ফেইসবুকগ্রস্ততার মনস্তত্ত্ব: মিলেনিয়াল প্রজন্মের দ্বিতীয় জীবন (পর্ব ১/২)

আমি সাগর দেখি নি কোনদিন শেষ যেবার দেখেছিলাম, এতই ছোট্ট ছিলাম তখন যে ওকে দেখা বলে না স্বপ্ন সত্যি হওয়ার মতন, সেদিন যখন অস্তগামী সূর্যের আলো গায়ে মেখে হেঁটে যাচ্ছিলাম তুমিআমি, বাতাসে ঢেউয়ের শব্দ আর আমার হাতে তোমার আলতো ছোঁয়ার একাকার অনুভূতিকে সবার কাছে জানিয়ে দিতে ফোনেস্ট্যাটাস লিখতে লিখতে হঠাৎ পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি, বালুতে কেবল একজোড়া পায়ের ছাপ আরেক জোড়া থেমে গেছে বেশ খানিকটা আগেঢেউগুলোর মাথা ছাড়িয়ে অনেক দূরে দৃষ্টি ফেলে সেদিন তুমি কী ভাবছিলেজানি না

*** 

স্কুলের বন্ধুদের সাথে কতকাল পর দেখা হল সেদিন! গিটার শিখে হাত পাকিয়ে ফেলেছে কয়েকজন, স্কুলে যেমন কাড়াকাড়ি করে টিফিন খাওয়া হত সেরকম আরেকটা খাওয়াদাওয়া পর্ব চুকিয়ে, মহানন্দে গলা ছেড়ে গান ধরলো সবাই তখনই তো আমি তোমাকেমেসেজকরে জানাচ্ছিলাম কত মজা করছি, মনে আছে? পরে তুমি যখন জানতে চাইলে কী গান, আমি আর মনেই করতে পারলাম না মেসেজে কী লিখবো ভাবতে ব্যস্ত ছিলাম যে!

*** 

কাজিনরা মিলে একসাথে ঘুরতে যাব, কতবার প্ল্যান করি কিন্তু একবারও সবার সময় মেলে না এই শীতে কীভাবে যেন ঠিকঠাক হয়ে গেল সব, একটা গাড়ি ভাড়া করে সবাই মিলে রওনা হলাম পাহাড় দেখবো বলে হাসিগল্পগানে পুরো রাস্তা মেতে রইলো সবাই; এদিকে পড়ার চাপে পিষ্ট আমি, একটু ফাঁক পেয়ে এতদিননাপড়াফীডগুলো দেখতে আর সবারপোস্টেমন্তব্য করতে মশগুল এমন সময় কাঁধে ছোট বোনের গুঁতো খেয়ে চমকে রেগে উঠে– চোখ তুলে তাকিয়েই দেখি, বৃষ্টি শেষে শহরের বাইরের ঝকঝকে আকাশে দুটো রঙধনু একসাথে উঠেছিল, আমার তাকাতে তাকাতে জানালার সামনে গাছের ঘন সারি চলে আসায় আর ভালমত দেখতেই পেলাম না

***

এক বিদেশি বিজ্ঞাপন থেকে নেয়া ছোট ছোট কিছু ছবি থেকে এই গল্পগুলোর শুরু। তবে কেবলই কি গল্প, নাকি আমাদের একান্ত মূহুর্তগুলোয় উঁকি দিয়ে দেখে নেওয়া অপ্রিয় সব সত্য, তা নিয়ে ভাবার অবকাশ আছে। যার কথা ছিল জীবন যাপনের উপকরণমাত্র হওয়ার, সে যখন রীতিমত শেকড় গেড়ে বসে দ্বিতীয় জীবন হিসেবে- তাকে চিন্তার খোরাক হিসেবে জায়গা না দেওয়াটা কঠিন বৈ কী!

বৃক্ষ তোমার নাম কী? ফলে পরিচয়!

নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন, কিংবা শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছেন হয়তো কেউ- নতুন পরিবেশে এত এত নতুন মুখ মনে রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এই সমস্যা দূর করতে পৃথিবীর অনেক দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নবাগতদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় সবার নামসহ ছবির ছোট্ট অ্যালবাম, নাম তার ফেইসবুক (facebook)।

এই সংস্কৃতি তেমন করে চালু নেই বলে এই তথ্য জানেন এমন মানুষও অন্তত আমাদের দেশে খুব বেশি মিলবে না হয়তো, তবে সংজ্ঞা না জানলেও ফেইসবুকের ব্যবহারে সিদ্ধহস্ত আমরা অনেকেই। সেই ফেইসবুকেও ছবি থাকে বটে, তবে সেটা অ্যালবাম নয়– অনলাইনের জনপ্রিয়তম ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম’।

বাংলায় ‘খোমাখাতা’, ‘মুখবই’ ইত্যাদি নানান নামে ডাকা হয় যে ফেইসবুককে, তার কাজটা কী আসলে? আমরা যেন বন্ধুদের চেহারা মনে রাখতে পারি? নাকি এখানে আমাদের সত্যিকারের চেহারা প্রকাশ পায়, তাই? কিংবা এমন কি হতে পারে, ফেইসবুক আমাদের নতুন নতুন চেহারা তৈরি করে?

প্রশ্ন হতে পারে সামাজিক যোগাযোগে এর অবদান নিয়েও। যোগাযোগ কি বাড়াচ্ছে আদৌ ফেইসবুক, নাকি কমাচ্ছে, নাকি পরিমাণ আগের মত রেখে উপায়টাকেই সহজ করছে কেবল? আর এই মাধ্যমে যোগাযোগের মান– সেটার গ্রাফ কোন্‌দিকে ধাইছে, আকাশ নাকি পাতাল?

ফেইসবুকে কী করা হয় তা জানেন না এমন মানুষ খুবই সীমিত, বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে তো শূন্যের কোঠায়! এক আমেরিকান তরুণ যেমন বলেছেন- এ যুগে এসব ওয়েবসাইটে উপস্থিত না থাকার মানে আপনার অস্তিত্বই সঙ্কটাপন্ন! আমেরিকায় প্রতি ৪ জনে ৩ জন তরুণ ফেইসবুক ব্যবহার করে, বাংলাদেশেও এমনই হওয়ার কথা সংখ্যাটা, চাই কি বেশিও হতে পারে। এক গবেষক এই ফেইসবুককে তুলনা করেছেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের করিডোরের সাথে, যেখানে ক্লাস শেষে ছেলেমেয়েরা একসাথে হয়, গল্পগুজব থেকে শুরু করে প্রেমও করে, মাউসের ক্লিকে বন্ধু কিংবা ভালবাসার মানুষ জুটিয়ে ফেলে, কথা চালায় ব্যক্তিগত মেসেজে কিংবা সবার জন্য উন্মুক্ত ওয়ালে, আর ব্যক্তিগত ছবির অ্যালবাম শেয়ার করে ঘনিষ্ঠতম বন্ধু থেকে শুরু করে অদেখা-অচেনা সব মানুষদের সাথেও।

নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝির দিক থেকে অনলাইনে এ ধরনের যেসব মাধ্যম ডালপালা ছড়াতে শুরু করে, সে রকমই এক ওয়েবসাইট ‘ফ্রেন্ডস্টার’এর মালিক জোনাথন এব্রাম্‌স বেশ আগ্রহ-জাগানিয়া একটা কথা বলেছেন। তিনি জানিয়েছেন, সহজে আকর্ষণীয়াদের দেখা পাওয়াই নাকি ছিল তাঁর ফ্রেন্ডস্টার প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য! আমরা যারা ব্যবহারকারী, তাদের অনেকে কিন্তু আসলেও তার পথেই হাঁটছি; ইতিমধ্যেই যারা বন্ধু তাদের সাথে যোগাযোগ চালু রাখার বদলে ফেইসবুক হয়ে উঠছে নতুন সব বন্ধু তৈরির কারখানা, যেখানে কারও বন্ধু হওয়া কিংবা না-হওয়া একটা ক্লিকের দূরত্বমাত্র- কারও প্রেমাস্পদ হওয়াও অনেকটা তাই। ফেইসবুকের প্রবেশপথেই যদিও সে আমাদেরকে তার উদ্দেশ্য জানিয়ে বলে, “Facebook helps you connect & share with the people in your life“, আমরা বরং তাকে এমন এক নতুন মাত্রা দিচ্ছি যেন “Facebook helps you connect & share with people to bring them into your life

যদি বন্ধু হও, হাতটা বাড়াও!

