শিকড়

বেশ কয়েক মাস আগে CommunityAction এর একটি ওয়ার্কশপে শিখেছিলাম সামাজিক সমস্যা নিয়ে চিন্তা করার একটি খুব সহজ টুলের ব্যবহার। একেবারেই কমন সেন্স টাইপের টুল, কিন্তু মাঝে মাঝে মনে হয় কমন সেন্স জিনিসটারই তো অভাব আমাদের মধ্যে 🙁

একটি ত্রিভুজ আঁকুন। ত্রিভুজের শীর্ষে লিখে ফেলুন আপনি যেই সমস্যাটা নিয়ে চিন্তিত সেটার সবচেয়ে এক্সট্রিম ফলাফল/উদাহরণ কী কী হতে পারে। এবার ত্রিভুজের একেবারে ভূমির দিকে লিখে ফেলুন সমস্যাটার সবচেয়ে নিরীহ, সবচেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ কী হতে পারে। এবার মাঝামাঝি তীব্রতার যা যা প্রভাব/ফলাফল আপনি কল্পনা করতে পারছেন ধারাবাহিকতা অনুযায়ী লিখে ফেলুন ত্রিভুজের উপর থেকে নিচের দিকে। একটু দম নিন। একটু দূর থেকে ত্রিভুজটিকে দেখুন। পেয়ে যাবেন আপনার ফোকাস কোথায় হওয়া উচিৎ তার উত্তর।

একটা উদাহরণ দিই। ক’দিন আগে মুম্বাইয়ে গণধর্ষণের ঘটনা নিয়ে বিশ্বব্যাপী তোলপাড় হয়ে গেল, আমাদের দেশেও এ সংক্রান্ত সচেতনতা কার্যক্রম হয়েছে, হচ্ছে। চলুন আমরা নারীর সঙ্গে অযাচিত আচরণ নিয়েই একটা ত্রিভুজ বানানোর চেষ্টা করি।

[চিত্রের ক্রম স্রেফ বুঝানোর জন্য লিখেছি, ভুল হতেই পারে, মূল ফোকাস সঠিকভাবে চিন্তা করতে পারার উপর]

লক্ষ্য করুন, ত্রিভুজের শীর্ষের এক্সট্রিম কেইসগুলো বন্ধ করতে সমাজে আইন আছে, আদালত আছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আছে। তবুও যখন এক্সট্রিম ঘটনাগুলো ঘটে যায়, আমাদের বিবেক কেঁদে উঠে, আমরা প্রতিবাদ করি।

কিন্তু ত্রিভুজের যতই নিচের দিকে যেতে থাকবেন, ফরমাল আইন করে প্রতিরোধের ব্যবস্থা যেমন নেই, সেটা সম্ভবও নয়! পুত্র সন্তানকে কে প্রাধান্য দিল তা রাষ্ট্রের পক্ষে তদারকি করা সম্ভব নয়!

এই ত্রিভুজটির দিকে স্থির মনে তাকালেই আপনি বুঝে যাবেন সমস্যার মূলটা কোথায়, ঠিক কোথায় কোথায় ফোকাস করতে হবে সত্যিকার পরিবর্তনের জন্য! ত্রিভুজের নিচের দিকের পয়েন্টগুলো আপাতদৃষ্টিতে নিরীহ, কিন্তু এগুলোই দানা বাঁধতে বাঁধতে একদিন এক্সট্রিমের পথ খুলে দেয়! মনে রাখুন, এক্সট্রিম কিন্তু প্রতিদিন ঘটে না, কিন্তু ‘তাকিয়ে থাকা’ নিত্যদিনের ঘটনা! এই ‘তাকিয়ে থাকা’ ব্যক্তিদের মধ্যে একজনই কোন একদিন এক্সট্রিম কিছু করে বসবেন।

ত্রিভুজের নিচের দিকের পয়েন্টগুলো পরিবর্তন করতে প্রয়োজন মানসিকতার পরিবর্তন, আর সেটি একদিনে বা একমুহূর্তে মানববন্ধন করে অর্জন করা সম্ভব নয়। প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা আর প্রচেষ্টা– সেই পরিকল্পনা হতে পারে সাংস্কৃতিক উদ্যোগ, হতে পারে ধর্মীয় মূল্যবোধের উদ্যোগ, হতে পারে সামাজিক ও পারিবারিক শিক্ষা প্রসারের উদ্যোগ– সেটি আপনি ঠিক করবেন, ত্রিভুজটি Problem Visualization Tool মাত্র, Problem Solving কিন্তু আপনার আমার জন্য বাকি থেকে যাচ্ছে! ত্রিভুজটির কাজ কেবল চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া কেন বারংবার এক্সট্রিম কেইসগুলো ঘটেই চলেছে। সেগুলো যে আদৌ ঘটতে পারছে, তার কারণ মূল-কাণ্ড পার হয়ে এক্সট্রিম পর্যন্ত পৌঁছানোর উপায় আমরা রেখে দিচ্ছি আমাদের সমাজ ব্যবস্থায়।

এবারে হোমওয়ার্ক! 😀

সাম্প্রতিক ঐশীর ঘটনার প্রেক্ষিতে আপনি মাদকাসক্তি সংক্রান্ত ত্রিভুজ আঁকতে পারেন। ত্রিভুজের শীর্ষে নিঃসন্দেহে ঐশী নিজেই থাকবে– এটি নিতান্তই একটি এক্সট্রিম কেইস, এটি প্রতিদিন ঘটে না। এবার ভাবুন মাদক সংক্রান্ত সবচেয়ে কম ক্ষতিকর উদাহরণ কী হতে পারে।

