গ্রামাঞ্চলে একটা কথা চালু আছে।কাউকে বিপদে ফেলার কিংবা শত্রুতা উদ্ধারের দুইটা রাস্তা আছে।প্রথমটা হল,ঘরে সুস্থ কর্মক্ষম স্ত্রী থাকতে দ্বিতীয় বিয়ে করিয়ে দেওয়া।আর পরেরটা হল নারী ও শিশু নির্যাতন মামলা করে দেওয়া।হালে প্রথম ব্যাপারটা খুব একটা সহজ না।আইন আদালত তো বটেই প্রথম পক্ষের স্ত্রীর বাপের বাড়ির লোকজন ও এখন আর ছেড়ে কথা কয় না।তবে দ্বিতীয় ব্যাপারটা বেশ সহজ বলাই চলে।যার কারণে এই পদ্ধতি বেশ জনপ্রিয়।কষ্ট করে স্থানীয় থানার বারান্দায় পৌঁছাতে পারলেই হয়।কেবল আপনার উদ্দেশ্য জানাবেন আর বাদ বাকি ব্যবস্থা করার জন্য থানা কম্পাউন্ডেই বিশেষ লোকজন থাকে।আর মামলা একবার আদালতে উঠলেই হয়।বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা বলে কথা।এক মামলা আদালতে উঠলে বছর দুই তিনের আগে নিষ্পত্তি হয় না।এটা সর্বনিম্ন।প্রথম আলো পত্রিকা ও ট্রান্সকম গ্রুপের মালিক লতিফুর রহমান তার মেয়ে শাজনিনের ধর্ষণ ও হত্যা মামলার রায় পেয়েছেন প্রায় ১৪ বছর পর!বছরের পর বছর মামলা চালিয়ে সর্বস্বান্ত হওয়ার কথা হরহামেশাই পত্রিকার পাতায় দেখি।তারও চাইতে দুঃখের কথা হল মামলা এতদিন চলার পরে রায়ে দেখা যায় অভিযুক্ত ব্যক্তি সম্পূর্ণ নির্দোষ।ততদিনে ঐ লোকের বাহিরের দুনিয়ার চাইতে জেলের দুনিয়াটাকেই শ্রেয় মনে হয়।
কিন্তু এভাবে মামলা চলার ফলাফল কি?প্রায় বছর খানেক আগে চালানো এক গবেষণায় দেখা গিয়েছিল বাংলাদেশের ‘নারী ও শিশু নির্যাতন’ আইনে দায়ের হওয়া মোট মামলার মাত্র ১৫-২০ ভাগ মামলা সত্যি মামলা।আর বাদবাকি ৮০-৮৫ ভাগ মামলাই হয় প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোর জন্য বা সহজ ভাষায় সাজানো মামলা।গত জুন মাসে এক সেমিনারেও এই সত্যটিকে অকপটে স্বীকার করেছিলেন আইনমন্ত্রী।এতে করে আর কেউ ক্ষতিগ্রস্থ হয় না।অকল্পনীয় রকমের ক্ষতিগ্রস্থ হয় বাস্তবেই বিচারপ্রার্থী কোন অসহায় নারী ও তার পরিবার।ধর্ষিতাদের মামলা পুলিশ নেয় না বলে আমরা বিভিন্ন সময় পত্রিকায় দেখে থাকি।কিন্তু এখানে পুলিশ এক তরফা ভাবে দায়ী না।যেহেতু পুলিশ জানে থানায় অধিকাংশ মামলাই আসে ‘বানের জলে ভেসে’,সেহেতু পুলিশ ও গা করার দরকার মনে করে না।একজন অপরাধীর বিরুদ্ধে যথাস্থানে অভিযোগ করার পরেও বিচার নিশ্চিত হচ্ছেনা।আর অভিযোগ যদি হয় কোন প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে,তাহলে তো কথাই নেই।পুলিশ ধরেই নেয় মামলার উদ্দেশ্য মানহানি ও হয়রানি।আর পুলিশ যদি জানতেও পারে সেই প্রভাবশালী লোকটা আসলেই অপরাধী তবে টাকা নিয়েই হোক বা উপরের চাপের কারণেই চেপে যাওয়ার চেষ্টা করে।এর বাইরে ধর্ষিতার পরিবারকে একঘরে বা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার একটা সামাজিক ট্রেন্ড তো আছেই।কেউ কেউ হয়ত অর্থাভাবে বা ভয়ে বিচারই চান না।সব মিলিয়ে এক ভয়ংকর রকমের অবস্থা।কেউ বিচার নিয়ে ফুটবল খেলে আর কেউ বিচার না পেয়ে উল্টো অপমানিত হয়ে গলায় দড়ি দেয়,কীটনাশক গিলে।