জেনে অবাক লাগতে পারে, তবে ম্যাচমেইকিং সাইটগুলোতে যেমন টাকা দিয়ে সদস্য হতে হয়, ইন্টারনেটে এমন অনেক ওয়েবসাইটও আছে যেগুলোতে টাকা দিয়ে সদস্য হতে হয় কেবল ‘বন্ধু’ হওয়ার জন্য, ভুলেও অন্য কিছু না! ফেইসবুকের এত চমৎকার গ্রহণযোগ্যতার অন্যতম কারণ হল, এর সদস্য হতে আমাদেরকে কোন টাকা দিতে হয় না- বিনামূল্যে বন্ধুত্ব রক্ষা আর সেই সাথে সৃষ্টিরও এ এক অন্তবিহীন সুযোগ।

To meet, to know, to love & then to part – is the sad tale of many a human heart.“- বন্ধুত্বের জন্য এত সব শর্তের তবে প্রয়োজন নেই আর?  আমাদের চিরচেনা বন্ধুত্ব আর এই ফেইসবুকীয় বন্ধুত্বের স্বরূপ তবে একই? নিজেরা মাথা খাটানোর সাথে সাথে, মহামতি অ্যারিস্টট্‌লের এ নিয়ে কী বলার আছে সেটাও এই ফাঁকে জেনে আসা যাক।

মানুষে মানুষে বন্ধুত্ব মোটামুটিভাবে তিনটা ভিত্তির ওপর গড়ে ওঠে বলে অ্যারিস্টট্‌ল দাবি করেন- সুবিধা, আনন্দ আর মূল্যবোধ। একে অন্যের কাছ থেকে সুবিধা পাওয়া কিংবা একজন অন্যজনের আনন্দের কারণ হওয়ার মধ্য দিয়ে যে বন্ধুত্ব তৈরি হয় তা একেবারেই ঠুনকো- প্রয়োজন ফুরোনো মাত্রই এর আবেদনও হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। দুজন মানুষ কেবল তখনই সত্যিকারের বন্ধু হতে পারেন, যখন তারা দুজনেই একই মূল্যবোধে বিশ্বাস করেন, নিজের চাহিদা যেখানে থাকে একেবারেই গৌণ। অনলাইনে আমাদের ‘তালিকাভুক্ত বন্ধু’রা প্রথম দুটো শর্ত যে পূরণ করছেন সেটা স্পষ্ট, কিন্তু তৃতীয় আর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ শর্তটা?

কম্পিউটার আর ইন্টারনেটের চমৎকার সম্ভাবনা নিয়ে একসময় লেখালেখি করেছেন যে মনস্তত্ত্ববিদ শেরি টার্ক্‌ল- তিনি যে আজকাল নিজের আগেকার ধারণা থেকে সরে আসছেন একটু একটু করে, তাঁর লেখা বইগুলো থেকে স্পষ্ট সেটা। কেন- তা জানতে টার্ক্‌লের করা গবেষণাগুলোর একটার গল্প শোনা যাক এখানে। এক বৃদ্ধার বাড়িতে বেড়াতে এসেছে তার নাতি-নাতনী, যাদের সাথে পাঠানো হয়েছে আবার এক রোবট শিশুকে। দেখা গেল, ভদ্রমহিলা প্রথমে নিজের নাতনীকে আদর করলেও, কিছুক্ষণ পরই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন রোবট শিশুকে নিয়ে। এমন কি সেটাকে বিরক্ত করছে বলে সত্যি সত্যি রেগে উঠে বকেও দিলেন মানুষ শিশুকে! তিনি কিন্তু জানতেন যে শিশুটি রোবট।

