা, মেলবোর্ন-কুয়ালালাম্পুর-ঢাকা

একবার হলো কি, কুয়ালালাম্পুরে যেই ভার্সিটিতে রিসার্চ করছিলাম সেটার র‍্যাংকিং ধপাস করে পরে গেল। এরপরে সেই ভার্সিটির ভিসিরে সবাই চেপে ধরলো, পেপারে পত্রিকায় রিপোর্ট আসতে লাগলো- কি ঘোড়ার আন্ডা হচ্ছে মিলিয়ন ডলারের রিসার্চ করে, এতো খড়-কাঠ পুড়ায়ে, এতো শ্রম খরচা, শিক্ষক ইভ্যালুয়েশন করে। তিনি বেশ ঠান্ডা মাথার লোক। বোঝালেন, র‍্যাঙ্কিং এ নিচে নামার মানে এইনা যে কাজ করে লাভ নাই। এরমানে এই যে অন্যরা আমাদের চেয়ে বেশি ভালো কাজ করতেছে।

ঢাকার র‍্যাঙ্কিং বসবাসযোগ্য শহরের তালিকায় ১৪০ দেশের মধ্যে ১৩৯, মানে পেছন থেকে দ্বিতীয় হয়েছে। আমি যেই শহরে এখন থাকি সেটা হইসে সেরা শহর। তাই হঠাত করে যখন মেলবোর্ন থেকে ঢাকায় নামি তখন পার্থক্যটা বুঝতে কষ্ট হয় না। এই ঈদেই গিয়েছিলাম। মাঝে কুয়ালালাম্পুরে নেমে বন্ধুদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ, শপিং, যাবার বেলায় ইফতার করলাম। তাই র‍্যাঙ্কিং এ সেরা শহর, মাঝামাঝিতে থাকা(৭৮তম) শহর কুয়ালালাম্পুর, আর তলানিতে থাকা (১৩৯তম) ঢাকা দেখা হলো খুব কম সময়ের মধ্যে। পুরা অস্ট্রালিয়ার সমান জনসংখ্যা নিয়ে ঢাকা যে এখনও একটা এক্টিভ সিটি হিসাবে দাড়ায়ে আছে এটাই বিস্ময়। মেলবোর্ন, কুয়ালালাম্পুরের মতো শহর জুড়ে ট্রেন নেটওয়ার্ক নেই ঢাকায়। এরপরেও এতো গুলান মানুষ দিব্যি স্কুলে, গার্মেন্টসে, অফিসে যাচ্ছে আসছে জ্যাম ঢেলে, অসম্ভব উদ্দ্যম নিয়ে। যারা ঘন্টা খানেক জ্যাম ঢেলে অফিস স্কুল করে আবার ঘরে ফেরেন তাদের এক এক জন একটা বুনো মহিষের মতো দম রাখেন। এই শক্তি প্রডাক্টিভ কিছুতে ব্যয় হলে কি হতো ভাবতেও আফসোস লাগে। ফ্ল্যাটের দামের দিকে দেখলে আবার ঢাকার সহজেই কুয়ালালাম্পুরকে টেক্কা দিয়ে, মেলবোর্নের সাথেও পাল্লা দিবে। কি এতো মধু ঢাকায়?

ঢাকার মধু তার সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। দেশের সেরা সব স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকায়। দেশের সেরা চিকিৎসা ব্যবস্থা। এতো হাসপাতাল কি দেশের আর কোথাও আছে? আছে ফ্লাইওভার। এতো ফ্লাইওভার আমাদের কোন শহরে আছে? তাহলে ঢাকা ছাড়া অন্য শহরগুলোর বসবাসযোগ্যতা কেমন? তালিকায় কোথায় তাদের অবস্থান? সেগুলোর অবস্থান বিবেচ্য হয় নি। কিন্তু ঢাকার চেয়ে মফস্বলগুলো অনেক বেশি আরামদায়ক, স্বস্তিকর। কারণ সেখানে ঢাকার মতো হাজারটা গার্মেন্টস নেই, সচিবালয় নেই। ক্যান্টনমেন্ট ও কুচকাওয়াজ কোম্পানির স্থাপনার ঘনত্বের বিবেচনায় ঢাকা নিঃসন্দেহে তালিকার অন্যদের চেয়ে এগিয়ে থাকবে। দুটি ক্যান্টনমেন্ট, দুটি ডিওএইচএস, আর্মি নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানের হোটেল, ব্যাংক, স্কুল, হাসপাতাল কি নেই এখানে।

তাহলে ঢাকার সজ্জার জন্য খালেদার আমলে ১৩০০কোটির প্রজেক্ট আমাদের কি দিলো? সুন্দর রোড ডিভাইডার আর তার উপরের বাগান, ফুটন্ত ফুলের হাসি। হাসিনা আমলে হাতিরঝিল দিল সুন্দর বেড়ানোর যায়গা, যেখানে লোকে নিঃশ্বাস নিতেও ভয় পেত। ওয়াসার জন্য করা হয়েছে নতুন পানি শোধনাগার। যদি শুধু ওয়াসার কথাই ধরেন, তাহলেও বলতে হবে আমরা যুদ্ধবিধ্বস্ত শহরের চেয়েও খারাপ পানি সরবরাহ করে যাচ্ছি। মোট কত জ্বালানী সাশ্রয় হতো যদি ওয়াসার পানি ফুটিয়ে না খেত তা হিসাব করে কেউ দেখাতে পারতে চোখ কপালে উঠে যেত।