যদি ভাবেন গ্রামেই কেবল এটা ঘটে তবে আপনার জানার আরেকটু আছে।আমাদের শহর-নগরে এই ট্রেন্ডটা একটু অন্যভাবে চালু আছে। ইদানীং অনেকের কাছেই এমনটাই শুনছি।বেশ ধুমধাম করে বিয়ে হচ্ছে।কিন্তু বিয়ের বছর না ঘুরতেই তালাক।অভিযোগ হয়ত ঐ ‘নারী নির্যাতন’ ও যৌতুক দাবী!এই অভিযোগ সাথে দেনমোহর আদায়ের জন্য স্ত্রী পক্ষ করে বসেন মামলা।নির্যাতনের ঘটনা হয়ত আসলেই ঘটে কিন্তু মিথ্যা অভিযোগের সংখ্যাও কম না।দেখা যায় শখ করে ১৫-২০ লাখ টাকা দেনমোহর দিয়ে,বেশ ধুমধাম করে একটা ছেলে বিয়ে করল।কিন্তু বছর না ঘুরতে ডিভোর্স,মামলা সাথে দেনমোহর আদায়ের ব্যাপারটা তো আছেই।এই প্রক্রিয়ায় একটা ছেলে হয়ত ত্রিশের আগেই নিজের জীবনের শেষটা দেখে ফেলেন।
গোটা ব্যাপারটা ঠান্ডা মাথায় ভাবলে শরীরটা কেমন যেন রি রি করে উঠে।নারী নির্যাতন মামলার মূল হাতিয়ার তো একজন নারীই।তিনি নিজেই প্রতিবন্ধকতা হয়ে উঠছেন আরেকজন নির্যাতিতা নারীর বিচারপ্রাপ্তিতে।কখনো কোন নারী এভাবে মিথ্যা মামলার ক্রীড়নক হতে অস্বীকার করেছেন কিনা জানিনা।তবে যদি সত্যিই জানতেন এই মিছামিছি খেলার কারণে তারই মত এক নারী অসহায় অবস্থায় মাথা ঠুকছেন,তবে হয়ত সত্যিই প্রতিবাদ করে এই খেলার অংশ হতে অস্বীকার করবেন।এভাবে সারা দেশে যদি সচেতনতা তৈরি হয় তবে হয়ত ধর্ষণ কিংবা এসিড নিক্ষেপ কিংবা অন্য কোন বর্বর নির্যাতনের বিচার পাওয়া অনেক সহজ হয়ে যাবে।আমার বিশ্বাস নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থের বদলে অন্য কোন বোনের নায্য বিচার পেতে এভাবেই বাংলাদেশী নারীরা এগিয়ে আসবেন।শত হোক,নারীরা তো মায়েরই জাত।আশা-ভরসার জায়গাটা সেখানেই।
পুনশ্চঃএই লেখা পড়ে কেউ হয়ত বা ‘পুরুষতান্ত্রিকতা’র গন্ধ পেতে পারেন।সেক্ষেত্রে এই লেখাটা লেখার প্রেক্ষাপট একটু জানিয়ে যাই।পত্রিকায় অহরহ ধর্ষণের সংবাদ পড়লেও এই ব্যাপারটা কেন ভয়ংকর সেটা জানতে পারি এক ফেসবুক নোটের মাধ্যমে।পড়ে আমি নিজেই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।খুবই শকিং একটা ব্যাপার।আর ধর্ষণের পরে একটা নারী কি পরিমাণ ট্রমার মধ্য দিয়ে যায় সেটা জানতে পারি হুমায়ূন আহমেদের ‘কে কথা কয়’ উপন্যাস পড়ে।পড়ার পরে আমার মনে হয়েছিল এমন দুর্বিষহ অভিজ্ঞতার পরে বিচার না পেয়ে কেউ যদি আত্মহত্যা করে তবে সেটা খুব একটা অস্বাভাবিক কিছুনা।যেসব নারী এই ভয়ংকর অভিজ্ঞতাকে জয় করে স্বাভাবিক জীবনে ফেরেন, তারা যেমন সেমন কেউ না।খুবই দৃঢ় চিত্তের ও জীবন জয়ী নারী।স্যালুট তাঁদের প্রতি।শ্রদ্ধাবনত সালাম ১৯৭১ এর সব বীরাঙ্গনাদের প্রতি।
বাংলাদেশ ……আর সেই দেশে বিচার 🙁
তথ্যবহুল লেখা।ভাল লাগল :love:
ধন্যবাদ তুসিন আপনাকে।মূল গবেষণা পত্রটা যুক্ত করতে পারলে তথ্যবহুল বলে আমিই ঢেঁকুর তুলতে পারতাম 😀
লেখাটা আমি ক্লিয়ার হইতে পারলাম না।
মনে হচ্ছে তাড়াহুড়া করা লেখা।
পুলিশ ধরেই নেয় মামলার উদ্দেশ্য মানহানি ও হয়রানি।
এইখানে তো একটা বড় সমস্যা। পুলিশ দুর্নীতিবাজ!