ঘটনাটা কি আশঙ্কাজনক মনে হচ্ছে? টার্ক্‌ল কিন্তু তাই মনে করেন! মানুষে মানুষে সম্পর্কে সবচাইতে অনন্য যে বৈশিষ্ট্য থাকে তা হচ্ছে আবেগ-অনুভূতির বিনিময়। আমরা একজন মানুষ আরেকজনকে ইশারা করলে, কথা বললে অন্যের মধ্যে নতুন কোন অনুভূতির জন্ম হয় আর সে তখন তা প্রকাশ করে নিজের মত করে, সেই প্রকাশ আবার প্রভাব ফেলে প্রথমজনের ওপর– এভাবে চলতেই থাকে; কিন্তু রোবটের বেলায় পুরো প্রক্রিয়াটাই একপাক্ষিক। এতে করে এই আধা-জীবন্ত সম্পর্ক অহঙ্কারের মত নেতিবাচক কিছু অনুভূতিকে উস্‌কে দেবে– এমন সম্ভাবনা প্রবল। অহঙ্কারী হলে আমরা যেমন অন্যদেরকে নিজের চাইতে নিচু ভাবি, মানুষকে মানুষের বদলে অনেকটা ‘বস্তু’ (ইংরেজিতে doormat!) হিসেবে দেখি আর নিজের প্রয়োজনমত ব্যবহার করতে চাই- সঙ্গী যখন রোবট হয় তখন আমাদের এই আচরণগুলোর ছোরায় শাণ দেওয়া আরও বেশি সহজ হয়ে পড়ে, আর রোবট ‘সঙ্গী’র তাতে আপত্তিও থাকে না।

ফেইসবুকীয় আলোচনায় যন্ত্রমানবকে টেনে আনার কারণ- অনলাইনে অন্যদের সাথে আমাদের সম্পর্ক ধীরে ধীরে হলেও বদলে যাচ্ছে অনেকটা এভাবেই। মুখোমুখি মানুষের সাথে আমাদের আচরণের সাথে এখানকার আচরণের মিল থাকে না তাই অনেক সময়েই- একজন মানুষের বাস্তব সত্ত্বার চাইতে তার অনলাইন সত্ত্বাকে নিয়েই আমরা ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠি বেশি। ভেবে দেখুন, আপনি হয়তো অনলাইনে কাউকে বলছেন যে কতদিন তার সাথে দেখা হয় না কিংবা তার কণ্ঠ শোনা হয় না- অথচ হাতের কাছে ফোন থাকলেও ডায়াল করে কথা বলছেন না অথবা সুযোগ থাকা সত্ত্বেও দেখা করছেন না তার সাথে; হয় নি কখনও এমন? আমাদের ‘সত্যিকারের ব্যক্তিত্ব’ আর ‘ই-ব্যক্তিত্ব’ এভাবেই মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন, সেই সাথে অ্যারিস্টট্‌লের দেওয়া বন্ধুত্বের সংজ্ঞাতেও ধরছে ফাটল।

সোনার কাঠি রূপার জাদু

“A friend to all is a friend to none.”– বন্ধুত্বের ঘনিষ্ঠতা নির্ণয়ের একটা সহজ উপায় হচ্ছে, আমরা কোন্‌বন্ধুর সাথে কত বেশি ব্যক্তিগত আলোচনা করি সেটা খতিয়ে দেখা। গবেষণায় দেখা গেছে, ফেইসবুকাক্রান্ত যুগে মানুষের গোপন কথা ভাগাভাগি করে নেওয়ার মত সঙ্গীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে আশ্চর্যজনক হারে। ১৯৮৫ সালে একজন গড়পড়তা আমেরিকান যতজনকে অন্তরঙ্গ বন্ধু ভাবতেন – অর্থাৎ যাদের সাথে ব্যক্তিগত বিষয়গুলো নিয়ে আলাপ করতেন, বর্তমানে তাদের সংখ্যা নেমে এসেছে দুই-তৃতীয়াংশে। এমন কি কারও সাথেই ব্যক্তিগত আলাপ করেন না এমন মানুষের সংখ্যাও অনেক বেড়ে গেছে এখন।