হতে পারে সেটি গাঁজা, হতে পারে সেটি সিগারেট। নিজেই ভাবুন ত্রিভুজটির ভূমি বরাবর কোনটিকে রাখতে পারছেন। আরও যা যা কুফল মনে আসে ত্রিভুজ জুড়ে সিরিয়ালে লিখে ফেলুন।

শুধু মনে রাখুন, ত্রিভুজ-তলার এই আপাত নিরীহ পয়েন্টগুলোই একদিন ডালপালা গজিয়ে ঐশীকাণ্ডের জন্ম দেবে। ত্রিভুজ-টুল আপনাকে সাবধান করেছিল, কিন্তু আপনি সিগারেট গাঁজার মত নিরীহ পয়েন্ট গায়ে না মেখে ঐশীকে নিয়ে স্ট্যাটাস দিতেই ব্যস্ত ছিলেন।।

রাইয়্যান সম্পর্কে

'এক্সট্রোভার্ট' শব্দটা আমার সঙ্গে বেশ মানিয়ে যায়-- পছন্দ করি নতুন মানুষের সাথে পরিচিত হতে। একজন ভোজন বেরসিক; খেলাধুলায় Own Goal ও Wide Ball এক্সপার্ট। তড়িৎ প্রকৌশলের ছাত্র, স্বপ্ন দেখি জীবনটাকে অর্থবহভাবে কাজে লাগানোর।
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে বিবিধ-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

10 Responses to শিকড়

  1. জ্ঞানচোর বলেছেনঃ

    একটা কথা ইদানিং টকশো থেকে শুরু করে সামাজিক আড্ডায় শোনা, “এই সমস্যার শিকড় অনেক গভীরে।”
    আপনার পোস্ট থেকে বুঝলাম, সমস্যার শিকড় শুধু গভীরে নয়, অনেক বিস্তৃতও।

    এখন প্রশ্ন হলো, একেবারে চুঁড়ার প্রবলেমগুলা সমাধান করা বেশ সহজ। কিন্তু, অপর দিকে, নিচের গুলো সমাধান তো দূরে কথা, এর ব্যপ্তি খুঁজে বের করাই বেশ কঠিন।

    পরিসংখ্যান এক্ষেত্রে বেশ কাজ দিতে পারে। কিন্তু, সমাধানের যে চেষ্টা সেটাও কালেক্টিভ এফোর্ট ছাড়া সম্ভব নয়।

    এই ডিলেমায়, আমাদের মাঝামাঝি একটা পয়েন্ট খুঁজে বের করা উচিত না। মানে, ঠিক যেখানে বরফ খন্ডটা পানি ছেড়ে বাতাস পেয়েছে?

    • রাইয়্যান বলেছেনঃ

      ত্রিভুজটি শুধুই প্রবলেম ভিজুয়ালাইজেশন পর্যন্ত আমাদেরকে সাহায্য করতে পারবে, যাতে আমরা নিজেরাই বুঝতে পারি ঠিক কোথায় ফোকাস করা উচিৎ। যেমন, ঐশীকে নিয়ে পোস্টে হোমপেজ ছেয়ে গেছে, অথচ ত্রিভুজে দেখা যাচ্ছে ঐশীকাণ্ড নিতান্তই একটি এক্সট্রিম উদাহরণ, আর সমস্যার সত্যিকার শিকড় নিয়ে হোমপেজে আদৌ কোন পোস্ট দেখা যাচ্ছে না! তার মানে আমাদের (অন্তত আমার ফেসবুক হোমপেজের) ফোকাস পুরোপুরি ভুল। সিগারেট গাঁজার কথা কেউ বলছি না, সেটি হয়তোবা বেশি করে বলা উচিৎ ছিল।

      একবার সঠিক ফোকাস কোথায় হওয়া উচিৎ বুঝতে পারলে, এরপরের কাজ হল ত্রিভুজের গণ্ডি পেরিয়ে প্ল্যানিং এর দিকে যাওয়া, সেটি আপনি আমি ঠিক করব, কখনও মাঝের পয়েন্ট বেশি কাজে দিতে পারে, কখনও ভূমির পয়েন্ট! কখনও হয়ত দেখা যাবে নিজের পরিবারেই ছোট ভাই বোনের সাথে খোলামেলা আলাপচারিতা দিয়ে মূল্যবোধের ট্রান্সফার নিশ্চিত করা সম্ভব হয় অনেকাংশে। সদিচ্ছাটাই বেশি জরুরী এক্ষেত্রে!

  2. সামিরা বলেছেনঃ

    দারুণ লাগলো জিনিসটা আমার কাছে। ছোট্ট কিন্তু চিন্তা জাগানিয়া পোস্ট।

  3. বোহেমিয়ান বলেছেনঃ

    নিজে উপস্থিত না থাকলেও ভালো জিনিস পেলাম।
    ভিজুয়ালাইজিং সব সময় হেল্প করে।

    আমি নিজেও ট্রাই করি…

    ভালো পোস্ট। আরেকটা উদাহরণ আসতে পারত

  4. শারমিন বলেছেনঃ

    ভালো লেগেছে
    ত্রিভুজের আইডিয়াটা দারুণ তো 😀

  5. মাধবীলতা বলেছেনঃ

    এত সুন্দর একটা চিন্তা জাগানিয়া ও কর্ম করণীয়া (:P) আইডিয়ার জন্য অনেক অনেক সাধুবাদ হে রাইয়ান। আসলেই আমরা শুধু এক্সট্রিম নিয়েই লাফালাফি করি, রুট কাজ এনালাইসিসের কাজটা করি না। এই ধরনের পোস্ট দেখলেই মনটা ভালো হয়ে যায়, আশাবাদি হই আরেকবার।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।