এই রকম ঘটনা কী পরিমাণ ঘটে?
তবে যদি সত্যিই জানতেন এই মিছামিছি খেলার কারণে তারই মত এক নারী অসহায় অবস্থায় মাথা ঠুকছেন,
পুরুষ শাসিত সমাজে আমাদের মনমানসিকতা সব কিছু মিলিয়ে মেয়েরা কিন্তু অনেক বেশি সমস্যার সম্মুখীন। benefit of the doubt কাকে দেয়া উচিৎ?
আমি তো মনে হয় আপনার লেখায় উলটা জিনিস দেখলাম!!
কাদম্বিনীকেই মরিয়া প্রমাণ করতে হবে সে মরে নাই?
হ্যাঁ, তাড়াহুড়ার লেখা বলা চলে।আমার অন্য লেখাগুলো অন্তত পাঁচ সাতদিন সময় খরচ করায়।এটা এক সকালেই মাথায় আসা এবং রাতে লেখা 😛
পুলিশ এই ধরনের অভিযোগ নিতে নিতে ক্লান্ত।এবং এই মামলায় কেবল মামলা দায়েরেই শেষ না।সাথে মেডিকেল সার্টিফিকেট নামে একটা ব্যাপার ও যুক্ত থাকে।যেহেতু পুলিশ জানেই যে মামলাটা বানোয়াট হওয়ার সম্ভাবনা ৭০ থেকে ৮০ ভাগ এবং টাকা দিলে এমন একটা সার্টিফিকেট যোগাড় করা কঠিন কিছু না।সেখানে পুলিশ অযথা মাথা ঘামাতে যাবে কেন?তার চাইতে সেখান থেকে টাকা পয়সা কিভাবে চেপে বের করা যাবে সেই চিন্তাই করে।
অস্বীকার করার উপায় নাই যে আমাদের সমাজে নারী নানাভাবেই নিপীড়িত।কিন্তু এর সাথে এই একটা প্রশ্ন ও মাথায় আসলো কিছু নৃ তাত্ত্বিক গোষ্ঠী ছাড়া আর কোথাও কি আদৌ নারীশাসিত সমাজ আছে?বা সম্ভব কিনা?আমরা না হয় নারীদের অধিকারের ব্যাপারে উদাসীন কিন্তু পশ্চিমারা যারা নারী স্বাধীনতার ব্যাপারে উচ্চকন্ঠ তারা কি নারীর প্রাপ্যটা দেয়?আর না হয় ধরেই নিলাম মানবিকতার দিক বিবেচনায় অভিযোগ নিয়ে আসা নারীকেই benefit of the doubt দিলাম।কিন্তু গোটা তদন্ত শেষ করে যখন দেখব আমার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল,তখন আমার কি করা উচিত হবে?এক দুইটা ক্ষেত্রে না হয় এটা হতেই পারে কিন্তু তাই বলে এমন ভুয়া অভিযোগ যদি মোট অভিযোগের ৭০/৮০ ভাগ হয়, তবে আমার কি করা উচিত?আমার কিংবা সাধারণ যে কারো পক্ষে নিশ্চয় ধৈর্য ও মানবাধিকারের অবতার হওয়া সম্ভব নয়।
কাদম্বিনী বাচা-মরার প্রশ্ন না।বাংলাদেশের পুলিশকে অনেক সীমিত সামর্থ্য নিয়ে অনেক কিছুই করতে হয়।এতগুলো ভুয়া অভিযোগের প্রত্যেকটাই যদি পুলিশ ঠিকঠাক ভাবে তদন্ত করতে যায়,তবে অন্যান্য সত্য ও দরকারি মামলাগুলোরই বা কি হবে?
বাংলাদেশ আবশ্যক এমন অনেক কিছুই কঠিন,
সো… কিছু বলার নাই।
তারপরেও আশায় বুক বাঁধি।একদিন আলো হয়ত ঠিকই আসবে।নিপীড়িত পাবে তার প্রাপ্য বিচার।