কেবল বন্ধুত্বই না, আমাদের একান্ত ব্যক্তিগত জীবনও পালটে যাচ্ছে ফেইসবুক ‘কাঠি’র পরশে। তবে ফেইসবুক আসারও অনেক আগে, টেলিভিশন ‘কাঠি’ কেমন করে জীবনকে বদলে দিল তা বোধহয় সবচেয়ে চমৎকারভাবে আমাদেরকে জানিয়েছেন রোয়াল্ড ডাল, তাঁর ‘টেলিভিশন’ কবিতায়। এই টেলিভিশনে এক ধরনের অনুষ্ঠান আজকাল জনপ্রিয়তার তুঙ্গে, নাম তার রিয়েলিটি শো। হালের ‘আমেরিকা’স নেক্সট টপ মডেল’ থেকে শুরু করে এমটিভির ‘রোডিজ’ আর বাংলাদেশের ‘ক্লোজ আপ ওয়ান’, আবার ‘মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়া’ কিংবা ‘ফিয়ার ফ্যাক্টর’– গল্পনির্ভর নাটক-সিনেমার চেনা গণ্ডির বাইরে এসে, এতকাল যারা দর্শকের কাতারে টিভি-সেটের সামনে বসে মুড়ি কিংবা পপকর্ন চিবুতেন, তাদেরকে পর্দায় তুলে আনার এই ধারা ব্যবসায়িক দিক থেকে চিন্তা করলে দারুণভাবে সফল।

ফেইসবুককে এ যুগের রিয়েলিটি টিভির সাথে তুলনা করেছেন মনোবিজ্ঞানী গোল অজিন সাঈদি। কারণ রিয়েলিটি টিভির মতই, এখানে আমরা জ্ঞাত- কিংবা অজ্ঞাতসারেই নিজেদের এমন সব নতুন ভাবমূর্তি তৈরি করছি, যার সাথে আমাদের ‘বাস্তব’ আচরণের ফারাক অনেক ক্ষেত্রেই প্রকট। আমাদের চিরচেনা সত্ত্বার বাইরেও এই যে নতুন এক সত্ত্বাকে ধীরে ধীরে আকার দিচ্ছে ফেইসবুক, তার নাম আরেক মনোবিজ্ঞানী রেখেছেন ‘প্রোটিয়ান’ সত্ত্বা- গ্রিক সাগরদেবতা প্রোটিয়াসের নামানুসারে। আত্মপ্রতারণা (নতুন ব্যক্তিত্ব তৈরি), উদ্ভট আচার-আচরণ আর তামাশাপ্রবণতা (এক জরিপে অংশ নেয়া ছেলেমেয়েদের ২৩% স্বীকার করেছে যে তারা অনলাইনে নিজের বাস্তব চরিত্রের সাথে মিলবিহীন ‘ফুর্তিবাজ’ ভাবমূর্তি তৈরির চেষ্টা করে), কারণ আর উদ্দেশ্যহীন কাজকারবার (ফেইসবুকে আমাদের কতজনের কতভাগ কাজ অর্থপূর্ণ?), ছন্নছাড়া অস্থায়ী অস্তিত্ব (একটামাত্র ক্লিকের ব্যবধানে কারও বন্ধু হওয়া-না হওয়া)- এসবই ছিল দেবতা প্রোটিয়াসের বৈশিষ্ট্য (আর আমরা যারা ফেইসবুক ব্যবহারকারী, তাদের)।

প্রোটিয়াস

আমায় ঘিরে আয়না শুধু, শুধু নিজের মুখ!

“Mirror mirror on the wall/ Who is the fairest of them all?”  আগেকার যুগে আর্থিকভাবে সচ্ছল কিংবা ক্ষমতাবান মানুষদের সখ ছিল দক্ষ শিল্পীদেরকে দিয়ে নিজের পোর্ট্রেইট আঁকানো, এখনও যে এই চল পুরোপুরি উঠে গেছে এমন নয়। তাদের এই সখ মূলত দু’ধরনের উদ্দেশ্য মেটাতো- একজন মানুষ আসলে দেখতে কেমন সেটা তুলে ধরা, সেই সাথে সে নিজেকে কীভাবে দেখাতে চায় সেটাও। এর মধ্যে প্রথমটাই কেবল আমাদের নিত্য ব্যবহার্য ক্যামেরার কাজ, ফটোগ্রাফ আর পোর্ট্রেইটের লক্ষ্যণীয় পার্থক্যটা এখানেই।