আপনি যদি মনে করেন ঢাকায় এতো ইনভেস্ট করে আসলে লাভ হয় নি তাহলে ভুল করছেন। সরকারী পদক্ষেপ ছাড়া ২০০১সালে যেই ফার্মগেট মোড় ছিল এখন তা অনেক উন্নত। বিএনপি সরকারের আনা সিএঞ্জি মুক্তি দিয়েছে কালো ধোয়ার আকাশ থেকে। পলিথিনমুক্তিও একটা বড় পদক্ষেপ। হাসিনা আমলে যেসব ফ্লাইওভার হচ্ছে তাতে হয়তো যানজটমুক্তি হবে না কিন্তু তা সহনীয় মাত্রায় থাকবে। ৭৮তম শহর মালয়েশিয়ার অনেক ফ্লাইওভার আর রেল থাকার পরেও যানজট চরমে উঠেছে গেল ৫ বছরে। সুত্রাং, আমাদের বিকেন্দ্রীকরণের কথা ভাবতে হবে, সব গার্মেন্টসকে ইপিজেড করে সরাতে হবে। ঢাকার বাইরে লিভেবল সিটি করতে স্কুল-হাসপাতাল করে এগিয়ে নিতে হবে। আমি অন্য শহরে যা দেখি নাই, আর যা দেখসি সেই বিচারে বললাম। আমার কোন নগর পরিকল্পনার জ্ঞান নেই। তবে তিন শহরের মধ্যে ঢাকা ১৩৯ হওয়ায় মনে হইতে পারে, মেলবোর্ন কুয়ালালাম্পুর মনে হয় জান্নাতের কাছাকাছি আর আমরা নরকে। সিডনিতেও রাস্তায় গোলাগুলি হয়ে মানুষ মরে, কুয়ালালাম্পুরেও ড্রাগ ট্রাফিকিং গ্যাং আছে, প্রস্টিটিউশন আছে,  গ্যাং ফাইট হয়, খুন হয়। দুই কোটি মানুষ মেলবোর্নে ঢুকে পড়লে সিটি কাউন্সিলের কান দিয়ে ধোয়া বের হয়ে যাবে।

নগর উন্নয়নের কোন প্রস্তাব নিয়ে আপনারা কি চাপ দিচ্ছেন নির্বাচনের আগে? দলগুলোর প্রতিশ্রুতি আদায় হয়েছে? বিএনপি-আওয়ামী লীগের নগর পরিকল্পনাবিদ, ইঞ্জিনিয়ারদের বলি-

দলবাজি করুন, ভোট মাগেন- কিন্তু কিছু পরিকল্পনা প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিন। রাজনীতিবিদদের আমরা সস্তা বলি। তাদের কথা ও কাজকে সস্তা বলি। কিন্তু আসলে আমরাই সস্তা। আমাদের ভোট এতো চিপ যে এটা পেতে তাদের নূন্যতম মগজ খাটাতে হয় না। অলীক জোড়া পদ্মা-সেতুর প্রতিশ্রুতি বা ১০টাকা চালের আশ্বাস নয়- সঠিক সাস্টেইনেবল উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি চাই।

বাঙ্গাল সম্পর্কে

আমি একজন ঘবেষক..চিন্তা করাই আমার কাজ...চিন্তিত ভাই ব্রাদারদের আমার পেজে স্বাগতম। [email protected] https://www.facebook.com/bangal
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে বিবিধ-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

6 Responses to নিকৃষ্টতম নগরের ভাবনা, মেলবোর্ন-কুয়ালালাম্পুর-ঢাকা

  1. বোহেমিয়ান বলেছেনঃ

    আহ বিকেন্দ্রীকরণ।
    বিক্যাশ (বিকাশ) এর মতো সার্ভিস এর জনপ্রিয়তারও এইটা একটা কারণ।

    একটা জিনিস এর কথা ভাবতেছি, আমরা কীভাবে Informed voter হইতে পারি

    • বাঙ্গাল বলেছেনঃ

      ইনফর্মড ভোটার বানাইতে সুশীল সমাজের নির্বাচন কমিশনে সকল একাডেমিক সার্টিফিকেট, ইনকাম স্টেইট্মেন্ট দেয়ার বুদ্ধিটা ভালো। এইটা আসতে আসতে আর বাড়াইতে হবে। ট্রান্সপারেন্সী আসতে হবে। সব পার্টি যদি তাদের ইকোনমিক প্লান (বাজেট) দেয় সেইটাও একটা ভালো জিনিস হবে। তবে পাবলিকের আগ্রহ থাকতে হবে।

  2. তুসিন বলেছেনঃ

    দলবাজি করুন, ভোট মাগেন- কিন্তু কিছু পরিকল্পনা প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিন। রাজনীতিবিদদের আমরা সস্তা বলি।

  3. রুহশান আহমেদ বলেছেনঃ

    ঢাকা তো ঢাকাই।
    ‘নিকৃষ্টতম’ কথাটা বড় নিষ্ঠুর শোনাচ্ছে।

    আর বাকী ব্যাপারগুলো রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিষয়, আমি কম বুঝি।

    আশা করি একদিন আপনার প্রস্তাবনাগুলো বাস্তবায়িত হবে।

  4. মাধবীলতা বলেছেনঃ

    আহ বিকেন্দ্রীকরণ !! এই স্বপ্ন যে কবে সত্য হবে ! আসলেই আমাদের ভোট খুব সস্তা, কারণ বেশিরভাগ মানুষই চিন্তা করে না, আলাভোলা গ্রাম্য ভোটারদের বাগিয়ে নেয়া তো ব্যাপারই না।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।