যে কারণে অর্ডার দিয়ে আঁকানো পোর্ট্রেইট সে সময় অহমের খোরাক যোগাত, সেই একই কারণটা এ সময়ের ফেইসবুকের বেলাতেও খাটে। এখানে আমরা নিজেদের পছন্দের ছবিগুলোই কেবল অন্যদেরকে দেখাই (ভুলেও বন্ধুদের কেউ আমাদের অপছন্দের ছবি দেখিয়ে ফেললে সরাতে বলি ঝটপট), নিজের পছন্দসই চিন্তাগুলোই কেবল স্ট্যাটাস আকারে দেই (অফলাইনে অন্যদের সাথে মিশতে গেলে বেছে বেছে দোষ-গুণ প্রকাশের সুযোগ থাকে না), যত বেশি সম্ভব বন্ধু জোটাই এবং পারলে যত উঁচুদরেরও (আপাতদৃষ্টিতে একে ‘মানুষ সামাজিক জীব’- এ ধারণার বহিঃপ্রকাশ বলে মনে হলেও, মূলত অন্যের চোখে নিজের মর্যাদা বাড়ানোর জন্য প্রবৃত্তির নিরন্তর কাঙালপনার দৃষ্টান্তও হতে পারে!)- ফেইসবুকে আমাদের ‘ফেইস’ হল তাই হাল জামানার সৌখিন পোর্ট্রেইট। মানুষ জাতি যেসব বস্তু কিংবা ‘অবস্তু’ অর্জনের জন্য জীবনের একটা বিপুল সময় ব্যয় করে, যেগুলোকে পাওয়ার মাত্রাতিরিক্ত বাসনা আমাদেরকে অধঃপাতে নিয়ে যেতে পারে নিমেষেই- সেই প্রশংসা, সম্মান আর মর্যাদা লাভের রাতারাতি উপায় বাতলে দিয়ে নিজেদের ওয়েবসাইট সাজিয়ে নিচ্ছে আজ ফেইসবুকের মত মাধ্যমগুলো। এজন্যই বুঝি মাইক্রোসফ্‌ট অনলাইনে সামাজিক যোগাযোগরক্ষকদেরকে ব্যবহারকারী, সদস্য কিংবা মানুষ না বলে ‘ভোক্তা’ নামে ডাকে!

নিজের প্রতিবিম্বের দিকে খুব বেশিক্ষণ ধরে তাকিয়ে থাকা ভাল নয়- প্রাচীন এই পুবদেশীয় বিশ্বাস থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে প্রাচ্যের অনেক দেশের রক্ষণশীল নারীরা দেয়ালে আয়না উলটো করে ঝুলিয়ে রাখেন, কিংবা ঢেকে রাখেন মখমলের কাপড় দিয়ে। আরবিতে ‘আমি’কে বলা হয় ‘আনা’, যেখানে বানান অনুযায়ী ‘না’টাকে টেনে পড়ার কথা থাকলেও নিয়ম হিসেবে বলা হয় এই শব্দটাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব উচ্চারণ করে পার হয়ে যেতে- যেন মানুষ নিজেকে নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করার সময় না পায়। “নিজেকে যে বড় বলে বড় সে নয়”- নিজের প্রশংসা করাটা মোটামুটি সব সংস্কৃতিতেই নেতিবাচক হওয়া সত্ত্বেও ফেইসবুকে কি আমরা অহরহ এই কাজটাই করি না? একটা ছবিকে প্রোফাইল পিকচার কিংবা কাভার ফটো হতে হলে বিশাল চড়াই-উৎরাই পাড়ি দিয়ে আসতে হয় (আমাকে ভাল দেখাচ্ছে তো? কিংবা অন্যরকম/মজার দেখাচ্ছে? সবাই মুগ্ধ/অবাক হবে?), কোন ঘটনা ঘটামাত্রই সেটা নিয়ে সবচাইতে চমকপ্রদ স্ট্যাটাস কী হতে পারে মস্তিষ্কে তা নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়ে যায়।

এসবের উপজাত হিসেবে মেলে একদল হতাশ্বাস মানুষ। আমরা হয়তো ফেইসবুকে নিজের কিংবা আত্মীয়ের ছোট্ট সুস্থ সুন্দর সন্তানের ছবি দেখাচ্ছি আর তার আদুরে কাজকর্মের বিবরণ দিচ্ছি নির্দোষ আনন্দ নিয়ে, তা দেখে হাহাকার জেগে ওঠে নিঃসন্তান কোন দম্পতির হৃদয়ে। ছুটিতে বিদেশে বেড়াতে গিয়ে কত চমৎকার সব হোটেলে থেকেছি আর মন-ভোলানো সুন্দর সব জায়গা দেখেছি- সেটা জানান দিতেই সামর্থ্যহীনদের মন ভরে উঠবে অনুযোগে। তাৎক্ষণিক প্রকাশ হিসেবে সেই মানুষই হয়তো ক্লিক করবেন লাইক বোতামে, মন্তব্য করবেন ‘কী সুন্দর!’, আর পরবর্তীতে ভিড় বাড়াবেন মনোবিজ্ঞানীদের চেম্বারে। বিশ্বাস হয় না? সত্যি এমন হয়, সুখী সুখী চেহারার নববিবাহিত বন্ধুকে সঙ্গীর বাহুবন্ধনে দেখে নিজের সঙ্গীহীনতার আর অযোগ্যতার কষ্ট মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে সত্যিই- মনস্তত্ত্ববিদরা তাদের শরণাপন্ন হওয়া মানুষদের কথা শুনেই জানিয়েছেন এমনটা। প্রশ্ন হতে পারে, বাস্তবেও তো ভাগ্যের এমন বৈষম্য আছে, পার্থক্যটা কী তাহলে অনলাইনের সাথে? পার্থক্য হচ্ছে প্রকটতা- অফলাইনে সুখ-দুঃখ মিলিয়েই মানুষকে দেখি আমরা, কিন্তু অনলাইনে সব তথ্যই আসে যাবতীয়-বিব্রতকর-আর-অপমানজনক-অভিজ্ঞতা-নিরোধক ছাঁকনির ভেতর দিয়ে, কেবল বাছাই করা সুখের মূহুর্তগুলোই দেখি আমরা আর একেই সবটা ধরে নিই।

[দুই পর্বে সমাপ্য এই লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ২০১২ সালের অমর একুশে বইমেলায় প্রকাশ পাওয়া সরবের প্রথম বই ‘তারুণ্যের ২০ কুড়ি’তে।]

[পুনশ্চ: এই লেখার উদ্দেশ্য অতি অবশ্যই কাউকে হেয় করা নয়। ফেইসবুক ব্যবহার করেছেন, কিন্তু ওপরের প্রভাবগুলোর একটারও স্বীকার নন কিংবা কখনও ছিলেন নাএমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। লেখিকাও তার ব্যতিক্রম নন। যে কোন মানুষই কোন না কোনভাবে এই লেখার সাথে নিজেকে সংযোগ করতে পারবেন, কেবল তা ভেবেই এ প্রসঙ্গের অবতারণা। লেখার অংশবিশেষ বিভিন্ন সূত্র থেকে অনূদিত কিংবা আংশিক রূপান্তরিত, এবং যেসব ঘটনার উদাহরণ দেয়া হল সেগুলোর প্রতিটাই পুরোপুরি সত্য।

তথ্যসূত্র:

/ আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের ভিজিটিং স্কলার এবং ইউনিভার্সিটি অফ অক্সফোর্ডের দর্শন বিভাগের ভিজিটিং প্রফেসর রজার স্ক্রুটনের প্রবন্ধ ‘Hiding Behind the Screen’

/ ইউনিভার্সিটি অফ কানেক্টিকাট, স্ট্যামফোর্ডের শিক্ষক পিটার লোপাটিনের প্রবন্ধ ‘Friendship Does Not Compute’

/ ‘দ্য নিউ আটলান্টিসজার্নালের সিনিয়র এডিটর এবংইথিক্স অ্যান্ড পাবলিক পলিসি সেন্টারএর ফেলো ক্রিস্টিন রোজেনের প্রবন্ধ ‘Virtual Friendship and the New Narcissism’

ইউনিভার্সিটি অফ নটরডেমের ছাত্র ব্রায়ান বয়েডের প্রবন্ধ ‘The Dotcomrade’

/ ইউনিভার্সিটি অফ নটরডেম থেকে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিতে ডক্টরেট ডিগ্রিপ্রাপ্ত এবং স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির পোস্টডক্টরাল ফেলো গোল অজিন সাঈদির প্রবন্ধ ‘Is Facebook the New Reality TV?’]

দ্বিতীয় পর্বের লিঙ্ক

 

মনস্তত্ত্ব সিরিজের আগের দুটি পোস্ট:

সৌন্দর্যপ্রীতির মনস্তত্ত্ব: যদি ভালবাসতেই হয়…

ক্ষুণ্নিবৃত্তির মনস্তত্ত্ব

সামিরা সম্পর্কে

পীচ-গলা তরলে আটকে পা, দুঃস্বপ্ন অন্ধ দুই চোখে/ অসতর্ক হৃদয় পোষ মানে মিথ্যে বলার আফসোসে.../// প্রকাশিত লেখার কপিরাইট সংশ্লিষ্ট লেখক সংরক্ষণ করেন এবং লেখকের অনুমতি ছাড়া লেখা আংশিক বা পূর্ণভাবে কোন মিডিয়ায় পুন:প্রকাশ করা যাবে না।
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে চিন্তাভাবনা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, সচেতনতা-এ এবং ট্যাগ হয়েছে , , স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

11 Responses to ফেইসবুকগ্রস্ততার মনস্তত্ত্ব: মিলেনিয়াল প্রজন্মের দ্বিতীয় জীবন (পর্ব ১/২)

  1. বোহেমিয়ান বলেছেনঃ

    এই সেই ঐতিহাসিক লেখা!

    সরব যেই সব লেখা নিয়ে গর্ব করতে পারবে তার একটি।

  2. আবদুল্লাহ বলেছেনঃ

    এ কোন মুসিবত!সামিরা আপার সব লেখায় দেখি প্রিয় স্বরে নেওয়া লাগে 🙂 অসাধারণ সামিরা আপা

  3. শারমিন বলেছেনঃ

    লিখাটা আগেই পড়েছি বইয়ে
    দারুণ একটা লিখা :love:

  4. আরফিন বলেছেনঃ

    এখন কথা হল। ফেসবুক কী ভাল না খারাপ?
    কনক্লিউশনের আশায় ছিলাম। পেলাম না :/

  5. নাজমুস সাকীব বলেছেনঃ

    পড়লাম। ভাল লাগল।
    ফেইসবুক কখনও অবদমিত ইচ্ছাকে প্রকাশ ঘটিয়ে আমাদের অন্য ব্যক্তিত্ব প্রকাশ করে, যা ফেইসবুক না থাকলে কখনও হয়ত প্রকাশ পেত না বা প্রকাশের সুযোগ থাকতো না। কিংবা ফেইসবুক ছাঁকন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শুধু ‘ভাল’ বা ‘সুন্দর’ প্রকাশ করে আমাদের মধ্যে অসীম অপ্রাপ্তিবোধ তৈরি করে দেয়, যার পেছনে আমরা ছুটতে থাকি। মানুষের জীবনে অন্য অধ্যায়ও থাকে। সেটা ফেসবুকে আসে না বা আমরা প্রকাশ করি না। ফেসবুক নিয়ে এই নিবন্ধটি জরুরী এই কারনে যে, ফেসবুক ফেনোমেনার মধ্যে এভাবে নানা আঙ্গিক থেকে আলো ফেললে তাকে ভালভাবে বুঝা যাবে। আমরা বুঝতে পারব ফেসবুকে জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে, ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে আমরা কি করছি, কিংবা ফেসবুক কিভাবে আমাদের মন, আচরন, চিন্তুা প্রভাবিত করছে, কিংবা ফেসবুকের সাথে আমাদের ইন্ট্যার‌্যাকশনের ফলে কি প্রভাব তৈরি হচ্ছে অনলাইনে বা অফলাইনে। এভাবে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে ফেসবুকের মেকানিজম বুঝতে পারলে বা ফেসবুকের রাজনীতি বুঝা গেলে আমরা আরও সতর্ক ও সংবেদনশীল ব্যবহারকারী হতে পারব।
    লেখককে অনেক ধন্যবাদ।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।